#রঙিন_প্রজাপতি
লেখনীতে – Ifra Chowdhury
পর্ব- ৩
.
শাস্তির কথা শুনেই আমার গলা শুকিয়ে গেল। প্রণব বলতে লাগলো,
‘তুমি দুই পা একসাথে রেখে জোড় লাফ দিয়ে দিয়ে পুরো ভার্সিটি তিনবার চক্কর দেবে। এইটাই তোমার শাস্তি! চলো, তাড়াতাড়ি শুরু করো।’
আমি বেকুবের মতো হা হয়ে রইলাম। আমি এই রোদের মধ্যে ক্লান্ত শরীর পুরো ভার্সিটি চক্কর দেবো? তাও তিন-তিন বার? আল্লাহ! তার উপর আবার ব্যাঙের মতো লাফ দিয়ে দিয়ে..
আমি কথাটা শোনামাত্রই নেতিয়ে গেলাম। ওরা সবাই আবার চেচিয়ে উঠলো,
‘এই যাও না তুমি? জলদি শুরু করো।’
প্রণব যোগ দিলো,
‘এখান থেকেই শুরু করো। প্রতিবার পুরো ভার্সিটি রাউন্ড দিয়ে আবার এখানে এলে এক চক্কর ধরা হবে। নাও, রেডি!’
চারপাশে অনেকেই তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে। কয়েকজন দূর থেকে ঠায় দাঁড়িয়ে দাড়িয়ে মজা নিচ্ছে এবং অন্যেরা তো কৌশলে আসা যাওয়া করছে, আর আড়চোখে দেখছে ও হাসছে।
আমার মেজাজটা খুব বিগড়ে গেছে। কিন্তু ওদের এই ভারী দলের সামনে একা বিরোধিতা করার, বা মুখের উপর না বলার সাহস পাচ্ছি না আমি। তাই বাধ্য হয়ে শাস্তিটা মেনেই নিতে হলো।
ধ্যাৎ! এত্তো র্যাগ খেতে হবে জানলে প্রথম দিন থেকেই ওদের থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলতাম।
আমি আস্তে আস্তে দুই পা একসাথে রেখে জাম্প দিয়ে দিয়ে এগোতে শুরু করলাম। চট করে সেদিনের মতো একটা প্ল্যানও চলে আসলো মাথায়। বেশ কিছুটা সুন্দরভাবে এগিয়ে গিয়েও হুট করে স্লিপ খাওয়ার ভাব ধরে পড়ে গেলাম আমি। গতমাসেই এই জায়গাটা পিচ করা হয়েছিলো সম্ভবত। তো এখানে এভাবে হুট করে পড়ে যাওয়ার কারণে আমার ডান হাতের কনুইটা বেশ ছিলেও গেল। রক্ত ঝরছে। আমি কেঁদে উঠলাম।
প্রণবেরা সবাই দ্রুত আমার দিকে এগিয়ে এলো। সেই সাথে এগিয়ে এলো আরও একজন। আমার নতুন বান্ধবী, মুমু। ও-ই তখন আমার নাম ধরে পেছন থেকে ডেকেছিলো। ও ছুটে এসে আমাকে আগলে ধরে ওদেরকে বলতে লাগলো,
‘দিলে তো মেয়েটাকে ব্যাথা পাইয়ে! এখন খুশি তো তোমরা? ইশশ! দিবার এমনিতেই একটু শরীর খারাপ বলছিলো। যার জন্য সব ক্লাস না করেই বাসায় ফিরে যাচ্ছিলো। আর তোমরা ওকে এই রোদের মধ্যে এভাবে…’
মুমু আর কিছু বলার আগেই প্রণবের বন্ধু সুদীপ্ত বলে উঠলো,
‘আমরা কি জানতাম নাকি?’
সবাই বেশ হকচকিয়ে গেছে। প্রণব সবাইকে সামলে নেওয়ার পুরো চেষ্টা করলো এবং ওর কয়েকজন বন্ধুকে দ্রুত ফার্স্ট এইড বক্স নিয়ে আসারও আদেশ দিলো। ওরা হন্তদন্ত হয়ে ফার্স্ট এইড বক্স নিয়ে আসলো।
মুমু নিজেই আমাকে ড্রেসিং করে দিতে চাচ্ছিলো। কিন্তু প্রণব মুমুকে কিছু করতে না দিয়ে নিজেই ওর ড্রেসিং করে দিলো। ওকে বেশ চিন্তিত দেখা যাচ্ছে। ওর চারপাশের বন্ধুদেরও একই অবস্থা। ভেতর ভেতর সবাই চুপসে গেছে বোধহয়, অথচ বাইরে বাইরে ঠিকই নিজেদের ঠাট বজায় রাখার চেষ্টা করছে।
আমার তো বেশ মজা লাগছে এসব দেখে। পড়ে যাওয়ার ভান করতে গিয়ে সত্যি সত্যিই ব্যাথা পেয়েছি ঠিক, কিন্তু ব্যাপার না; এটা সইয়ে নেওয়া যাবে। অন্তত এই কঠিন শাস্তিটা থেকে তো মুক্তি পাওয়া গেলো! আর সবচেয়ে বড় কথা, ওরা আমাকে হেনস্তা করতে গিয়ে নিজেরাই এভাবে জব্দ হয়ে গেল!
মনে মনে বেশ হাসছি আমি। কিন্তু বাইরে বাইরে ঠিকই ব্যাথার জন্য ককিয়ে যাচ্ছিলাম আমি। উঠেও দাঁড়াতে পারছিলাম না, এমন ভাব ধরলাম! অতঃপর সাবধানে দেখেশুনে বাড়ি পৌছে দেওয়ার জন্য মুমু আর আমাকে এক সিএনজি রিজার্ভও করে দেওয়া হলো।
পরে সব খুলে বলার পর মুমুর কী হাসি! দুজনেই সিএনজিতে আড্ডা দিতে দিতে বাড়ি ফিরছি আর ভার্সিটির কাহিনীগুলো মনে করে মারাত্মক মজা নিচ্ছি।
________________________________
পরদিন ভার্সিটিতে গিয়েই দেখি প্রণবেরা পাউরুটি আর কলা খাচ্ছে। কয়েকজন খাচ্ছে না অবশ্য, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আড্ডা দিচ্ছে। ব্রেকফাস্ট সারছে হয়তো। এনার্জী জমা করতে হবে তো ওদের, নাহলে অন্যদের জ্বালাবে কীভাবে? হনুমান কোথাকার!
আমি গোপনে মুখ ভেংচিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে চাচ্ছিলাম। হুট করেই মাথায় একটা বুদ্ধি এলো। ক্যান্টিনে গিয়ে আমিও একটা কলা কিনে আনলাম। দ্রুত কলাটা শেষ করে খোসাটা ওদের পাশেই একটা নির্দিষ্ট জায়গায় ফেলে দিলাম। আর এমন সচেতন হয়ে কাজটা করলাম, যাতে কেউ দেখতে বা বুঝতে না পারে।
প্রথম ধাপ শেষ, এখন দ্বিতীয় ও শেষ ধাপটা বাকি।
গতদিনের মতো আজকেও আবার প্রণবদের কাছে গিয়ে ‘বড় ভাই, বড় ভাই’ করতে লাগলাম। সব্বাইকে সালাম দেওয়া শেষ হলেই প্রণবের উদ্দেশ্যে বললাম,
‘বড় ভাই, বড় ভাই, আজকে আপনাকে সেলফি তুলতেই হবে। প্লিজ, প্লিজ।’
প্রণব বললো,
‘হ্যাঁ আর গতকালের মতো তুমি আবার কোনো কেলেঙ্কারী বাধাও।’
আমি ফোন আর দাঁত বের করে অপ্রস্তুত হেসে বললাম,
‘আরে না বড় ভাই, গতকাল তো ক্লাসের তাড়া ছিলো। তাই আর কি.. কি-কিন্তু.. কিন্তু আজ আর এমন হবে না ভাই। আসুন না প্লিজ?’
প্রণব আমার জোরাজুরিতে রাজী হয়ে গেলো। ও ওর বন্ধুদের সাথে দাঁড়িয়েই সেলফি তোলার জন্য রেডি হয়ে আছে। কিন্তু এখানে তুললে তো হবে না। আমি বলতে লাগলাম,
‘ভাই, ভাই, এখানে না। এখানে ভালো পিক আসবে না। আর ব্যাকগ্রাউন্ডও ভালো না তো। আসুন আমরা একটু এদিকে পিক তুলি।’
প্রণব অনিচ্ছাসত্ত্বেও এদিকে এগিয়ে এলো। আমি আড়চোখে কলার খোসাটা কোথায় আছে, একনজর দেখে নিলাম। তারপর হিসেব করে কলার খোসাটার ঠিক কয়েক পা সামনে দাঁড়িয়েই প্রণবকে বললাম,
‘ভাই, আসুন, আসুন, হাসি দিন।’
আমি প্রণবের দিকে বেশ খানিকটা দূরত্বে মোবাইল নিয়ে সেলফি তোলার জন্য তৈরি ছিলাম। তাই প্রণবও এদিকে এগিয়ে আসার জন্য পা বাড়ালো। যেই না প্রণব কয়েক পা বাড়ালো, তখনি ধপাস করে কলার খোসায় স্লিপ খেয়ে বেসামাল হয়ে পড়ে গেল প্রণব। ও চেঁচিয়ে উঠলো৷ ওর বন্ধুরা সব দৌড়ে আসলো।
প্রণবের পড়ে যাওয়ার দৃশ্যটা দেখে বড্ড হাসি পেয়ে গেল আমার। কিন্তু হাসতে পারছি না! নাহলে ধরা পড়ে যাই যদি? বা আবার যদি র্যাগ দেয়? তাই হাসিটা চেপে রেখেই আমিও ওদের দিকে এগিয়ে গেলাম,
‘কী হয়েছে বড় ভাই? হঠাৎ পড়ে গেলেন কীভাবে? জায়গাটা তো পিচ্ছিলও না। তবে কী হলো?’
প্রণব দাঁত কিড়মিড় করে কলার খোসাটা দেখিয়ে প্রশ্ন করলো,
‘এটা কে ফেলেছে এখানে?’
আমি চোখ বড় বড় করে বললাম,
‘ওমা! কলার খোসা? আল্লাহ! আপনার বন্ধুরাই তো কলা খাচ্ছিলো। ওরাই ফেলেছে হয়তো।’
আমার কথাটা শুনে ওদের সবার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল। হয়তো ওরা সবাই বিভ্রান্ত হয়ে পড়লো। বেচারাদের মুখগুলো দেখে আবারও পেট ফেটে হাসি পাচ্ছে আমার। কিন্তু আমার মুখ বন্ধ! নিজেকে খুব কষ্ট সামলাচ্ছি।
ওদিকে প্রণব তো রীতিমতো বন্ধুদের উপর চিল্লাচিল্লি শুরু করে দিয়েছে। কেয়ারলেস সব্বাই, দেখেশুনে চলতে পারে না, এখানে সেখানে কলার খোসা ফেলে দেয়, কান্ডজ্ঞান নেই নাকি, হ্যান ত্যান কত্ত কী!
আমি তো মনে মনে মজা নিতেই ব্যস্ত। অতঃপর ওদের মাঝখানে আর ভাব ধরে দাঁড়িয়ে না থেকে ধীরে ধীরে কেটে পড়লাম। তারপর মাঝপথে মুমুকে পেয়ে সব কথা বলছি আর হাসতে হাসতে দু’জন ক্লাসের দিকে যাচ্ছি।
______________________________
আজ ক্লাস থেকে বের হওয়ার পথেই কেউ একজন আমার পথ আটকে দাঁড়ালো। আমি মাথা তুলে তাকাতেই দেখলাম আরিশা দাঁড়িয়ে আছে। ও কেন হঠাৎ আমার পথ আটকালো, ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না। আমি কিছুটা ভ্রু কুচকে তাকালাম।
আরিশা রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে ঝাঁঝালো কন্ঠে আমায় বলতে লাগলো,
‘এই মেয়ে, তোমার সাহস তো কম নয়! তুমি আমার বয়ফ্রেন্ডের সাথে সেলফি তুলতে যাও! তুমি জানো, এই তল্লাটে এমন কোনো মেয়ে নেই, যে আমাকে টপকে আমার প্রণবের সাথে লাইন মারতে যাবে। আর সেই তুমি কিনা হুট করে উড়ে এসে জুড়ে বসতে চাইছো?’
আরিশা রীতিমতো আমার দিকে আঙুল তুলে ধমকানো শুরু করলো। আমি হা হয়ে ওসব হালকা পাতলা শুনছি আর ভাবছি,
‘উড়ে এসে জুড়ে বসবো মানে? আমি কি ঐ প্রণবের উপর নজর দিয়েছি নাকি? ইয়াক! ঐ গুন্ডার সাথে মেয়েরা আবার লাইনও মারতে চায়? কী হাস্যকর! আমি তো শুধুই বদলা নেওয়ার জন্য এতো জ্বালাতে চাইছি ওদের। আর তো কিছুই না!’
আমি চুপচাপ আনমনা হয়ে দাঁড়িয়ে আছি দেখে জোরে একটা হুংকার ছাড়লো আরিশা,
‘এই! কথা কি কানে যাচ্ছে না?’
আমি কিছুটা চমকে উঠে নিজের হুশে ফিরলাম। তারপর কাচুমাচু হয়ে বলতে লাগলাম,
‘এ কী বলছেন আপু? আপনার বয়ফ্রেন্ড তো আমার বড় ভাই। আপনি অযথাই ভুল বুঝছেন আপু।’
আরিশা ওর চোখ দুটো যেন রসগোল্লার মতোই বড় বড় করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ওর ভাবসাবও পুরো প্রণবেরই মতো। যেমন গুন্ডা, তেমন গুন্ডী! একদম মিলেছে দু’টোতে।
আমি মনে মনে নাক শিটকাচ্ছি আর ভাবছি এসব। আবারও একটা জোরে ধমক দিয়ে উঠলো আরিশা,
‘চুপ! আর কোনোদিন যদি তোমাকে প্রণবের আশেপাশে দেখেছি, তো তোমার একদিন কি আমার একদিন!’
কথাটা বলেই আরিশা রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে চলে গেল। আমি প্রথমে বেকুবের মতো ঠায় দাঁড়িয়ে থাকলেও, পরবর্তীতে একটা জিনিস ভেবেই মনে মনে পৈশাচিক হাসি দিয়ে উঠলাম।
এই আরিশার জন্যই তো ঐদিন কোনো দোষ না করেও সবার সামনে কেমন অপদস্ত হতে হয়েছিল। সবকিছুর মূলে সেই প্রণব আর আরিশা! এবার তাহলে ওদের দু’জনকেই এক অভিনব কৌশলে ঘায়েল করবো আমি।
ব্যাপারটা ভেবে নিজেই নিজেকে বাহবা দিতে লাগলাম,
‘আহ দিবা, তুসি গ্রেট হো!’
তারপর ফুরফুরে মেজাজে পা চালিয়ে নিজের মতো চলে এলাম।
.
.
চলবে..