#রঙিন_প্রজাপতি
লেখনীতে – Ifra Chowdhury
পর্ব-১০ (অন্তিম পর্ব )
.
আচমকা প্রণব টবে পানি দিতে দিতে দৃষ্টি সরিয়ে আমাদের বারান্দার দিকেই তাকালো। আমি চটজলদি আমার অর্ধেক বের করা মাথাটা সম্পূর্ণই পর্দার আড়ালে ঢুকিয়ে নিলাম। আমার বুকের ভেতরটা কবুতরের মতো ঢিপঢিপ করছে। প্রণব কি আমায় দেখতে পেয়ে গেলো? আরেকবার কি উঁকি মেরে তাকাবো?
না থাক। দরকার নেই। কেন তাকাবো আমি? হুহ।
ভাবলাম আর তাকাবো না।
কিন্তু মনটাকে মানাতে পারলাম না।
কেন জানি মনে হলো, এই শেষ বারের মতো একটু তাকিয়ে দেখি। যেমন ভাবা, তেমন কাজ। আল্লাহকে স্মরণ করতে করতে ওপাশ থেকে একটু গলাটা উঁচিয়ে তাকালাম।
একি! প্রণব নেই। মাত্রই তো ছিলো। কি সুন্দর একে একে ওর ফুলের গাছগুলোতে পানি দিচ্ছিলো। প্রণবকে দেখতে না পেয়েই আমি বেরিয়ে পড়লাম আবার। কোমরে দুই হাত গুজে ভাবতে লাগলাম, ব্যাটা গেল কই? এত তাড়াতাড়ি পানি দেওয়া শেষ হয়ে গেল ওর? নাকি কোনো কাজে ভেতরে গেল? আবার ফিরে আসবে?
ব্যাপারটা ভেবেই আমি আবারও প্রণবের বারান্দার দিকে উঁকিঝুকি মারতে লাগলাম; ওর গাছে পানি দেওয়ার মগ, বালতি আছে কিনা দেখার জন্য। দেখলাম, ওগুলোও নেই। বুঝে নিলাম, ওর আজকের মতো পানি দেওয়া শেষ তাহলে। মনটা একটু খারাপ হয়ে গেল। কেন হলো, জানি না।
চায়ের কাপটা নিয়ে ডাইনিং রুমের দিকে চলে গেলাম। কিন্তু প্রণবের চিন্তাভাবনা এখনো আমার মাথা থেকে যাচ্ছে না। মানুষ যে বলে, মাথায় ভূত চেপেছে নাকি। ঠিক তেমনই মনে হচ্ছে, প্রণবের ভাবনাও আমার মাথায় বেশ চেপে বসেছে। আমি কি ওর প্রেমে টেমে পড়ে গেলাম নাকি?
ভাবতে ভাবতে কিছু কথা মনে পড়ে গেল। আরিশা যেদিন আমায় ওয়ার্নিং দিতে এসেছিলো, ঐদিন যে মনে মনে টিপ্পনী মারছিলাম। প্রণবের মতো গুন্ডার প্রেমেও কেউ পড়ে নাকি? কীভাবে কেউ ওর জন্য পাগল হতে পারে.. হ্যান ত্যান কতো কী!
কিন্তু ইদানীং বোধ হচ্ছে, আমি নিজেই কি ওর প্রতি দুর্বল হয়ে গেলাম?
গুন্ডার প্রেমে আমিও পড়লাম?
না, না, যাই হউক। ও তো নাকি ভালো গুন্ডা।
আচ্ছা, আগে তো গুন্ডাদের জ্যোতিষ ভেবেছিলাম। এখন মনে হচ্ছে তারা কি কোনো যাদুটোনাও জানে? যার মায়াজালে অন্যদের বশ করে নিতে পারে?
নাকি শুধু প্রণবের মধ্যেই এসব গুণ আছে?
কে জানে!
_______________________________
সকালের স্নিগ্ধ পরিবেশে অবচেতন মনটাও স্নিগ্ধ হয়ে যায়। আমি বেলকনিতে পায়চারি করছি। সতেজ হিমেল হাওয়া পুরো শরীরে কাঁপুনি ধরিয়ে দিচ্ছে। কুয়াশার চাদরে শহরের ইট, পাথর ও কংক্রিটের রাস্তাগুলোও যেনো ঢাকা পড়ে গেছে।
আমার বাসা থেকে এক ফুট দুরত্বের বিল্ডিংটাও দেখা যাচ্ছে না। হঠাৎ করে প্রণবের জন্য মনটা বেশ আকুপাকু করছে। মনে হচ্ছে, ইশ! যদি এমন স্নিগ্ধ সকালে ওর মুখটা একবার দেখতে পেতাম। কিন্তু উপায় নেই। প্রকৃতি আমায় সেই সুযোগ দিলো না।
কিছুক্ষণ অস্থিরতার মধ্য দিয়ে কাটিয়ে রুমে ফিরে আসলাম। তবুও স্বস্তি পাচ্ছি না। এদিকে সূর্য মামাও উঁকিঝুকি দিচ্ছে। ছাদে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালাম। দিয়াও আমার সাথে আসতে চেয়েছিলো। কিন্তু ঘন্টা দুয়েক পর ওর পরীক্ষা শুরু হবে, তাই আপাতত পড়ার মাঝেই ডুবে থাকতে বললাম ওকে।
কনকনে শীতে আমার শরীর বরফের ন্যায় জমে আছে। পা দু’টো চলতে চাইছে না। তবুও আসলাম ছাদে। প্রথমেই প্রণবের ছাদের দিকে তাকালাম। আমার চোখ জোড়া যেনো কোথাও আটকে গেলো। প্রণব ছাদে! সূর্যের প্রথম কিরণটা যেনো ওর মুখেই পড়লো। আমি সন্তর্পণে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম। তবে দীর্ঘশ্বাসের কোনো কারণ খুঁজে পেলাম না।
কুয়াশাগুলো যেনো ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে। প্রণব আরো স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হচ্ছে। ও নিজেও আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। যেনো কতো জনমের তৃষ্ণা মেটাচ্ছে। হুট করে মেসেঞ্জারে একটা রেকর্ডিং আসলো। আমি ক্লিক করতেই প্রণবের কন্ঠ পেয়ে চমকে উঠলাম।
“প্রণয়িনী,
আড়ালে ডেকে তোমার দু’টো গাল ধরে
আলতো ছুঁয়ে দেওয়ার চেষ্টা আমাকে তাড়া করে ভীষণ করে।
চেষ্টা আমি থামাচ্ছি না।
তোমার দর্শন না মিললেও যেনো
আমি তোমায় আমার কল্পনায় ছুঁয়ে দেই প্রতিটা মুহুর্তে।
ওহে তুমি,
শুনতে পাও কি আমার বাণী?
যে বাণী শুধু তোমাকে নিয়েই মাতিয়ে রাখে আমাকে।
যেনো কত শত নদী,
সমুদ্র, পাহাড়, বন পাড়ি দিয়ে
তোমাকে আমার মাঝে বদ্ধ করে দিচ্ছে।
তোমাতে বদ্ধ আমি যেনো কোনো কালেই রুদ্ধ হতে অপারগ।
এ কেমন পথ চলা!
আঁধারে তোমার চারিপাশে যেনো ঘুরি ফিরি।
যেনো তোমাকে এতটুকু আলো দেওয়ার আশায়
থামিয়ে দিচ্ছে আমায় অনন্তকাল।
হাটা পথে আজ যেনো কোনো ভয়ই আর কাজ করে না।
এ কেমন পাগলামি!
তোমাকে ছুঁতে যেনো এ মন বারবার দেয় হাতছানি।
তুমি আমার!
আমার তুমি, যেনো আমাতেই তোমার বসবাস।
যেনো অনন্তকাল থেমে যায় এভাবেই।
থামতে বাধ্য।
কারণ,
তুমি আমার।”
এতোকাল এভাবে তো ওর কন্ঠটা শুনিনি। কি মায়া! আমি বারংবার শুনলেও এই কন্ঠে বিরক্ত হবো না। প্রণব কবিতা আবৃত্তি করতে পারে জানতাম না।
আমার গলা শুকিয়ে আসছে। ঠোঁট দু’টো অনবরত কাঁপছে। এটা কিসের কাঁপন? প্রণয়ের কাঁপন না কি শীতের? জানা নেই। শুধু এটুকু জানি আমি প্রেমে পড়েছি। এ প্রেমের প্রণয় হতে বেশিদিন বাকি নেই। মনের গভীরে মিশ্র অনুভূতিদের সাড়া দিতে গিয়ে বেমালুম ভুলে গেলাম পাশের ছাদে দাঁড়িয়ে প্রণব আমায় দেখছে।
ফোনের স্ক্রিন থেকে চোখ তুলে পাশের ছাদে তাকাতেই দেখি প্রণব নেই। নেই মানে কোথাও নেই। আশ্চর্য, এই মাত্রই তো ছিলো! হুট করে জলজ্যান্ত মানুষটা কোথায় উবে গেলো? আমায় অস্থিরতায় ফেলে নিজে গায়েব হয়ে গেলো।
দিয়ার ডাকে হুড়মুড়িয়ে ঘুম থেকে উঠলাম। কিছুক্ষণ কেবলাকান্তের মতো ওর দিকে ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে রইলাম। দিয়া আমার মাথায় গাট্টা মেরে বললো,
‘তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নে। তোর ভার্সিটি যাওয়ার সময় হয়ে গেছে।’
নিজের বোকামিতে নিজেই লজ্জা পেয়ে গেলাম। এতোক্ষণ তাহলে স্বপ্ন দেখছিলাম! আচ্ছা, স্বপ্নটা কি সত্যি হতে পারে না?
আপন মনে প্রশ্ন আওড়ালাম। কিন্তু উত্তর পেলাম না।
______________________________
ভার্সিটিতে পৌঁছেই শুভ আর মুমুকে পেয়ে গেলাম। গেইটের বাইরে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ ওয়েট করার পর অনন্যাও এসে গেল। তারপর চারজনে হাসি আড্ডায় ভেতরে প্রবেশ করলাম। কথা বলতে বলতে হাঁটছি সবাই। হুট করে একটা উঁচুনিচু জায়গায় হোঁচট খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে গেলাম আমি।
সবাই থমকে গেল দেখে। অনন্যারা আমায় তুলবে কি, তার আগেই কোত্থেকে যেন প্রণব ছুটে এলো। এসেই সবাইকে সরিয়ে তাড়া দিতে লাগলো,
‘সবাই সাইড হও। সাইড হও একটু। আমি দেখছি।’
প্রণবকে দেখে বাকিরাও আর কিছু বললো না। সবাই ওর কথামতো জায়গা খালি করে দাঁড়ালো। আমার হাত ধরে তুলে ক্যাম্পাসের জারুল গাছটার নিচের পাটাতনে বসানো হলো।
শুভ দৌড়ে পানিও নিয়ে এলো। প্রণবের বন্ধুরা ইতোমধ্যে ফার্স্ট এইড বক্সও নিয়ে এসেছে। আমার থুতনিটা খানিক কেটে গেছে। আর বাম হাতটাও ছিলে গেছে। হাঁটুতেও ব্যাথা পেয়েছি। তবে পায়ে কোনো ক্ষত সৃষ্টি হয়নি সম্ভবত।
প্রণব ঐদিনকার মতোই ড্রেসিংয়ে ব্যস্ত। খুব আলতো ভাবে আমার ক্ষতস্থানগুলো পরিষ্কার করে দিচ্ছে। আমি একদৃষ্টে ওর দিকে তাকিয়ে আছি। ঐদিন যখন প্রণব আমার ড্রেসিং করে দিচ্ছিলো, তখন ওর মধ্যে দায়িত্ববোধটা বেশ ছিলো। আর আজ সেটার সাথেসাথে কেমন যেন অস্থিরতাও দেখতে পাচ্ছি আমি। প্রণব কেন এত অস্থির হচ্ছে আমার জন্য? তবে কি.. প্রণবও…
আমার ভাবনা আর এগোলো না। এর ফাঁকেই প্রণব আমার দিকে দাঁত কিড়মিড় করে খুব রাগী দৃষ্টিতে বললো,
‘এত্ত কেয়ারলেস কেন তুমি?’
প্রণব চোখ রাঙিয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। ওর কপাল ভাঁজ হয়ে আছে। ওকে এমন অস্থির দেখেও কেন জানি বড্ড ভালো লাগছে আমার। মনে মনে হাসলাম আমি।
ড্রেসিং শেষে আমার থুতনিতে একটা নিওস্ট্রিপও লাগিয়ে দিলো প্রণব। তারপর প্রণব আমায় বাসায় ফিরে যাওয়ার কথা বললো। আজ আর ক্লাস করার দরকার নেই। শুভ, মুমুরাও প্রণবের সাথে সম্মতি জানালো। কিন্তু আমি এখনি এসেই আবার চলে যেতে চাচ্ছি না। আর আমার তো ততো সিরিয়াস কিছুও হয়নি৷ ক্লাস তো করতেই পারবো।
কিন্তু প্রণব হয়তো চাচ্ছে না সেটা।
অনন্যা আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
‘কী রে, কী করবি? বাসায় যাবি? নাকি ক্লাস করবি?’
আমি জবাব দিলাম,
‘আরে কিচ্ছু হয়নি আমার। ক্লাসই করবো। চল্।’
প্রণব এটা শুনেই গম্ভীর গলায় বললো,
‘দিবা, তুমি এক্ষুণি বাসায় যাবে। বিশ্রাম নাও গিয়ে। যাও।’
প্রণবের মুখের উপর না করে দিলাম আমি,
‘না আমি যাবো না। আপনার কী?’
প্রণব রক্তলাল দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকায়। ও রেগে আছে বোঝাই যাচ্ছে। তাও নিজেকে সংযত করে আমায় বললো,
‘তুমি আজকেই ক্লাস শেষে দেখা করবে আমার সাথে।’
বলেই গটগট পায়ে ওখান থেকে চলে গেল প্রণব। সাথে ওর বন্ধুরাও। আমরা বাকি সবাই অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছি।
শুভ জিজ্ঞেস করলো,
‘কী রে, প্রণবের কী হলো হঠাৎ?’
মুমু উত্তর দিলো,
‘কে জানে।’
আমিও বুঝতে পারছি না প্রণবের কী হলো। কিন্তু এখন শুভর প্রশ্নটা শুনে ওকেই উলটো প্রশ্ন করলাম আমি,
‘শুভ, তুই আবারও প্রণব ভাইকে নাম ধরে ডাকলি? উনি কি তোর বন্ধু হয়? হু?’
শুভ হেসে মাথা চুলকে বললো,
‘হা হা হা। আরে না। আমার স্বভাবই তো জানিস, হুট করে কাউকে মজার ছলে নাম ধরেই সম্বোধন করে ফেলা। কিছু মনে করিস না। এমনিই বলে ফেলি আমি।’
ওর কথা শুনেই একটা গাট্টা মারলাম ওর মাথায়। তারপর ওদের সবার উদ্দেশ্যে বললাম,
‘আচ্ছা চল্ ক্লাসে যাই এখন।’
তারপর ওদের সহায়তায় একত্রে ক্লাসের দিকে পা বাড়ালাম।
_______________________
গত পরশু ক্লাস শেষে প্রণবের সাথে দেখা করার কথা ছিলো। কিন্তু হাঁটুর ব্যাথার জন্য আর দেখা করতে পারিনি। দুইদিন ভার্সিটিতেও আসতে পারিনি। ব্যাথা�টা বেড়েছিলো। প্রণব না জানি কত্ত রেগে আছে! তাই আজ ভার্সিটিতে এসেই প্রণবকে খুঁজছি।
অনেক খুঁজে শেষে পুকুরপাড়েই ওকে নিরালায় বসে থাকতে গেলাম। ওকে দেখেই আমি এগিয়ে গেলাম ওর দিকে। চুপিসারে গিয়ে ওর পাশে দাঁড়ালাম। ও আমার উপস্থিতি টের পেয়েই বললো,
‘তুমি এখানে কেন?’
‘আপনিই তো বলেছিলেন দেখা করতে বলেছিলেন।’
‘আমি তো আজ দেখা করতে বলিনি। দু’দিন আগে বলেছিলাম। সেদিন যখন আসোনি, আজ আর কেন এসেছো?’
আমি ধীরে ধীরে ওর পাশে বসে দুই কান ধরে বাচ্চাদের মতো বললাম,
‘সরি প্লিজ?’
প্রণব কোনো জবাব দিলো না। আমি আবারও বলতে লাগলাম,
‘আমার ব্যাথাটা বেড়েছিলো তো। তাই আসতে পারিনি। সরি বড় ভাই।’
প্রণব এবার মুখ ঘুরিয়ে বলতে লাগলো,
‘তোমায় তো আমি আগেই বলেছিলাম বাসায় চলে যাও। তখনি গিয়ে যদি রেস্ট নিতে, বেটার হতো। কিন্তু তুমি তো শুনবা না আমার কথা! ক্লাস করার জেদ ধরে বসলে। তারপর ঠ্যালা বুঝলে তো?’
কিছুক্ষণ দম নিয়ে প্রণব আবারও বলতে লাগলো,
‘তুমি জানো? এই দুইদিন আমি কত্ত একটা চিন্তার মধ্যে ছিলাম? জাস্ট তোমায় নিয়ে! তোমায় নিয়ে। বারান্দায় গিয়েও দাঁড়িয়ে থাকতাম, তোমায় যদি একনজর দেখতে পেতাম। ভার্সিটিতেও আসতে না। আমার একদম একা একা লাগছিলো। রোজ তোমার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকতাম। কিন্তু তুমি…’
প্রণবের কথাগুলো শুনে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি আমি। জিজ্ঞেস করলাম,
‘কেন? আমি আপনার কে হই?’
প্রণব আড়চোখে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকালো আমার দিকে। তারপর দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
‘কেউ না।’
‘আচ্ছা তবে যাই আমি।’
প্রণব মুহুর্তেই আমার হাত ধরে ফেললো। জিজ্ঞেস করলো,
‘কোথায় যাচ্ছো?’
বলে প্রণব নিজেও হাত ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো।
ও আচমকা আমার হাত ধরাতে বেশ চমকে উঠেছিলাম আমি। বুকটা এখনো ধড়ফড় করছে। আমি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছি।
প্রণব ওর অভ্যাসমতো পকেটে হাত ঢুকিয়ে আস্তে হেঁটে হেঁটে বলতে লাগলো,
‘গতকাল আরিশা টিসি নিয়ে ভার্সিটি থেকে চলে গেছে। আমার কাছে ক্ষমা চেয়ে গেছে। কিন্তু ওর অহংকার ঠিকই বজায় ছিলো। তোমার কাছে সে মাথা নত করবে না। তাই বললো আমিই যেন ওর হয়ে তোমাকে বলে দিই, ও দুঃখিত সবকিছুর জন্যই।’
আমি অবাক হলাম। জিজ্ঞেস করলাম,
‘ওহ। থাক। কিছু বলার নেই আমার।’
সঙ্গে সঙ্গে আবারও বললাম,
‘এটা বলার জন্যই দেখা করতে বলেছিলেন?’
প্রণব পিছন ঘুরে বললো,
‘না। এটা তো গতকালের কথা। ঘটলো, তাই বলে নিলাম আগে।’
‘ওহ। তাহলে কেন ডেকেছেন?’
প্রণব আমার প্রশ্নটা এড়িয়ে গেল। উলটো নিজেই আবার প্রশ্ন করলো,
‘তোমার ব্যাথা কেমন এখন? শরীর ঠিকঠাক আছে?’
আমি মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ-সূচক জবাব দিলাম।
প্রণব বললো,
‘তোমার ব্যাথা পাওয়ার আগের দিনের কথা। বিকেলবেলা তুমি আমায় বারান্দায় দেখে লুকিয়ে গেছিলে কেন?’
ওর কথাটা শুনেই আমি বড় বড় চোখে হা করে তাকালাম। প্রণব হেসে ফেললো। বললো,
‘অবাক হওয়ার কিছু নেই। আমি বারান্দায় চায়ের কাপ দেখতে পেয়েছিলাম। আর এভাবে চা তো তুমিই খাও। আর…’
আমি কথার পিঠেই প্রশ্ন করলাম,
‘আর আমি পরখ করার জন্য ভেতর থেকে দেখলাম, আমি যাওয়ামাত্রই তুমি আড়াল থেকে বেরিয়ে বারান্দায় হাজির। এভাবেই নিশ্চিত হলাম, তুমি যে লুকিয়ে পড়েছিলে।’
বলেই প্রণব হাসলো। আমি মনে মনে ভাবতে লাগলাম, প্রণবও এত্ত নজর রাখে আমার উপর? যাকগে, যাই হউক। এটা তো বলতেই হবে যে ব্যাটা কিন্তু খুবই তীক্ষ্ণদৃষ্টিসম্পন্ন। কেউ এতো সহজে উনাকে ফাঁকি দিতে পারবে না।
এসব চিন্তা করছি, আর তখনি সে আমার ভাবনায় ছেদ ঘটিয়ে বললো,
‘আচ্ছা যাও আজকের মতো। আগামীকাল ক্যান্টিনের দিকে এসো। কথা আছে। জরুরী কথা।’
বলেই প্রণব নিজের মতো করে চলে গেল। আর এদিকে আমি ভাবতে লাগলাম, আবার কী কথা? আজকেও তো কিছু বললো না তেমন। কালকেও কি আবার এমন করবে নাকি?
ধ্যাৎ ভাল্লাগে না। কালকেও আবার দেখা করতে হবে। কী আর করার। প্রবাদে আছে রাজা মন্ত্রীর কথা। আর আমার কাছে হচ্ছে- প্রণব বাবুর খেয়াল; আর ভাঙা বাড়ির দেয়াল। কোনদিকে যে হেলে পড়বে, কোনোটাই ঠিক নেই।
যাক। যাই আজকে। কাল দেখা হবে প্রণবের সাথে।
_________________________
আজকের আবহাওয়াটা দারুণ বোধ হচ্ছে। গোসল সেরে ভার্সিটি যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে নিলাম। সকাল সকাল বড্ড ফ্রেশ লাগছে। প্রজাপতির মতো উড়ুউড়ু মুডে বারান্দায় দাঁড়িয়ে এক মগ কফি পান করলাম। নীল-সাদা আসমানটা খুব টানছে আমায়। সূয্যিমামা কিরণ ছড়াচ্ছে ঠিক, কিন্তু এতোটাও তেজ নেই যেন আজ। মনে হচ্ছে, রোদটাও এক প্রকার শীতল ছায়া।
ভার্সিটিতে পৌঁছেই ক্যান্টিনের দিকে প্রণবকে বেশ অস্থিরভাবে পায়চারি করতে দেখতে পেলাম আমি। ভাবলাম, প্রথমেই ওখানে যাই। আমাকে যেতে দেখেই ওর বন্ধুরাও একটু নড়েচড়ে দাঁড়ালো। সাথে প্রণবকেও অস্ফুটস্বরে কী যেন বললো। প্রণব ওদের কথায় ফিরে আমার দিকে তাকালো এবং একদৃষ্টে তাকিয়েই থাকলো।
আমি এমন অদ্ভুতভাবে ওকে তাকিয়ে থাকতে দেখে ওর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললাম,
‘ক-কী হয়েছে, বড় ভাই?’
প্রণব আমার কথায় হুশে ফিরলো। কিছুক্ষণ ওভাবেই অপ্রস্তুত অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকলো। কিছু একটার জন্য বেশ উশখুশ করছে প্রণব। ওর দৃষ্টি ও হাবভাবও অস্থির। হুট করেই প্রণব আমাকে চমকে দিয়ে আমার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো। পেছন লুকোনো হাত দু’টো আমার সম্মুখে নিয়ে আসতেই দেখলাম এক গুচ্ছ কচুরিপানার ফুল।
আমি বড্ড অবাক হলাম ফুলগুলো দেখে। এগুলো আমার প্রচন্ড পছন্দের ফুল। ছোটবেলায় পুকুরের মধ্যে ফুলগুলো দেখলেই পাগল হয়ে যেতাম। সেই ফুলগুলো হাতেই আজ প্রণব আমার সামনে। প্রণবের এমন কান্ডেও কতো যে আশ্চর্য হয়েছি, তা জানা নেই আমার। কিছুক্ষণ নীরবতার পর বেশ সাহস সঞ্চয় করেই প্রণব বলতে থাকলো,
‘দিবা,
মিসেস প্রণব হবে?
কথা দিচ্ছি, সবসময় নিজের করেই আগলে রাখবো।
ভালোবাসবো, হৃদয়ে জড়িয়ে রাখবো।
আমি.. আমি জানি না, মানুষ কীভাবে প্রেমে পড়ে;
বা কেমন করে কাউকে ভালোবাসে।
কিন্তু আমি হয়তো.. অজান্তেই পড়ে গেছি,
তোমার চাঞ্চল্যের প্রেমে,
তোমার দুষ্টুমিষ্টি মন ও স্বভাবের প্রেমে।
কীভাবে যেন ভালোবেসে ফেলেছি,
নিজেই সেই ধাঁধার সমাধান খুঁজে পাই না।
আমার জীবনটা সুন্দর অবশ্যই,
আমি তোমার দেখা পেয়েছি,
তোমাকে অনুভব করেছি;
এই জীবনের প্রত্যেকটা মুহুর্তই আরও রঙিন হউক,
আর সেজন্য আমার তুমি এবং
তোমার ভালোবাসাই চাই।
শুধু তোমার.. হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা!
আমি তোমাকে চাই।
তোমার সুখ-দুঃখ সবকিছু চাই।
বিয়ে করবে আমায়?’
প্রণবের ভালোবাসা নিবেদনে আমি একদম হতবাক হয়ে গেছি। আচ্ছা এটা কি বাস্তব? নাকি ঐদিনের মতোই স্বপ্ন দেখছি? আমি কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না। মূর্তির মতো ঠায় দাঁড়িয়ে আছি। চোখের পলকটুকুও পড়ছে না। প্রণব আবারও বললো,
‘তুমি কি আমার হবে?’
আমি যেন সত্যিই স্বপ্ন দেখছি৷ চারপাশ আলোয় ঝলমল করছে মনে হচ্ছে। আর উড়াউড়ি করছে শত শত রঙিন প্রজাপতি। তাদের ডানায় ডানায় শুধু ভালোবাসার ছড়াছড়ি। এমনটাই বোধ হচ্ছে আমার। প্রণবের ঠোঁট ও চোখের পাতা ক্রমাগত কাঁপছে। কন্ঠটাও কেমন লাগছে। সে আবারও জবাব চাইলো,
‘করবে বিয়ে?’
আমি আর নিজেকে আটকে রাখতে পারলাম না। আমিও তো মনে মনে প্রণবের ভালোবাসাই চাচ্ছিলাম। হাবুডুবু খাচ্ছিলাম ওর প্রেমে। ওর ভালোবাসাতেই ডুবে মরতে চাই আমি। ধীরে ধীরে হাত বাড়িয়ে প্রণবের হাতের ফুলটা গ্রহণ করে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লাম আমি। সাথে সাথেই প্রণবের বন্ধুবান্ধবের করতালি শুনতে পেলাম। সবাই হৈ হুল্লোড় করছে। যেন প্রণব কোনো যুদ্ধ জয় করে ফেলেছে।
আমি প্রণবের চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করলাম,
‘এসব কি সত্যিই সত্যি?’
প্রণব হাসিমুখে মাথা নাড়লো,
‘শতভাগ সত্যি।’
আনন্দে আত্মহারা আমি। চরম খুশিতে নিজেকে শান্ত করছে পারছি না। ওকে জিজ্ঞেস করলাম,
‘এজন্যই দেখা করতে বলেছিলেন?’
প্রণব হেসে মাথা চুলকে বললো,
‘না আসলে আমার কোনো পরিকল্পনাই ছিলো না, এসব বলার। তবে যা যা বলেছি, সব মন থেকেই কিন্তু। আজ.. সকালেই.. হঠাৎ ইচ্ছে হলো, আজকেই তোমাকে মনের কথা বলে দেবো। তারপর যা আছে, কপালে! তো.. তারপরেই.. এই তো বলে দিলাম।’
আমি লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে হাসলাম। তারপর আবার প্রশ্ন করলাম,
‘তাহলে এমনিতে ডেকেছিলেন কেন?’
প্রণব বললো,
‘এমনিতেই। তোমায় ক্ষ্যাপাতে ভালো লাগে, তাই আর কি। ইচ্ছে করেই ডাকতাম। বিরক্ত করতে ভালো লাগতো। এই যেমন, ইচ্ছে করেই প্রতিবার জিজ্ঞেস করতাম- তোমার নাম কী যেন?’
বলেই খিলখিল করে হেসে উঠলো প্রণব। আমি বাচ্চাদের মতো প্রণবের উদ্দেশ্যে বললাম,
‘আপনি বড্ড পাজি। বড্ড বেশি।’
প্রণব হাসলো। একটু বাদেই ওর ডান বাহুটা হেলিয়ে আমার দিকে অগ্রসর করে বললো,
‘চলো তবে, হাঁটি একটু?’
আমি হেসে ওর বাহুটা জড়িয়ে ধরে এগিয়ে গেলাম পছন্দের সেই পুকুর পাড়ের দিকে। দু’জনে হাঁটছি আর এতো এতো মনের জমে থাকা কথাগুলো প্রকাশ করছি। কতো কাহিনী পেরিয়ে ভালোবাসার সূত্র ধরে দু’জন দিনশেষে, পরস্পরেরই হয়ে গেলাম।
আজকের সকালটা আমার জীবনে এমন দারুণ কিছুর সূচনা করে দেবে, বুঝতেও পারিনি। গিয়েই সব দিয়ার সাথে শেয়ার করতে হবে। সত্যিই, আচমকা এতো সুন্দর একটা ঘটনার জন্য সত্যি প্রস্তুত ছিলাম না। তবে আমি মাত্রাতিরিক্ত খুশি। ধন্য আমি, নিজের মনের মানুষটাকে পেয়ে। এমন রাজকপাল ক’জনের বা থাকে? অশেষ কৃতজ্ঞতা আল্লাহর প্রতি।
আমাদের হাঁটার মাঝখানেই হঠাৎ প্রণব আমার চুলের দিকে তাকিয়ে বললো,
‘এই তুমি আজ বিনুনি করে এসেছো?’
আমি ওর এমন কথায় অদ্ভুতভাবেই হেসে মাথা নাড়লাম,
‘হ্যাঁ তো। কেন?’
‘দাঁড়াও, দাঁড়াও।’
বলেই প্রণব ছুটে একধার থেকে কিছু ছোট ছোট বুনো ফুল কুড়িয়ে নিয়ে এলো।
ফুলগুলোর নাম জানি না আমি। প্রণবও বলতে পারবে না হয়তো৷ ও ফুলগুলো নিয়ে এসেই আমাকে পেছন ঘুরে দাঁড়াতে বললো। তারপর ও নিজ হাতে আমার বিনুনির ফাঁকে ফাঁকে বুনো ফুলগুলো গুজে দিয়ে বললো,
‘আহ! তোমার চুলে ফুলগুলো কত্ত সুন্দর লাগছে!’
ওর পাগলামি দেখে বেশ হাসলাম আমি।
বড্ড সুখী সুখী মনে হচ্ছে নিজেদের। প্রণবের ভালোবাসা এভাবেই আমায় আজীবন ঘিরে থাকুক। আমিও আগলে রাখবো আমার খেয়াল, যত্ন ও ভালোবাসায়। দুই সদ্যোজাত কপোত-কপোতীর মতোই ক্যাম্পাসের মধ্যে প্রেমালাপ করে পায়চারি করছি আর প্রণয়ের শুরু নিয়ে সীমাহীন ভালোবাসা বিনিময় করছি আমরা।
.
.
(সমাপ্ত)