#রংধনুর_রঙ_কালো
৩৭.
পাহাড় দেখতে যাওয়ার আয়োজনে ভাটা পড়লো বৃষ্টির প্রকোপে। সাইকেল নিয়ে মাঝপথ অবধি যেতেই ক্ষীপ্রবেগে বাতাস ছুটল। হঠাৎ করেই আকাশ কাঁপিয়ে মেঘের তীব্র গর্জন আর মেঘ গলে ঝরো বৃষ্টি। সাদিকা ভয়ে ইলহানকে জাপটে ধরে রাখলো। সে মেঘের গর্জনে অনেক ভয় পায়। তার ছোট্ট হাত-পা থরথর করে কাঁপছিল আতঙ্কে,ভয়ে। চোখমুখ কুচকে শুধু একটাই নাম জপ করছিল সে,” ইলু, ইলু, আমার ভয় লাগছে।”
ইলহান যত দ্রুত সম্ভব সাইকেল থামিয়ে একটা ছাউনির নিচে গিয়ে দাঁড়ালো সাদিকাকে নিয়ে। অরিনও তাদের পেছনে হেঁটে আসলো। সাদিকার দিকে চেয়ে বলল,” আমার মেয়েটা বজ্রপাতে খুব ভয় পায়।”
ইলহান এই কথা শুনে সাদিকাকে কয়েকবার ডাকলো। দাঁতে দাঁতে লেগে মেয়েটার প্রায় খিঁচুনি উঠে গেছে। অরিন মুখে দুইহাত চেপে কাঁদতে লাগল। ইলহান ভরসা দেওয়ার মতো অরিনের দিকে না তাকিয়েই বলল,” কিচ্ছু হবে না।”
ইলহান সাদিকার কানের কাছে মুখ নিয়ে কয়েকবার তার নাম ধরে ডাকল। তারপর তার দুই কানে আঙুল চেপে ধরল। তার ওর তুলোর মতো নরম শরীর বুকের মধ্যে এমনভাবে গুটিয়ে নিল যেনো সাদিকা একটুও ভয় না পায়।অন্য সময় হলে অরিন এই অবস্থায় অস্থির হয়ে উঠতো। বৃষ্টি হলেই সাদিকাকে নিয়ে সে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। নানা কলা-কৌশলে তাকে ভুলিয়ে রাখতে চায়। মেঘের গর্জন খুব বেশি হলে সাদিকার এভাবেই খিঁচুনি উঠে যায়। তাই অরিন বৃষ্টির দিনগুলোতে মেয়েকে নিয়ে সবসময় তটস্থ থাকে। কিন্তু আজকে তার তেমন তটস্থ লাগছে না। কারণ সাদিকা এমন একজনের কাছে আছে, যেখানে সে নিশ্চিত সুরক্ষিত। সাদিকা ঠিক একটা বিড়ালছানার মতো বাবার বুকে মুখ ঠেকিয়ে চোখ বুজে রইল। আস্তে আস্তে তার হাত-পায়ের কাঁপুনি কমে আসলো। ইলহান সাদিকার গায়ে এমনভাবে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল যে আবেশে সাদিকা চোখ বুজে নিল। ইলহান পরম আদরে মেয়ের কপালে চুমু দিল। অরিনের অদ্ভুত তৃপ্তি অনুভব হচ্ছিল তখন। হোক না কিছু সময়, সাদিকা তার বাবার আদর তো পাচ্ছে। আর কয়দিন দেরি করলে হয়তো এই সৌভাগ্যটুকুও তার হতো না। অরিনের চোখের কোলে জল চলে এসেছে অদ্ভুত এক সম্মোহনে। একটা সময় সাদিকা ওইভাবেই ঘুমিয়ে গেল বাবার কোলে। ইলহান সাদিকাকে নিয়ে সোজামতো দাঁড়িয়ে রইল। যেনো একটা পুতুল কোলে নিয়ে রেখেছে। অরিনের মনে হলো এতো চমৎকার দৃশ্য এ পৃথিবীতে আর কোথাও নেই। থাকতে পারে না। হুমায়ূন আহমেদ হয়তো ঠিকই বলেছিলেন। এ পৃথিবীতে অজস্র খারাপ পুরুষ থাকতে পারে। কিন্তু একটাও খারাপ বাবা নেই। অরিন স্থিরচিত্তে তাকিয়ে ছিল বাবা-মেয়ের দিকে। হঠাৎ আবারও বজ্রপাতের শব্দে অরিন বিকট আওয়াজে চেঁচিয়ে উঠলো। এইবার সাদিকা একটা টু শব্দও করল না। সে ঘুমিয়ে আছে। ইলহান শীতল গলায় বলল,” আস্তে, তুমিও দেখছি মেয়ের মতো শুরু করেছো।”
ইলহান কথাটা ঝোঁকের মাথায় বলে নিজেই মনে মনে আফসোস করল। অরিনের সাথে কথা না বলার, তাকে নিজের মুখ না দেখানোর শপথ করেছিল সে। তার প্রত্যেকটা শপথ আস্তে আস্তে ভেঙে যাচ্ছে।
অরিন খেয়াল করল ইলহান নিচের দিকে তাকিয়ে কথাটা বলেছে। সে অরিনের মুখের দিকে কেনো তাকাচ্ছে না? এতো আদব-কায়দা কবে থেকে শিখলো? অরিনও একইভাবে নিচের দিকে চেয়ে বলল,” হ্যাঁ শুরু করেছি। তাতে তোমার কি? মেয়ের মতো আমাকেও কি তুমি…”
উফফ, শিট,শিট! অরিন মনে মনে যেটা ভাবছিল মুখ দিয়ে সেটাই বলে ফেলল। এবার কি হবে? দুজনই একই সময় একইভাবে একে-অপরের দিকে তাকালো। অরিনের চোখে কিঞ্চিৎ লজ্জা আর ইলহানের চোখে বিস্ময়। এভাবেই কেটে গেল কয়েক মুহুর্ত কিংবা কয়েক হাজার বছরসম অনুভূতি। অরিনের মনে অচিরেই একটা গান খুব তাল মিলিয়ে বাজছে। বৃষ্টির দিনে বৃষ্টির সেই মায়াবী গান।
“আকাশে রিমঝিম বাদল জমেছে
তোমাকে পাবার মাদল বেজেছে,
কিছু তো শোনা যায় না
তোমাকে ছাড়া।
প্রকৃতি নতুন সাজে সেজেছে
তোমার আমার দেখা হয়েছে,
কিছু তো ভেবে পাই না
মন যে আর মানে না।
আমার মনের বনে কত
কথা ছিল বন্দি,
মেঘের আড়াল থেকে বৃষ্টি
হয়ে পড়বি।
রিমঝিম বৃষ্টি ঝরে যায়
তাকিয়ে দেখো না,
তুমি আমি বৃষ্টিতে ভিজে আজ
একাকার হয়ে আমরা…”
ইলহান শব্দ করে বলল,” স্টপ ইট অরিন। প্লিজ স্টপ ইট!”
ইলহান অরিনকে সামনে থেকে সরিয়ে সাদিকাকে নিয়ে সাইকেলে উঠে গেল। বৃষ্টির তেজ কমে এসেছে। অরিন ছাউনির নিচে দাঁড়িয়ে কাঁপতে লাগল। তার সারা শরীর অপমানে রি রি করছিল। এতোবড় ভুল, এতোবড় ভুল তার দ্বারা হয়ে গেল! কি করে? অরিন নিজের চুল নিজেই খামচে ধরল। নিজেকে ধিক্কার দিতে মন চাইল চিৎকার করে। ইলহান সাইকেলের বেল বাজাচ্ছিল। অরিন কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে পাথরের মূর্তির মতো পেছনে গিয়ে বসল। এমন ভাবে বসলো যাতে ইলহানের গাঁয়ের সাথে তার গাঁয়ে একচুল পরিমাণ স্পর্শ না লাগে। কেউ কোনো শব্দ করল না। চুপচাপ বাড়ি ফিরে এলো।
সুমনা আর অর্ণভের মধ্যে বড়সড় ঝগড়া হয়েছে। একে-অপরের মধ্যে মুখ দেখাদেখিও বন্ধ। অরিন এসবের কোনো মানে খুঁজে পাচ্ছে না। মিহরীমার কাছে সে শুনেছে তাদের ঝগড়াটার মূল ইস্যু নাকি অরিন। কিন্তু কেনো? অরিন কি এমন করেছে? তাছাড়া তাকে নিয়ে তারই ভাই আর ভাবীর মধ্যে ঝগড়া হবে আর সে কিছুই করবে না এটা তো হতে পারে না। অরিন অর্ণভের সাথে এই ব্যাপারে কথা বলতে গেল৷
” ভাইয়া কি হচ্ছে এসব? তোমরা মরাবাড়িতে এসে এমন ঝগড়া শুরু করেছো কেনো?”
অর্ণভ নিরুত্তর। অরিন কাছে গিয়ে বলল,
” ভাইয়া প্লিজ, ঝামেলাটা তো আমাকে নিয়ে হয়েছে তাই না? তাহলে তুমি আমার সাথে ঝগড়া করো। সুমনার সাথে কেনো?”
অর্ণভ নিরসমুখে উত্তর দিল,” তোর সাথে কেনো ঝগড়া করবো? দোষ তো তোর নয়।”
” সুমনা কি দোষ করেছে শুনি? ইলহান ফাঁসির আসামী এইটা আমাকে বলে দিয়েছে এখানেই কি ওর দোষ? কেনো? আমার কি সত্যি জানার অধিকার নেই?”
” এই বিষয়টা তোর কাছে গোপন রাখা কতটা জরুরী ছিল সেটা তুই বুঝবি না।”
” কেনো গোপন করতে চেয়েছিলে? কিসের এতো জরুরী? প্লিজ বলো!”
” এখন নিশ্চয়ই ইলহানের জন্য তোর খুব দয়া হচ্ছে। ভালোবাসা উথলে উঠছে। তাই না?”
অরিন একটু অপ্রতিভ হয়ে বলল,” হ্যাঁ।খারাপ তো একটু লাগছেই। আমি তো মানুষ ভাইয়া। এতোটাও পাষাণ না যে এমন কঠিন সময়েও নিজেকে পাথর বানিয়ে রাখবো।”
” এইখানেই তো প্রবলেম। দ্যাট ইজ দ্যা মেইন ফ্যাক্ট!”
” মানে?”
” এখন কেনো তোর মায়া লাগছে? এতোদিন তো ওর নামও শুনতে চাসনি। ওকে নিয়ে কিছু বললেও তোর গাঁয়ে ফোসকা পড়তো। ছ্যাঁত করে উঠতি। ও মরে গেছে না বেঁচে আছে সেটা পর্যন্ত জানার আগ্রহ ছিল না তোর। তাহলে হঠাৎ করে এখন মায়া কেনো লাগছে? এটাকে কি বলে জানিস? করুণা। একটা ফাঁসির আসামীর জন্য মানুষের যতটুকু সমবেদনা আসে তোরও ঠিক ততটুকুই সমবেদনা এসেছে।”
” ভাইয়া, এসব তুমি কি বলছো? ”
” ঠিকই বলছি। তোকে যতবার আমি ফোন করে ইলহানের ব্যাপারে বোঝানোর চেষ্টা করেছি ততবার তুই ইলহানকে গালাগালি করেছিস। তুই কি জানিস? আমি তোকে ফোন করে স্পিকারে কথা বলতাম।তখন ফোনের অপর পাশ থেকে ইলহান বসে বসে সব শুনতো।”
অরিন অবাক হয়ে গেল,” হোয়াট? এসব তুমি কেনো করতে ভাইয়া?”
” ও ফোন করলে তুই নিশ্চয়ই কথা বলতি না। তাই ইলহান আমার কাছে আসতো। যেনো আমি কথা বললে ও তোর কণ্ঠ শুনতে পারে। কিন্তু তোর কণ্ঠ থেকে বেচারা ভালো কথা জীবনেও শুনতে পারেনি। শুনেছে শুধু গালাগালি।”
অরিন বিস্মিত চোখ মেলে স্থির চেয়ে রইল। অর্ণভ অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বলল,” ইলহান মৃত্যুর আগে এজন্যই তোর সাথে দেখা করতে চায়নি। তুই এতোবছরেও তাকে ক্ষমা করতে পারলি না। মৃত্যুর আগে তোর ঘৃণাভরা দৃষ্টিতে করুণার বৃষ্টি ও সহ্য করতে পারবে না। এইযে এখন তুই কাঁদছিস। এটা তোর করুণার কান্না।”
অরিন হতবিহ্বল হয়ে কথাগুলো শুনছিল। আর একপা, দুইপা করে পিছিয়ে যাচ্ছিল। আসলেই কি সে ইলহানকে সারাজীবন শুধু ঘৃণা আর করুণাই করেছে? কোনোদিনও ভালোবাসেনি? সত্যিই কি ভালোবাসেনি? অরিন উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটে গেল ইলহানের ঘরের দিকে। কেনো যে গেল তা সে নিজেও জানতো না। ইলহান তখন সম্পূর্ণ একা সেই ঘরে। ব্যাগপত্র গুছাচ্ছে। সে কি জেলে ফিরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে? অরিনকে দেখে কৌতুহলী দৃষ্টিতে একবার তাকাল ইলহান। অরিন বলল,
” চলে যাচ্ছো?”
ইলহান খুব ধীরে উচ্চারণ করল,” হুম।”
অরিন ঢালা বর্ষণের মতো সিক্ত কণ্ঠে বলল,” আই এম স্যরি!”
ইলহান হকচকিয়ে গেল। কিছুটা স্তম্ভিত হলো। তারপর হাসার চেষ্টা করে বলল,” তুমি কেনো স্যরি বলছো আমাকে?”
অরিন দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়ালো৷ অসহায়ের মতো বলল,
” জানিনা। কেনো স্যরি বলছি আমি?”
কিছুক্ষণ দুজনেই চুপ। তারপর ইলহান গলা পরিষ্কার করে বলল,” আমিও স্যরি।”
অরিন সরাসরি ইলহানের চোখের দিকে চেয়ে প্রশ্ন করল,” কেন?”
” তোমার দেওয়া ডিভোর্স পেপারে আজও সাইন করতে পারলাম না। তোমার শেষ চাওয়া অপূর্ণ রেখেই বিদায় নিতে হচ্ছে।”
অরিনের হু হু করে কেঁদে উঠতে ইচ্ছে করল। খুব করে বলতে মন চাইল,” আমিও ইলহান। আমিও পারিনি তোমাকে ডিভোর্স দিতে। আমার হাতের আঙুলগুলো তখন খুব কাঁপছিল জানো? আমি অন্বয়সাহেবকে বললাম, সইটা আপনিই করে দিন। ইলহান না বুঝলেই হলো। তিনি আমার লেখা হুবুহু নকল করে সাইন করেছিলেন।”
অরিন মুখ ফুটে একটা শব্দও বলতে পারল না। কণ্ঠনালী দিয়ে যেনো রক্তক্ষরণ হচ্ছিল তার। ইলহান চলে যাচ্ছে। সারাজীবনের জন্য চলে যাচ্ছে!
চলবে
– Sidratul Muntaz