#রঙ_বেরঙের_খেলা
#আলিশা
#পর্ব_১৬
সাঁঝ নেমে এলো। সভ্যর ঘুরঘুর করতে হচ্ছে সাবিহার পেছন পেছন। মিনিট বিশেক পেরোতে না পেরোতেই সাবিহার কাছে গিয়ে বার্তা জানার আশায় বলতে হচ্ছে, ‘খারাপ লাগছে? কিন্তু খাবে? বমি আসছে কি?’ রকমের মতো আরো নানান প্রশ্ন। সাবিহা গুমোট মুখে প্রতিবারই নির্বাকে মাথা নাড়ে। সভ্যর উপর তার অভিমান। সভ্য সে অভিমান বোঝে কিনা কে জানে? তবে এই মুহূর্তে সে নিজ ইচ্ছায় সাবিহাকে ভাত খাইয়ে দিতে খাবার টেবিলে এনে বসিয়ে দিয়েছে। সাবিহা নিশ্চুপে বসে সভ্যর কর্ম দেখছে। সভ্য প্লেট সাজায় খাবারে। সাবিহা আড় চোখে পরখ করে।
— নাও।
টেবিলে মৃদু শব্দে খাবার ভর্তি প্লেট রেখে সভ্য বলে উঠলো। সাবিহার মনঃক্ষুণ্ন হলো। ভেবেছিল সভ্য তাকে তুলে খাওয়াবে। কিন্তু সে তো বিরস মুখে শুধু খাবার গরম করে দিলো। সাবিহা ভার হওয়া মন নিয়ে আড় চোখে একবার সভ্যর পানে চাইলো। সভ্য পানি পান করে। গ্লাস তার মুখের অর্ধাংশ ঢেকে রাখায় সাবিহার দেখায় ব্যাঘাত ঘটলো। সভ্য পানির গ্লাস টেবিলের উপর রেখে বলল
— তুমি খাও। আমি একটু আসছি।
সাবিহা মাথা নাড়িয়ে সাই দিতেই সভ্য অহেতুক মুচকি হাসিতে ঠোঁট প্রসারিত করে প্রস্থান করলো। সাবিহাও অপ্রস্তুত হাসলো। দু’জনের সৌজন্যমূলক হাসি। সভ্য যখন পুরোপুরি ড্রইং রুম ছেড়ে তার রুমে প্রবেশ করলো তখন সাবিহা এক ভয়ঙ্কর, অবিশ্বাস্য ইচ্ছা মনের মাঝে অনুভব করলো। পানি পিপাসা পেয়েছে তার। তা পাওয়ারই কথা। মানব জাতির পানি পিপাসা লাগবে, গলা শুকিয়ে এই গরমে কাঠ হয়ে যাবে। এমনকি জল ঘাটতিতে গলা ফেটে চৌচিরও হয়ে যেতে পারে। দোষের কোনো ছিটেফোঁটা নেই এহেন কর্মে। তবে সভ্যর এঁটো পানিতে কেন নজর যাচ্ছে সাবিহার? সাম্য, সন্ধ্যার বাবা যেথায় ঠোঁট লাগিয়ে পানি পান করে তৃষ্ণা নিবারণ করলো সেথায় কেন সাবিহার মন পরে আছে? এ কেমন বাসনা? আনচান আনচান করছে যে মন। বুকের অবাধ্য বেয়ারা হৃদপিণ্ড ক্ষণে ক্ষণে লাফিয়ে উঠছে তুমুল গতিতে। ইশ! মন বড্ড বেপরোয়া জিনিস। যার বুকে তার কাটে মাসের পর মাস তার কথাকেই করে না মান্য। সাবিহার ভাবনা উথাল পাথাল। এই উথাল পাথাল ভাবনার মাঝে হুট করে সাবিহার মনে হলো, মনের ইচ্ছে অপূর্ণ রাখতে নেই যদিনা তার নিমিত্তে কোনো ক্ষতি হয়। তাছাড়া তার গর্ভে এখন সন্তান। অন্যসবার তো কতকিছু খেতে ইচ্ছে করে এই সময়ে। সাবিহার না হয় একটু পানি খাওয়ার ইচ্ছে হয়েছে। সভ্যর এঁটো পানিই তো। দোষের কিছু না। খাওয়াই যায়। দ্বিধা, সংকোচ, কিঞ্চিৎ লজ্জা আর আড়ষ্টতা নিয়ে সাবিহা হুট করে কম্পমান হাতে তুলে নিলো সম্মুখের পানির গ্লাসটা। নজর করলে দেখা যায় গ্লাসের তলদেশে পরে আছে একটুখানি পানি। সাবিহা ক্রমশ গ্লাসটা মুখের দিকে অগ্রসর করতে লাগলো। তার পূর্বে একবার ঝটপট দেখে নিলো সভ্যর ঘরের দরজা। এখনো আসেনি সভ্য। সাবিহা এবার হাতের গতি বাড়িয়ে তড়িঘড়ি করে বন্ধ চোখে মনে থোকা থোকা আড়ষ্টভাব রেখে ঢকঢক করে পান করলো পানি। অতঃপর হাতের গ্লাস টেবিলে রাখতেই আচমকা বিবেক প্রশ্ন করে বসলো আহতভাবে, ” কি হলো এটা?”। এবার সাবিহা নিজের খামখেয়ালি পনায় লজ্জায় রাঙা হয়ে গেলো। আকষ্মিক তড়বড় করে উঠে পরলো চেয়ার হতে। খেতে হবে না তার কিছু। এখানে থাকার দুঃসাধ্য তার এই মুহূর্তে একদমই হচ্ছে না।
সাবিহা প্রায় দৌড়ে চলে গেলো নিজের ঘরে। সভ্য ফোন হাতে হতভম্ব হয়ে দাড়িয়ে রইলো তার দরজার পাশে। সে প্রচন্ড অবাক! আকাশসম বিস্ময় তার চোখের দৃষ্টিতে। সাবিহার কর্ম তার চোখ এড়ায়নি। সে দেখে ফেলেছে। মুখে হাক ডাক এলেও ডাকেনি সভ্য। অপ্রত্যাশিত মিনিট দুয়েকের এই ঘটনা সভ্যর মুখে হঠাৎ হাসিও ফুটিয়ে তুলল। সাবিহা কি ইদানীং তরুণীর ঘর ছেড়ে কিশোরীর ঘরে নেমে আসছে? নাকি সে সভ্যকে ভালোবেসে হয়ে গেছে খামখেয়ালী। ভাবনার মাঝে সভ্য ঠোঁটে সেই এক চিলতে হাসির বিদ্যমানতায় সাবিহার রুমের দরজা বরাবর তাকিয়ে অনুচ্চ কন্ঠে বলল
— এতো তাড়াতাড়ি সফল হবো ভাবিনি। তুমি কি দেখে আমায় এতো ভালোবাসলে তাও জানি না। আমি না হয় অপেক্ষায় রইলাম, দেখি সাবিহা কর্তৃক সভ্যর হৃদয় নিহত হয় কিনা। বুকে অপমানের দগদগে ক্ষততে তুমি পারো কিনা ভালোবাসার রঙ লেপিয়ে দিতে। তবে আমি বড্ড ভালোবাসি আমার মা’কে সাবিহা। মা’কে কিছু না বললে হয়তো এতটা কঠিন হতো না আমার মন।
.
সেই যে সাবিহা আপন ঘরের বন্দিনী হলো। সাঁঝ পেরিয়ে রাতের আগমন হলো সাবিহা নিজ ঘর হতে বের হচ্ছে না। সভ্য আর ডাকেনি। সেও মোটামুটি এক ভয়ংকর কাজ করে ফেলেছে। মনকে বুঝিয়েছে, যার সনে বেঁধেছে ঘর, চাইলেও হতে করতে পারেনি পর বরং ফেঁসে গেছে জটিল ভাবে তাকে এবার ক্ষমা করার একটু চেষ্টা করতেই হয়। মন গুমোট হয়ে সাঁই দিয়েছে। অতঃপর সভ্য সাম্য সন্ধ্যর মাম্মামের রেখে যাওয়া খাবার গুলো নিজে গলাধঃকরণ করেছে খানিকটা খুঁত খুঁত করা মন নিয়ে। সাবিহার কথা ঠিক। সেও হয়তোবা একটু অপরাধ করেছে। নারীর নিরাপদ স্থান একমাত্র স্বামীর বুকে। ওমন ব্যাবহার করে সভ্য আজ কিছুটা অপরাধ বোধ অনুভব করে। এই একটা ভুলের জন্য সে আরো উঁচু করতে সক্ষম মাথা ঈষৎ ঝুঁকে রাখছে। না হলে সে সর্বদিক থেকে নির্দোষ থাকতো।
এশার আজান হয়ে গেছে। সভ্য তার ঘরে বিছানায় আধশোয়া হয়ে শুয়ে ইউটিউব ঘাটাঘাটিতে মত্ত। ভাবছিলো এখনই সে সাবিহাকে ডাকতে যাবে। জলদি ঘুমিয়ে পরার জন্য আহবান করবে কিন্তু সে ভাবনা হুট করে বিদায় হলো একটা ভিডিওতেই। সভ্য শোয়া থেকে তড়াক করে উঠে বসে পরলো ব্যাস্ত ভঙ্গিতে। চোখ মুখে পরলো গাঢ় কৌতুকের ছায়া। তার হাতের ফোনে স্ক্রিন জুড়ে সাবিহার মুখাবয়ব। লাইভে এসেছে সাবিহা। সভ্য পূর্ণ মনোযোগ ফোনে নিবদ্ধ রাখতে রাখতেই হুট করে আনমনে চাইলো তার দরজার পানে। দক্ষিণের ঘর হতে মন ছুটে গেলো সাবিহার কক্ষে। সাবিহা মাথায় ওড়না পেচিয়ে সুন্দর এক বধুবেশী রূপ ধারণা করেছে। সভ্যর হাতের ফোনে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে সাবিহা কোমল মুখে নমনীয় সুরে বলছে,
“আমি প্রথমেই সকলকে সালাম জানাই এবং অন্যান্য ধর্মের ভালোবাসা মানুষদের জানাই আদাব। গত একমাস হলো আমি মিডিয়া থেকে দূরে আছি, অনলাইন হতে দূরে আছি। অনেকেই আমায় মেইল করেছেন, ম্যাসেজ দিয়েছেন জানতে চাচ্ছেন আপনারা আমি কেন মডেলিং -ও করছি না, নতুন টিকটিকও আপলোড করছি না। সেই কারণটাই এখন বলতে এসেছি। আমি খুশির সাথে জানাচ্ছি যে আমি আর কখনো ফিরবো না এই অনলাইন জগতে। সকল পেইজ, চ্যানেলের সকলকে আমি রিকোয়েস্ট করি আমার ভিডিও গুলো যেন ডিলিট দেওয়া হয়। আমি নিজেও আমার পেইজ আইডি রাখবো না। ডিজেবল করে দেবো। কারণ আমার…..। ”
হুট করে কথার মাঝে থমকে গেলো সাবিহা। সভ্য দরদর করে ঘেমে যাচ্ছে। মাথার উপরে পুরো দমে চলছে ফ্যান, ততটা তপ্ত নয় আবহাওয়া তবুও সে ঘর্মাক্ত। অধীর আগ্রহ নিয়ে সভ্য তাকিয়ে রইলো ফোনের স্ক্রিনের দিকে। সাবিহা পুনরায় বলছে
” ২৬ মে তে আমি আমার জীবনে বরণ করে নিয়েছি আমার লাইফ পার্টনার কে। এবং আমি জীবনের সেরা উপহার পাওয়ার পথে। নতুন অতিথি আসবে আমার ঘর আলোকিত করে। উনি…..”
আবারও থমকে গেলো সাবিহা। সভ্য যে এই টিকটক পছন্দ করে না তা বলা যাচ্ছে না। সে নিজেও একজন সুখ্যাতিসম্পন্ন মডেল। সাবিহা অবগত হয়েছে সভ্যর অপছন্দ টিকটকের টিম ধরে ছেলেদের সাথে টিকটক করা, হাসাহাসি, নাচ গান করা। এই নিমিত্তে সাবিহা ভেবে নিলো গোঁজামিল দিতে হবে লাইভে। প্রধান কারণ বললে সভ্যর মানহীন হবে। তবে অবশ্যই সাবিহা নিজ হতে বলবে না সে সুনামধন্য মডেল তারকা এবং অভিনেতা সাজিদ আহমেদ সভ্যর বউ।
.
অনাকাঙ্ক্ষিত মানুষের হঠাৎ অপ্রত্যাশিত আচরণ সভ্যকে থমকে দিয়েছে মিনিটের মধ্যে। সে হতভম্ব, আশ্চর্যান্বিত, কিংকর্তব্যবিমূঢ়। যেন নিঃশ্বাস- প্রশ্বাস আদান প্রদানের কথা ভুলে গেছে। থম মেরে সে সাবিহার লাইভ শেষে বসে আছে বিছানায়। এতো পরিবর্তন সাবিহার? সভ্যর বুকের মাঝে ধুকপুক ধুকপুক করছে। বুকের ছটফট ভাব পরখ করে সভ্য হুট করে উঠে দাড়ালো। আচমকা দুরুদুরু বুক নিয়ে হেঁটে গেলো সাবিহার রুমের দিকে। দরজার নিকট যেতেই আচমকা ওপাশ হতে বেরিয়ে পরলো সাবিহা। ছোট খাটো এক সংঘর্ষ হলো দু’জনের। সাবিহা চমকে উঠলো। আরো চমকে উঠলো সে যখন সভ্যর পানে চাইলো। কেঁপে উঠলো ভেতরটা। সভ্যর চোখের দৃষ্টি শান্ত। চোখের ভাষায় কি একটুকরো আদর ভাসে? বুঝলো না সাবিহা। সভ্য তার থেকে দু-হাত দূরে দাড়িয়ে পলকহীন বড় বড় দুইটা নেত্রে মায়ার মিছিল ছাপিয়ে তাকিয়ে আছে সাবিহার দিকে। সাবিহার হৃদপিণ্ড লাফালাফি করে। এই লাফালাফি হুট করে বাড়িতে দিতে যেন সভ্য বলে উঠলো
— স্যালুট জানাই সন্ধ্যার মা’কে।
চলবে……..
( ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন)