রংধনুর মিল পর্ব -১১

#রংধনুর_মিল
#পর্বঃ১১
#মাহিয়া_মুন

পরিবেশ থমথমে। নিস্তব্ধতার চাদরে মুড়ে আছে এক একজন। অবাকের রেশ কেটে উঠতে পারছে না কেও। অভিভাবকগণ এর মুখে অবশ্য দেখা যাচ্ছে মৃদু হাসি। নুজহাত পলকহীন চোখে তাকিয়ে আছে রাফির পানে। রাফির বলা কথাটি মস্তিষ্ক মানতে নারাজ। এটা হওয়ার নয়, তবুও কেন হচ্ছে। রাফি এরকম করা তো দূর, এরকম কথা বলছেই বা কোন সাহসে। সে জানে নাহ, নুজহাত তাকে কতটা ভালোবাসে। আর সেও তো নুজহাতকে কতটা ভালোবাসে। তাহলে এখন এই কথা কেন বলছে।
নুজহাত হন্তদন্ত পায়ে রাফির সামনে এসে দাঁড়ালো। মৃদু হেসে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলে উঠলো,
“এসব কি বলছো রাফি। এখন নিশ্চয়ই মজা করার সময় নাহ।”
রাফি বিরক্ত কণ্ঠে বলে উঠলো,
“আমি মজা করছিও নাহ। আমি সত্যিই বলছি। তোমার সাথে আমি আর সম্পর্ক রাখতে চাই নাহ।”
“কেনো, তুমি তুমি দেখেছ না যে আমি তোমাকে পাওয়ার জন্য কত কি করেছি। তাহলে এই কথা কেন বলছো?”
“হ্যা দেখেছি কি করেছো তুমি। বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়ার নাটক করে আমাকে সকলের সামনে অপমান করেছো। থানা পুলিশ পর্যন্ত ঘটনা নিয়ে এসেছো। তোমার পরিবারের লোকজন পরপর আমাকে, আমার পরিবারকে অপমান করে এসেছে।”
রাফির কথায় নুজহাত যেন গতি হারালো। মুখের কথা ফুরিয়ে গেল নিমিষেই। মস্তিষ্ক মানতে নারাজ যে রাফিই এসব বলছে। এটা কি সত্যিই তার রাফি।
তবুও নিজেকে ধাতস্থ করে বলে উঠলো,
“এখানে আমার পরিবার সবকিছু আমার অজান্তে করেছে। এগুলোর সাথে আমার কি সংযোগ। আমি তোমায় ভালোবাসি আমার পরিবার তো না।”
“তুমি এই পরিবারেরই মেয়ে। তোমার পরিবার যেহেতু তোমায় নিয়ে এতটাই ভাবুক, তাহলে মেয়েকে এতো স্বাধীনতা দিল কেন। মেয়ে আজ চার বছর প্রেম করছে আর তারা টেরও পায়নি। আশ্চর্য্য। যাই হোক আমি এতো কথা বলতে চাই নাহ। আমি তোমার সাথে আর কোনরকম যোগাযোগ রাখবো না। আর এটাই শেষ কথা আমাদের।”
নুজহাত এর রাগ যেন এবার সপ্তম আকাশে। এই ছেলে এসব কি করে বলছে। কথাবার্তা এমন ভাবে বলছে যেন সেই সেধে প্রেম করতে গিয়েছে ওর সাথে। এই ছেলে কি আসলেই রাফি। রাগে হিতাহিত জ্ঞান শূণ্য হয়ে রাফির কলার চেপে ধরলো।
“এই তুমি কি সত্যিই আমার রাফি। আমার রাফি তো এমন থাকার কথা নয়। আমার রাফি এসব বলতেই পারে নাহ। এই এই এই, চার বছর আগে কে সেধে প্রেম করতে এসেছে বলো। ”
রাফি নিজের কলার থেকে নুজহাতের হাত ঝাড়া দিয়ে ছাড়িয়ে বলে উঠলো,
“হ্যা মানলাম আমিই তোমায় প্রথমে প্রপোজ করেছি। তুমি তো জানতে তোমার পরিবার এমন। তবুও কেন নাচতে নাচতে আমার সাথে সম্পর্কে জড়ালে। নাকি আমার মত সুন্দর ছেলে দেখে আর নিজেকে সামলাতে পারো নি।”
রাফির কথা শেষ হতেই নুজহাত দুই পা পিছিয়ে গেল। মস্তিষ্ক আর নিতে পারছে না এসব কথা। কাল রাত থেকে এক ফোঁটা পানিও খায় নি এতক্ষন অবধি। খালি পেটে শরীর যেন আর সায় দিচ্ছে নাহ। চারদিক থেকে যেন অন্ধকার তার দিকে ধেয়ে আসছে। এক পর্যায়ে অন্ধকারের মাঝেই তলিয়ে গেল।
সবাই চমকে নুজহাতের দিকে তাকালো। যে এই মুহুর্তে মেঝেতে পড়ে আছে। মিস্টার হাসান দ্রুত মেয়ের শিয়রে গিয়ে বসে পড়লেন। নুজহাতের গালে হাত দিয়ে উৎকণ্ঠে বলে উঠলেন,
“নুজু মা আমার চোখ খোল। নুজু।”
নুজহাতের মা মেয়ের মাথায় হাত রেখে কেঁদে উঠলেন।
মেয়েটার কি হয়ে গেল।
তাকিয়া দ্রুত হসপিটালে ফোন করে অ্যাম্বুলেন্স পাঠাতে বললো। তারা জানিয়েছে দশ মিনিট এর মাঝেই তারা আসছে। তাকিয়া দ্রুত মিস্টার হাসানকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো,
“আংকেল ওকে নিয়ে বের হোন। অ্যাম্বুলেন্স আসছে।”
মিস্টার হাসান দ্রুত মেয়েকে কোলে নিয়ে বেড়িয়ে পড়লেন। তাকিয়া যেতে গিয়েও থেমে গেলো। রাফির দিকে ক্রুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে উঠলো,
“পস্তাবে রাফি তুমি। নুজহাত কে সারিয়েও তুলবো। তোমার থেকে ভালো ছেলেও ওর জীবনে আসবে। যে তোমার মত মাঝ রাস্তায় বিপদগামী হয়ে হাত ছেড়ে দিবে নাহ্। নুজহাত তো ভালো থাকবে, তবে তুমি কতদিন ভালো থাকো সেটাও দেখবো।”
এই বলে তাকিয়া নিজেও প্রস্থান করলো। রাফি রেগে নিজেও সেখান থেকে চলে গেল। রাফির বাবা ছেলের যাওয়ার দিকে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইলেন। তার ছেলে যে মন গহীনে রাগ এবং অভিমান পুষে রেখে নুজহাত কে এসব বলেছে তা ঠিকই বুঝতে পেরেছে। তবে এই রাগ এবং অভিমান দুটোই ভুল সময়ে প্রকাশ করে ফেলেছে।
“**রাগ মানুষকে ধ্বংস করে। রাগের বশবর্তী হয়ে জীবনে অনেক কিছুই হারাতে হয়। তাই রাগকে যেভাবেই হোক নিয়ন্ত্রণে রাখা জরুরী।”(যদিও এই কথাটা আমি কোনো ভাবেই নিজেকে বুঝাতে পারি নাহ।😒😒)
*
*
ডক্টরের সামনে চিন্তিত মুখে বসে আছে তাকিয়া এবং মিস্টার হাসান। নুজহাতের মা অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাকে বাসায় রেখে এসেছে। নুজহাত এর এখনো জ্ঞান ফিরেনি। তবে তার আগে ডক্টর তাদের কেবিনে ডেকে পাঠিয়েছে।
ডক্টর নিজের মুখের মাস্ক খুলে মিস্টার হাসানের দিকে তাকালেন। বেশ নরম স্বরে বলে উঠলেন,
“মিস্টার হাসান। আমি এখন আপনাদের যেই কথাগুলো বলবো মন দিয়ে শুনবেন। আপনার মেয়ে জ্ঞান হারিয়েছে মূলত সারাদিন না খেয়ে থাকা এবং মাথায় অতিরিক্ত চাপ পড়ায়। তবে সেটা বড় কথা নয়। আপনার মেয়ে মেন্টালি ডিপ্রেসড। সে এখন একটা ট্রমার মধ্যে আছে। এক্ষেত্রে আপনার মেয়ে যখন তখন নিজের অথবা অন্যের ক্ষতি করে ফেলতে পারে। ডিপ্রেসন এর সময়কাল দীর্ঘ হলেও ট্রমাতে যাওয়ার সময়কাল খুব একটা বেশি নাহ। তাই আমি মনে করছি যে ইনশা আল্লাহ সেরেও উঠবে খুব দ্রুত। তবে যতদিন সুস্থ্য না হচ্ছে ততদিন তার প্রপার ট্রিটমেন্ট করা লাগবে। আর আমাদের এখানে এরকম চিকিৎসা খুব একটা ভালো হয় নাহ। আমি ঢাকার একটা হাসপাতালের নাম লিখে দিচ্ছি। সেখানে নিয়ে আপনার মেয়েকে ভর্তি করান। সর্বোচ্চ দু থেকে তিন মাসের মধ্যেই ইনশা আল্লাহ সুস্থ্য হয়ে যাবে।”
মিস্টার হাসান এবং তাকিয়া চমকে ডক্টরের পানে তাকিয়ে রইলো। ডক্টরের বলা কথাগুলো দু জনের একজনও মানতে পারছে না। মিস্টার হাসান চেয়ার ছেড়ে দাড়িয়ে আস্তে আস্তে কেবিন ছেড়ে বেরিয়ে পড়লেন। তাকিয়া উঠতে যেতেই ডক্টর পুনরায় বলে উঠলেন,
“আর হ্যা মিস/ মিসেস, ওনাদের মেয়ের সাথে ভালো ব্যবহার করতে বলবেন। মেয়েকে মেন্টালি সাপোর্ট করতে বলবেন। আর এই নিন প্রেসক্রিপশন। মেয়েকে যদি উনি ঢাকা নিতে চান তাহলে আপনাকে জানাতে বলবেন।”
নুজহাত সম্মতি জানিয়ে মলিন মুখে ধন্যবাদ জানিয়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে পড়লো।
*
*
“আমি টিকেট কেটে ফেলবো। এতো কিছু হয়ে যাওয়ায় পরও আমি এখানে থাকতে পারি নাহ।”
আবিদের বলা কথায় তাকিয়া ফোনে আবিদের মুখের দিকে তাকালো। ছেলেটা কাল নিজেই ভিডিও কল এ সবটা দেখেছে। এক রাতেই চেহারার কি অবস্হা করে ফেলেছে। তাকিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে উঠলো,
“তোর ফাইনাল এক্সাম কবে ওখানে। আর প্রস্তুতিই বা কেমন নিলি। এই পরীক্ষার মাধ্যমেই কিন্তু তুই চাকরী করতে পারবি।”
“তুই কিসের মধ্যে কি জিজ্ঞেস করছিস।”
“দরকার আছে বলেই জিজ্ঞেস করেছি বল।”
“এক্সাম আগামী দুই মাস পর। আর প্রস্তুতিও আলহামদুলিল্লাহ।”
“যাক ভালো। এবার আমি কিছু কথা বলছি মন দিয়ে শোন। ধর তুই এখন দেশে চলে আসলি। এমনও হতে পারে নুজহাত তোকে মেনেও নিল। তোর বাবা মাত এমনিতেই রাজি। কিন্তু নুজহাত এর বাবা মা, তারা কি একটা বেকার ছেলের সাথে মেয়েকে বিয়ে দিবে। আন্টি আংকেল কে তুই ভালো করেই চিনিস। তাই আমি বলবো এই মুহুর্তে তুই দেশে আসিস নাহ। এক্সাম টা দিয়ে এক সাথেই দেশে চলে আয়। চাকরীও ইনশা আল্লাহ হবে তারপর নুজহাত কেও পাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। এখন তুই ভাব তুই কি করবি।”
আবিদ কিছুক্ষন চুপ করে তাকিয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। তার মাও ঠিক এই কথাটাই বলেছে তাকে। তাকিয়া মেয়েটা সত্যিই খুব বুঝদার।
তাকিয়ার দিকে তাকিয়ে ইশারায় সম্মতি জানিয়ে কল কেটে দিল। তাকিয়া হাসি মুখে নুজহাতের দিকে তাকালো। নুজহাত এখনও ঘুমিয়ে আছে। কিছুক্ষন পূর্বেই জ্ঞান ফিরেছিল। আগামী পরশু তাকে ঢাকা হসপিটাল নিয়ে যাওয়া হবে। নুজহাত এর মা প্রথমে রাজি হতে না চাইলেও পরে রাজি হয়ে গেলেন। তারাও সাথে যাচ্ছে। তাকিয়াও যাবে তবে সে গিয়ে পূনরায় চলে আসবে।
*
*
*
#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here