#রংধনুর_রঙ_কালো
২০.
” একটু একটু করে মেয়েটা আমার কাছ থেকে সবকিছু ছিনিয়ে নিচ্ছিল। ইলহান বসে থাকতো আমার পাশে কিন্তু ওর মন পড়ে থাকতো বেংলাডেশে। অরিনের কাছে। সারাক্ষণ শুধু মোবাইল, ম্যাসেজ আর অরিন। আমাকে পাশে রেখেও ও মগ্ন হয়ে অরিনের সাথে ম্যাসেজে কথা করতো। এমনকি ওই সময় আমি কথা বললেও বিরক্ত হতো। সম্পূর্ণ একা হয়ে যাচ্ছিলাম আমি। ইলহান যেনো আমার কাছে থেকেও নেই। শুধু ওর শরীরটা ছিল। কিন্তু ও ছিল না। আমি হতাশায় জর্জরিত হয়ে যাই। কাজেও মনোযোগ দিতে পারছিলাম না৷ আমার সাজানো বিশাল দুনিয়ার আভিজাত্যপূর্ণ জীবনে ভাঁটা পড়লো অরিন নামের একটা কুচকুচে কালো বেংলাডেশী মেয়ের জন্য। সে আমার জীবনটা ধ্বংস করে দিচ্ছিল। কি অদ্ভুত তাই না? কোথায় অরিন আর কোথায় আমি। আমাদের মধ্যে তো আকাশ-পাতাল পার্থক্য। তবুও ওই মেয়েটা কত সহজে আমার স্বপ্নের ভুবন তছনছ করে দিল।আমি অরিনকে পৃথিবীতে বাঁচিয়ে রাখার কোনো কারণ খুঁজে পাইনি। শেষমেষ সিদ্ধান্ত নিলাম ওকে খুন করবো। তাই টুয়ার্ডকে বেংলাডেশে পাঁঠিয়ে ছিলাম।”
বাকি কথা অন্বয় নিজেই বললো,” কিন্তু আপনি এই কাজটা খুব কৌশলে করেছেন৷ এমনভাবে সবকিছু পরিকল্পনা করেছেন যাতে করে সন্দেহের তীর ইলহান মাহদীর দিকে যায়। আর মিসেস অরিনের সাথে মি.ইলহানের সম্পর্ক খারাপ হয়। আমি কি ঠিক বলেছি?”
সোফিয়া হতবিহ্বল দৃষ্টিতে তাকালো। এই ব্যারিস্টার বেটা এটাও বুঝে গেছে? অন্বয় রসিকতাপূর্ণ কণ্ঠে বললো,” আপনি নিঃসন্দেহে সফল হয়েছে মিস সোফিয়া। আই এপ্রিশিয়েট ইউর এফোর্ড। কিন্তু একটা বিষয় বুঝলাম না। ইলহান মাহদীর সাথে মিসেস অরিনের তো সেপারেশন হয়েই গেছে। এমনকি ইলহান মাহদী আপনাকে বিয়েও করতে যাচ্ছেন। আপনাদের এনগেজমেন্ট ডান! তাহলে গতকাল আপনি কেনো আবারও মিসেস অরিনকে আক্রমণ করলেন?”
” ইলহান আমাকে বিয়ে করছে আমি প্রেগনেন্ট বলে। দায়বদ্ধতা থেকে। ভালোবেসে নয়। ও এখনো অরিন বলতে পাগল৷ দেখলেন না সেদিন এংগেজমেন্ট পার্টিতে কি করলো? অরিন যখন আমার গাঁয়ে হাত তুলছিল তখন ওর কিচ্ছু যায়-আসছিল না। কিন্তু যেই আপনি অরিনকে স্পর্শ করলেন ওমনি সে হিংস্র বাঘের মতো তেতে উঠলো। এতোটাই সেন্সিটিভ ও অরিনের বিষয়ে।”
অন্বয় ঠোঁট ফুলিয়ে দীর্ঘ করে উচ্চারণ করলো,” ও! বুঝলাম। তাহলে এনগেজমেন্ট পার্টির এক্সিডেন্টের কারণে আপনার মনে যে ক্ষোভ তৈরী হয়েছিল সেইটারই বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে গতকালকের দূর্ঘটনা।”
সোফিয়া নিশ্চুপ। অন্বয় থুতনিতে হাত রেখে বিচক্ষণের মতো বললো,
” তাহলে তো আমার এখন অন্য বিষয়েও সন্দেহ হচ্ছে মিস সোফিয়া।”
” কিরকম?”
” মিসেস অরিন অস্ট্রেলিয়া আসার পর ইলহান মাহদীর সাথে আপনার ঝামেলা শুরু হয়। এম আই রাইট?”
” জ্বী। এটাই তো স্বাভাবিক। ”
” তখন মিসেস অরিনও সন্দেহ করছিলেন ইলহান মাহদীকে। আর ইলহান মাহদী ধরা পড়ার ভয়ে আপনার সাথে ব্রেকাপের সিদ্ধান্ত নিলেন। সেজন্য আপনিও প্রেগ্ন্যাসির ফলস নিউজ বানিয়ে ইলহান মাহদীকে বিয়ের জন্য বাধ্য করে ফেললেন।”
” কি যা-তা বলছেন? এতো সেন্সিটিভ একটা বিষয় নিয়ে আমি কেনো মিথ্যে বলবো?”
” তার মানে সত্যিই আপনি প্রেগন্যান্ট? ”
” মিথ্যে কেনো হবে?”
” ঠিকাছে। আপনাকে কষ্ট করে এখানে আরও একদিন বন্দ্বী থাকতে হবে সোফিয়া। কারণ কনফার্ম হওয়ার জন্য আমি মেডিকেল টেস্ট করাবো। আসলে সবকিছুর একটা বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ রাখা দরকার।”
সোফিয়া কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,” আপনার ধারণা সঠিক। আমি প্রেগন্যান্ট না।”
অন্বয়ের মুখে বিজয়ের হাসি। সোফিয়া কয়েক ফোঁটা অশ্রু চোখ থেকে ঝরিয়ে বললো,” এই নাটক না করলে আমি সত্যি সত্যি ইলহানকে হারিয়ে ফেলতাম। ওকে অরিনের থেকে আলাদা করার জন্য আমি এসব করেছি। কারণ আমি জানি, বাচ্চার কথা শুনলে ইলহান কখনও আমাকে ছাড়তে পারবে না। আর অরিনও কখনও ইলহানের সাথে থাকবে না। আমি এসব করেছি শুধুই নিজের মানুষটিকে ফিরে পাওয়ার জন্য। প্লিজ ব্যারিস্টার, এইসব কথা ইলহান যেনো কখনও জানতে না পারে। সে আমাকে ঘৃণা করতে শুরু করবে।”
” এই সিদ্ধান্ত আমি না, মিসেস অরিন নিবেন।”
সোফিয়ার চেহারা শুকনো হয়ে গেল। কণ্ঠ থেমে আসলো।
” অরিন মানে? ”
অন্বয় এবার অরিনকে ডাকলো। অন্য রুম থেকে অরিন গুঁটি গুঁটি পায়ে বেরিয়ে এলো। তার চেহারা নিরস ছিল। দৃষ্টি নত ছিল। রুমে ঢুকেই চট করে সোফিয়ার দিকে তাকালো সে। সোফিয়ার চোখমুখ তীক্ষ্ণ হয়ে এলো। অন্বয় বললো,” আপনিই বলুন মিসেস অরিন। আপনাকে হত্যার চেষ্টাকারীকে কেমন শাস্তি দিতে চান?”
অরিন সোফিয়ার থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নির্বিকার কণ্ঠে বললো,” আমার কাউকে শাস্তি দেওয়ার ইচ্ছে নেই। ছেঁড়ে দিন তাকে।”
” হোয়াট?” অন্বয়ের কণ্ঠে বিস্ময়। সোফিয়া দাঁত কিড়মিড়িয়ে বললো,” আমাকে দয়া দেখানো হচ্ছে? তোমার মতো মেয়ের দয়া নিবো আমি? এর চেয়ে বিষ খাওয়া ভালো। আই হেইট ইউ অরিন। তুমি কল্পনাও করতে পারবে না কত ভয়ংকর ঘৃণা করি আমি তোমাকে।”
অরিন মুচকি হাসলো। দুই হাত বুকের কাছে ভাজ করে বললো,
” এতে আমার কিছুই যায়-আসে না। কেউ আমার ক্ষতি করতে চাইলে আমাকেও তার ক্ষতি করে প্রতিশোধ নিতে হবে এমন তত্ত্বে আমি বিশ্বাসী না। তুমি যা করেছো তা নিকৃষ্ট মানসিকতার পরিচয়। আমিও তোমার মতো একই কাজ করে নিজেকে তোমার দলের অন্তর্ভুক্ত করতে চাই না। বরং আমি তোমাকে আরেকটা সুযোগ দিচ্ছি। তুমি নিশ্চিন্তে বাড়ি ফিরে যাও। ইলহান কখনও এসব বিষয়ে কিচ্ছু জানবে না। কিন্তু যদি কখনও তুমি দ্বিতীয়বার আমার ক্ষতি করার চেষ্টা করো আমি কিন্তু তখন আর চুপ থাকবো না।”
অন্বয় বললো,” আমি থাকতে শুধু সোফিয়া কেনো, আল্লাহ ছাড়া এ পৃথিবীর কারো ক্ষমতা নেই আপনার ক্ষতি করে।”
অরিন হেসে বললো,” শুনে খুশি হলাম অন্বয়সাহেব।”
সোফিয়া দু’জনের দিকে তাকিয়ে থেকে বললো,” তোমরা কি একসাথে লিভিং শুরু করেছো? ইলহানের সন্দেহ তাহলে সঠিক ছিল। ছি অরিন, তোমার পবিত্রতা নিয়ে ইলহানের কত গর্ব। শেষমেষ কি-না তুমিও পঁচা শামুকে পা কাটলে?”
” আমার পা যেখানেই কাটুক, দ্যাটস নান অফ ইউর বিজনেস। তুমি বরং নিজের চড়কায় তেল দাও। তোমার চড়কা হলো ইলহান।”
” আমি যতকিছুই করি, কোনো লাভ নেই। তুমি তো ওকে বশ করে রেখেছো। কালো জাদু করেছো তাই না?”
” অস্ট্রেলিয়ার মতো একটা দেশের বেস্ট ফ্যাশন আইকন মডেল সোফিয়া কালো জাদুর মতো লেইম জিনিসেও এতো বিশ্বাস করে? ইন্টারেস্টিং তো।”
” তোমার মতো শয়তান মেয়ে এ ছাড়া আর কি পারবে? তুমি তো শয়তানের পূজারী। এজন্যই তোমার গাঁয়ের রঙ এতো কালো, অন্ধকার। কারণ তুমি একটা ডাইনি।”
অন্বয় চেতে উঠলো,” মিস সোফিয়া, বেশি হয়ে যাচ্ছে এবার।”
অরিন নম্র কণ্ঠে বললো,” থাক, ওকে বলতে দিন মি. অন্বয়। যার জ্ঞান যেমন, তার চিন্তা-ধারাও তেমনই হবে। এর থেকেই প্রমাণিত হয়, শুধু বাহ্যিক সৌন্দর্য্য দিয়ে মানুষের মনের পরিধি মাপা বোকামী।”
” এই মেয়ে শোনো, আমি বোকা না ঠিকাছে? তোমার ছলচাতুরী সবই বুঝি আমি। এসব তোমার নিজেকে মহান প্রমাণ করার চেষ্টা। আমাকে ছাঁড় দিয়ে নিজেকে খুব বিশাল কিছু ভাবছো। কিন্তু মনে তো তোমার ঠিকই শয়তানি। তুমি নিজেও খুব ভালো করে জানো আমি যত চেষ্টাই করি না কেনো ইলহান শেষমেষ তোমার কাছেই ফিরে আসবে৷ তাই এতো নিশ্চিন্তে বসে আছো।”
” যদি আসলেই ও আমার কাছে আসে তাহলে এখানে আমার কিছু করার নেই সোফিয়া৷ বরং এটা তোমার ব্যর্থতা। তুমি যদি নিজের বয়ফ্রেন্ডকে সামলে রাখতে না পারো তাহলে সেই দোষ কি আমার? আমি তো যেচে কখনও তোমাদের লাইফে ইন্টারফেয়ার করতে আসিনি। বরং ইলহান নিজেই তোমাকে ছেড়ে আমার কাছে এসেছিল। আমি ওকে বার-বার প্রত্যাখ্যান করেছি। শেষবারের মতো আবার প্রত্যাখ্যান করলাম। এবার ওকে আটকে রাখার দায়বদ্ধতা সম্পূর্ণ তোমার। আই হ্যাভ নাথিং টু ডু হেয়ার।”
” কি গ্যারান্টি আছে যে তোমার মন আবার চেঞ্জ হবে না? আজকে ইলহান তোমার কাছে ক্ষমা চাইলে কালকেই তুমি ওকে মাফ করে দিবে না? তাহলে আমি কোন ভরসায় বিশ্বাস করবো?”
” আমি তুমি নই সোফিয়া। আমার কাছে প্রতারণার কোনো ক্ষমা নেই৷ তাছাড়া যে জিনিস আমি একবার ফেলে দিই সেটা আমার কাছে উচ্ছিষ্ট হয়ে যায়। দ্বিতীয়বার সেই উচ্ছিষ্ট তুলে নেওয়ার মতো নোংরা কাজ আমার অভ্যাস বহির্ভূত। ভালো থেকো।”
অরিন তার বক্তব্য শেষ করে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। অন্বয় কিছুক্ষণের জন্য পুরোপুরি স্তম্ভিত হয়ে রইল। এমন অরিনকেই তো দেখতে চেয়েছিল সে। সোফিয়ার মতো সেও ভেবেছিল এতোকিছু জানার পর মিসেস অরিনের হয়তো মন পাল্টে যাবে৷ তিনি ইলহান মাহদীকে ক্ষমা করে দিবেন। কিন্তু মিসেস অরিন এইমাত্র যেটা বলে গেলেন তাতে অন্বয়ের ভালোবাসা অরিনের জন্য আরও দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেল। অন্বয় মনে মনে আওড়ালো,” আপনি বেস্ট অরিন। আপনি সত্যিই ব্ল্যাক পার্ল। আমার সবচেয়ে মূল্যবান, সবচেয়ে ভালোবাসার ব্ল্যাক পার্ল।”
চলবে
– Sidratul Muntaz