মোনালিসা
ইসরাত জাহান তানজিলা
পর্ব-৮
মোনা অগ্নিবর্ণ চোখে প্রিয়মের দিকে তাকিয়ে আছে। রাগে মোনার ঠোঁট ঈষৎ কাঁপছে। প্রচণ্ড ক্ষোভে রাগে চোখ দুটি গভীর ভাবে বন্ধ করে, দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে রাগের বহিঃপ্রকাশ করছে। চোখ,মুখ কুঁচকে রেখেছে। ইচ্ছে করছে চিৎকার করতে।প্রিয়ম বলে,
-“তোমার লাইফস্টাইল, মেন্টালিটি, তোমাদের কালচার এসব আমার বুঝা উচিত ছিলো। তুমি এতটা কনজারভেটিভ আমি বুঝতে পারিনি। দুঃখিত আমি।”
এসব কথাও মোনার অসহ্য লাগছে। মনে মনে উগ্র রোষে ফেটে পড়লেও খুব ঠান্ডা গলায় বলল,
-“ইট’স ওকে।”
-“তোমার রাগ করাটা স্বাভাবিক। কিন্তু ক্লাবে তো তোমার সাথে খারাপ কিছু হয়নি, যাস্ট একটু চুমু।”
মোনার কপালে ভাঁজ পড়ে। অস্ফুট স্বরে বলে যাস্ট একটা চুমু? মোনা তাৎক্ষণিক উত্তর দিতে পারলো না। কিছু মুহূর্ত পর বলল,
-“ওর থেকে বেশি কিছু হওয়ার জন্য আপনি আমায় ক্লাবে নিয়েছিলেন না? আপনাদের কথা শুনলে আমি হতবুদ্ধি হয়ে যাই, উত্তর দেওয়ার মত ভাষা খুঁজতে বেগ পেতে হয়।”
প্রিয়ম যেন একটু বিরক্ত হলো।নাক মুখ কুঁচকে বলল,
-“তুমি একটু বেশি বেশি বলছো। একটা চুমু দেওয়াতে পাপ হয়ে গেছে?”
মোনা তাচ্ছিল্য ভরা গলায় বলল,
-“না পাপ হয়নি। এবার আমার হাত ছাড়ুন। আমার হাতটা ভেঙে যাবে।”
-“তোমাদের মত মেয়েদের সমস্যা কি বুঝিনা।একটু প্রিয়োরিটি দিলে ন্যাকা নন্দনি হয়ে যাও।”
মোনা এবার রাগে চাপা চিৎকার করে বলল,
-“আপনার কাছে প্রিয়োরিটি কে চেয়েছে?আর আমাদের মত মেয়ে বলতে আপনি কি বুঝিয়েছেন বলুন?আপনারা তো সিক, আপনাদের ট্রিটমেন্ট দরকার।”
-“তুমি তো দেখছি আস্ত বেয়াদব।খুব কথা জানো।”
-“আমি বেয়াদব? আপনার বাপ কি বলেছে জানেন?বলেছে আমি নাকি আপনায় ফুঁসলাচ্ছি, নাইট ক্লাবে নিজের ইচ্ছেতে গেছি আপনার সাথে,আপনার গলায় ঝুলে পড়ার পরিকল্পনা করছি। আপনার বাপ একটা বেয়াদব।”
প্রিয়মের মুখ থমথমে হয়ে গেলো। মোনা নিজেও বুঝতে পারল না কথার স্রোতে কি বলতে কি বলে ফেলেছে। কিন্তু যা বলেছে তা সত্য! সত্য হজম করতে পারেনা সবাই। প্রিয়ম কোন উত্তর না দিয়ে মোনার হাত ছেড়ে দিয়ে চলে যায়।
মোনা বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকে।প্রিয়ম নিশ্চয়ই হাবিব সাহেবের কাছে বলে দিবে। মোনা হাবিব সাহেবের ডাকের অপেক্ষায়! হাবিব সাহেব যে এবার বাসা থেকে বের করে দিবে এতে কোন সন্দেহ নেই। মোনা মনে মনে ভাবছে এ বাসা থেকে বের করে দিলে কোথায় যাবে?জ্যাক এর সাহায্যে নিবে?
নিশান ধীরে ধীরে এসে মোনা পাশে দাঁড়ায়। মোনা কে উদাসীনতায় গ্রাস করেছে, নিশানের উপস্থিতি টের পায়না। নিশান মোনার শরীর ঘেঁষে দাঁড়িয়ে যায়। মোনা নিশানের দিকে তাকিয়ে হাসে। নিশান আদুরে ভঙ্গিতে মোনার গাল টেনে দেয়। নিশানের ভবিষ্যৎ নিয়ে মাঝে মাঝে চিন্তিত হয়ে পড়ে মোনা। মোনা যেদিকেই যাবে নিশানও সেদিকে যাবে। মোনার শরীর ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকবে। মোনা কে একদন্ড না দেখলে অস্থির হয়ে পড়ে।
মোনার ধারণা মিথ্যা হলো হাবিব সাহেব ওঁদের ডাকেনি। বাসা থেকেও বের করে নি। খাবার টেবিলে সবাই একসাথে খেয়েছে তখনো কিছু বলেনি। প্রিয়ম হাবিব সাহেবের কাছে কিছুই বলে নি তাহলে। এত অপমানের পরও খাবার টেবিলে এক সাথে নির্লজ্জের মত খেতে হয়। পরিস্থিতি যেন মোনা কে নির্লজ্জ বানিয়ে দিচ্ছে ক্রমশ।
_____
লিলি বেগম মানুষটা মোনা কে সাপোর্ট দিয়ে যাচ্ছে, কিভাবে খারাপ পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হয় তা শিখাচ্ছে।জীবনের এই ক্লান্তিলগ্নে, তীব্র খড়ার পর এক পশলা বৃষ্টির মত লিলি বেগম মোনার মনে স্নেহের পরশ বিস্তার করে। মোনার মন সজীব হয়ে উঠে। মোনা বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা পায়।
রাত বৃদ্ধি পাওয়ায় সাথে সাথে মোনার চিন্তা ভাবনা বৃদ্ধি পায়। রাত হলেই যেন চিন্তা গুলো মোনার মস্তিষ্ক গ্রাস করে। সেই চিন্তা-ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসতে আসতে রাত প্রায় অর্ধেক চলে যায়। মোনা ঘুমে তলিয়ে যায়। বাইরের কোলাহল বাড়ছে, রাত শেষ হয়ে আসছে। মোনা ঘুম ঘুম চোখ দুটো জোর করে মেলে। আকাশ সূর্যের ফিকে আলোয় উদ্ভাসিত হচ্ছে। রাত শেষ হয়ে গেছে। আস্তে আস্তে উষার রাঙা আলোয় ভরে যাবে শহর। কুয়াশার পর্দা ভেদ করে সূর্যোদয় হবে, আর এক উজ্জ্বল দিনের শুরু হবে সারা শহর জুড়ে।
মোনা বিছানা ছাড়ে। ছাদে যায়। ছাদে যেতেই কালকের কথা মনে পড়ে। মোনা চারদিকে তাকিয়ে দেখছে আজকে আবার কেউ ছাদে আছে কিনা? মোনা চারদিক অবলোকন করে, কাউকেই দেখছে না। কিছুক্ষণ পাঁয়তারা করে মোনা রুমে যায়। নিশান কে ডাকে। নিশান গুটিসুটি মেরে ঘুমাচ্ছে। মোনা ওড়নাটা আলনার উপর রেখে ওয়াশরুমে যায় ব্রাশ হাতে। ওয়াশরুমের দরজা খুলতেই মোনা চিৎকার করে উঠে। দৌড়ে রুমে চলে আসে! প্রিয়ম ওয়াশরুমের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ব্রাশ করছে। ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে রুমে এসে মোনার দিক তাকিয়ে বলল,
-“আরে এভাবে চিৎকার করছো কেন? আমার রুমের ওয়াশরুমে একটু প্রবলেম হয়েছে।”
মোনা ভুত দেখার মত ভয় পেয়েছিল। বিধ্বস্ত মুখে কেবল আস্তে করে বলল,
-“ও।”
-“ওয়াশরুম তো বড়ই আছে দুইজন একসাথে কি ফ্রেশ হওয়া যায় না?এটা তো টয়লেট না যে দুইজন একসাথে গেলে সমস্যা।”
প্রিয়মের এসব অসংলগ্ন কথা উপেক্ষা করে মোনা বলে,
-“আপনি ফ্রেশ হয়ে যান,আমি পরে ফ্রেশ হবে।”
প্রিয়ম জোর গলায় বলল,
-“না এক্ষুনি ফ্রেশ হবে তুমি এবং আমার সাথে।”
প্রিয়মের আচরণে মোনা তিক্ত হয়ে পড়ে। অধৈর্য হয়ে বিরক্ত গলায় বলল,
-“আপনি কিন্তু বাড়াবাড়ি করছেন।”
-“যদি বাড়াবাড়ি ভাবো তাহলে বাড়াবাড়ি।”
প্রিয়ম মোনার হাত ধরে হেঁচকা টান দিয়ে ধরে ওয়াশরুমে নিয়ে যায়। এই অসুরে শক্তির সাথে মোনা পেরে উঠে না। প্রিয়ম ওয়াশরুমের দরজাটা বন্ধ করে দেয়।তারপর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। যাতে মোনা বের হতে না পারে। মোনা আতংকিত হয়ে বলে,
-“দরজা বন্ধ করলেন কেন?দরজা খুলুন। আমি বের হবো।”
-“ব্রাশ মুখে নেও,ফ্রেশ হও। যদি কথা না শুনো তাহলে কি হবে বুঝো তো।”
মোনা শঙ্কিত হয়ে বলে,
-“কি হবে?”
-“ওইদিন পার্টিতে যা হয়েছে তার থেকে খারাপ কিছু হবে। ওইদিন তো শুধু চুমু খেয়েছি।”
মোনার মুখ চুপসে যায়। কাঁপা কাঁপা হাতে ব্রাশ করে,মুখে পানি দেয়।প্রিয়ম হেসে বলে,
-“তোমায় মাঝে মাঝে খুব সাহসী মনে হয়,মাঝে মাঝে ভীতু।”
মোনা উত্তর দেয় না। দ্রুত ফ্রেশ হয়ে বলে,
-“এবার যেতে দিন।”
প্রিয়ম নির্বিবাদে দরজা খুলে দেয়। মোনা তড়িৎ বেগে বেরিয়ে যায়।যেন জেলহাজত থেকে মুক্তি পেয়েছে। প্রিয়ম বেরিয়ে নিজের রুমে চলে যায়। প্রিয়ম সব সময় দুপুর ঘুম থেকে উঠে,আজ এত তাড়াতাড়ি! মোনা বুঝতে পারলো না। শুধু শুধু জোরজবরদস্তি করে ওয়াশরুমে নিলো। আবার ফ্রেশ হওয়ার পর দরজা খুলে দিলো। কি অদ্ভুত ব্যাপার!এঁদের যে জটিল হাবভাব, এঁরা যদি কোন সাবজেক্ট হত তাহলে অনার্স কমপ্লিট করতে বারো বছর লেগে যেত।
___
হাবিব সাহেব অফিসে চলে যাওয়ার পর লিলি বেগম মোনা কে রুমে ডাকে।লিলি বেগম রুমে মোনার উপস্থিতি বুঝতে পেরে সেদিকে না তাকিয়েই বলল,
-“তোকে আর নিশান কে নিয়ে কিছু কেনাকাটা করতে যাবো। একটু দ্রুত রেডি হয়ে নে।”
-“কেনাকাটা তো তুমি একাই করতে পারো। আমার যেতে ইচ্ছে করছে না খালা।”
-“আমি তোদের জন্য কেনাকাটা করব।”
-“না, না খালা। আমাদের কোন কিছু লাগবে না।”
লিলি বেগম রাগান্বিত গলায় বলল,
-“মোনা তুই কিন্তু বেশি বুঝিস।”
লিলি বেগমের রাগ দেখে মোনা দমে যায়। রুমে গিয়ে নিশান কে রেডি করিয়ে দেয়। তারপর নিজে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে। হোয়াইট কালারের একটা কুর্তি পড়েছে সাথে ব্লাক জিন্স প্যান্ট।গলায় একটা ওড়না ঝুলানো। মোনা ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে নিজের চেহেরা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। চোখের নিচে কালি জমেছে, মোনা কাজল দিয়ে নেয়। রেডী হয়ে রুম থেকে বের হয়। লিলি বেগম কে দেখে মোনার খানিকটা অস্বস্তি লাগে। লিলি বেগম শর্ট কুর্তির সাথে জিন্স পরেছে। এই বয়সের সাথে এমন পোশাক-পরিশ্চেদ যায় না। ওরা বাসা থেকে বের হওয়ার পর পরই প্রিয়ম বের হয়। লিলি বেগম কে ডাক দেয়।লিলি বেগম পিছনে ফিরে বলল,
-“তোর আবার কি হলো?”
-“কোথায় যাচ্ছো তোমরা?”
-“শপিংএ।”
-“চলো আমি পৌঁছে দিয়ে আসি।”
-“দরকার নেই তুই তোর কাজে যা।”
-“উফ আম্মু! উঠো তো গাড়িতে।”
প্রিয়ম আড় চোখে কয়েকবার মোনার দিকে তাকায়। মোনা চুপচাপ বসে আছে। প্রিয়মকে দেখে বিরক্ত হচ্ছে। প্রিয়ম বলল,
-“মোনা আজ তোমায় কি যে সুন্দর লাগছে!”
মোনা প্রত্ত্যুতর করে না। গাড়ি এসে বিশাল এক শপিং মলের এর সামনে থামে। মার্কেটের সম্মুখে বিশাল পার্কিং চত্বর। মানুষের ভীড়। কেউ কেউ ট্রলি হাতে দাঁড়িয়ে আছে, কেউ গাড়ি পার্ক করছে, কেউ শপিং শেষে চলে যাচ্ছে। ওঁদের মার্কেটে পৌঁছে দিয়ে প্রিয়ম গাড়ি নিয়ে চলে যায়। শপিং শেষে আবার ফোন দিতে বলে।
দুই-তিন ঘন্টা ধরে কেনাকাটা করেছে লিলি বেগম। হাবিব সাহেব টাকার ব্যাপারে কখনো কিছু বলেনা লিলি বেগম কে, কোন কৈফিয়ত চায়না। মোনা শুধু ভাবছে কত ডলার খরচ হবে?এত কেনাকাটা! শপিং শেষে মোনা যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। কেনাকাটার প্রতি কোন আগ্রহ নেই মোনার। মোনা সব সময় ভাবে দরকার মত জামাকাপড় হলেই হলো।
লিলি বেগম মোনা কে উদ্দেশ্য করে বলে,
-“মোনা তোর মোবাইল আছে?একটা মোবাইল কিনে দেই?”
-“না খালা মোবাইল আছে, শুধু সিম কার্ড নেই।”
-“আচ্ছা তাহলে সিম কার্ড কিনি শুধু।”
মোনা মাথা নাড়ায়। প্রিয়ম কে কয়েকবার ফোন দেয়, ফোন রিসিভ করছে না। বাধ্য হয়ে ট্যাক্সি করে বাসায় যায়। লিলি বেগম বাসায় এসে দেখে হাবিব সাহেব সোফায় গম্ভীর মুখে বসে আছে। হাবিব সাহেব তো এত তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরে না। লিলি বেগম মোনা আর নিশান কে রুমে চলে যেতে বলে। হাবিব সাহেব বলে,
-“কত ডলার খরচ করেছো?”
লিলি বেগম অবাক হয়ে বলে,
-“তুমি আমার কাছে কৈফিয়ত চাচ্ছো?”
-“টাকা কি পানিতে ভেসে আসছে যে তুমি টাকা যার তার জন্য খরচ করবে?”
লিলি বেগমের প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে। রাগ সংযত করে বলল,
-“তুমি যদি এটা নিয়ে চেঁচামেচি করো আমি সত্যি বলছি হাবিব আমি বাসা ছেড়ে চলে যাবো। তুমি প্রতিনিয়ত সবার কাছে আমায় ছোট করছো।”
-“আমার টাকা খরচ করেছো আর আমি চেঁচাবো না?”
লিলি বেগম হাবিব সাহেবের সামনে আর এক মুহূর্ত না দাঁড়িয়ে রুমে চলে যায়। ওখানে দাঁড়ালেই ঝগড়া হবে।
মোনা রুমে এসে মোবাইল টা অন করে। মাঝে মাঝে মোনার মনে হত ওর মোবাইলের প্রয়োজন নেই। মাসে একবারের জন্যও কেউ ফোন দেয়না। মোনা জ্যাকের দেওয়া কার্ডটা বের করে। তারপর জ্যাকের নম্বরে ডায়েল করে। দুই বার রিং হওয়ার পর ওপাশ থেকে কল রিসিভ হয়।জ্যাক বলল,
-“কে বলছেন?”
-“মোনালিসা।”
তারপর ওপাশ থেকে কোন কথায় শব্দ পাওয়া গেলো না। জ্যাক কি চিনতে পারছে না ওকে? মোনা আবার বলে,
-“ওইদিন রাতে আপনি আমায় হেল্প করেছিলেন।”
-“আপনার নাম শুনেই বুঝতে পেরেছি,আমার মেমোরি খুব শার্প। ভুলিনি আপনায়।কিন্তু আমি একটু ব্যস্ত আছি। ডোন্ট মাইন্ড মোনালিসা, পরে কথা বলি।”
(চলবে)
বিঃদ্রঃ নাইস, নেক্সট থেকে বিরত থাকুন