রঙ বেরঙের খেলা পর্ব -১৭

#রঙ_বেরঙের_খেলা
#আলিশা
#পর্ব_১৭

সোফার সম্মুখের ছোট টেবিলটায় শোভা পাচ্ছে বেশ কয়েকটা মোম বাতি। লাল লাল তাদের অগ্নিশিখা যেন ঘরের মাঝে বয়ে এনেছে অনন্য এক সৌন্দর্য। সাবিহা শুয়ে আছে গুটিশুটি মেরে বিছানার মধ্যভাগে। সভ্যর গভীর মনোযোগ মোমবাতিকে ঘিরে। একে একে আগুনের শিখা ছুঁয়ে দিলো ছয়টা মোম বাতিতে। উদ্দেশ্য হলো সাবিহা যেন ভয় ডর না পায় রাতে, আবার ওয়াশরুমে যাওয়ার সময় যেন অন্ধকারে পরে না যায়। বিদ্যুৎ নেই পুরো বাড়িতে। ঘরময় আধারের অস্তিত্ব। সাবিহার ঘরে অবশ্য আইপিএস আছে কিন্তু সভ্য ওঘরে যাবে না। সে তো ঘর জামাই না! কেন যাবে নিজের রুম থাকতে সাবিহার রুমে? তাই তো সাবিহাকে স্যালুট জানানোর পর বিদ্যুৎ চলে গেলে সভ্য এই বুদ্ধি খুঁজে আনলো। বাইরে মেঘের গুড়গুড়। ঝড় ঝাপ্টার আওয়াজ আসছে কানে। তেজ নিয়ে বয়ে চলা হাওয়ায় জানালার পর্দা উড়ন্ত। সভ্য মোম জ্বালানোর কাজ সম্পন্ন করে তড়িঘড়ি করে চলে গেলো জানার নিকট। মসৃণ কাচ টেনে বন্ধ করে দিয়ে পর্দা টেনে দিলো আপন হাতে। সাবিহা শান্ত দৃষ্টিতে পরখ করলো ঘাড় ঘুরিয়ে। মোমের মৃদু আলোয় সভ্যর ঈষৎ অস্পষ্ট মুখে তাকিয়ে রইলো অনিমেষ। সভ্য জানালা থেকে সরে বিছানার নিকট এসে দাড়িয়ে সাবিহার উদ্দেশ্যে বলল

— গরম লাগছে?

— নাহ।

সাবিহা উত্তর কালে অহেতুক হাসলো। সভ্যও আচমকা সেই হাসির নিমিত্তে ছুড়ে দিলো একটু হাসি। অতঃপর যথাসম্ভব নরম কন্ঠে বলতে চাইলো

— ঘুমাও। রাতে খারাপ লাগবে আমায় ডাক দিও।

সাবিহা শয়ন দশাতেই ধীর গতিতে মাথা নাড়লো। সভ্য আর কথা না বাড়িয়ে নিজেও শুয়ে পরলো সাবিহার পাশে। আজ না ঘুমালে তার শরীরের ফিটনেস ধরে রাখা মুশকিল। দেখা যাবে চোখের নিচে কালি জমেছে, মাথার চুল উষ্কখুষ্ক হয়ে গেছে উপরন্তু ঘুম না হওয়ার দরুন মুখে দুই একটা ফুশকুরি আসন পেতে নেবে। ভাবনার মাঝে সভ্য ফোস করে নিশ্বাস ছাড়লো। গলার নিচে সাবিহার কামড়ের দরুন ঈষৎ কালচে দাগ হয়েছে। সেখানে দুপুরের পর চিনি আর কাচা দুধ লাগিয়ে রেখেছিল সভ্য। মা’কে বলেছিল লেবুর ব্যাবস্থা করে দিতে। কিন্তু সভ্যর মা তো এলোই না আজ। ফ্লাটে চলে গেছে। এখন এই দাগ উঠাবে কিভাবে সভ্য? একটু আগে ডিরেক্টর ফোন করে বলল তার কাল শুটিং আছে, মডেলিং আছে। ঢাকা যেতে হবে। শুটিং সময়ে যখন টিশার্টের উপর শার্ট পরবে তখন তো গলার দাগ স্পষ্ট নজরে আসবে সবার। কেউ শুধালে সভ্য কি বলবে? পিঁপড়া কামড় দিয়েছে? মৌমাছি, বোলতা নাকি সন্ধ্যা বা সাম্যর মাম্মা?

— সভ্য ভাই, আপনি সত্যিই অ-যুক্ত অসভ্য

ভাবনার মাঝে সাবিহার কন্ঠ। সভ্য পিলে চমকে উঠলো। তড়াক করে সাবিহার দিকে ঘার ঘুরিয়ে বলল

— মানে? অসভ্য হলাম কিভাবে?

আধো আলোয় সাবিহার বিরক্তি ভরা মুখ অক্ষিপটে ভেসে উঠলো সভ্যর। সাবিহা নাক মুখ কুঁচকে বলে উঠলো

— ফ্রুট স্ক্রাব লাগাইছিলেন মুখে তাই না? চুলে জেলও দিয়েছেন মনে হয়। ঘ্রাণ আমার সহ্য হচ্ছে না।

সাবিহার এহেন কথায় সভ্য আচমকা দিশেহারা হয়ে পরলো। থ বনে গিয়ে অসহায়হয়ে তাকিয়ে থাকা অবস্থায় কিছু একটা বলবে সে ঠিক তখনই আবারও সাবিহার বিরক্তির সুর। সে শোয়া থেকে উঠে বলল

— সরেন। বমি আসছে আমার। পারফিউম, হ্যান ত্যানের ঘ্রাণ ইদানীং সহ্য হয় না। কামড় দেবো কিন্তু সরেন।

সভ্য তড়িঘড়ি করে নেমে পরলো বিছানা থেকে। কামড়ের কথা শুনেই তার হৃদপিণ্ড ভয়ঙ্কর এক লাফ দিয়েছে।

— তো আমি এখন কি করবো?

সভ্য ঈষৎ বিরক্তি নিয়ে বলল। সাবিহা আধবোজা চোখে বলল

— ভালো করে সাবান দিয়ে গোছল করবেন। চুলে শ্যাম্পু লাগাবেন। গন্ধ ছাড়া শ্যাম্পু লাগাবেন কিন্তু।

শর্ত দিয়ে দিলো সাবিহা। সভ্যর স্বভাব বশে হুট করে মাথা গরম হয়ে গেলো। এতো রাতে সে গোসল করবে? কিন্তু পরক্ষণেই মন উদয় করলো কারণ। তারই সন্তানের দোষ। সাবিহার তো দোষ নেই। ভাবতে গিয়ে সভ্য দমিয়ে ফেলল রাগ। করুণ এক চাহনি সে নিক্ষেপ করলো সাবিহার পানে। অতঃপর বিছানা থেকে ফোন নিয়ে টর্চ জ্বালিয়ে ধুপধাপ পা ফেলে গন্তব্য করলো ওয়াশরুম কে। করতে হবে কিছু। গোসল না করলেও মাথা ধুয়ে আসতে হবে। অভিনেতা হয়েও দেখা যাচ্ছে মুশকিল। রূপ চর্চা করা যাচ্ছে না। আরো বড় আকারের মুশকিল সাবিহার ইদুর দাঁত আর ওয়াক্! দু’টোই ভয়ংকর সভ্যর কাছে।

.
রাতে সিক্ত মাথায় ঘুম হলো না ভালো। অতঃপর আজ সকালে নির্ঘুম চোখ নিয়ে ছুটতে হচ্ছে সভ্যকে ঢাকায়। ফারজানা বেগম এলেন খুব ভোরেই। সাবিহা রান্নাবান্না যা জানে করে ফেলল আজ দ্রুত গতিতে। সভ্য মানা করলো অনেক করে। কিন্তু সে শোনেনি। তড়িঘড়ি করে মাংস রান্না করে সভ্যকে প্লেটে খাবার সাজিয়ে দিলো। সকাল সাতটাতেই সভ্য রওনা হচ্ছে। ক্ষণিকের বিদায় কালে কথা আসছে না কারো মুখে। সাবিহার গাঢ় মন খারাপ হয়েছে। সভ্য প্রায় নির্বিকার। তৈরি হয়ে সে গাড়িতে অবস্থানরত। পাশের গ্লাসটা খুলে রাখা। ফারজানা বেগম আর সাবিহা দাড়িয়ে আছে গাড়ির নিকট। রাহেলা ইসলামকে আর এতো তাড়াতাড়ি সংবাদ দেওয়ার প্রয়োজন মনে করেনি সাবিহা। সভ্য যে আজই হুট করে চলে যাবে তা ঘুনাক্ষরেও জানতো না সে। হিসেব মতো আরো একদিন থাকার কথা ছিল সভ্যর।

— পৌঁছে একটা ফোন দিস সভ্য।

ফারজানা বেগমের কন্ঠ। সভ্য তার সিট বেল বাঁধতে বাঁধতে বলল

— ঠিক আছে। তুমি টেনশনে খাওয়া ঘুম ছিটি দিও না। আমি সময় পেলেই আসার চেষ্টা করবো।

মা ছেলে এরপর আরো টুকিটাকি কথা বলল। সাবিহা ঠাঁই দাড়িয়ে শুনছে। তারও ইচ্ছে হলো সভ্যকে জলদি আসার কথা বলতে। কিন্তু জড়তা বা সংকোচে বলা যাচ্ছে না। সভ্যও কিছু বলছে না। ভাবনার মাঝে সাবিহা আড় চোখে চাইলো সভ্যর পানে। আকস্মিক ওমনি চোখে চোখ পরলো প্রিয়র। সাবিহা হুট করে কেঁপে উঠলো। সভ্য মুচকি একটা হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে বলল

— কষ্ট করে একটু খাওয়ার চেষ্টা কইরো। অযত্ন কোরো না নিজের।

সাবিহার ভেতরের অপ্রস্তুত ভাব মুহূর্তেই কেটে গেলো। সভ্যর পানে দৃষ্টি স্থির রেখে ঈষৎ লজ্জা নিয়ে মাথা হেলিয়ে সায় জানালো। সভ্যও ক্ষণকাল দেখলো সাবিহাকে। তারপরই হুট করে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে ধা করে মোড় ঘুরিয়ে নিলো। গাড়ি যেমন কেঁপে উঠলো ঠিক ওভাবেই কেঁপে উঠলো দু’জনের মন। অদৃশ্য অদ্ভুত এক সুর বুকে বেজে উঠলো। সভ্যর যেন হুট করে খালি হতে লাগলো বুকের বা পাশ। আর সাবিহার ভার হতে লাগলো বুক। যেন অহরহ বিষন্নতা এসে ভির করছে মন মাঝারে।

.
রাজশাহী থেকে ঢাকা এসে একে একে দিন পার করলো সভ্য পাঁচ টা। মডেলিং, ক্রিকেট আর শুটিং রুটিনে নিয়ে দিন কাটছে। পূর্বের চাইতে এবারের ব্যাস্ততা বেশি। এর মাঝে সাবিহাকে ফোন করা হয়েছিল একবার। তবে নিয়ম করে তিনবার খোঁজ নেওয়া হয় সাবিহার। মায়ের কাছে সকালে ঘুম থেকে উঠে, দুপুরে লান্সের সময় এবং নিশিতে ঘুমের দেশে তলিয়ে যাওয়ায় আগ মুহূর্তে ফোন করা হয়। আজও করবে সভ্য। মাত্র শুটিং শেষ হলো। এখন সে সাবিহার খোঁজ নিয়ে তার ভাড়া বাসায় চলে যাবে। অতঃপর আবার বের হতে হবে তিনটায় ক্রিকেটের জন্য।

— শুনছেন? এই যে?

ভাবনার মাঝে সভ্যর উদ্দেশ্যে ডাক। সভ্য পেছন ফিরে চাইলো। সুষ্মিতা দাড়িয়ে আছে। সভ্য ফিরে চাইতেই মুচকি একটা হাসি উপহার দিয়ে বলল সুষ্মিতা

— তিনদিন পর একটা পার্টি আছে আমার বাসায়। আমন্ত্রণ জানাই আপনাকে। নেমন্তন্নে আসবেন আশা করি। আপনি কিন্তু আমার বিশেষ অতিথি।

কথাটা বলেই হাতের একটা কার্ড সভ্যর দিকে বাড়িয়ে দিলো সুষ্মিতা। সভ্য হাত বাড়িয়ে কার্ড নিয়ে হাসলো মৃদু শব্দে। সুষ্মিতার চমৎকার কথা বলার ধরণ।

— অবশ্যই।

— আচ্ছা আজকে চলুন একসাথে লান্স করি।… না আমি একা না দিঠি, নয়ন, তন্ময় ওরাও আছে।

সুষ্মিতার ঝটপট বলা কন্ঠ। সভ্যর সুষ্মিতাকে পেরিয়ে চোখের দৃষ্টি নিয়ে গেলো আরো একটু দূরে। ক্লান্ত শ্রান্ত তিনটা মুখ মুহূর্তেই চোখে ধরা দিলো। নয়ন ছেলেটা সভ্যকে দেখতেই অদূর হতে উচ্চ কন্ঠে বলে উঠলো

— চলে আসেন বস। আজ না করলে কিন্তু মানবো না।

দিঠিও একই সুর ধরে কৃত্রিম রাগ নিয়ে বলে উঠলো

— ইউনিক ক্রাশ ভাইয়া চলে আসেন।

সভ্য সবার ডাকার ধরণে হেসে উঠলো। পুনরায় সুষ্মিতার পানে তাকিয়ে বলল

— পাঁচ মিনিটের মধ্যে আসছি। একটা জরুরি ফোন করার আছে।

বলেই সভ্য সম্মুখে হাঁটা দিলো। আজ সাবিহাকেই ফোন করবে সে। দু’টো চমৎকার জিনিস দেখাবে। একটা হলো, গত রাতে আজিজের হাত পা ভেঙে দিয়েছে সভ্য আর তার এসিস্টেন্ট মিলে। আর দ্বিতিয়টা হলো সাবিহা যে প্রথম দিন তার বুকের উপর ওয়াক্ করে দিয়েছিল তার ছবিটা। ডিরেক্টরের ক্যামেরায় বন্দি ছিল।

চলবে….

( 😒)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here