যে শহরে প্রেমে পড়া বারণ পর্ব -০১

‘বাহ!আমার রিলেশনের খবর ঠিকই ম্যামের কানে তুললি আর মাহিদ স্যার আর সন্ধির মধ্যে কী চলে সেটা বলবিনা নেহা ম্যামকে?’ তূর্ণার কথায় আঁতকে উঠে সন্ধি। এমনিতেই নেহা ম্যাম মাহিদ স্যারকে পছন্দ করে তার উপর তার সামনে এমন একটা কথা বলে ফেলল মেয়েটা! না জানি এখন কোন শাস্তি পেতে হবে সন্ধিকে। ম্যামের হাতে থাকা শক্ত বেতটা এই বুঝি তার হাতটাতে ক্ষত সৃষ্টি করতে উদ্যত হবে। নেহা ম্যামের রাগান্বিত চেহারাটা দেখে চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় করতে লাগলো সন্ধি, ‘মাহিদ স্যার, কেন আমাকে একা রেখে চলে গেলেন? আপনার পিচ্চিটা যে মহাসঙ্কটে পড়লো।’

১.
বসন্তের শুরু তখন। ক্লাস টেনের সেকশন সি এর ইংরেজি বিষয়ের শিক্ষক আব্দুল্লাহ হঠাৎ করেই চাকরী ছেড়ে দিলেন। শিক্ষার্থীদের মধ্যে তখন বেশ কিছু গুজবের আভাস পাওয়া গেল। স্যার নাকি কোন এক ছাত্রীর সাথে সম্পর্কে ছিলেন। এজন্যই তাকে স্কুল হতে বহিষ্কৃত করা হয়েছে। এ গুজব প্রায় সপ্তাহখানেকের মতো থাকলো। এরই মধ্যে নতুন ইংরেজির শিক্ষক জয়েন করলেন স্কুলে। নতুন স্যার যুবক, মাত্র অনার্স কমপ্লিট করেছেন। তিনি মূলত ছিলেন ভারপ্রাপ্ত শিক্ষক। প্রধান শিক্ষকের ভ্রাতৃষ্পুত্র হওয়ায় তিনি অভিজ্ঞতা লাভের উদ্দেশ্যে স্কুলে জয়েন করেন। প্রধান শিক্ষক সামাদ উদ্দিনও ভাবলেন ভাগ্নে তার ইংরেজি সাহিত্যে অনার্স করা, শিক্ষার্থীদের জন্য অবশ্যই ভালো এবং যোগ্য শিক্ষক সে। মুদ্রার একপিঠ দেখেই তিনি কাজটা করে ফেললেন অথচ মুদ্রার উল্টোপিঠ ভাবলেন না। মাহিদ মারাত্মক সুর্দশন এক যুবক। এরকম একজন শিক্ষককে কিনা দায়িত্ব দেওয়া হলো ক্লাস টেনের সি সেকশনের মেয়েদের ক্লাস নেওয়ার। সি সেকশনের মেয়েরা মারাত্মক পাঁজি, পিওর ব্যাকবেঞ্চার বলে যে একটা কথা আছে না? ঐরকম। মাহিদ প্রথম যেদিন ক্লাসে ঢুকলো, স্যারের রূপের আগুনেই অর্ধেক ছাত্রী খুন। তবে একজন ছিল যে বরাবরই ভাবলেশহীন। এই ক্ষণিকের পৃথিবীতে সবকিছুতেই বিষাদ খুঁজে বেড়ানো এক অতৃপ্ত মানবী সে। বলছিলাম সন্ধির কথা। সন্ধি একটিবারও তাকালো না মাহিদের মুখের দিকে। এমনকি ক্লাসেও মনোযোগ দিল না। মন পড়ে রইল কাঁচঢাকা জানালার বাইরের উন্মুক্ত পৃথিবীর দিকে।

‘এই যে জানালার পাশের মেয়েটা, জানালার ওপাশে কী শাহরুখ খানের সিনেমা চলছে?’ মাহিদের কথায় সারা ক্লাসে হাসির রোল পড়লো। বিভ্রান্ত-অপ্রস্তুত সন্ধি ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইল মাহিদের দিকে। ক্লাসের অধিকাংশ মেয়ের চোখজোড়া সন্ধির দিকে। মাহিদের ভ্রু কুঁচকানো ভঙ্গি আর ঠোঁটের কোণে প্রসারিত হাসিটা খেয়াল করে মাথা নিচু করে সন্ধি। মাহিদ পড়ানো কন্টিনিউ করে।

প্রথম সাক্ষাৎটা নিতান্তই পর্যায় সারণীর আঠারো নম্বর গ্রুপের মৌলগুলোর ন্যায় নিষ্ক্রিয় ছিল। সন্ধির বিন্দুমাত্র আগ্রহ হয়নি ঐ সুদর্শন যুবকটির প্রতি। তবে ঠিক কী কারণে যেন লোকটার উপর খানিকটা বিতৃষ্ণা জন্মালো। ক্লাসে সন্ধিকে খোটা দেওয়ার জন্য এ বিতৃষ্ণা? সন্ধি ঠিক করলো সে আর ইংরেজি ক্লাস করবে না, যেভাবে সম্ভব ক্লাসটা বাঙ্ক দিবে। আগে সপ্তাহে ইংরেজি ক্লাস হতো দুদিন, এখন পরপর চারদিন। চারদিন ক্লাস মিস দেওয়া চাট্টিখানি কথা নয়।

ছুটির পর আশেপাশে তূর্ণাকে খুঁজতে লাগলো সন্ধি। তূর্ণা এ সেকশনের মোটামুটি মেধাবী স্টুডেন্ট। তূর্ণার সাথে সন্ধির বন্ধুত্বটা বছর দুয়েকের। দুজনের বাসা কাছাকাছি হওয়ায় একসাথে যেত দুজন। সেখান থেকেই বন্ধুত্বের সূচনা। তূর্ণা আসছে না দেখে গুটি গুটি পায়ে সামনে এগোল সন্ধি। টিচার’স কমন রুমের বাইরে মেয়েদের জটলা লেগে আছে। বিরক্তিসূচক দৃষ্টিতে সেদিকে উঁকি দিতেই আবারো মাহিদের দৃষ্টির অভিমুখে পড়ল সে। সাথে সাথে দৃষ্টি নামিয়ে কপালে বিরক্তির ভাঁজ ফেলল। মাহিদ সেদিকে খেয়াল করলো বোধহয়। মেয়েটা যে তার প্রতি বিরক্ত তা সে প্রথম সাক্ষাতেই বুঝে গেছে। অবশ্য এই ক্ষমতাটা সচরাচর মেয়েদের থাকে। কেন যেন সৃষ্টিকর্তার অসীম মহিমায় মাহিদ এই ক্ষমতার অধিকারী হয়েছে।

তূর্ণা এ সেকশন থেকে বেরোলো মিনিট সাতেক পর। বের হওয়ামাত্র জ্বলজ্বল করতে থাকা মুখে উৎফুল্ল চিত্তে সন্ধিকে টেনে হাঁটতে শুরু করলো।

– ‘এত খুশি যে? তোকে তো এত খুশি দেখিনা সচরাচর।’

– ‘ইশস! কী যে বলিস। আমি তো সবসময়ই হাসিখুশি থাকি।’

– ‘ওহ। আমার চোখ বুঝি গেছে তাহলে।’

তূর্ণা ক্যাবলাকান্তের মতো তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। সন্ধি দিব্যি বুঝেছে কিছু একটা হয়েছে। তূর্ণার চোখেমুখে লজ্জারাঙা ভাব, চোখজোড়া অস্থির দেখাচ্ছে। এমন অস্বাভাবিক তাকে আগে কখনো মনে হয়নি কিন্তু এখন সন্ধি এ কথা জিজ্ঞাসা করলে তূর্ণা এড়িয়ে যেতে চাইবে। এর চেয়ে সন্ধির চুপ থাকাটাই ভালো। সে চুপ থাকলে তূর্ণা নিজে এসেই সবটা বলে দিবে।

– ‘এই শোন, একটা কাহিনী হয়েছে আজ।’

– ‘হুম বল।’

– ‘না থাক, বিশেষ কিছু না। বাদ দে।’

সন্ধি মনে মনে হাসছে। তূর্ণা তাকে মনের কথা বলতে চাইছে কিন্তু এটাও চাইছে যেন সন্ধি বিষয়টা জানার আগ্রহ দেখাক। সন্ধি তো তা করছে না, সেজন্য তূর্ণার বলতে সংকোচবোধ হচ্ছে।

– ‘আচ্ছা শোন। বলি কী হয়েছে।’

– ‘বলে ফেল।’

– ‘ঐ আ..আসলে…রা..রাফি আছে না?’

– ‘ঐ গুণ্ডামার্কা চেহারার ছেলেটা?’

– ‘আহা এমনে বলোস ক্যান! তোর দুলাভাই লাগে।’

– ‘আল্লাহর দোহাই লাগে বল এটা সত্যি না।’

– ‘সত্যি।’

সন্ধি এই মুহূর্তে গাধার সংজ্ঞাটা মনে করার চেষ্টা করলো। নাহ! এই মেয়েকে গাধা বললে গাধাকেও অপমান করা হবে। সন্ধিকে চুপ থাকতে দেখে তূর্ণা উশখুশ করতে লাগল।

– ‘কী রে? এমন শক লাগার মতো হইলি ক্যান? দেখ, রাফিরে তোরা যেরম ভাবোস, ও ঐরকম না।’

– ‘কাল অবধি তুমিও ওরে রাস্তার ছ্যাঁচড়াই ভাবতা। আজ যে কোন কালো যাদু করছে!’

– ‘ধূর! তোকে বলাই ভুল। আচ্ছা শোন, তোর বাংলা বইটা রয়ে গেছে আমার কাছে। এই নে।’

তূর্ণা বিরক্তি চোখে তাকিয়ে বইটা দিল কেবল। সন্ধি তাতে প্রতিক্রিয়া দেখালো না। সে তো এখনো বিশ্বাস করে উঠতে পারছে না তূর্ণার কথা। এর মধ্যে সন্ধির বাড়ি চলে এসেছে। দরজার কাছে যেতে যেতে তূর্ণার দিকে প্রশ্ন ছুঁড়লো সে, ‘এত বাজে রুচি কী করে হলো তোর?’ তূর্ণা কিছুটা ভ্রু কুঁচকে জবাব দিল, ‘ভালোবাসা রূপ মানেনা, মন বোঝে আর শুধু মনটাকেই খোঁজে।’ তূর্ণার কথাটা মাথায় ঘুরতে লাগল সন্ধির। অদ্ভুত একটা বাক্য! এতই সহজ নাকি ভালোবাসা? এত সস্তা এ অনুভূতি?

বিকেলবেলা সন্ধির মা সায়েরা জামান তার টেবিল গোছাতে নিয়েছেন। মেয়েটার অগোছালো স্বভাবে তিনি রীতিমতো বিরক্ত হয়ে পড়েছেন। এতবড় একটা মেয়ে, কোথায় ঘরদোর গোছগাছ করে রাখবে তা না! উল্টো ঘরটাকে আস্তাকুঁড়ে বানিয়ে রেখেছে। বই গোছাতে গিয়ে বাংলা বইটা হাত থেকে পড়ে গেল। তৎক্ষণাৎ বইয়ের ভাঁজ থেকে বেরিয়ে এলো একটা কুঁচকানো কাগজ। সায়েরা জামান সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে কাগজটা হাতে নিলেন। টেবিল থেকে চশমাটা নিয়ে চোখে দিলেন। অতঃপর কাগজের ভাঁজ খুলে পড়তে শুরু করলেন,

” প্রিয়তমা,

সে এক কাব্যিক শীতের সন্ধ্যেতে প্রথম তোমার দর্শনে মুগ্ধ হয়েছিলাম। বছর কতক একসাথে পড়েও কখনো এতটা টান অনুভূত হয়নি। ভেবেছিলাম মনের কথা মনেই রাখবো কিন্তু পাছে তোমাকে হারিয়ে ফেলি ভয়ে বলে দিতে বাধ্য হচ্ছি।

এই যে বালিকা, হবে কী আমার দিনশেষে মুখের হাসি?
এই যে বালিকা, রোজ নিয়ম করে বলবে ভালোবাসি?
তোমার স্পর্শে ভাঙবে নিদ্রা, কাটবে ঘোর
তিমির কালো কাটিয়ে হবে কি আমার ভোর?

খুব যতন করে লেখেছি। মনের যত জমানো অভিলাষ, সবটা ব্যক্ত করেছি। খোলা বইয়ের ন্যায় উপস্থাপন করলাম নিজেকে। চাইলেই পারো দুহাতে আকড়ে এই খোলা বইটাকে প্রিয় সাথী বানাতে।”

চিঠিটা পড়া শেষ করে কাগজটা আবারো ভাঁজ করলেন তিনি। সন্ধিকে ডাকলেন রুক্ষ স্বরে। সন্ধি স্কুল থেকে এসেই ঘুমিয়ে পড়েছে। এই অবেলায় মায়ের ডাকে লাফ দিয়ে উঠে মায়ের সামনে এলো। সন্ধি আসামাত্র সায়েরা জামান শক্ত হাতে মেয়ের গালে আঘাত করে বসলেন। ঘুমের ঘোর পুরোপুরি না কাটায় সন্ধি আকস্মিক আঘাতে খানিকটা দূরে সরে গেল। মায়ের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। পরমুহূর্তে মায়ের মুখ থেকে নিঃসৃত বাক্যটা শোনার জন্য কিছুতেই প্রস্তুত ছিল না সে।

চলবে…

যে শহরে প্রেমে পড়া বারণ (১)
~মিহি

[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here