রঙিন প্রজাপতি পর্ব ২

#রঙিন_প্রজাপতি
লেখনীতে – Ifra Chowdhury

পর্ব- ২
.
আমরা দুইবোন ঘাপটি মেরে সিঁড়িঘরে লুকিয়ে রইলাম। আর খেয়াল করলাম জানালার কাঁচ ভাঙার শব্দে কেউ একজন তড়িঘড়ি করে ছুটে এলো। ছেলেটার চিৎকার চেঁচামেচি শুনে আমরা নিশ্চিত হলাম, ওটা প্রণবেরই গলা। এহেন কান্ডকারখানা দেখে মুখ টিপে টিপে দুজনেই হাসছিলাম।

ওদিকে প্রণবের উচ্চস্বরে চিল্লাচিল্লি শোনা যাচ্ছে,
‘এই কোন বদমাশ আমার জানালার গ্লাস ভেঙেছিস? হ্যাঁ? সাহস থাকলে সামনে আয়!’
এভাবে বকতে বকতে হঠাৎ থেমে যায় প্রণব। তারপর আবার কাকে যেন বলতে থাকে,
‘এই তুই! তুই ভেঙেছিস? হ্যাঁ তুইই করেছিস এই কাজটা। সেদিন আমি তোর সাইকেল আটকে রেখেছিলাম, সেজন্যই আজ এমন কান্ডটা করলি, তাই না? প্রতিশোধ নিলি? বেয়াদব কোথাকার!’

অপর পাশ থেকে জবাব আসে,
‘না ভাই। সত্যি আমি কিচ্ছু করি নাই। আমি তো বসে বসে একমনে ইউটিউব ঘাটছিলাম। হঠাৎ করে কাচ ভাঙার শব্দে আমি নিজেই কেঁপে উঠি। সত্যি ভাই, আমি কিচ্ছু করি নাই।’
প্রণব হুংকার দিয়ে উঠে,
‘চুপ থাক্! তুই ব্যাটা কতো বড় মিনমিনে শয়তান, আমার বেশ জানা আছে। তোকে তো আমি দেখে নেবোই। দেখিস!’

দিয়া ফিসফিস করে আমার কানে বলে,
‘ওই আপুই, প্রণব ভাইয়া তো থার্ড ফ্লোরের বিল্টু ভাই যে, উনাকে দোষী ভাবছে মেবি।’
ওকে থামিয়ে দিয়ে চাপাস্বরে বললাম,
‘বেশ হয়েছে! কিন্তু তুই কী রে? পাড়ার সব ছেলেকেই চিনিস!’

দিয়া কিছু বলতে যাবে, তখনি আবার প্রণবের গলা শোনা গেল। ঝাড়ু ও বেলচা নিয়ে এসে কাঁচের টুকরোগুলো পরিষ্কার করছে, আর বলছে,
‘ধ্যাৎ! কয়দিন আগেই মাত্র নতুন গ্লাস লাগিয়েছিলাম। আর আজকেই…’

আমরা লুকিয়ে লুকিয়ে ওসব দেখছি আর মজা নিচ্ছি। বারান্দা সাফ হয়ে গেলেই প্রণব সব ডাস্টবিনে ফেলে ভেতরে চলে গেল। সেইসাথে আমি আর দিবাও খোশমেজাজে নিজেদের রুমে পা বাড়ালাম।

_________________________________

পরদিন ভার্সিটি পৌঁছাতেই আবারও ছেলেগুলো আমার সামনে পড়লো। অবশ্য আমিও মনে মনে ওদেরকেই খুজছিলাম। কোনো কৌশলে টাইট দেওয়ার জন্য! ওদের সামনে গিয়ে বলতে থাকলাম,
‘আরে বড় ভাইয়েরা! আসসালামু আলাইকুম।’
হয়তো এভাবে হুট করে এসেই সালাম দিচ্ছি দেখে ছেলেগুলো কেমন যেন ভ্রু কুচকে তাকালো।

ওদের একপাশে প্রণব দাঁড়িয়ে। আমি ওকে উদ্দেশ্য করে বললাম,
‘বড় ভাই, বড় ভাই। দেখুন আমি কত্ত সুন্দর করে সালাম দিলাম, কিন্তু আপনার ছেলেগুলো উত্তরই দিলো না।’
প্রণব হতচকিত হয়ে জিজ্ঞেস করে,
‘আমার ছেলেগুলো মানে?’
একটা ছোট্ট ঢোক গিলে আমতা-আমতা করে জবাব দিলাম,
‘না মানে.. আপনি তো ওদের গুরু। আর তাদের আপনার শিষ্যই মনে হয়। তাই আর কি.. সেই হিসেবেই বললাম।’

প্রণব এ প্রসঙ্গে আর কথা বাড়ায় না। ওর বাকি বন্ধুদের উদ্দেশ্য করে বলে,
‘এই সবাই সালামের জবাব দে।’
তারপর প্রণব নিজেও আমার দিকে তাকিয়ে উত্তর দেয়,
‘ওয়ালাইকুমুস সালাম।’
সাথে সাথে বাকিরাও সালাম আর উত্তর দেয়।

আমি খুশিতে খিলখিলিয়ে হাসলাম। আর প্রণবকে বললাম,
‘আহ বড় ভাই! আপনি খুব ভালো। কতো বুদ্ধিমান আপনি আর আচার ব্যবহারও সুন্দর!’
প্রণব চমকালো কিছুটা। সে কী একটা বলতে যাবে, তার আগেই আমি আবারও বলতে শুরু করলাম,
‘বড় ভাই, বড় ভাই, আমি কি আপনার সাথে একটা সেলফি তুলতে পারি প্লিজ? প্লিজ! প্লিজ! না করবেন না।’

প্রণবের উত্তরের অপেক্ষা না করেই আমি তাড়াহুড়ো করে ব্যাগ থেকে ফোন বের করায় ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। ফোনটা হাতে নিয়ে সেলফি তুলতেও তৈরি হয়ে যাই। ঠিক তখনি আবার ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে ছোটখাটো একটা চিৎকার দিয়ে উঠি,
‘ওহ মাই গড! ১০টা ১০ বেজে গেছে। আমার ক্লাস ধরতে হবে ভাইয়া। সরি ভাইয়া কিছু মনে করবেন না। আমি পরে অবশ্যই এসে সেলফি তুলে নেবো। যাই যাই বড় ভাইয়েরা।’

বলেই কিছুটা দৌড়াতে দৌড়াতেই ওর ক্লাসের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। বেশি ছুটতে গিয়ে একটা মেয়ের সাথে ধাক্কা খেয়ে গেলাম। আর ঐ মেয়েটার বাম হাত থেকে বোতলটাও পড়ে গিয়ে সব পানি গড়িয়ে পড়ে। আমি হন্তদন্ত হয়ে থেমে বোতলটা তুলে দিয়ে দুঃখ প্রকাশ করতে থাকলাম।

মেয়েটা হয়তো প্রচন্ড বিরক্ত হলো। কিন্তু ওকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়েই আমি এক নজর মেয়েটার দিকে তাকিয়ে সরি বলতে বলতে ওখান থেকে প্রস্থান করলাম।

________________________________

তিনটা ক্লাস শেষ করেই আজ বেরিয়ে পড়লাম। খুব খিদে পেয়েছে। হাঁটতে হাঁটতে গিয়ে ক্যান্টিনে গিয়ে হাজির হলাম। তারপর হালকা খিদে মেটানোর জন্য একটা মাফিন কেক কিনে খেলাম।
হুট করে আমার নজর গেলো প্রণবদের দলটার প্রতি। একটা মেয়ে প্রণবের বাম হাত জড়িয়ে ধরে বেশ ঘেষাঘেষি করে গাছতলায় বসে আছে। আর চারপাশে ওর বন্ধুরা ঘিরে সবাই আড্ডা দিচ্ছে।

আমি এখন এমনিতেই বাসায় ফিরে যাবো। তাই আমি মেইন গেইটে যাওয়ার রাস্তাটা ধরে হাঁটছি আর আড়চোখে প্রণবের পাশের মেয়েটাকে দেখার চেষ্টা করছি। কিন্তু মেয়েটাকে পুরোপুরি দেখাই যাচ্ছে না। অবশেষে আমি হাল-ই ছেড়ে দিলাম।

তখনি কেউ একজন সজোরে আমার নাম ধরে ডাকলো। ডাক শুনে আমি পেছন ফিরে তাকালাম। সেই সাথে প্রণবের দলের কয়েকজনও তাকায়। ঠিক তখনি প্রণবের পাশের মেয়েটা উত্তেজিত কন্ঠে বলে উঠে,
‘প্রণব! এই মেয়েটাই! এই মেয়েটাই সকালে আমাকে ধাক্কা মেরেছিলো। আবার কোনোরকম পাত্তাও দিলো না আমাকে! এমনি এমনিই ভাব দেখিয়ে চলে গেল।’

মেয়েটার কথা শুনে আমি পুরো স্তব্ধ হয়ে গেলাম। আর ভাবতে লাগলাম,
‘আরে, এটা তো সেই মেয়েটা, সকালে যে তাড়াহুড়ায় ধাক্কা লেগেছিলো। কিন্তু আমি তো ইচ্ছে করে ধাক্কা দিইনি। আর দিলেও.. সে তো আমার কেউ না, না বন্ধু, না শত্রু। তো কেন লাগতে যাবো আমি ওর সাথে?’

আমি যখন এসব চিন্তায় ব্যস্ত, তখনি প্রণবের বন্ধু আর ঐ মেয়েটা এসে আমাকে ঘিরে ফেললো। ওদের একজন বলতেও লাগলো,
‘এই মেয়ে, তোমার সাহস তো কম না! তুমি আরিশাকে ধাক্কা মেরেছো? তুমি জানো আরিশা কে? আমাদের প্রণব ভাইয়ের গার্লফ্রেন্ড! আর তুমি কিনা তার সাথেই বেয়াদবি করলে?’

ছেলেটার কথা শুনে দিবা পুরো হা হয়ে গেল। এই মেয়েটা প্রণবের গার্লফ্রেন্ড? আরিশা? আমি অবাক হয়ে বড় বড় চোখে মেয়েটার মাথা থেকে পা অবধি পর্যবেক্ষণ করতে থাকি।
মেয়েটা একটা ধমক দিয়ে আমার মনোযোগ ভেঙে বকাঝকা করতে লাগলো। আমি বেশ হকচকিয়ে উঠলাম। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছি আমি।

প্রণব ওর গার্লফ্রেন্ডকে থামিয়ে দিয়ে বলে,
‘তুই শান্ত হ, আরিশা। আমি দেখছি।’
মেয়েটা রাগে চোখ ফিরিয়ে নেয় আমার থেকে।

প্রণব আমার দিকে গম্ভীরভাবে তাকিয়ে বললো,
‘তোমার নাম কী যেন?’
আমি কাচুমাচু হয়ে বললাম,
‘দিবা।’
‘তো দিবা, তুমি কী অপরাধ করেছো, শুনলেই তো। আমার কাছে কোনো অপরাধীর ছাড় নেই। তুমিও ছাড় পাবে না। ছোট হউক বা বড়, অপরাধ যখন করেছো, শাস্তি তোমাকে পেতেই হবে।’

উনার কথা শুনে আমি চমকে উঠলাম। আরে আমি অপরাধ করলাম কই? ভুলে ভুলে ধাক্কা লাগলো, আমি তো জেনেশুনে করিনি। তার জন্য উনি আমাকে অপরাধী বলবেন? না, না।

আমি নিচুস্বরে জবাব দিলাম,
‘বড় ভাই, আমি তো নিজ ইচ্ছায় করিনি। ভুলবশত হয়ে গেছে। অপরাধ না ভাইয়া, ভুল হয়ে গেছে।’

পাশ থেকে একজন ধমক দিয়ে উঠলো,
‘চুপ! প্রণব ভাইয়ের মুখে মুখে কথা? একদম বন্ধ করো মুখ!’
আমি কেঁপে উঠলাম। প্রণব ভাইয়া ইশারায় ঐ ছেলেটাকে থামিয়ে আমায় বলে,
‘যা-ই হউক। ভুল তো ভুলই। শাস্তির জন্য তৈরি হও!’

উনার কথাটা শুনে এবার কান্না পেয়ে যাচ্ছে আমার। চারদিকে কতো মানুষ আড়চোখে দেখছে, আর মজাও নিচ্ছে হয়তো। আর আমি এখানে জেলখাটা আসামীর মতো জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছি।

ভয়ে আমার আত্মারামও খাঁচা ছাড়া হয়ে যাচ্ছে। ওরা সবাই যেভাবে ঝেকে ধরেছে আমায়, না জানি কী থেকে কী শাস্তি দেয়! ব্যাপারটা ভেবেই বুকটা ধকধক করে কাঁপছে আমার।
.
.
চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here