রাজমহল পর্ব -০৮

#রাজমহল
#লেখিকা-শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-৮

সন্ধি মাথায় হাতটা চেপে বলল

– জানি না কোথায় গিয়েছিলাম। তবে মনে হয়েছিল সব বাস্তবে হচ্ছে আমার সাথে। মনে হচ্ছিল সেটা আমি ছিলাম না আমার ভেতরে অন্য কেউ ছিল। কেন জানি না সে জায়গায় অসম্ভব মায়া কাজ করছিল। সবকিছু বেশ চেনা চেনা লাগছিল। অদ্ভূত রকমের টান অনুভব করছিলাম।

আমি অস্থির গলায় সন্ধির কথা থামিয়ে বললাম

– এত ভূমিকা রেখে কী হয়েছে বল।

পাশ থেকে হাসিব আমার কাঁধে হাত রেখে আমাকে হালকা গলায় বলল

– তুমি একটু স্থির হও। ওকে ওর মতো করে বলতে দাও। ও এখন ওর মধ্যে নেই। চাইলেও সে তোমার কথা মতো সব একটানে বলবে না। ওকে বাঁধা দিও না।

হাসিবের কথা শোনে কিছুটা আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলাম

– মানে?

হাসিব আমাকে তার চোখ দিয়ে সন্ধির চোখের দিকে ঈশারা করে বলল

– ওর চোখ দেখলেই সবটা বুঝতে পারবে।

আমি তড়িঘড়ি করে সন্ধির চোখে তাকিয়ে চমকে গেলাম। কারণ তার চোখ গুলো ধূসর হয়ে আছে। কি যেন সে বিড়বিড় করছে। নিজের মধ্যে সাহস সঞ্চার করে সন্ধির হাতে হাত রেখে বললাম

– কী হয়েছে বল। কী বিড়বিড় করছিস?

আমার স্পর্শে যেন সন্ধির গা টা কেঁপে উঠল। হালকা কেঁপে উঠে আমাকে বলল

– হ্যাঁ বলছি তো। তাহলে শোন আমাকে যখন গর্ভপাত করাতে ওটি রুমে নিয়ে গেল। তার কিছুক্ষণ পর আমাকে অজ্ঞান করা হলো। ঠিক তখন মনে হলো কেউ একজন আমাকে ওটি রুম থেকে বের করে নিল। আমি ওটি রুম থেকে বের হয়ে এমন জায়গায় আসলাম যেটা নিস্তব ছিল আর সবুজে ঘেরা। চারপাশে গাছে ঘেরা এক সবুজ রাস্তা। সেখানে দাঁড়িয়ে ছিল একটা পালকি। আমি রাস্তার পাশে তখন নব বধু সাজে দাঁড়িয়ে ছিলাম। আশেপাশে অনেক মানুষ ছিল। তারা দাসীর মতো আমার শাড়ি গয়না ঠিক করে দিচ্ছিল। চুল ঠিক করে দিচ্ছিল। তালের কারুকাজ খচিত পাখা দিয়ে আমায় বাতাস করতেছিল। আমি খুব স্বাভাবিক ভাবে সব দেখতে লাগলাম।

এর মধ্যেই হুট করে আমার কানে আসলো ঢোলের আওয়ায়। এত বিকট আওয়াজ কি বলব। আমি কান চেপে রাখলাম। তার মধ্যে আস্তে আস্তে ঢোলের আওয়াজটা প্রখর হতে হতে আমার সামনে এসে থেমে গেল। কেউ একজন সেখান থেকে এসে আমাকে ঈশারা দিয়ে বলল পালকিতে উঠতে।

আমিও কেমন জানি আনমনে হয়ে গেলাম। মনে হচ্ছিল আমি আমার মাঝে ছিলাম না। অন্য একজন আমাকে নিয়ন্ত্রণ করছে। আমি তাদের কথায় পালকিতে উঠলাম। আরেরেরের…. বলে পালকি কাধেঁ তুলে যেতে লাগলো। পালকির সামনের কাপড়টা সরিয়ে বাইরের দিকে তাকালাম।দিনের প্রথম রোদটা যেন আমার মুখে এসে লেপ্টে গেল। পালকি হনহনিয়ে যেতে লাগল সেই সাথে রোদটাও আমার সাথে যেতে লাগল। অদ্ভুত অনুভূতি অদ্ভুত মায়ার টান অনুভব করছিলাম। বাইরের সবুজ গাছ পার করে মনে হচ্ছে অচেনা এক গন্তব্যে যাচ্ছি। পালকিতে বসে বুঝতে পারছিলাম না সে গন্তব্য কোথায় ছিল তবে সেটা যে সুখের গন্তব্য ছিল সেটা আমার মনের অনুভূতিতে টের পাচ্ছিলাম। হনহনিয়ে পালকি যেতে যেতে ভর দুপুর হলো। পালকির লোক গুলো পালকিটা থামিয়ে একটু বিশ্রাম নিচ্ছিল।ঠিক তখন এক সুন্দর ঘোড়ার গাড়ি আমার পালকির সামনে এসে দাঁড়াল। সেই গাড়ির উপরে তাকিয়ে দেখলাম এক সুন্দর সুদর্শন যুবক বসে আছে কারুকাজখচিত জামা পড়ে। মনে হচ্ছিল সে কোনো রাজ্যের রাজা।তবে সে যুবককে দেখে মনে হয়েছিল আমি তাকে অনেক ভালোবাসি আর তার সাথে আমার সদ্য বিয়ে হয়েছে। কেন এমনটা মনে হয়েছিল জানি না। আমি যুবকের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। যুবক ঘোড়ার গাড়ি থেকে নেমে আমার সামনে এসে হাঁটু ঘেরে বসে বলল

– তোমার কি লাগবে বলো? আর কি আহার করবে বলো। পালকিতে বসে আহার করবে নাকি বের হবে একটু।

উনার কথা শোনে একটু লজ্জা পেলাম আমি৷ লজ্জায় মাথা নত করে বললাম

– আপনার চাওয়াই আমার চাওয়া।

তখন উনি হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল

– আমার চাওয়া তো তোমাকে নিয়ে একটু জঙ্গলটা ঘুরব। যেহেতু তুমি আমার সহধর্মিণী তোমাকে নিয়ে একটু ঘুরতে পারলে আমার বেশ ভালো লাগবে।

উনার কথায় পুনরায় লজ্জা পেলাম। বুঝতে পারছিলাম এ লোকটার সাথে আমার বিয়ে হয়েছে। কী থেকে কী ঘটছে সেটা আমার মনের অজান্তেই যেন সব টের পাচ্ছিলাম। আমি উনার কথার জবাব না দিয়ে হাতটা বাড়িয়ে উনার হাতে রেখে বললাম

– চলুন তাহলে আপনার চাওয়া পূরণ করা যাক।

বলেই উনার হাত ধরে পালকিতে থেকে নামলাম। উনি আমার হাতটা শক্ত করে ধরে বলল চলো সামনে এগুনো যাক। আমি আর উনি একটু সামনে এগুলাম। কিছুক্ষণ চারপাশ ঘোরার পর কয়েকজন এসে আমাদের গাছতলায় মাদুর পেতে দিল। আমি আর উনি বসলাম। সামনে বেশ মজাদার মিষ্টান্ন ভান্ডার রাখা ছিল। উনি আমাকে সেখান থেকে মিষ্টি নিয়ে মুখে তুলে দিল। আমিও খেলাম। এরপর উনি আমার দিকে তাকিয়ে বলল

– তোমাকে আজকে বেশ সুন্দর লাগছে। মনে হচ্ছে একটা পুতুল তুমি। তোমার গর্ভেই আসবে আমার উত্তরাধিকার।

আমি উনার কথা শোনে অপলক দৃষ্টিতে উনার দিকে তাকিয়ে রইলাম। পরক্ষণেই হালকা লজ্জা পেয়ে উনার চোখ থেকে চোখটা নামিয়ে নীচের দিকে তাকালাম।উনি আমার থুতুনিটা ধরে উপরের দিকে তুলল। আমি লজ্জায় চোখ বন্ধ করে ফেললাম।পরক্ষণেই আবার চোখটা খুলে উনার দিকে তাকালাম। মনের মধ্যে এক ভালোবাসার অনুভূতি বিরাজ করছিল। ভালোবাসার মতাল হাওয়া যেন সারা শরীরে বইছিল। উনি আমার অবস্থা দেখে মুচকি হেসে বললেন

– এত লজ্জা পাওয়ার মতো কিছু হয়নি প্রিয়তম। এবার পালকিতে গিয়ে বসো আবার যাত্রা শুরু হবে।

আমাকে ধরে উনি পালকিতে বসালেন তারপর আবার ঘোড়ার গাড়িতে গিয়ে উনি বসলেন। পালকি পুনরায় আরেরেরেরেরে….করে চলতে শুরু করল। হনহন করে পালকি চলছে। পড়ন্ত বিকালের রোদটা আমার সাথে গড়িয়ে গড়িয়ে চলছে।দিন পেরিয়ে রাত নামল। চারপাশে লন্ঠন জ্বালানো শুরু হলো। যাত্রাপথ লন্ঠনের আলোতে আলোকিত হলো।

দীর্ঘ যাত্রা পেরিয়ে গভীর রাতে পৌঁছালাম একটা বিরাট বড় বাড়িতে। বাড়িটা আর কোথাও ছিল না আমরা যেখানে থাকি সেখানেই ছিল তবে বাড়ির আশপাশটা আরও বড় আর বাড়িটা আরও কারুকাজ খচিত সুন্দর ছিল। আমি বাড়ির সামনে যেতেই একজন মহিলা এসে আমাকে নামাল। তিনি আমাকে বরণ করে ঘরে তুলল। সবাই আমাকে আমার নামে ডাকছে না৷ কেউ আমাকে সন্ধি বলছে না সবাই আমাকে জার্নিভা বলে সম্বোধন করছে। আমাকে বরণ শেষে আমাকে বসানো হলো একটা পালঙ্কে।

আমি আস্তে করে পালঙ্ক থেকে নামলাম। একটু সামনে গিয়ে একটা আয়না দেখতে পেলাম। খুব ইচ্ছা হচ্ছিল নিজের প্রতিচ্ছবিটা আয়নাতে দেখি। নিজের প্রতিচ্ছবি আয়নাতে দেখার জন্য যখন আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম তখনেই চমকে গেলাম। কারণ আমার রুপে আমি ছিলাম না৷ আমার চেহারাটা পুরো বদলে গিয়ে অন্য একটা নারীর রূপ ধারণ করেছিল। এমন সময় পেছনে কেউ একজনের অস্তিত্ব অনুভব করলাম৷ পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখলাম সেই যুবক দাঁড়িয়ে আছে। জানতে পারলাম সে এ মহলের রাজা। যার নাম মেহেদীরাজ।

উনি আমার কাছে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরল। অসম্ভব ভালোবাসায় সাগরে যেন আমি ডুবে গেলাম। দেখতে দেখতে সেখানে অনেক সময় পার করলাম৷ আমার গর্ভে সন্তান আসলো। সারা রাজমহল আমার সন্তানের খবরে খুশির জোয়ারে ভাসছে।

কিছুদিন পর একজন মহিলা এসে আমার পেটে চেপে পরীক্ষা করতে লাগল। মহিলাটা এমন ভাবে পেট চেপেছিল যে আমি ব্যাথা পেয়ে লাথি মারি। তারপর কি হয়েছিল আমি জানি না। উঠে দেখলাম আমি এখানে।

সন্ধির কথা শোনে আমি ভাবতে লাগলাম ডাক্তার রাহনুমা বলেছিল সন্ধি লাথি মেরেছে তার উপর সন্ধির চেহারাও পরিবর্তন হয়েছে। তার মানে সন্ধি এমন কোনো জগতে গিয়েছিল সেটা আমাদের অন্তরালে ছিল। সন্ধি সে জগতে সে মহিলাকে লাথি দেয় আর এ জগতে লাথিটা পরে ডাক্তার রাহনুমার শরীর বরাবর। সে জগতে সন্ধির চেহারা পরিবর্তন হয় আর এ জগতেও সন্ধির চেহারা পরিবর্তন হয়েছে। তার মানে সন্ধি কল্পনায় অন্য কোনো জগতে চলে যাচ্ছে বাস্তবেও তার প্রতিফলন হচ্ছে।

আমি সন্ধির দিকে তাকিয়ে দেখলাম সন্ধির চোখ স্বাভাবিক হয়ে গেছে। তবে সে ভয় পেয়ে আছে। আমি সন্ধিকে হালকা হাতে ধরে বললাম

– ভয় পাস না। কোনো না কোনো উপায় তো পাব। এবার আস্তে করে উঠে চল। বাড়ি যেতে হবে।

সন্ধি আমার কথা শোনে হালকা কেঁদে দিয়ে বলল

– আমার পেটটা এত বড় হয়েছে এখন বাড়ি গেলে তো সায়রা আপু বকবে। আমি যাব না।

আমি সন্ধিকে ভরসা দিয়ে বললাম

– চিন্তা করিস না আমি সায়রা আপুকে সবটা বুঝিয়ে বলব। এবার চল তো।

বলেই সন্ধি আর হাসিবকে নিয়ে হাসপাতাল থেকে বের হয়ে একটা সি এন জি নিলাম।সি এন জি টা গন্তব্যের দিকে যেতে লাগল। আর আমি আনমনে বসে ভাবতে লাগলাম সায়রা আপুকে কীভাবে বিষয়টা বুঝাব। এসব ভেবে মনটা অস্থির হচ্ছিল তবুও নিজেকে স্থির করে নিচ্ছিলাম। ততক্ষণে সি এন জি বাসার সামনে এসে থামল। সিন এন জি থেকে নেমে বাসার সামনে অ্যাম্বুলেন্স দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একটু ভয় পেয়ে গেলাম। ভবলাম সায়রা আপুর কিছু হয়নি তো। এসব ভেবে ভেবে সন্ধি আর হাসিবকে নিয়ে ভয়ে ভয়ে বাসার ভেতর ঢুকতেই গা টা শিউরে উঠল।

কপি করা নিষেধ চাইলে শেয়ার করতে পারেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here