মোনালিসা পর্ব ২৯

মোনালিসা
লেখা-ইসরাত জাহান তানজিলা
পর্ব-২৯
মোনা ওভাবে কতক্ষণ প্রিয়ম’কে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে ছিলো হিসেব নেই। প্রিয়ম বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে আছে। মোনা ও’কে জড়িয়ে ধরেছে?এটা ভেবে যত না রোমাঞ্চিত হয়, তার থেকে হাজার গুন বিস্মিত হয়। প্রিয়মের মনে হচ্ছে এটা নিছকই স্বপ্ন। ঘুম ভাঙার সাথে সাথে এসব মিছে হয়ে যাবে। এটা যদি স্বপ্ন হয় তাহলে সারাজীবনেও যেন ঘুম না ভাঙে,এটা যদি বাস্তব হয় তাহলে যেন এই বাস্তবতা অন্তত কাল অক্ষত থাকে।
প্রিয়মের চোখের পানি দেখে মোনার মনে যে তোলপাড় শুরু হয়েছে,সে তোলপাড় থেমে যাওয়ার পর মোনা নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করে প্রিয়মের আলিঙ্গনে।
মোনা তাৎক্ষণিক নিজেকে প্রিয়মের আলিঙ্গন থেকে মুক্ত করে। মোনার দৃষ্টি ফ্লোরের দিকে নিবদ্ধ। মোনা আর কোথায়ও তাকাতে পারছে না। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ’টার জন্য একটু আগেও বুকের ভিতর প্রেম অনুভূত হয়েছে। কিন্তু একটু সময়ের ব্যবধানে সেই প্রেম, বুকের ভিতর তোলপাড় সব শেষ হয়ে গেছে যেন। মোনা কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,
-“প্রিয়ম ভাই,আর কখনো আসবেন না আমার সামনে।আমায় দুর্বল করার চেষ্টা করবে না।”
মোনা অনুনয় করছে বলছে কথা গুলো। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারার ব্যর্থতা থেকে এই অনুনয়। আজকাল প্রিয়মের সামনে আসলেই মোনার ভিতর কি যেন কি হয়ে যায়। মুহূর্তেই মোনার এই বিচিত্র আচরণে প্রিয়ম আবার চমকায়। মোনার আচরণে ক্ষণে ক্ষণে চমকায় ইদানিং।প্রিয়ম বুঝতে পারেনা মোনা কি চায়? কঠিন থেকে কঠিনতর কাজ মোনা’কে বুঝা। প্রিয়ম মোনার নিচু হয়ে থাকা মুখের চিবুক আলতো করে ধরে মুখ’টা উঁচু করে। অদ্ভুত এক মোহময় গলায় বলে,
-“কিসের এত দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছো মোনা?কিসের এত দোটানা? বিশ্বাসী হও মোনা, বিশ্বাস করতে শিখো। জীবনে কোন এক মোড়ে হেরেছো বলে, প্রতি পদক্ষেপে হারবে এমন কিন্তু না।”
মোনা চোখ তুলে তাকায়। প্রিয়মের চোখে চোখ রাখে। মোনার শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা। মাথার ভিতর থাকা সমস্ত চিন্তাভাবনা উপেক্ষা করে, শীতল গলায় বলে,
-“হার -জিতের ভয় আমি করিনা।‌‌‌ ছোট এই জীবনে পাওয়া না পাওয়া, হার কিংবা জিত, পূর্ণতা-অপূর্নতা এত হিসেব কষতে নেই। এত সব হিসেবে মগ্ন থাকলে জীবনের বেলা কখন ফুরিয়ে যায় টের পাওয়া যায় না।
আমি কারো প্রেয়সী হতে পারবো।নিজের অস্তিত্বে কাউকে জড়িয়ে নিজেকে বিলীন করতে পারব না।”
প্রিয়ম কি ভেবে যেন একটু হাসলো। রহস্যময় একটা ভাব ছিলো হাসিতে। অসংশয়ে, অভ্রান্তচিত্তে বলল,
-“তুমি ইতোমধ্যে আমাতে বিলীন হয়ে গেছো মোনা।তোমার অস্তিত্বে আমি জড়িয়ে গেছি।”
প্রিয়মের দৃষ্টিতে মিশে থাকা দৃষ্টি সরিয়ে নেয় মোনা। অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে ফেলে। মোনার অন্যদিকে ফিরিয়ে থাকা মুখটা দেখার জন্য প্রিয়মের মুহূর্তেই কৌতূহল জাগে। প্রিয়ম কয়েক পা মোনার ঘুরিয়ে রাখা মুখের সম্মুখে দাঁড়ায়।প্রিয়ম প্রেমময় ধরা গলায় বলল,
-“মনের ভিতরের সন্দিহান ভাব’টা ঘুচিয়ে ফেলো মোনা।”
মোনা প্রত্যুত্তর করলো না। চিন্তান্বিত চিত্তে বিষাদময় এক যন্ত্রনা অনুভব করে। দোটানা থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না। ভালোবাসতে পারছে না,আবার রহস্যময় এক মায়ায় আবদ্ধ হয়ে আছে। মোনা দিশেহারা হয়ে বলল,
-“প্রিয়ম ভাই আপনি এখন এখান থেকে যান, এক্ষুনি যান। আমার সময় দরকার।”
প্রিয়ম কিছু বলতে গিয়েও গিলে ফেলল। অকারণে আরো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলো। দুই জনই নির্বাক , নিঃশব্দ হয়ে রইলো। একটু আগে প্রিয়মের মনে হয়েছে পৃথিবীর সব সুখ ওঁর মনে জড়ো হয়েছে। মোনার মনে হয়েছিল প্রিয়ম’কে ভালোবাস’তে কোন বাঁধা নেই, কিন্তু এখন কিছু মুহূর্ত বাদে আবার হাজার দ্বিধার মুখোমুখি হলো।
প্রিয়ম হতাশ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ব্যর্থ গলায় বলল,
-“আমি আসি মোনা। তুমি সময় নেও।” প্রিময় এইটুকু বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
-“প্লীজ আমায় অন্তন একবার সুযোগ দিও।”
প্রিয়ম চলে যায়। মোনা যেভাবে দাঁড়িয়ে ছিলো, ঠিক সেভাবেই দাঁড়িয়ে আছে। কিছুক্ষণ পর মোনা নড়েচড়ে দাঁড়ায়। দরজার দিকে এগিয়ে গিয়ে দরজা’টা লক করে দেয়। ওয়াশরুমে গিয়ে চোখে-মুখে পানি দিচ্ছে। প্রিয়ম’কে কেন জড়িয়ে ধরলো?আত্মক্ষোভে মোনা ফেটে পড়ছে। নিজেকে সংযত করতে পারে না, কি ব্যর্থতা!
মোনা একটু আগ বাড়িয়ে ভাবলো। প্রিয়মের সাথে প্রেম তারপর বিয়ে।প্রিয়মের সাথে বিয়ে হলে প্রিয়মের বাসায় থাকবে?কখনো না! মোনা সেটা পারবে না। প্রিয়মের প্রতি ভালোবাসার পথে সে রাত’টাই এখন তীব্র ভাবে বাঁধ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। মোনা দোটানা, দ্বিধা কাটিয়ে উঠতে পারবে। কিন্তু লিলি বেগমের বাসায় কখনো যেতে পারবে না। অমন পিতার সন্তান’কে ভালোবাসতে পারবে না। ঘৃনায় মোনার চোখ দুটো ভিজে যায়।
——
মোনা ভার্সিটির উদ্দেশ্য বের হয়। নিজেকে পাগল পাগল মনে হয়। আজ ট্যাক্সিও নেয় নি। হেঁটে হেঁটে যাবে। অকারণেই এই সিদ্ধান্ত। মোনার মাথায় নানান ভাবনা উঁকি দেয় আর অস্থির ভাবে পা বাড়ায়। হঠাৎ কি হলো মোনা বুঝতে পারলো না। কার থেকে এক ভদ্রলোক মোনার দিকে তাকিয়ে ধমক দিয়ে বলল,
-“রাস্তায় দেখেশুনে হাঁটেন। নেশাগ্রস্ত মানুষের মত পথ চলছেন।”
মোনা ভ্রু কুঁচকে তাকায়। মোনার কাছ থেকে প্রত্যুত্তের অপেক্ষা না করেই চলে গেলো গাড়ি নিয়ে শোঁশোঁ করে। মোনা পুনরায় নিজের ভাবনায় নিমজ্জিত হয়ে পথ চলে।
ভার্সিটির কাছাকাছি গিয়ে দেখা ওয়াটসের সাথে। ওয়াটস পিছন‌ থেকে ডাকছে মোনালিসা,মোনালিসা বলে। মোনার সমস্ত খেয়াল মাথার ভিতর থেকে দুশ্চিন্তায় নিবদ্ধ। চারদিকে ভূমিকম্প হয়ে গেলেও বোধ হয় টের পাবে না। ওয়াটস মোনার একটু দূরে ছিলো। দৌড়ে এসে মোনার পাশে দাঁড়িয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,
-“মোনালিসা তুমি আমায় উপেক্ষা করছো কেন?”
আচমকা কারো এমন গলা শুনে মোনার অবচেতন মনে চমকায়। অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে বলে,
-“আমি উপেক্ষা করবো কেন তোমায়? কিভাবে উপেক্ষা করলাম?”
-“কতক্ষণ ধরে ডাকছি তোমায়। কোন সাড়া দিলে না।”
-“স্যরি ওয়াটস‌ শুনিনি আমি।”
ওয়াটস মোনার দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে বলল,
-“তোমার অস্বাভাবিক, চিন্তাগ্রস্থ লাগছে। কোন প্রবলেম মোনালিসা?”
মোনা একটু হাসার চেষ্টা করলো। চেহেরা স্বাভাবিক করতে চাইলো। জোরপূর্বক মুখে হাসি টেনে বলল,
-“না,না। আই এ্যাম ওকে।” মোনা একটু থেমে আবার বলল,
-“আচ্ছা শ্রুতি এসেছে?”
-“অদ্ভুত তো মোনালিসা! তুমিও মাত্র আসলে, আমিও আসলাম। আমি বলবো কিভাবে?”
মোনা বুঝতে পারলো ও একটা উদ্ভট প্রশ্ন করে ফেলেছে। ওয়াটস এর সাথে কথা বলতে বলতে ক্লাস রুমে গেলো।ওয়াটস অনার্গল কথা বলে যাচ্ছে। মোনা শুধু উদাস মনে হ্যাঁ,হু বলে যাচ্ছে।
মোনা আজ আর ক্লাসে মন বসাতে পারলো না। কি এক যন্ত্রনা, চিন্তা মোনা’কে দগ্ধ করছে প্রতিনিয়ত। মোনা বের হতে পারছে না এসব। এসবে মোনা ক্লান্ত হয়ে পড়েছে, বিশ্রাম দরকার।
মোনা অফিসে যাওয়ার পর পরই লরি এগিয়ে এসে বলল,
-“তোমার কয়েক দিন যাবৎ কি হয়েছে বলো তো মনা? মনমরা, বিষন্ন হয়ে থাকো।”
-“কিছুই হয় নি। শরীর’টা একটু খারাপ লাগছে।”
লরি বুঝতে পারলো মোনা মিথ্যা বলেছে, লরি আরো কয়েক বার জিজ্ঞেস করলো। মোনা একই উত্তর করলো। লরি দমে গেলো, নিজের কাজে মন বসালো। কাজের মাঝে মাঝে হঠাৎ মোনা নির্লিপ্ত হয়ে যায়।‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌ কয়েক মিনিট পর আবার সম্বিত ফিরে।
মোনা বাসায় ফিরে।‌ প্রিয়ম কয়েকবার ফোন দিয়েছে, জ্যাকও ফোন দিয়েছে। মোনার ফোন সাইলেন্ট ছিলো। মোনা জ্যাকের কল ব্যাক করল।জ্যাক বলল,
-“আজকাল কি হয়েছে আপনার মোনালিসা? আপনার হদিস পাওয়া মুশকিল হয়ে যাচ্ছে। বাসায়ও গিয়ে আসছি আপনার।”
জ্যাকের বলা কথা গুলোর প্রত্যুত্তর খুঁজে পেলো না মোনা। মোনা কথা গুলো উপেক্ষা করে বলল,
-“প্রিন্সেস কেমন আছে?”
-“প্রিন্সেস এখন স্পষ্ট ভাবে কথা বলতে পারে। একদিন আসুন একবার।”
-“সময় হয়ে উঠে না।‌‌‌‌ সময় পেলে আসবো একদিন আসবো।” মোনা একটু থেমে আবার বলল,
-“জ্যাক রাখছি আমি, একটু কাজ করছি।”
মিথ্যা বলেই ফোন রাখলো মোনা। কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না। জ্যাক ফোন রাখার পর পরই প্রিয়ম আবার ফোন দিলো। মোনার আবার অস্থিরতা শুরু হলো। কয়েকবার রিং হওয়ার পর ধরলো ফোন। মোনা ক্লান্ত স্বরে হ্যালো বলল। ওপাশ থেকে বলল,
-“কালকে একটু রেস্টুরেন্টে আসবে?কথা ছিলো।”
কথা বলতে রেস্টুরেন্ট কেন? ফোনে বলা যায়, ম্যাসেজে বলা যায়। বাসায় এসে বলা যায়। মোনা কিছুক্ষণ পর বলল,
-“কথা শুনতে রেস্টুরেন্টে যেতে হবে?”
-“তো কি তোমার বাসায় আসবো?”
মোনা জোর গলায় বলল,
-“না,না। বাসায় আসবেন না খবরদার।”
প্রিয়ম হাসলো।
-“না,না তোমার বাসায় যাবো না। তোমার বাসায় গেলে তো তুমি আমার প্রেমে পড়ে যাবে। এত তাড়াহুড়া করে প্রেমে পড়ার দরকার নেই। আস্তে আস্তে পড়ো।”
মোনা ফোন রাখার পর ভাবছে চোখ বুঁজে ভাবছে, প্রিয়মের চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া পানির কথা। প্রিয়ম নিজেকে বদলে ফেলল,মোনার জন্য চোখ ভিজে ওঠে, দিশেহারা হয়ে ওঠে। মোনার প্রিয়মের ভালোবাসা নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। দোটানা শুধু হাবিব সাহেবের জন্য।কাল কেন ডেকেছে প্রিয়ম রেস্টুরেন্ট? মোনা কৌতূহল বোধ করে। কাল একবার প্রিন্সেস কে দেখতে যাবে,অনেকদিন দেখে না।
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here