#রংধনুর_মিল
#পর্বঃ০৯
#মাহিয়া_মুন
জীবন বড়ই বৈচিত্র্যময়। জীবন তরী কখন কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা পূর্বাবস্থায় কেউ বলতে পারে নাহ। আমাদের জীবনে যখন কোনো প্রিয় বস্তু বা প্রিয় মানুষ হারিয়ে যায় তখন আমরা খুব ভেঙে পরি। অনেকের সাথে এমন টাও হয় যে সৃষ্টিকর্তার উপর থেকে তাদের বিশ্বাস টাই উঠে যায় ক্ষণিক সময়ের জন্য। এটা কিন্তু মোটেই ঠিক নয়। আমাদের মনে রাখতে হবে, তিনিই উত্তম পরিকল্পনাকারী।
রাফিদের ড্রয়িং রুম থেকে একে একে বিদায় নিল নুজহাতের বাবা মা এবং গুরুজনরা। মূলত তারা এখানে এসেছে রাফি এবং রাফির বাবা মাকে সাবধান করতে। যাতে করে রাফি আর তার মেয়ের সাথে যোগাযোগ না রাখে। আর রাফির বাবা মাও যাতে ছেলেকে বুঝায়। এর সাথে আরও নানারকম অপমান তো আছেই। রাফি নিজেও তাঁদের সাথে তর্কে জড়িয়েছে। সে মানতেই পারছে নাহ যে তার বাসায় এসে তার বাবা মা এবং তাকেই অপমান করে গেছে। এটা তার ব্যক্তিত্বে লেগেছে। ড্রয়িং রুমের সব কিছু উলোপালোট করে দ্রুত রুমে ঢুকে রুমের দরজা আটকে দিল। একেতো নুজহাতকে হারাতে হবে সেই ভয়, তার উপর তার বাবা মায়ের এতো অপমান। কিছুতেই মানতে পারছে না। এর একটা বিহিত তো সে করেই ছাড়বে। নুজহাতকে হারানোর কষ্টের তুলনায় নিজের ব্যাক্তিত্বের অপমান যেন তার খুব লেগেছে।
রাফির বাবা সমানে রাফিকে নানারকম কথা শুনিয়ে যাচ্ছে।
“শীলা তোমার ছেলেকে সাবধান করে দেও। আজ তোমার ছেলের জন্য বাহিরের লোকজন বাসায় এসে অপমান করে যাচ্ছে আমাদের। কয়দিন পর হয়তো রাস্তায় বের হলেও লোকজনের থেকে অপমানিত হতে হবে। এই ছেলেকে নিয়ে আমি কত স্বপ্ন দেখি আর এই ছেলে কিনা মেয়ে নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে। তোমাকে আমি আগেই বলেছিলাম ছেলেকে এতো প্রশ্রয় দিও নাহ। তোমার প্রশ্রয়ে তোমার ছেলে এমন হয়েছে। লজ্জা হওয়া উচিত এই ছেলের। বেকার হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তোমার ছেলে আদও কোনো চাকরীর ইন্টাভিউ দেয়, আমার তো মনে হয় নাহ। আমি তো ওই মেয়ের বাবা মায়ের কোনো দোষ দেখছিনা। কোনো বাবা মাই চাইবে নাহ তাদের মেয়েকে কোনো বেকার ছেলের হতে তুলে দিতে। তোমার ছেলের যদি দম থেকে থাকে তাহলে চাকরী নিয়ে দেখাক। এর আগে যাতে আমার চোখের সামনে না আসে। আজ থেকে একটা টাকাও সে আমার থেকে পাবে নাহ্।”
এই বলে রাফির বাবা ফুঁসতে ফুঁসতে নিজের রুমে চলে গেলেন। রাফি তার বাবার সব কথাই নিজের রুম থেকে শুনতে পেয়েছে। রাগ বেড়ে যেন আকাশে উঠেছে।
রাফির মা মিসেস শীলা হতাশ মুখে বাবা এবং ছেলের রুমের দিকে তাকিয়ে রইলেন। দোষ কি একা তার ছেলের নাকি। দোষ তো ওই মেয়েরও কম নাহ। সে যেহেতু জানে তার পরিবার মানবে নাহ, তবুও কেন তার ছেলের প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেছে। পুরুষ মানুষ তো চাইবেই যে তার ভালো লাগার রমনীর সাথে সে যেন প্রণয় গঠিত সম্পর্কে জড়াতে পারে। তাই বলে কি মেয়েটাও ধেই ধেই করে রাজি হয়ে যাবে। সম্পর্কে জড়ানোর আগে নিজের পরিবারের কথা মাথায় থাকে নাহ, সম্পর্কে জড়ানোর পর সব মাথায় আসে।
_______________________________________
ব্যালকনিতে হাঁটু মুড়ে বসে আছে নুজহাত। চোখে মুখের অবস্থা যাচ্ছে তাই। রাফির সাথে যোগাযোগ বিহীন কেটে গেছে সাত সাতটি দিন। এই সাত দিনের এক একটা মিনিট যেন এক একটা বছরের ন্যায় মনে হয়েছে তার কাছে। চোখের কোণে জমে থাকা পানিগুলো ও এখন আর পড়ে নাহ। চোখের পানি চোখেই শুকিয়ে যায়। নুজহাত ভেবে পায় না, সেতো রাফিকে ছাড়া এক দন্ড নিঃশ্বাসও ঠিক মত ফেলতে পারছে না। তাহলে না জানি রাফির কি অবস্থা। তাকে ছাড়া নিশ্চয়ই পাগল প্রায়। একেতো ভালোবাসা হারিয়ে যাওয়ার ভয় তার উপর উঠতে বসতে প্রতিনিয়ত বাবা মায়ের অপমান, অবমাননা, তাচ্ছিল্য করে কথা বলা, এগুলা যেন এই সাতদিন রুটিনে পরিণত হয়ে গেছে। তাদের প্রতিটা কথায় যেন তাকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়, সে খুব বড় অন্যায় করে ফেলেছে। যেই বাবা তাকে ছাড়া খাবার খেত নাহ সেই বাবার এখন সে খেল কি গেলো তাতেও যেন কিছু যায় আসে না। কাউকে ভালোবাসা কি এতো বড়ো অন্যায়। বাবা মায়ের এই রূপ যেন ভিতর থেকে আরও ভেঙে দিচ্ছে তাকে। দিন দিন এক প্রকার ট্রমাতে চলে যাচ্ছে। চারদিকে তাকালে এখন মনে হয় যেন রাফি তার আশেপাশেই আছে। এইতো হাত ধরেছে, এইতো দুজন হেসে হেসে কথা বলছে, রাফির কথাগুলো শুনে সে লজ্জায় নত হয়ে যাচ্ছে। রাফিকে ধরতে গেলেই যেন রাফি হারিয়ে যাচ্ছে। নাহ্ নাহ্ সে রাফিকে ছাড়া থাকতে পারবে নাহ, রাফিকে কিছুতেই হারাতে দিবে নাহ্।
এরকম ভাবনা মাথায় আসতেই বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। দ্রুত চোখে জমে থাকা পানি মুছে মুচকি হাসলো। আনমনেই বলে উঠলো,
“আমি আসছি রাফি। তুমি আমি আবার এক হয়ে যাবো। আমরা দূরে কোথাও চলে যাবো। যেখানে আর কারো অপমান, অবমাননা শুনতে হবে নাহ। কাওকে চাই নাহ আর।”
এই বলে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। সূর্যি মামা এখনও হয়তো ঘুমিয়ে আছে। আসলে সূর্য্য তার সঠিক সময়েই ধরণীতে নিজের আলো ছড়ায়। নুজহাত তো এই সাতদিন রাত ঘুমাতেই পারে নি। কিছুক্ষন আগেই ভোরের আলো ফুটেছে। খুব ভোর হওয়ায় বাবা মা এখনও ঘুম থেকে উঠে নি। এইটাই বেশ ভালো সুযোগ। বেশ সাবধানে বাড়ির মেইন দরজা খুলে আস্তে আস্তে বেরিয়ে গেল বাসা থেকে।
_________________________________
সকালের সূর্য্য নিজের কিরণ ছড়িয়ে দিয়েছে ধরণীতে। সেই সাথে জেগে উঠেছে ঘুমিয়ে থাকা মানুষগুলোও।
মিসেস রিদিমা সকালের নাস্তা তৈরি করে খাবার টেবিলে রেখে নিজের স্বামীকে ডাকার উদ্দেশ্যে রুমের দিকে যেতেই হঠাৎ নজরে আসলো বাড়ির মেইন দরজা। হাঁটা থামিয়ে ভ্রু কুঁচকে দরজার দিকে তাকালো। দরজা খোলা দেখে যার পর নাই অবাক হয়ে গেল। তিনি কি রাতে দরজা না আটকেই ঘুমিয়ে পরলেন নাকি। মনে করে দেখলো যে রাতে দরজা আটকেই ঘুমিয়েছে। কিছু একটা ভাবতেই দ্রুত নুজহাতের রুমে গেলো। রুমের আনাচে কানাচে কোথাও নুজহাতকে দেখতে পেল নাহ। যা বুঝার সহজেই বুঝে নিল। হন্তদন্ত হয়ে নিজের রুমে গিয়ে স্বামীকে ডেকে তুললো।
“কি হয়েছে রিদিমা, এতো সকাল সকাল এভাবে চিল্লাচ্ছো কেন?”
“তুমি মরার মত ঘুমাও, আর এদিক দিয়ে তোমার মেয়ে ওই কু*লা*ঙ্গা*র রাফির সাথে পালিয়ে যাক।”
“মানে।”
“আরেহ আমি টেবিলে নাস্তা দিতে গিয়ে দেখি বাড়ির মেইন দরজা খোলা। সন্দেহবশত নুজুর রুমে গিয়ে দেখি সে কোথাও নেই। বুঝতে পারছো কিছু।”
মিস্টার হাসান বড় বড় চোখ করে নিজের স্ত্রীর পানে তাকিয়ে রইলেন। ঘুম একেবারেই হাওয়া। দ্রুত বিছানা ছেড়ে নুজহাতের রুমে গেল। আসলেই সত্যিই, মেয়ে তার কোথাও নেই। পুরো বাসা ভালো করে দেখে নিল। এবার পুরোপুরি ভাবেই নিশ্চিত যে মেয়ে তার পালিয়েছে। ভয় এবং রাগ দুটোই সপ্তম আকাশে উঠেছে।
_______________________________
মাথা নিচু করে খেয়ে যাচ্ছে রাফি। সামনের টেবিলেই তার বাবা এবং মাও বসে আছে। মা তার সাথে সহজ ব্যবহার করলেও তার বাবা ভুলেও তার সাথে কথা বলছে নাহ। বাবা যে খুব রেগে আছে তা ভালোই বুঝতে পারছে। ভেবে নিল যে আস্তে আস্তে রাগ পানি হয়ে যাবে।
খাওয়াদাওয়ার মাঝেই বাড়ির কলিং বেল বেজে উঠলো। এইসময় আবার কে আসলো। ভাবনা মাথায় আসতেই নিজেই টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। ড্রয়িং রুম পেরিয়ে গিয়ে দরজা খুলতেই বেশ অবাক হলো। এরা আবার এখানে কেন। দরজার বাহিরেই নুজহাতের বাবা মা এবং তাকিয়া দাড়িয়ে আছে। নুজহাতের বাবা মায়ের মুখ দেখে মনে হচ্ছে তারা অত্যধিক রেগে আছে। আর তাকিয়া ভীতু মুখে তাদেরকে পরখ করে যাচ্ছে। এদের দেখতেই রাফির রাগ পূনরায় মাথায় চেপে বসলো।
কঠিন মুখে বলে উঠলো,
“কি চাই আবার আপনাদের?”
মিস্টার হাসান রাগি স্বরে বলে উঠলো,
“কি চাই তাইনা।”
এই বলেই রাফির কলার চেপে ধরে পূনরায় বলে উঠলো,
“তোর সাহস কি করে হয় আমার মেয়েকে এখানে নিয়ে আসার। কোথায় আমার মেয়ে হ্যা।”
তাকিয়া দ্রুত রাফির কলার থেকে মিস্টার হাসানের হাত ছাড়িয়ে বলে উঠলো,
“আংকেল ছাড়ুন, কি করছেন। মাথা ঠান্ডা করুন।”
এই বলে মিস্টার হাসান কে কিছুটা দূরত্বে নিয়ে দাড় করালো। পুনরায় রাফির সামনে এসে বলে উঠলো,
“ভাইয়া এবার যা করলেন তা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেল নাহ।”
রাফি বিরক্ত কণ্ঠে বলে উঠলো,
“এসব কি তাকিয়া। বলা নেই কওয়া নেই একেতো এই লোকটা আমার কলার ধরেছে। তার উপর তুমি আবার উল্টা পাল্টা এসব কি বলছো। কি করেছি আমি।”
“নুজহাত কোথায়। ওতো আপনার সাথেই পালিয়ে এসেছে তাইনা।”
“কি…. ও বাড়িতে নেই। আর আমার সাথে পালাবে কিভাবে, আমিতো আজ সাতদিন বাড়ির বাহিরেই বের হতে পারছি নাহ। মাথা ঠিক আছে তোমাদের।”
রাফির কথা শুনতেই তাকিয়ার কপালে ভাঁজ পড়ল। রাফিকে দেখে বুঝাই যাচ্ছে যে সে মিথ্যে বলছে নাহ।
মিস্টার হাসান পিছন থেকে চিল্লিয়ে বলে উঠলেন,
“এই ছেলে একদম মিথ্যে বলবে নাহ। কোথায় লুকিয়ে রেখেছো আমার মেয়েকে।”
*
*
*
#চলবে