মোনালিসা পর্ব ৪৪

মোনালিসা
লেখা-ইসরাত জাহান তানজিলা
পর্ব-৪৪
প্রিন্সেস আসাতে মোনা লিলি বেগমের প্রতি অমনোযোগী হয়ে পড়ে। লিলি বেগম সেদিকে সরু চোখে তাকিয়ে আছে। লিলি বেগমের কথা গুলো শোনার পর কোন এক অজ্ঞাত কারণে লিলি বেগম’কে ও মোনার খানিক বিরক্ত লাগছে।মোনা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে জ্যাকের কর্মচারীর সাথে হাসি মুখে কথা বলছে। ডায়েরি গুলো হাতে নিলো,প্রিন্সেস ডায়েরির পৃষ্ঠা ধরে টানছে। মোনা চোখ লাল করে তাকিয়ে শাসালো প্রিন্সেস’কে, মোনার চোখে ভাষা প্রিন্সেস বুঝেছে হয়ত।ডায়েরির পৃষ্ঠা হাত থেকে ছেড়ে দিয়েছে। মোনা স্মিত হেসে জ্যাকের কর্মচারীর দিকে তাকিয়ে বলল,
– “ভিতরে আসুন।”
– “না,অন্যদিন।”
জ্যাকের কর্মচারী চলে যাওয়ার পর মোনা দরজা বন্ধ করল। তারপর দ্রুত ছুটে গিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে থেকে মোবাইল’টা হাতে নিলো। জ্যাক ম্যাসেজ করেছে,
“প্রিন্সেস এক অদ্ভুত কাণ্ড করেছে আজ, বার বার বলেছে মাদারের কাছে যাবে।সকালে আবার কর্মচারী’দের পাঠিয়ে দিবো ,প্রিন্সেস’কে নিয়ে আসবে।”
আর একটা ম্যাসেজ ছিলো,
“এই ডায়েরি তিন’টা ইংরেজি’তে লিখে দিবেন।যদি প্রবলেম হয় তাহলে থাক।আমার দীর্ঘ দিনের অধীরতা এই ডায়েরির কথা গুলো বুঝার। আপনি’ই একমাত্র মাধ্যম যে আমায় বুঝাতে পারবেন।”
মোনা মোবাইল’টা হাত থেকে রেখে প্রিন্সেস’কে খাটে বসালো।লিলি বেগম সোফা থেকে উঠে এসে প্রিন্সেসের কাছে বসল। ডায়েরি তিন’টার ব্যাপারে মোনা কৌতূহলী কেন জানি,তবুও একটা ব্যাপার মোনা ভাবছে কারো খুব যতনে লেখা ব্যক্তিগত কথা গুলো পড়া’টা ভীষণ অন্যায়। মোনা বুক সেল্ফে ডায়েরি গুলো রেখে এসে প্রিন্সেসের কাছে বসলো।
– “এই মেয়ে যদি কাঁদে রাতে?”
মোনা তাকায় লিলি বেগমের দিকে।লিলি বেগমের সামনে মোনার হঠাৎ অস্বস্তি লাগছে।
– “না কাঁদবে না,ও আমার সাথে থাকতে পছন্দ করে খুব।”
মোনা থামে।প্রিয়মের ব্যাপার’টা যদি এড়িয়ে যায় এটা তাহলে লিলি বেগমের সন্দেহ হতে পারে। মোনা নিজ থেকেই প্রসঙ্গ’টা তুলল,
– “খালা কি যেন বলছিলে?খালা আমি না আশ্চর্য না হয়ে পারি না! তুমি বিভা আপুর কথা বিশ্বাস করে আমায় জেরা করতে এসেছো। তোমার ছেলের প্রতি যদি আমার প্রেম এত উছলে পড়ত তাহলে তোমার বাসা ছেড়ে আসতাম না।”
লিলি বেগম একটা ক্ষীণ নিঃশ্বাস ফেলল। মুখ’টা গম্ভীর ,ফ্যাকাশে। কপালে চিন্তার রেখা স্পষ্ট। মুখে বিষণ্ণতা।
– “তোর খালু অনেক আগে থেকেই চাইত বিভা’কে ছেলের বউ করবে।তার চাওয়া পূরণ না হলে সব দোষ পরবে আমার ঘাড়ে।বিভার কথা আমি বিশ্বাস করিনি,তবুও জিজ্ঞেস করেছি।”
লিলি বেগমের চেহেরার তীব্র এক ক্ষোভ। বেদনায় ছলছল করা গলায় বলল,
– “কাল রাতে প্রিয়মের বিষয় নিয়ে কথা ওঠে।তর্কের এক পর্যায়ে বলে আমায় ডিভোর্স দিয়ে দিবে। ছেলে দুই’টা হয়েছে তার মত।আমার দোষ কিসের?বিশ্বাস কর মোনা,প্রিয়মের সাথে যে মেয়ের বিয়ে হবে সে কখনো শান্তি’তে থাকতে পারবে না। আর বিভার মত মিনি স্কার্ট পরা, হাতে-পায়ে উল্কি, গলায়-পিঠে ট্যাটু করা মেয়ে আমি পছন্দ করি? কখনোই না।আমি আমার ছেলে’কে ই পছন্দ করিনা,ছেলের বউয়ের কাছ থেকে আর কি প্রত্যাশা করব? কিন্তু বিভার সাথে প্রিয়মের বিয়ে হলো ওরা দুইজন ভালো থাকবে। খারাপের সাথে খারাপ’ই টিকে থাকতে পারে।”
লিলি বেগমের কথা শুনে মোনার চোখ ক্রমশ ঝাঁপসা হয়ে আসছে।যে বয়সে দুই জন দুই জনের ওষুধের কৌটা আগলে রাখবে,সে বয়সে ডিভোর্সের কথা?লিলি বেগমের চোখে কষ্টের মহাতরঙ্গ। একজন মা কত’টা অসহ্য হয়ে গেলে নিজের ছেলে’কে খারাপ বলে?কত’টা অসহায় হলে এই বয়সে ডিভোর্সের ভয় করে? মোনার অপরাধ বোধ কাজ করছে,মোনা তো এতদিন বুঝতে পারিনি লিলি বেগমের কষ্টগুলোর গভীরতা। মোনা তো সম্পর্কের আগে জানতো না এতকিছু।
– “খালা প্রিয়ম ভাই তো ভালো হয়ে গেছে।”
লিলি বেগম মোনার দিকে তাকিয়ে যন্ত্রনাপূর্ণ একটা হাসি দিলো। পৃথিবীর সমস্ত ক্লেশ যেন মানুষ’টা কে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে।
– “আমার এই দুর্দশা কিসের জন্য জানিস?তোর মায়ের জন্য।”
– “এগুলো কেমন কথা বলছ খালা? আমার মা কি করেছে তোমায়?”
লিলি বেগম যেন পুরানো স্মৃতি বন্দনা করছে। উদাস হয়ে গেল হঠাৎ।
– “ভার্সিটি লাইফে এক ছেলের সাথে প্রেম করতাম।কি যে ভালোবাসত আমায়! বিশ্বাস কর মোনা ওর সাথে বিয়ে হলে আমি সুখী হতাম! কিন্তু তোর মায়ের জন্য পারিনি।
তোর মা তোর বাপের সাথে পালিয়ে গেল।এতে আমার বাপের মান-সম্মানে ভাটা পড়ল। মান-সম্মানে জোয়ার বয়াতে আমায় জোর একটা অমানুষের সাথে বিয়ে দিয়ে দিল।তোর মা পালিয়ে যাওয়ার পর আমার বাপ এত ভয়ংকর রূপী হয় যে আমি না বলা তো দূরের কথা, চোখের দিকে তাকিয়েও কথা বলতে পারিনি।আমার যার সাথে সম্পর্ক ছিলো সে হাবিবের থেকে সব দিক থেকে ভালো ছিলো। কিন্তু সেই মুহূর্তে এই কথা মুখে উচ্চারণ করলেই আমায় খুন করে ফেলত। সব জিদ আমার উপরে দেখিয়েছে। তোর মা পালিয়ে যাওয়া’তে পরিবারের সবার সম্মান গেছে অথচ আমার গেছে সব তবুও আমি লুকিয়ে লুকিয়ে তোর মায়ের সাথে যোগাযোগ করতাম। যা হয়েছে সেটা’কে নিয়তি বলে মেনে নিয়েছিলাম। আর এখন যদি তোর কারণে বিভা আর প্রিয়মের বিয়ে ভাঙে তাহলে এই বয়সে আমি ডিভোর্সি হবো।”
মোনার হৃদস্পন্দন স্প্রিংয়ের বলের মত লাফাচ্ছে। নিজের কাছে নিজে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে গেল।সম্পর্ক’টা শেষ করে দেওয়া উচিত।এই ছোট একটা বাক্য ডাঙায় তুলে রাখা মাছের ন্যায় মোনার মস্তিষ্কে ছটফট করছে অস্থির ভাবে। মর্মদেশে ভারি এক যন্ত্রনা সঁচরণ করছে। মোনার কি করা উচিত সেটা স্বচ্ছ কাঁচের ন্যায় স্পষ্ট। মোনার পাঁজর ভেঙে কান্না আসছে। মোনা কঠোর চেষ্টা করে চোখের পানি রুদ্ধ করে রেখেছে। অনেকক্ষণ নিঃশব্দে কাটার পর বলল,
– “খালা প্রিয়ম ভাইয়ের সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই।বিশ্বাস করো আমায়,উনি আমার বড় ভাইয়ের মত।”
এর ভিতর প্রিন্সেস কেঁদে উঠে।প্রিন্সেসের কান্নার বাহানায় মোনা লিলি বেগমের কাছ থেকে সরে যায়।প্রিন্সেসের কান্না থামানোর নিছক অভিনয় করে বারান্দায় পাঁয়তারা করছে। চোখ জলে ছাপিয়ে উঠছে বার বার। লিলি বেগমের সামনে যেতে পারছে না, লিলি বেগমের বেদনাপূর্ণ চেহেরার দিকে তাকালে মোনার মনে অপরাধ বোধ নাড়া দিয়ে ওঠে।মোনার জীবনের সব সম্পর্ক গুলো জটিল সমীকরণের মত। সব সম্পর্কের ভাগশেষ শূন্য। প্রিন্সেসের কান্না থেমে যায় অনেক আগে কিন্তু মোনার সেদিকে মনোযোগ নেই। কান্না থামানোর জন্য পাঁয়তারা এখনো চলমান।
রুম থেকে লিলি বেগম গলা উঁচিয়ে ডাকে,
– “মোনা এদিকে আয়। বাসায় যাবো।”
মোনা আসে। ধরণীর সমস্ত আড়ষ্ট’টা মোনা’কে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। লিলি বেগমের সামনে দাঁড়াতে সংকোচ হয়।লিলি বেগম মোনার দিকে কয়েক পা এগিয়ে এসে, মোনার হাত ধরে বলল,
– “মোনা তুই রাগ করিস না।আমি বিভার থেকে তোকে বেশি ভালোবাসি। আমি নিপার থেকে লিপি’কে বেশি ভালোবাসতাম। আমি বিশ্বাস করেছি তোকে।”
মোনা নিষ্প্রভ দৃষ্টিতে তাকায়।মোনা নিজের দোষও খুঁজে পাচ্ছে না খুব। প্রিয়মের সাথে সম্পর্কের আগে তো জানত না এসব। সেখানে মোনার দোষ কিসের? মোনা বিমর্ষপূর্ণ গলায় বলল,
– “যাও খালা।উনাদের নিয়ে এসো আবার।”
– “আমাদের বাসায় চল মোনা।”
– “কষ্ট পেয়ো না খালা।একটা সত্যি কথা বলি। খালু’কে আমার পছন্দ না তাই আমি যাই না। আমায় সেধো নি কখনো।”
লিলি বেগমও কথা বলল না।দ্বিতীয় বার সাধলো না মোনা’কে।লিলি বেগম সিঁড়ি বেয়ে নামছে। মোনা তাকিয়ে আছে সেদিকে,চোখ দুটো জলে টলমল।
___
জ্যাকের কাছে একবার ফোন দেওয়া উচিত। কিন্তু এখন কথা বলার মেজাজ নেই।জ্যাক কিছু’টা গুটিয়ে নিয়েছে নিজেকে। মোনার সামনে আসতে হয়ত অস্বচ্ছন্দ বোধ করে। মোনাও জ্যাকের সামনে অস্বস্তি’তে পড়ে। জ্যাক যাতে অপরাধ বোধ কিংবা অস্বচ্ছন্দ বোধ না করে সে জন্য মোনা খুব স্বাভাবিক আচরণ করার চেষ্টা করে। জ্যাকের কথা মনে পড়তেই মোনার মাথায় আরেক পীড়া চাপ সৃষ্টি করে। জ্যাকের ম্যাসেজের উত্তর দেওয়া হয় নি। মোনা জ্যাকের নম্বরে ডায়েল করে। ওপাশ থেকে ফোন তুলে না।
নিশান প্রিন্সেসের সাথে দুষ্টুমি’তে মেতে ওঠে। মোনা আনমনা হয়ে বসে রইলো।নিশানের সাথে পুতুল নিয়ে টানাটানি বাঁধে প্রিন্সেসের। প্রিন্সেস হাত পা দাবড়াচ্ছে। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে বলে,
– “মাদার।”
মোনা তাকায় ওদের দিকে।নিশানের হাতে পুতুল। মোনা নিশানের দিকে তাকিয়ে চোখ রাঙিয়ে বিরক্ত গলায় বলল,
– “এই নিশান তুমি কি প্রিন্সেসের মত বাচ্চা? বাসায় তো সারাক্ষণ পরে থাকে এটা। তখন ধরতে পারো না?”
এই বলে নিশানের হাত থেকে পুতুল’টা ছোঁ মেরে নিয়ে প্রিন্সেস’কে দেয়।প্রিন্সেস বসা থেকে উঠে এগিয়ে আসে মোনার দিকে। মোনার গলা ধরে বলে,
– “মাদার লাভ ইউ।”
মোনা বিস্ময়ে হাঁ করে থাকে। ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে আপন ইচ্ছেতে। মোনা চমকানো গলায় বলেন,
– “ডু ইউ লাভ মি?”
প্রিন্সেস আদো আদো সুললিত কণ্ঠে বলল,
– “ইয়েস।”
বাচ্চাদের মুখে ফোটা প্রথম বলা কথা গুলো’তে বিস্মিত হয় সবাই। আত্মীয়-স্বজনের বিস্ময়ের সীমা থাকে না। অথচ এটা স্বাভাবিক নিয়ম। নির্দিষ্ট একটা একটা বয়সে সব বাচ্চারাই কথা বলে।মোনা উল্লাসিত হয়ে বলে,
– “গিভ মি এ্যা কিস প্রিন্সেস।”
প্রিন্সেস ওর গোলাপী আভা যুক্ত ঠোঁট ছুঁয়ে দেয় মোনার গালে। ক্ষণকালের জন্য মোনার সব দুঃখ, দুর্দশা উপশম হয়ে যায়। এর ভিতর জ্যাক ফোন দেয়। মোনা ফোন রিসিভ করে নিশানের দিকে তাকিয়ে প্রিন্সেস’কে দেখতে বলে। মোনা ফোন নিয়ে বারান্দায় যায়। প্রিন্সেস আর নিশানের চেঁচামেচি’তে কথা বলার জোঁ নেই।ওপাশ থেকে জ্যাক বার বার বলছে,
– “মোনালিসা,কথা বলছেন না কেন?”
– “জ্যাক।”
– “হুম।ব্যস্ত আপনি?”
– “না, না ব্যস্ত না।প্রিন্সেস আর নিশান চেঁচিয়ে পুরো বাসা মাথায় তুলেছে। বারান্দায় আসলাম।”
– “প্রিন্সেস আজকাল এত দুষ্টু হয়েছে।প্রিন্সেসের আম্মু ছিলো চুপচাপ স্বভাবের,আর আমিও সেরকম।প্রিন্সেস হয়েছে আমাদের বিপরীত।”
মোনা হেসে বলল,
– “আচ্ছা ডায়েরি তো ব্যক্তিগত জিনিস।আমি তো সব পড়ে ফেলব।”
জ্যাক ও হাসল,
– “রোমান্টিক মুহূর্ত গুলো স্কিপ করেন।”
জ্যাক একটু থেমে কিছু’টা জড়িমা নিয়ে বলে,
– “মোনালিসা আপনার সমস্যা কিংবা সময় না হলে দরকার নেই।”
– “কি বলছেন এসব? আপনি আমার কত উপকার করেছেন!আপনার কিছু’টা কাজে আসতে পারলেও আমি স্যাটিসফাইড।”
– “উপকারের প্রতিদান হিসেবে কাজ’টা করছেন?”
– “আপনি কিন্তু উল্টা বুঝছেন। আপনার অত বেশি উপকারের প্রতিদান দেওয়া সম্ভব না।”
জ্যাক এই কথার উত্তর না দিয়ে বলল,
– “প্রিন্সেস আপনায় বিরক্ত করছে?”
মোনা কপট রাগ দেখিয়ে বলল,
– “জ্যাক আমি কিন্তু রেগে যাবো। ইউ নো হাউ মাচ আই লাভ প্রিন্সেস।”
কথা বলতে বলতে মোনার চোখ যায় রুমের দিকে। প্রিন্সেস নিশানের চুল গুলো দু হাতের মুঠোয় খামচে রেখেছে। প্রিন্সেসের চেহেরায় প্রকট রাগ। মোনা জ্যাক কে বলল,
– “জ্যাক রাখছি।”
ফোন রেখে মোনা দ্রুত রুমে ছুটে আসে।প্রিন্সেসের হাতের মুঠো থেকে নিশানের চুল ছাড়িয়ে বলল,
– “প্রিন্সেস করছো’টা কি তুমি?এত ফাজিল হয়েছো কেন?”
মোনা নিশানের দিকে তাকায়। নিশানের মুখের অভিব্যক্তি দেখে বুঝা যাচ্ছে প্রিন্সেস’কে ইচ্ছে করে রাগাচ্ছে ও। মোনা নিশান’কে শাসিয়ে বলল,
– “সমস্যা কি?রাগাচ্ছো কেন ও’কে? নিশান বই নিয়ে বসো,আমি প্রিন্সেস’কে নিয়ে ওই রুমে যাচ্ছি।”
মোনা প্রিন্সেস’কে নিয়ে পাশের রুমে গিয়ে বসে থাকে।প্রিন্সেস পোষা বিড়ালের মত মোনার শরীর ঘেঁষছে।জ্যাকের ডায়েরি গুলোর প্রতি মোনার কৌতূহল থাকলেও এই মুহূর্তে অনাদৃত মনে হচ্ছে। ইচ্ছে করছে না খুলে দেখতে। লিলি বেগমের বলা কথা গুলো মোনার কানে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। চৈত্র মাসের রোদের মত প্রখর এক মর্মবেদনা মোনার মনে বয়ে যাচ্ছে। প্রিয়ম’কে আজ’কে ই বলে দিবে এই সম্পর্ক সম্ভব নয়।রাখতে পারবে না এই সম্পর্ক। লিলি বেগমের জন্য হলেও সম্পর্ক’টা ছিন্ন করতে হবে।হাবিব সাহেবের থাবা থেকে লিলি বেগম’কে রক্ষা করার জন্য হলেও এই সম্পর্ক ছিন্ন করতে হবে।এই কথা গুলো অবাধে চিন্তা করা যায়, কিন্তু সম্পর্কের বেড়াজাল থেকে বের হয়ে আসা কঠিনতর কাজ।এই কঠিন কাজ’টা করার জন্যই মোনা প্রস্তুতি নিচ্ছে। মোনার চোখ দুটি বর্ষণমুখর হয়ে পরেছে। নিজের মন’কে শক্ত করতে হবে।এই আবেগ,মায়া উপেক্ষা করতে হবে।জীবনে আর কখনো ভালোবাসার প্রত্যাশা করা যাবে না, ভালোবাসা মোনার জন্য মৃগতৃষ্ণা বৈ কিছুই না। মোনার চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে। সব ভেঙে চুরে চূর্ণ বিচূর্ণ করে দিতে ইচ্ছে হচ্ছে। প্রিন্সেস মোনার কোলের ভিতর উঠে দাঁড়ায়। মোনার চোখ থেকে পড়া পানির ফোঁটা গুলো আঙ্গুলে মাখে।চোখ বেয়ে পড়া পানির ফোঁটা গুলো দেখে যেন উৎফুল্ল হয়ে ওঠে ‌।
__
রাত অনেক হয়েছে। নিশান ঘুমিয়ে গেছে। মোনা খাটের সাথে বালিশ ঠেস দিয়ে বসে আছে হেলান দিয়ে। প্রিন্সেস ও বসে আছে।প্রিন্সেসের রাত জাগার স্বভাব। জ্যাক বারো’টা-এক’টা পর্যন্ত ল্যাপটপ চালাবে আর প্রিন্সেস জ্যাকের পিঠে উঠে বসে থাকবে নয়ত গভীর মনোযোগে ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে থাকবে। মোনা প্রিয়ম’কে রাতে আসতে নিষেধ করেছে। প্রিয়ম কি আসবে?কথা বলা প্রয়োজন প্রিয়মের সাথে। সম্পর্ক’টা শেষ করে দেওয়া প্রয়োজন। আবেগের স্রোতে গা ভাসিয়ে দিলে হবে না। কলিং বেলের শব্দে মোনার ভাবনার সুতো ছিঁড়ে।উঠে গিয়ে দরজা খুলে।প্রিয়মের দিকে তাকায় শঙ্কা ভরা চোখে।ভালোবেসেছিল এই মানুষ’টা কে। হৃদয়ের শুদ্ধতম আবেগ, অনুভূতি দিয়ে চেয়েছে। ভালো থাকতে চেয়েছে। মোনার গলা একদম নিস্তেজ।
– “আপনায় না আসতে না করেছি রাতে?”
প্রিয়ম হাতের কব্জি থেকে ঘড়ি’টা খুলে খাটে বসে। চেহেরায় ক্লান্তি। মোনার দিকে তাকিয়ে বলল,
– “তোমার সব কথা শুনতে হবে আমার?তোমায় অমন দেখাচ্ছে কেন? কেঁদেছো কেন মোনা?”
এসব বলতে বলতে প্রিয়মের চোখ যায় প্রিন্সেসের দিকে। মোনা ভেবে নিয়েছে প্রিন্সেস’কে দেখে প্রিয়ম হয়ত ক্ষুব্ধ হবে।হোক! প্রিয়ম ভীষণভাবে চমকিত হয়ে গেল।
– “জ্যাকের মেয়ে না?প্রিন্সেস!”
এইটুকু বলে প্রিয়ম প্রিন্সেস’কে কাছে টেনে এনে কোলে নিলো। প্রিন্সেসের গালে চুমু খেয়ে বলল,
– “এত কিউট হওয়া লাগে?”
মোনা যথা রীতি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে প্রিয়মের আচরণ দেখে। চোখ জুড়ে বিস্ময়। মোনার দিকে তাকিয়ে প্রিয়ম জিজ্ঞেস করে,
– “জ্যাক এসেছিল?”
– “না, জ্যাকের এক কর্মচারী এসে দিয়ে গেল প্রিন্সেস’কে।”
– “তুমি যদি আমার এত জঘন্য অতীত জেনেও আমায় ভালোবাসতে পারো, আমি কেন তোমার একজন শুভাকাঙ্ক্ষী’কে সহ্য করতে পারবো না? আমার কোন প্রবলেম নেই জ্যাক’কে নিয়ে। আই বিলিভ ইউ এন্ড রেসপেক্ট ইউর ফ্রেন্ডশীপ।”
মোনা ক্রমশ অবাক হয়ে চলেছে।প্রিয়ম প্রিন্সেস’কে কোলে নিয়ে মোনার দিকে কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে নিচু গলায় বলল,
– “মোনা পাখি রেগে আছো এখনো?”
মোনা ক্লান্ত মুখো হয়ে আছে। চেহেরায় নিস্তেজ ভাব। যে কেউ দেখলেই বুঝবে এই মানুষ’টার ভিতরে প্রচণ্ড অশান্তি বিরাজ করছে। তীব্র যন্ত্রনায় মোনা চোখ বুঁজে বলল,
– “খালা এসেছিল।আপনার সাথে আমার কথা আছে।”
প্রিয়ম ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলল,
– “তোমার খালা আবার তোমার মাথায় কি বিষ ঢুকিয়ে দিয়ে গেছে?”
– “এই সম্পর্ক’টা আমি আর রাখতে চাচ্ছি না।আমি চাই না এই বয়সে আমার জন্য আমার খালা ডিভোর্সি হোক।”
মোনার কাছ থেকে সব’টা শুনে প্রিয়ম একটা ক্ষীণ নিঃশ্বাস ফেলে সোফায় বসলো।মোনা আবার বলল,
– “খালা’কে এসব বলেন না।তাহলে সব বুঝে যাবে।কিছু বুঝার বাকি থাকবে না।”
প্রিয়ম মোনার হাত ধরে নিজের পাশে বসায়। মোনার অশ্রুসিক্ত চোখ গুলোর দিকে তাকিয়ে বলে,
– “আমি সব ম্যানেজ করে নিবো মোনা।”
– “আপনার কিছু ম্যানেজ করতে হবে না।আপনি আপনার বাসায় যান।এ সম্পর্ক রাখা সম্ভব নয় আমার পক্ষে।বিভা আপু’কে বিয়ে করুন।”
প্রিয়মের কোন কথা শুনতে চাচ্ছে না মোনা।প্রিয়ম রেগে গল। রাগে প্রিয়মের চোখ গুলো ধিকধিক করছে।
– “এত বেশি কেন বুঝো মোনা?বলেছি তো ম্যানেজ করবো আমি সব।কারো রাগ,জিদের জন্য আমি বলি হবো?”
মোনা অধৈর্য গলায় বলে,
– “এত সব সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। সবচেয়ে সহজ উপায় সম্পর্কের ইতি টানা।এত সব চিন্তা আমি নিতে পারছি না, আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি।”
– “বিষয় গুলো ভাবতে হবে।সম্পর্ক শেষ করে দেওয়া সব সমস্যার সমাধান না। আমি ভেবে একটা উপায় বের করব। সকাল পর্যন্ত সময় দেও।অন্তত তোমার মত ছেড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিবো না।”
মোনা চুপ করে থাকে।কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না। প্রিয়ম আবার বলে,
– “মোনা আমি ডিনার করিনি এখনো।”
মোনা আস্তে করে বলে,
– “আমি রান্না করিনি।”
– “আচ্ছা বাইরে থেকে খেয়ে আসি চলো।সকালে একটা উপায় বের করে ফেলব মোনা।আর কোন চিন্তা করো না।”
মোনা বিষণ্ণ গলায় বলে,
– “আমি খাবো না,আপনি খেয়ে বাসায় চলে যান।”
প্রিয়মের কোলে প্রিন্সেস।প্রিয়ম সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়।মোনার হাত ধরে হেঁচকা টান দিয়ে দরজার কাছে নিয়ে যায়। মোনা অস্থির গলায় বলে,
– “আরে নিশান ভয় পাবে। আমি যাবো না বলছি তো।”
মোনার সমস্ত কথা উপেক্ষা করে প্রিয়ম দরজা বাইরে থেকে লক করে মোনা’কে হাত ধরে টেনে নিয়ে চলে।
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here