মোনালিসা পর্ব ৩০

মোনালিসা
লেখা-ইসরাত জাহান তানজিলা
পর্ব-৩০
মোনা বিছানা গোছাচ্ছে। দিনে কয়েকবার গোছাতে হয় বিছানা।‌ রুম’টা সাজানো থাকলে নিশানের বোধ হয় অশান্তি লাগে। সব কিছু এলোমেলো করে রাখবে। মোনা বিরক্তিতে মনে মনে বিড়বিড় করছে আর বিছানা গোছাচ্ছে। উঁচু গলায় নিশানের নাম ধরে ডাকে। নিশান পাশের রুম থেকে ছুটে আসে গলা ফাটানো চিৎকার শুনে।‌ মোনা কর্কশ গলায় বলে,
-“নিশান তোমায় কতদিন না বলছি বিছানা এলোমেলো করবে না? প্রতিদিন এক কথা কতবার বলল?সব কিছু এলোমেলো করে রেখেছো।‌ আমার কথার অবাধ্য হলে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিবো।”
নিশান ভীতি হয়ে তাকায় মোনার দিকে। মুখ দেখে মনে হচ্ছে প্রচণ্ড ভয় পাচ্ছে। মোনা নিশানের চেহেরার অভিব্যক্তি দেখে রাগ ধরে রাখতে পারলো না, হেসে ফেলল।
-“থাক মন খারাপ করো না। পাঠাবো না বাংলাদেশে।”
নিশানের সাথে কথা বলার মাঝে মোনার ফোনের ম্যাসেজের টিউন বেজে ওঠে। প্রিয়ম ম্যাসেজ করছে,
“রেস্টুরেন্টের লোকেশন বলবো নাকি আমি নিতে আসবো?আর শুনো খবরদার আমায় দেখে প্রেমে পড়ে যেয়ো না। পাব্লিক প্লেসে জড়িয়ে ধরো না। আমি লজ্জা পাবো।”
সুযোগ পেয়ে খোঁটা দিচ্ছে। মোনা বিরক্ত হলো, কিছুক্ষণ পর কি মনে করে যেন হাসলো। রিপ্লাই করলো,
“আপনি পাব্লিক প্লেসে কাঁদবেন‌ না প্লীজ। কেউ কাঁদলে আমার জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দিতে ইচ্ছে করে।”
এমন একটা উপযুক্ত উত্তর দিতে পেরে মোনা নিজের মনে হাসলো।প্রিয়ম রিপ্লাই দিলো,
“আজকাল কথায় প্রচুর মিষ্টি, মিষ্টি ভাব।প্রেমে পড়ে গেলে নাকি আমার?”
মোনা উত্তর দিলো না। বিরক্তি’তে কপাল ভাঁজ করলো। প্রিয়ম সুযোগ বুঝে লজ্জা দিচ্ছে। মোনার যত’টা বিরক্ত হওয়ার কথা তত’টা বিরক্ত হতে পারছে না। অদ্ভুত এক অনুভূতি হচ্ছে।
মোনা নিশানের দিকে তাকিয়ে বলল,
-“আজ স্কুলে যেতে হবে না। এক জায়গায় যাবো আমরা।”
নিশান কোথায়ও যাওয়ার কথা শুনলে আনন্দে মাখামাখি হয়ে যায়। মোনা একটা হোয়াইট কুর্তি পড়েছে। ঠোঁটে হালকা রঙের লিপস্টিক দিয়েছে। মোনা সাজতে পছন্দ করে না। ছোট বেলা থেকেই কোন এক অজানা কারণে সাজতে পছন্দ করত না।
প্রিয়ম মোনার বাসার সামনে গাড়ি পার্কিং করে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগলো। মোনা বাসা থেকে বের হয়ে দরজা লক করে সামনে তাকাতেই দেখে প্রিয়ম আসছে। প্রিয়ম’কে দেখে চমকালো।প্রিয়মের উপস্থিতি মোনা’কে যথাযথ নিয়মানুসারে অস্বস্তি দিতে লাগলো। মোনা ইতস্তত বোধ করে বলল,
-“আপনি! আমি তো বলেছি বাসায় আসার দরকার নেই। আমি নিশান’কে নিয়ে যাবো রেস্টুরেন্ট।”
প্রিয়ম হাসলো।মোনার দিকে তাকিয়ে কয়েক মুহূর্তের জন্য দৃষ্টি থেমে গেলো। মোনা অস্বস্তি’তে পড়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে।
-“এগিয়ে নিতে আসলাম। বাংলাদেশী সুন্দরী, ন্যাকা নন্দিনী।”
মোনার চোখে মুখে নিদারুণ বিরক্ত উপচে পড়ছে যেন। বাহির থেকে দেখে যত’টা বিরক্ত মনে হচ্ছে ,মোনা ভিতরে তত’টা বিরক্ত না।
-” আচ্ছা কি বলতে রেস্টুরেন্টে ডেকেছেন?এখন তো বাসায়ই এসে গেছেন। রেস্টুরেন্টে যাওয়ার প্রয়োজন নেই।”
প্রিয়ম খুব সিরিয়াস গলায় বলল,
-“রেস্টুরেন্টের কথা বাসায় বসে বলা যায় না। আমেরিকান রুলস এটা।”
-“এমন অদ্ভুত রুলস যদি থেকেও থাকে সেটা আপনার জন্য আমার জন্য না।”
প্রিয়ম এদিক ওদিক তাকালো। আচমকা মোনা’কে কোলে তুলে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নামতে শুরু করলো। ঘটনার আকস্মিকতায় মোনা হতভম্ব হয়ে গেলো।‌ হাত-পা ছুঁড়তে থাকে। কি বলে প্রতিবাদ করবে মোনা বুঝে উঠে পারলো না। ক্ষুব্ধ হয়ে বলল,
-“প্রিয়ম ভাই, খারাপ হচ্ছে খুব। অতিরিক্ত করছেন কিন্তু।”
মোনার কোন কথা যেন প্রিয়মের কান অবধি পৌঁছায় না যেন। প্রিয়ম ভাবলেশহীন ভাবে পিছনে নিশানের দিকে তাকিয়ে বলল,
-“নিশান আসো তুমি। মোনা পায়ে ব্যাথা পেয়েছে ও’কে হসপিটালে নিয়ে যেতে হবে।”
মোনা অধৈর্য গলায় প্রচণ্ড রাগ নিয়ে বলল,
-“আমি কোথায়ও ব্যথা পাইনি। আমি কিন্তু খারাপ আচরণ করবো প্রিয়ম ভাই।”
প্রিয়ম মোনার সব কথা উপেক্ষা করে গাড়িতে নিয়ে তুলে। মোনা চোখ বুঁজে ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলছে। কয়েক মুহূর্ত পর গাড়ি থেকে নামার জন্য উদ্যত হলো। প্রিয়ম বাঁধা হয়ে দাঁড়ালো। মোনা নাক মুখ ঘুচিয়ে রেখেছে।
-“ভৃত্য হিসেবে রানির সেবা করলাম।”
মোনা কঠিন দৃষ্টিতে তাকায়। প্রিয়ম গাড়ি স্টার্ট করলো। মোনা নিদারুণ বিরক্ত ভঙ্গিতে বসে রইলো। প্রিয়ম মোনার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল,
-“আমায় প্রিয়ম ভাই ডাকো কেন? ছেলে-মেয়ে আমাকে বাবা না ডেকে, মামা ডাকবে।”
কথা’টা মোনার কানে তীক্ষ্ণ ভাবে বিদ্ধ হলো যেন। কি নির্লজ্জের মত কথা! মোনা কিঞ্চিৎ লজ্জা পেলেও প্রকাশ করলো না। গলায় ভারি রাগ নিয়ে বলল,
-“আমার ছেলে-মেয়ে আপনায় মামা’ই ডাকবে। মামা’কে কেউ বাবা ডাকে? ছিঃ!”
প্রিয়ম হেসে উঠলো মোনার মুখের অভিব্যক্তি দেখে। কিছুক্ষণ পর প্রিয়ম আবার বলল,
-“আমাদের ছেলে-মেয়ের চোখও আমার মত নীল হবে। তুমি যেমন আমার নীল চোখ দেখে দেওয়ানা হয়েছো, আমার ছেলে-মেয়ে’দের জন্যও মানুষ অমন পাগল হবে।”
মোনা বিধ্বস্ত মুখে তাকালো প্রিয়মের অসংলগ্ন কথা শুনে। চোখে মুখে রাগ উপচে পড়ছে। মোনা জবাব দেওয়ার উপযুক্ত ভাষা খুঁজে না পেয়ে, কোন প্রত্যুত্তর করলো না। প্রিয়ম ও’কে রাগানোর চেষ্টা করছে মোনা সেটা স্পষ্টভাবেই বুঝলো।
কিছু সময় পর একটা রেস্টুরেন্টের সামনে গাড়ি থামলো। প্রিয়ম গাড়ি থেকে নেমে নিশান’কে নামতে বলল। তারপর গাড়ির ভিতরে উঁকি দিয়ে মোনার উদ্দেশ্য বলল,
-“মহারানী মাটি’তে পা রাখবে নাকি কোলে করে রেস্টুরেন্টে নিতে হবে?”
মোনা গাড়ি থেকে নামলো। প্রিয়মের দিকে এক নজর তাকিয়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো। চোয়াল শক্ত করে বলল,
-“এত প্রেম আসে কোত্থেকে?”
রেস্টুরেন্টে বসার পর প্রিয়ম খাবার অর্ডার করলো। মোনা আগের ন্যায় গম্ভীর’ই থাকলো। প্রিয়মের বলা কথা গুলো হজম করতে কষ্ট হচ্ছে। মোনা এখন প্রিয়ম’কে মন থেকে জোর গলায় বাঁধা দিতে পারেনা। মোনা প্রিয়মের দিকে না তাকিয়ে অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে রেখেছে। খাবার আসার পর প্রিয়ম বলল,
-“যে কথা বলতে রেস্টুরেন্টে ডেকেছি শুনবে না?”
মোনা কথা শোনার জন্য আগ্রহী হলেও প্রকাশ করলো না। একটু আগের বলা কথা গুলোর জন্য অনাগ্রহ মিশ্রিত আচরণ করল। প্রিয়ম নিজ থেকেই বলল,
-“আমার জব’টা হয়ে গেছে।” একটু থেমে বিষাদময় সুরে বলল,
-“কাল থেকে অফিস। তোমায় সারাদিন বিরক্ত করা হবে না।”
মোনার মুখাবয়ব দেখার জন্য তাকালো প্রিয়ম। মোনা খুশি হয়েছে কিনা সেটা বুঝতে পারলো না। প্রিয়ম জিজ্ঞেস করল,
-“খুশি হও নি?”
-“অভিনন্দন! খালাত ভাইয়ের চাকরি হয়েছে খুশি হবো না?”
মোনা যেন ব্যঙ্গ করে বলল কথা’টা। প্রিয়ম খাবার নাড়াচাড়া করছে চিন্তিত মুখে। মোনার দিকে তাকিয়ে বলল,
-“আমি তো তোমার জন্য—”
প্রিয়ম কথা’টা শেষ করতে পারলো না। কোত্থেকে এক মেয়ে এসে উচ্ছ্বাসিত হয়ে প্রিয়ম’কে জড়িয়ে ধরলো। প্রিয়ম অপ্রস্তুত এক অবস্থার মুখোমুখি হলো। মোনার সামনেই হতে হলো এটা!
-“জব হয়েছে নাকি? পার্টি কবে দিচ্ছো?”
মেয়ে’টা প্রিয়ম’কে আলিঙ্গন থেকে মুক্ত করে প্রিয়মের গালে চুমু খেয়ে বলল,
-“কনগ্রাচুলাশন।”
প্রিয়ম মেয়ে’টার সাথে ইতস্তত বোধ করে কথা বলল। সরু চোখে তাকালো মোনার দিকে। মেয়ে’টার সাথে প্রিয়মের বলা কথায় মোনা বুঝতে পারলো মেয়ে’টা প্রিয়মের ক্লাসমেট।
মেয়ে’টা তড়িঘড়ি করে বলল,
-“আসছি। টাইম শর্ট।”
মেয়েটা চলে যাওয়ার পর প্রিয়ম মোনার দিকে তাকানোর সাহস পেলো না। মোনা কেমন প্রতিক্রিয়া করবে? প্রিয়ম ভীতি হচ্ছে। মোনার দিকে তাকিয়ে হতাশ হয়ে বলল,
-“আমার ক্লাসমেট।” প্রিয়ম একটু থেমে মোনা’কে যথাসাধ্য বুঝানোর চেষ্টা করে বলল,
-” প্লীজ মোনা তুমি আমায় ভুল বুঝো না। তুমি তো অনেকদিন ধরে থাকছো এখানে। তুমি তো এখন এখানকার মানুষের জীবনধারা সম্পর্কে জানো। এঁরা এমনই মোনা।”
মোনার সাথে সম্পর্কের যেন অবনতি না ঘটে সেজন্য প্রিয়ম প্রাণপণে বুঝানোর চেষ্টা করছে। প্রিয়ম অস্থির হয়ে ওঠে। মোনা প্রিয়ম’কে স্বাভাবিক গলায় বলল,
-“আমি কিছু মনে করেনি। বুঝেছি মেয়ে’টা আপনার ক্লাসমেট। আপনার স্পেশাল কেউ হলেও আমার কিছু এসে যায় না।”
খুব সাবলীল গলায় বলল মোনা। কোন রাগ, অভিমান কিছুই নেই। প্রিয়ম মোনা’কে বুঝে উঠতে পারলো না ঠিক।প্রিয়ম মোনার দিকে তাকিয়ে বলল,
-“সময় চেয়েছিলে না তুমি? সিদ্ধান্ত নিয়েছো? আমি জানি তুমি আমায় ভালোবাসলেও হ্যাঁ বলবে না।”
মোনা কোন উত্তর করলো না।মোনা’কে নিরুত্তর দেখে প্রিয়ম আবার বলল,
-“তুমি যদি আমায় বিশ্বাস না করতে না পারো তাহলে বিয়ে করি চলো।”
মোনা চমকালো। ভারি গলায় বলল,
-“আমি এখনো সিদ্ধান্ত নিই নি। আমার একটু তাড়া আছে উঠতে হবে এখুনি।”
মোনা নিশান’কে নিয়ে রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়।প্রিয়ম ওঁদের পিছু পিছু আসছে। মোনার কাছে এসে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে বলল,
-“কোথায় যাবে?আমি পৌঁছে দিই?”
-“না,না দরকার নেই।”
প্রিয়ম জোর করতে লাগলো। মোনা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
-“আমার এক ফ্রেন্ডের বাসায় যাবো। সেখানে আপনি কি করতে যাবেন বলুন?”
প্রিয়ম আর কথা বাড়ালো না। মোনা নিশান’কে নিয়ে চলে গেলো। কতদিন পর জ্যাকের বাসায় আসছে। মোনা গিয়ে দেখে জ্যাক বাসায় না। জ্যাক’কে ফোন করে বলল মোনা তাঁর বাসায় এসেছে। জ্যাক অপেক্ষা করতে বলল, একটু বাদে আসছে সে। প্রিন্সেস’কে কোলে নিলো। গালে গভীর আবেগে চুমো খেলো। মোনা প্রিন্সেস’কে বলল,
-“Say Father.”
প্রিন্সেস স্পষ্ট ভাবে বলল। প্রিন্সেসের মুখে কথা শুনে মোনা আনন্দিত হয়ে গেলো। মোনা দ্বিগুণ উৎসাহি হয়ে বলল,
-“say Mother.”
প্রিন্সেস আগের ন্যায় বলল। মোনা হাসলো। এর ভিতর জ্যাক আসলো। কফি খেতে খেতে গল্প করলো অনেকক্ষণ। তারপর বাসায় ফিরলো।
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here