রাজমহল পর্ব -১৪

#রাজমহল
#লেখিকা-শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-১৪

তারপর জার্নিভা যা বলল তা শোনে বুকটা কেঁপে উঠল। কারণ এক কাহিনির অবসান ঘটাতে গিয়ে অন্য এক বিভৎস কাহিনির সূচণা হয়েছে। জার্নিভা বলল

– সন্ধির গর্ভে শুধু আমার বাচ্চা ছিল না।

কথাটা শোনে কিঞ্চিৎ বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম

– মানে?

– হ্যাঁ সন্ধি যে গাছটার নীচে গিয়েছিল সেখানে একটা শয়তানও ছিল। সেদিন সন্ধির গর্ভে আমার বাচ্চা প্রবেশের সাথে সাথে সেই শয়তানের বাচ্চাও প্রবেশ করেছে। দুটো বাচ্চার সংমিশ্রণে একটি বাচ্চা তৈরী হয়েছে। রাতে বাচ্চাটা শয়তানের ন্যায় আচরণ করবে। আর দিনে আমার প্রতিশোধ নিবে।

কথাটা শোনে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম

– এ ধ্বংসলীলা থেকে বাঁচার কী কোনো উপায় নেই? এ শয়তানের বাচ্চার হাত থেকে পরিত্রাণের উপায় কী?

জার্নিভা অট্ট হেসে বলল

– এ উপায় তো বলব না আমি। কারণ এ শয়তানের বাচ্চাটা আমার কাজকে আরও সহজ করে দিবে।

– কিন্তু জার্নিভা সে তো শুধু তার মৃত্যু লিলা আমাদের মাঝে সীমাবদ্ধ রাখবে না। সে তো এ মৃত্যুর খেলা সবার সাথে খেলবে। আর আমার তো মনে হয় এ বাচ্চাটা বড় হওয়ার সাথে সাথে তার শক্তিও বাড়বে এবং সে আরও ভয়ংকর হয়ে উঠবে। কেন সামান্য প্রতিশোধের জন্য এতগুলো মানুষের প্রাণ দিতে হবে বলো? কিছু একটা করো।

জার্নিভা চোখগুলো বড় বড় করে রাগী কন্ঠে বলল

– সামান্য প্রতিশোধ মানে? মায়ের কোল থেকে সন্তান কেড়ে নেওয়ার কষ্ট তুমি বুঝো?

– মা হয়নি সে কষ্ট পুরোপুরি বুঝা সম্ভব না তবে একটু হলেও তোমার কষ্টটা উপলব্ধি করতে পারছি । তবে তুমি যাদের উপর আজকে প্রতিশোধ নিতে চাচ্ছ তারা নির্দোষ তুমি সেটা মানো বা না মানো। ধরো তোমার বাচ্চাকে কেউ খুন করেছে কিন্তু তুমি জানতে পারলে তাদের পূর্বপুরুষ দোষ করেছে বলে তোমার বাচ্চাকে খুন হতে হয়েছে। তোমার তখন কেমন লাগবে? তোমার এ প্রতিশোধটাও তো অনেক মায়ের বুক খালি করবে। যারা বিনা দোষে সন্তান হারা হবে। তাদের কষ্ট তো নিশ্চয় তোমার বুঝার কথা। তোমার সন্তানের সাথে যা হয়েছে সেটা সত্যিই অন্যায় হয়েছে। তবে যারা এ অন্যায়টা করেছে তারা তো মৃত। আর এখন তোমার সন্তান পুনরায় জন্ম দিতে গিয়ে একটা শয়তানের সন্তান ও জন্ম হয়েছে। শয়তানের সন্তানটা কতটা হিংস্র সেটা রাতের হালকা দৃশ্য দেখেই বুঝতে পেরেছি। সে যে কত জনের প্রাণ নিবে বলা যায় না। কত মায়ের বুক বিনা দোষে খালি হবে। এর দায় কে নিবে জার্নিভা?

জার্নিভা এবার আমার কথা শোনে চুপ। কোনোরূপ কথা না বলে অদৃশ্য হয়ে গেল সে। অস্থির গলায় জার্নিভাকে ডাক দিলাম সে আর আসলো না। নিরাশ হয়ে ঘরে গিয়ে বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল। খেয়াল করলাম সিলিং ফ্যানের সাথে হাসিবের লাশটা ঝুলছে। প্রিয় মানুষটাকে এভাবে দেখতে হবে বুঝতে পারিনি। জোরে চিৎকার দিয়ে কাঁদতে চেয়েও কাঁদতে পারছিলাম না। চোখ দিয়ে আপনাআপনি পানি পড়ছে। নিজের জীবনটায় বিষাক্ত মনে হচ্ছে এবার। খুব সাহস করে হাসিবের লাশটা ধরতে যেতেই লাশটা উধাও হয়ে গেল। কী হচ্ছে এগুলো ভাবতেই শরীরটা কেমন জানি হিম হয়ে যাচ্ছে। দিনকে দিন মানসিক শক্তিও যেন হারিয়ে ফেলছি। হাসিবের সাথে কী হয়েছে জানি না। তবে ভেতরটা যেন দুভাগ হয়ে চৌচির হয়ে গেছে ওকে এভাবে দেখে। যতই মানসিকভাবে শক্ত হতে চাচ্ছি ততই যেন ভেঙ্গে পড়ছি।

নিজেকে সামলে নিয়ে সায়রা আপুর রুমে গেলাম। সায়রা আপু আমার কান্না দেখেই বলে উঠল

– হাসিবকেও ওরা মেরে দিল রে তন্দ্রা। অনিকের মতো হাসিব ও নেই।

বুঝতে আর বাকি রইল না আপুও হাসিবের লাশটা দেখেছে। আপুর কথাটা শোনে মনে থাকা সকল কান্না যেন বের হয়ে আসলো। দুজনেই দুজনকে ধরে কাঁদতে লাগলাম। কি যে সময় পার করছি সেটা শুধু আমরা বুঝছি। কোনোরকমে শুধু খাচ্ছি আর সময়গুলো পার করছি আতঙ্ক নিয়ে। জানি না এ সময়ের শেষ কোথায়। কোথায় গিয়ে ঠেকবে এ মৃত্যুর খেলা।

আপুকে ধরে কিছুক্ষণ কাঁদতে পেরে যেন মনটা হালকা লাগছে। কান্না বন্ধ করে দুজনেই চুপ হয়ে বসে রইলাম। এর মধ্যে আপু বলে উঠল

– তন্দ্রা এটা ঠিক আমাদের সময় খারাপ যাচ্ছে তবে এ সময়টায় যদি আমরা নিজেরা ভেঙ্গে পড়ি তাহলে কখনো আলোর মুখ দেখব না। প্রত্যেক জিনিসের যেমন সৃষ্টি আছে তেমনি ধ্বংস ও আছে৷ এ বাড়িটার মধ্যেই সকল রহস্য লুকিয়ে আছে। এ বাড়ির কোথাও না কোথাও এর উত্তর পেয়ে যাব। কীভাবে এর শেষ হবে অবশ্যই জানব।

আপুর কথা শোনে একটু মনটা প্রশস্ত হলো। শত কষ্টের মধ্যেও যেন একটু শান্ত হলো মনটা। মনে হচ্ছে মরভূমির মতো খা খা রোদের পর এক পশলা বৃষ্টি বয়ে গেছে। বসা থেকে হুট করে শুয়ে আপুর কোলে মাথাটা রেখে বললাম

– কোনো উপায় তো পাচ্ছি না আপু। যেখানেই যাচ্ছি সেখানেই শুধু ধোঁয়াশা দেখতে পাচ্ছি। এত ধোঁয়াশার ভিড়ে সঠিক পথ খুঁজে পাওয়া যে কঠিন আপু। আর এ বাড়িটা নতুন। আর আগের রাজমহলটা এটার নীচেই চাপা পড়ে আছে। এমন তো না যে এ বাড়িতে খু্ঁজলে কোনো কিছু পাব। এখানে সারা ঘর খু্ঁজলেও তো কিছু পাব বলে মনে হয় না।

আপু আমার কথা শোনে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল

– এ বাড়িতে কিছু পাব না এটা আমিও নিশ্চিত। তবে ঐ বেলী ফুল গাছটার জন্ম হুট করে হয়েছে। অবশ্যই সেখানে কিছু না কিছু পাব। সন্ধির গর্ভে বাচ্চা এসেছে যে স্থান থেকে সেখানেও কোনো না কোনো সমাধান পাব। অনেক সময় দেখার বাইরেও একটা অদেখা রয়ে যায়। দেখতে চাইলেও যেন আমরা দেখতে পারি না অনেক কিছু। আমাদের গভীর ভাবে সে অদেখা গুলোকে দেখে সঠিক পথ খুঁজে বের করতে হবে।

আপুর কথা শোনে মনটাকে শক্ত করে নিলাম। আপু আর আমি উঠে হালকা নাস্তা করে নিলাম। পাশের রুমে বাচ্চাটা শুয়ে আছে আর তার পাশে সন্ধি এখনো অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে আছে। আপু আর আমি বাসাটা গুছিয়ে নিলাম। মনের জোর নিয়ে সব কাজ করতেছি। কারণ এখন মনকে শক্ত রাখা জরুরি।বাসাট গুছানোর মূল কারণ হলো নিজেকে সুস্থ স্বাভাবিক রাখতে হলে আশেপাশের পরিবেশটাও স্বাভাবিক রাখা জরুরি। এ কয়দিনে বাসাটা ভূতুরে বাসায় পরিণত হয়েছে যা আমাদের মনকে আরও নিরাশ করে তুলছে। সারাদিন পার করলাম এভাবে। সন্ধ্যা হতেই শুরু হলো বাচ্চাটার রূপ বদলানো। বাচ্চাটা আস্তে আস্তে ভয়ংকর হতে লাগল। এতটায় ভয়ংকর রূপ ধারণ করল যে বাচ্চাটাকে দেখে দম বন্ধ হয়ে আসছিল। বাচ্চাটা শুয়া থেকে গড়িয়ে খাট থেকে নীচে পড়ল তারপর গড়িয়ে গড়িয়ে আমাদের দিকে আসতে নিল। আমি আর সায়রা আপু ভয়ে পেছন যেতে লাগলাম যতই, বাচ্চাটা ততই গড়িয়ে গড়িয়ে এগুতে লাগল। একটা সময় পর বাচ্চাটা এসে আমাদের দুজনের পায়ে ঝাঁপটে ধরল। আমি আর আপু ভয়ে কাঁপতে লাগলাম। এতটাই ভয় পাচ্ছিলাম যে নিজের কানে নিজের হার্টবিটের শব্দ শোনতে পারছিলাম। তবুও সাহস করে কাঁপা কাঁপা হাতে বাচ্চাটাকে ধরে টানতে লাগলাম। এমন সময় অনিক ভাই আর হাসিবের মৃত দেহটা সামনে এসে ঘুরতে লাগল। চারদিকে নিকষ অন্ধকারে ছেয়ে আছে সব। লাশ দুটো আর বাচ্চাটাকে ছাড়া যেন কিছুই দেখতে পারছি না। বাচ্চাটাকে টেনে হিঁচড়ে পা থেকে কোনোরকমে ছাড়িয়ে দূরে যেতেই এক ভয়ংকর পরিস্থিতির শিকার হলাম।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here