রঙহীন জীবনের রঙ,পর্ব:২৪

0
848

গল্প: #রঙহীন_জীবনের_রঙ
অন্তিম পর্ব
লেখনীতে: #স্বর্ণা_সাহা (রাত)

নীলাদ্রি দিশানীকে জিজ্ঞেস করে,
—আচ্ছা তুমি কি ভালোবেসে আমাকে বিয়ে করছো নাকি আমার ভালোবাসার জন্য আমাকে বিয়ে করছো? এখনো কি তুমি আমাকে ভালোবাসো?

দিশানী উত্তর দিলো,
—একসময় আমি আপনাকে ভালোবাসতাম কিন্তু কিছু কঠিন পরিস্থিতির কারণে আমার বিয়ে হয়ে যায় তখন আমি অন্য কারোর বউ হয়ে যাই সেক্ষেত্রে অন্য কোনো মানুষকে ভালোবাসা একপ্রকার পাপের মতোই, তাই আমি নিজের ভালোবাসাকে বালিচাপা দিতে বাধ্য হয়েছিলাম।আমি ভেবেছিলাম সময়ের সাথে সাথে সবাই নিজের জীবনে এগিয়ে যাবে কিন্তু আমার জীবন যে এরকম হবে তাতো বুঝিনি। আর এখন আমি নিজেও ঠিক করে বুঝিনা আপনাকে ভালোবাসি কি না। হয়তো ভালোবাসতেও পারি। সব প্রশ্নের উত্তর যে সবসময় প্রশ্ন করার সাথে সাথেই জানতে হবে এমন তো কোনো কথা নেই, যেদিন জানার সেদিন ঠিকই জানবেন।

—আমার কথা আমাকেই শোনাচ্ছ?

—হুম!কিন্তু একটু ঘুরিয়ে, আপনি বুদ্ধিমান হলে বুঝবেন নয়তো বুঝবেন না।

দিশানীর কথায় নীলাদ্রি হেসে উঠলো।তারপর বললো,
—আচ্ছা এটা নাহয় বুঝলাম কিন্তু তুমি আমাকে আপনি ডাকাটা কবে বন্ধ করবে?

—কেনো আপনি ডাক খারাপ কিসে ভালোই তো আছে।

—তুমি আমাকে তুমি করেই ডাকবে ব্যস।

দিশানী হেসে উঠলো আর বললো,
—আচ্ছা তুমি করেই ডাকবো।

দেখতেই দেখতেই দিশানী আর নীলাদ্রির বিয়ের দিন চলে আসে।
বিভিন্ন অনুষ্ঠান-আনন্দের মধ্যে দিয়েই নীলাদ্রি আর দিশানীর বিয়ে হয়ে যায়।নীলাদ্রির আত্মীয়রা একজন ডিভোর্সি মেয়েকে বিয়ে করার জন্য আপত্তি করলেও নীলাদ্রি ওদেরকে সুন্দরভাবে বোঝায়, যার কারণে ওরা আর কিছু বলেনি।

এদিকে প্রথম প্রথম এলিনা বাড়ির সব কাজ করলেও কিছুদিন হলো এলিনার ব্যবহারে পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়, ও প্রায় সারাদিনই একজনের সাথে ফোনে কথা বলে। বাড়ির কাজ-কর্ম কিচ্ছু করে না, নিরা আর সুজাতাকেই সব করতে হয়, এলিনা নিজেকে অসুস্থ বলায় প্রথম কয়দিন সুজাতা আর নিরা কিছু বলেনি।কিন্তু ওর শরীর এখন ঠিক থাকলেও ও বাড়ির কোনো কাজ করে না।কিন্তু দিন দিন এলিনার ব্যবহারও খুব রুক্ষ হয়ে গেছে।নির্ঝর যে এলিনাকে মারে না তা না মারে কিন্তু খুব কম।এলিনা চুপচাপই থাকে।

———————–
অনার্স ফাইনাল এক্সামের কয়েকমাস আগে দিশানী কনসিভ করে।এক্সামের আগ পর্যন্ত নীলাদ্রি নিজের চেম্বার সামলে যতটুকু পারে দিশানীর প্রত্যেকটা জিনিসের দিকে নজর রাখে, টাইমে টাইমে খাওয়া-দাওয়া করা, এক্সামের প্রিপারেশন নেওয়াই হেল্প করা সব ক্ষেত্রেই নীলাদ্রি দিশানীকে সাহায্য করে। এটাসেটা খাওয়ার মুড করলে বাইরে গিয়ে খাবার আনা থেকে শুরু করে নিজেও মাঝে মাঝে রান্না করে খাওয়ায়। আর তাছাড়া দুজনের খুনসুটিময় ঝগড়া তো লেগেই আছে। দেখতে অনার্স ফাইনাল ইয়ারের এক্সামও শেষ হয়ে যায় আর প্রত্যেক এক্সামের দিনই নীলাদ্রি দিশানীর সাথে গেছে এবং দিশানীর প্রত্যেকটা এক্সামই খুব ভালো হয়। আজ দিশানীর রেজাল্ট দেবে। প্রত্যেকটা পরীক্ষা ভালো হলেও রেজাল্ট নিয়ে প্রত্যেকটা মানুষেরই টেনশন থাকে। দিশানী বেশ টেনশন করছে রেজাল্ট নিয়ে। দিশানীকে টেনশন করতে দেখে নীলাদ্রি বললো,
—এতো টেনশন করছো কেনো, পরীক্ষা যখন ভালো দিয়েছো রেজাল্টও ভালোই আসবে টেনশন কোরোনা।

দিশানী ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললো,
—তবুও একটু তো টেনশন হয়ই তাইনা?

—টেনশন কোরোনা আর বেশি স্ট্রেস নিও না বেবির জন্য এটা খারাপ হবে।

—আচ্ছা।

এরই মধ্যে রেজাল্ট দেওয়ার টাইম হয়ে গেলো। দিশানী ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছে। দিশানীর খুশি দেখে কে। নীলাদ্রি দিশানীকে বললো,
—বলেছিলাম না রেজাল্ট ভালো হবে।

দিশানী উত্তর দিলো,
—সব ক্রেডিট তোমার। তোমার জন্যই এটা সম্ভব হয়েছে।

আরো দিন কেটে গেলো দিশানীর একটা ফুটফুটে মেয়ে হয়েছে।

——————–
সাত বছর পর,

দিশানী পরীক্ষার খাতা কাটছে। পরীক্ষা শেষ হওয়ায় কয়েকদিন স্কুল বন্ধ থাকবে তাই আজ দিশানী স্কুলে যাওয়ার প্রয়োজন হয়নি।দিশানী এখন একটা বেসরকারি স্কুলে শিক্ষকতা করে
খাতা দেখতে দেখতেই বাড়ির কলিংবেল বেজে উঠলো। দিশানী উঠে গিয়ে গেট খুলতেই দেখে নির্ঝর গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। দিশানী অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,
—নির্ঝর!তুমি এখানে?

নির্ঝর মাথা নিচু করে বলে,
—তোমার সাথে কিছু কথা বলার ছিলো।

দিশানী নির্ঝরকে ভেতরে আসতে বলে। নির্ঝরের চোখমুখের পরিস্থিতি ভীষণ খারাপ। চোখমুখ শুকিয়ে গেছে। দিশানী নির্ঝরকে বসতে বলে নিজেও বসে। নির্ঝর দিশানীকে জিজ্ঞেস করে,
—কেমন আছো?

—ভালো আছি, তুমি?

নির্ঝর হাতজোড় করে বলে উঠে,
—আমাকে তুমি ক্ষমা করে দিও দিশানী, জানি আমি যা যা করেছি তাতে ক্ষমা চাওয়ার কোনো মুখ নেই আমার কিন্তু তবুও আমাকে ক্ষমা করে দিও, অনেক বড় ভুল করেছিলাম আমি। আর সেই ভুলের শাস্তিও পেয়েছি আর এখনো পেয়েই যাচ্ছি।

দিশানী জিজ্ঞেস করে,
—কি হয়েছে তোমার?

নির্ঝর দিশানীকে পুরো ঘটনা বলতে শুরু করে,

প্রথম প্রথম এলিনাকে মারলেও কোনো প্রতিবাদ করতো না।ওকে খুব একটা যে মারতাম তাও না, টুকটাক দুই একটা থাপ্পড় মারতাম তাও মাঝে মাঝে ।কিন্তু ধীরে ধীরে ও পাল্টে যেতে থাকে, কিছু না হতেই ও নিজেই আমাদের বাড়িতে অশান্তি লাগাতো। মুখে তর্ক করতো,আমাদের সংসারে এক প্রকার অশান্তি লেগেই থাকতো প্রতিদিন, নিরাকেও ও সহ্য করতে পারতো না, ওর এসব কাজে আমরা কিছু বললেই রাগ করে বাপের বাড়ি চলে যেত। নিরার জন্য একটা ভালো বিয়ের সমন্ধ আসায় আমরা ওকে বিয়ে দিয়ে দেই।এদিকে আমাদের বিয়ের প্রায় এক বছর হতে চললেও এলিনা সন্তানসম্ভবা হয়না,ওকেও ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই কিন্তু এবারে ওরও কোনো সমস্যা ধরে পড়েনি। সেদিন বাড়িতে আসতেই মা এলিনাকে অনেক কথা শোনায় সেদিন এলিনা আমার মাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেয় তারপর বলে,
—খবরদার আমার দোষ দেবেন না, নিজের ছেলের বাবা হওয়ার কোনো যোগ্যতা নেই আর উনি আমাকে দোষারোপ করে যাচ্ছে ফালতু মহিলা কোথাকার, এই জন্যই আপনার ছেলের আগের বউ টেকেনি, আপনি আপনার ছেলেকে যতগুলো মেয়ের সাথেই বিয়ে দেন না কেনো আপনার ছেলে কোনোদিনই বাবা হতে পারবে না।

আমি তো বরাবরই নিজের অক্ষমতা স্বীকার করতাম না তাই এলিনাকে ওইদিন আমি খুব মারি। ওই মারাই আমার কাল হয়ে দাঁড়ায়। ও এই ঘটনায় বাড়ি থেকে বের হয়ে গিয়ে ওর মা-বাবার সাথে গিয়ে পুলিশে কমপ্লেইন করে। পুলিশ এসে আমাকে ধরে নিয়ে যায়। এবার আত্মসমর্পণ করেও কোনো জামিন হয়নি কারণ শুধু নারী নির্যাতন না আরো অনেক কমপ্লেইন করে আমার নামে যার মধ্যে কিছু মিথ্যাও ছিলো। ওর বাবার টাকার কাছে আমরা হেরে যাই। পরে জানতে পারি ওর বাবার এক কর্মচারীর সাথে রিলেশনে জড়িয়ে ও পালিয়ে গিয়েছিলো। পরে ওকে ফিরিয়ে আনা হয়। আর এই ঘটনার জন্যই ওর বাবা আমার মতো ডিভোর্সি ছেলের সাথে বিয়ে দেয়। ওর চরিত্রেও সমস্যা ছিলো, আমার সাথে বিয়ের পরেও ওর অন্য ছেলের সাথে সম্পর্ক ছিলো। মামলার দায়ে আমার জেল হয়।কিছুদিন আগেই জেল থেকে মুক্তি পেয়েছি আমি। এতদিন জেলে থেকে অনুতপ্ত হয়েছি প্রতিটা মুহূর্ত। আমি সত্যিই তোমার সাথে খুব অন্যায় করেছি।

দিশানী সব শুনে বললো,
—আর নিরা?

—ও নিজেও শাস্তি পেয়েছে। ওর ননদও ওকে সবসময় কথা শোনায়। আর স্বামীও খুব অত্যাচার করে।আমি আবারো তোমার কাছে আমার কাজের জন্য ক্ষমা চাইছি। মূলত তোমার কাছে ক্ষমা চাইতেই এসেছি। সত্যিই তোমার মূল্য এখন হারে হারে টের পাচ্ছি।

—আমার কাছে ক্ষমা চাওয়ার কিছুই নেই, আমি অনেক আগেই তোমাকে ক্ষমা করে দিয়েছি।

এর মধ্যেই দিশানী আর নীলাদ্রির মেয়ে ঘুম থেকে উঠে ড্রয়িংরুমে চলে আসে। নির্ঝরকে দেখিয়ে বলে,
—এটা কে মাম্মাম?

দিশানী উত্তর দেয়,
—তোমার একটা আংকেল হয় উনি।

দিশানী নির্ঝরকে বলে,
—ও আমার আর নীলাদ্রির মেয়ে নীলাক্ষী।

নির্ঝর টুকটাক কথা বলে চলে যায়।
দিশানীর বড় ভাই আর বৌদি এখন আবার দিশানীদের সাথে যোগাযোগ শুরু করেছে। মেঘা আর সৌম্যরও একটা ছেলে হয়েছে।

——————
রাতের বেলা নীলাক্ষিকে ঘুমিয়ে পাড়িয়ে দিয়ে দিশানী এসে বেলকনিতে দাঁড়ায়। নীলাদ্রি পাশে এসে দাঁড়াতেই দিশানী নীলাদ্রিকে বলে,
—আজ তুমি না থাকলে আমার জীবনের অন্ধকার কখনো আলোয় পরিণত হতে পারতো না। তুমি এসেছিলে আমার রঙহীন জীবনের রঙ হয়ে।থ্যাংক ইউ ফর এভরিথিং নীলাদ্রি।

নীলাদ্রি দিশানীর কথার উত্তরে বললো,
—ভালোবাসি দিশুপাখি তোমায়, খুব ভালোবাসি।

দিশানীও মুচকি হেসে জবাব দিলো,
—আমিও খুব ভালোবাসি তোমাকে নীলাদ্রি।

“সমাপ্ত”

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here