রঙিন প্রজাপতি পর্ব ৪

#রঙিন_প্রজাপতি
লেখনীতে – Ifra Chowdhury

পর্ব- ৪
.
ভার্সিটিতে ঢুকেই প্রণবদের খুঁজতে লাগলাম আমি। এদিক ওদিক তাকাচ্ছি, তখন হুট করে কেউ একজন আমার মাথায় গাট্টা মেরে বললো,
‘এই, এমন চাতক পাখির মতো উঁকিঝুকি মেরে কাকে খুঁজছিস?’
আমি ব্যাথায় হালকা কাতরে উঠলাম। তাকিয়ে দেখলাম শুভ হেসে হেসে একটা চোখ মারলো আমায়।

আমি কিছুটা আহ্লাদী হয়ে বললাম,
‘উফ শুভর শুভ! তোকে কতদিন বলেছি এভাবে হুট করে পেছন থেকে মাথায় আঘাত টাঘাত করবি না; যতই হালকাভাবেই হউক। শয়তান! আমার ব্যাথা লাগে।’
শুভ দাঁত কেলিয়ে বলতে লাগলো,
‘বেশ করেছে মেরেছি! আরও একশো বার করবো। তোর কী?’

আমি শুভর কথার আর জবাব দিলাম না। বিরক্তের সহিত এদিক ওদিক তাকাতে লাগলাম। শুভ আবারও আমায় জিজ্ঞেস করলো,
‘কাকে খুঁজছিস বলবি তো? মুমুকে নাকি? নাকি নন্দিতাকে? ওরা তো এখনো আসেনি।’
আমি শুভকে থামিয়ে দিয়ে বললাম,
‘আরে না ওদের না। আমাদের ভার্সিটির ফ্রি গুন্ডাগুলোকে খুঁজছিলাম।’
‘প্রণব ভাইয়াদের খুঁজছিস তুই?’
‘জি হ্যাঁ। বেশি কথা না বলে তুইও খোঁজে দেখ্ তো, যা।’

শুভ বলে উঠলো,
‘আরে খুঁজতে হবে না। আমি ওদের মাত্রই পুকুর পাড়ের দিকে দেখে এসেছি। কিন্তু তোর কী দরকার ওদের দিয়ে?’
আমি ভ্রু নাচিয়ে একটা রহস্যময় হাসি দিলাম। তারপর বললাম,
‘কথা না বলে চল্ আমার সাথে। যদি দেখতে চাস আর কি, কী দরকার।’
শুভ কিছু একটা ভেবে নিয়ে বললো,
‘আচ্ছা চল্।’

আমরা দুজনেই পুকুর পাড়ের দিকে রওনা হলাম। সেই সাথে হঠাৎ অনন্যাও দৌড়তে দৌড়তে এসে আমাদের সাথে যুক্ত হলো। ও এসেই আমাকে একটা মিষ্টির প্যাকেটের মতো বক্স ধরিয়ে দিয়ে বললো,
‘দিবা, নে। তোর কাজ হয়ে গেছে।’
বলেই দাঁত বের করে একটা হাসি দিলো। তারপর দু’জনেই হেসে একটা হাগ করলাম। শুভ কিছু বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করলো,
‘কী রে, তোদের কি ঈদ লাগলো নাকি? কী হয়েছে হঠাৎ, বল্ তো?’
‘পরে বলবো। চল্ এখন।’
তারপর শুভকে সামলে তিনজনই প্রণবের দলের উদ্দেশ্যে হাঁটা ধরলাম।

আজ তো হবেই কিছু একটা!
আহা! ভাবলেই মনটা নেচে নেচে উঠছে আমার।

______________________

আমরা সবাই পুকুরপাড়ে পৌঁছে দূর থেকেই দেখতে পেলাম, প্রণব আর আরিশার মধ্যে হয়তো কথা কাটাকাটি চলছে। আর রোজকার মতো আজও ওদের বন্ধুরা নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে।

অনন্যা বলে উঠলো,
‘দেখ্, প্রণবের চেলাগুলো কীভাবে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। যেন ভাজা মাছটাও উলটে খেতে জানে না। প্রণব আর আরিশার ঝগড়া হলে এমনি চুপসে থাকে ওরা। অথচ এখন যদি অন্য কেউ হতো, দেখতি ওদেরও কেমন গলার জোর!’

আমরা তিনজনই দূর থেকে দাঁড়িয়ে নিজেদের মধ্যে ওদের নিয়ে কথা বলছি। কিন্তু কেউই আর এগোচ্ছি না ওদের দিকে। শুভ প্রশ্ন করলো,
‘কী রে, তোরা কি এখানে দাঁড়িয়ে ওদের ঝগড়া দেখতে এসেছিস? আর ওরা ঝগড়াই-বা করছে কেন?’
অনন্যা শুভর বাহুতে একটা থাপ্পড় মেরে বললো,
‘আরে ব্যাটা চুপ থাক্ না? দেখতে থাক্ এখন।’

আমরা ওদের কথা শোনার জন্য কিছুটা সাইডে এগিয়ে গেলাম। আর এমন ভাব ধরলাম যেন আমরা নিজেদের মধ্যেই কথা বলছি, প্রণবদের দিকে তাকাচ্ছিও না। এমনকি যেন বুঝতেও পারছি না ওদের মধ্যে কী হচ্ছে, না হচ্ছে। অবশ্য আমরা এমনভাবেও অবস্থান নিয়েছি, যাতে প্রণবেরা আমাদের খেয়ালও না করে।
যাকগে!

আমরা এখন স্পষ্ট প্রণবের গলা শুনতে পাচ্ছি। ও বেশ রেগেমেগে কথাগুলো বলছে,
‘আরিশা শোন্, তুই আমার বেস্ট ফ্রেন্ড বা গার্লফ্রেন্ড, দুইটাই ঠিক আছে। কিন্তু তাই বলে এই না যে তুই এভাবে মজা করবি! তুই জানিস আমার লিভারে সমস্যা। ঝাল টাল সবসময় এড়িয়ে চলি আমি। আর তুই এইটা নিয়েই এমন মজা করলি? ইট’স নট ফেয়ার, ইয়ার! ইট’স নট ফেয়ার।’

আরিশার পাল্টা জবাব,
‘শাট আপ প্রণব! আমি সব জানি তোর কিসে কী সমস্যা। তাও আমি এমন মজা করবো, তোর বিশ্বাস হয়? আমি এটা করিনি বিশ্বাস কর্। কীভাবে এটা এলো, কিছুই জানি না।’
প্রণব সোহাগের হাত থেকে বোতলটা কেড়ে ঢকঢক করে পানি খাচ্ছে। খুব তাড়াহুড়োও করেই পান করছে বিধায় অনেকটা পানিই প্রণবের চিবুক, গলা বেয়ে শার্টটাও ভিজে যাচ্ছে।

প্রণব একটানে বোতলের সবটুকু পানি শেষ করে জবাব দিলো,
‘তো এটা না বিশ্বাস করার কী হলো? আর তুই সব জানিস তো কী হয়েছে? তুই সব জেনেশুনেও তো কয়েকদিন আগে আমার বার্থডেতে আমার মাথায় ডিম ফাটিয়েছিলি, গালে মুখে কেক ক্রিম মাখিয়েছিলি। যেখানে এসবের কিছুই আমার পছন্দ না। আর সব থেকে বড় কথা, তুই জানতিস আমি ঐদিন গোসল করে এসেছিলাম, তো এসবের পর আবার যখন সেকেন্ড টাইম গোসল করবো, নিশ্চিত আমার ঠান্ডা লাগবেই। আর এটাই হয়েছিলো। দুইদিন এই ঠান্ডায় ভুগেছি আমি। দুইদিন।’

আরিশা অস্থিরভাবে বললো,
‘আরে ওটাও তো মাস্তি ছিলো ইয়ার। তুই আমাকে ভুল বুঝছিস।’
‘হ্যাঁ আর এটাও ঠিক তেমনই মজা করলি তুই। ভুল বোঝার কিছুই হয়নি আরিশা। বাদ দে। কিছু বলার ভাষা নেই আমার।’
‘উফফ প্রণব! বড্ড বাড়াবাড়ি করছিস তুই। আমি এত্তভাবে বলছি, তাও তুই বিশ্বাস করছিস না?’
‘তুই নিজেও বাড়াবাড়ি করছিস। চুপ থাক্।’

প্রণব আর আরিশার কথার মাঝখানে হঠাৎ সোহাগেরও গলা শোনা যায়। ও প্রণবকে উদ্দেশ্য করে বলছে,
‘দোস্ত, আরিশা যখন বলছে এভাবে, যে ও এটা রাখেনি। তবে তুই আবার…’
সোহাগ ওর কথা সম্পূর্ণ করার আগেই প্রণব ধমকে উঠলো,
‘তোকে বলেছি আমাদের মধ্যে কথা বলার জন্য?’
তারপর আবার বিড়বিড় করে বলতে লাগলো,
‘স্টুপিড কোথাকার। সবগুলাই এক কিসিমের। যত্তসব!’

অতঃপর আর কোনো কথা না বাড়িয়ে রাগে প্রণব একাই হনহন করে সেখানে থেকে অন্যদিকে চলে গেল।

___________________________

প্রণব চলে যাওয়ার পর আমরাও নিজেদের মতো কথা বলতে বলতে চলে এলাম৷ ক্লাসের দিকে যাওয়ার পথে শুভ মাথা চুলকে চুলকে প্রশ্ন করলো,
‘সবই তো দেখলাম। কিন্তু ওদের ঝগড়াটা হলো কী নিয়ে?’
অনন্যা আর আমি পুনরায় একযোগে হেসে উঠলাম। শুভ প্রশ্ন করলো,
‘আজব! তোরা হাসছিস কেন এভাবে?’
আমি কোনো উত্তর না দিয়ে অনন্যার দেওয়া বক্সটা শুভর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললাম,
‘নে খা।’

শুভ অবাক হয়ে বক্সটা খুললো। খুলতেই ও হা হয়ে গেলো। খুশিতে বলে উঠলো,
‘আরে পেস্ট্রি কেক! দে দে, সব আমিই খাবো।’
বলেই শুভ পেস্ট্রিগুলোর উপর হামলে পড়লো।
অনন্যা বলতে লাগলো,
‘খা খা। এই পেস্ট্রিই তো প্রণব ভাইয়া আর আরশির ঝগড়ার মূল কারণ।’
শুভ খেতে খেতে ভ্রু কুচকে তাকালো,
‘মানে?’

‘হ্যাঁ রে! এই পেস্ট্রিই তো ওদের ঝগড়া লাগালো।’
বলেই একটা চোখ মারলো অনন্যা। শুভ মুখ বেঁকিয়ে বললো,
‘ধুর তোদের যতো আজব গুজব কথা! পেস্ট্রি আবার ঝগড়া লাগায় ক্যামনে? সর্ তো। খেতে দে।’
এবার আমি বলতে লাগলাম,
‘আজব গুজব না পাগল। সত্যি কথাই। এই পেস্ট্রিকে কলকাঠি বানিয়েই তো ওদের মধ্যে ঝগড়া লাগানোর প্রচেষ্টা করলাম! আর সফলও হলাম।’
বলেই একরকম রহস্যময় দৃষ্টিতে হাসলাম আমি।

শুভ এবার অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
‘কীভাবে?’
আমি বলতে লাগলাম,
‘শোন্ তবে। গতকাল কীভাবে যেন শুনলাম আরিশা রশিদ চাচার কনফেকশনারী থেকে কিছু পেস্ট্রি কেক আনাবে। বেশ স্পেশালি, জাস্ট প্রণবের জন্য। আর সেটাই আজ আরিশা ভার্সিটিতে নিয়েও এলো। এদিকে আমি ও অনন্যাও প্ল্যান করে আরিশা ঠিক যেভাবে যতটা অর্ডার দিয়েছিলো, একদম তেমনই আরেক প্যাকেট পেস্ট্রি অর্ডার দিয়ে নিয়ে এলাম। কিন্তু শুধু একটা স্পেশাল টুইস্ট ছিলো। দুই তিনটা পেস্ট্রির মধ্যে আমরা কৌশলে কয়েকটা মারাত্মক ঝাল প্রকৃতির একটা ছোট্ট কাঁচামরিচ ঢুকিয়ে দিয়েছি। আর অনন্যা ওর এক আপুর সহায়তা নিয়ে সেটা আরিশার প্যাকেটের সাথে বদলেও দিয়েছে। হা হা হা। আর সেটাতেই কেল্লাফতে!’

শুভ চোখ দুটো ছানাবড়া বানিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি মুচকি হেসে আবারও বলতে লাগলাম,
‘তো প্রণব তো ঝাল টাল খায় না। সেটা ঐদিন প্রণবের মুখেই শুনেছিলাম। ও ওর অসুস্থতার জন্য ফুচকা চটপটি এসবও খায় না। সেই সূত্রেই জেনেছি আর কি। এন্ড আজ সেটাকেই কাজে লাগিয়ে প্রণব আর আরিশার মধ্যে একটু ঝগড়া বাধিয়ে দিলাম। প্রণব ভেবে নিলো, আরিশা ইচ্ছে করেই ওকে ঝাল মরিচ খাইয়েছে। বেশ ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে ওদের। দেখলি না কীভাবে কথা কাটাকাটি করছিলো?’

শুভ এবার ফিক করে হেসে দিলো,
‘হ্যাঁ হ্যাঁ দেখলাম। ওরে দিবা, তুই দেখি সত্যিই একটা ধানিলঙ্কা! যা করলি তুই.. হা হা হা!’

শুভর সাথে সাথে তাল মিলিয়ে আমি আর অনন্যাও হাসতে থাকলাম। আর ভাবতে লাগলাম, প্রণব আর আরিশার মধ্যে আবারও কীভাবে ঝগড়া বাঁধানো যায়। ওরা দু’জনই আমার পেছনে লেগেছিলো, এখন তাই আমি নিজেই ওদের শান্তি দেবো না। হুহ! এবার ওরা বুঝবে, দিবাকে র‍্যাগ দিতে চাওয়ার ঠ্যালাটা কী!

_____________________________

আজ দুইটা ক্লাস করেই বেরিয়ে পড়লাম আমি। মুমুরা এখনো ক্লাসেই। আমি একা একাই চলে এলাম। শরীরটা ভালো লাগছে না কয়দিন ধরেই। এক দুই ক্লাস করেই ফাঁকি মারি। আজও তেমনটাই।

একা একা হেলতে দুলতে সিঁড়ি দিয়ে নামছি। আশেপাশে তেমন কাউকে দেখতে পাচ্ছি না। অবশ্য এই সময় এখানটা নীরবই থাকে। সবাই ক্লাসে ব্যস্ত আছে আর আমি ফাঁকিবাজিতে ব্যস্ত!

মাথা নিচু করে ধীরে ধীরে নামছি। হঠাৎ.. কেউ যেন একটা হ্যাচকা টান দিয়ে আমায় সিঁড়ির ওপাশে নিয়ে গেল। বেশ প্রাপ্তবয়স্ক কারোর হাত আমার হাতটা চেপে ধরে আছে। আমি ব্যাথায় কুঁকড়ে উঠবো, তখনি সে অন্য হাতে আমার মুখটাও চেপে ধরলো। আমি মুহুর্তেই অস্থিরভাবে ছটফট করতে শুরু করলাম।
.
.
চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here