রাজমহল পর্ব -১১

#রাজমহল
#লেখিকা-শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-১১

দেরি না করেই ফুলটা তুলতেই একটা বিষয় লক্ষ্য করে থমকে গেলাম। লক্ষ্য করলাম ফুলটা তুলার সাথে সাথে ফুলের বোটা থেকে একটা আলোর রশ্নি বের হলো। আলোক রশ্নিটা একটা গোলাকার বৃত্তের ন্যায় ধারণ করলো। তারপর তার মাঝখানে একটা সুরঙ্গের মতো কিছু একটা তৈরী হলো। সেখানে কিছু জমাট বাঁধা পানি বলকের মতো উপরের দিকে উঠে ছাতার মতো ছড়িয়ে আবার নীচের দিকে পড়ে গেল। সে পরিশিষ্ট পানি থেকে এক নববধুর সাজে একটা মেয়ে বেরিয়ে আসলো।

মেয়েটাকে প্রথমে দেখেই চমকে গিয়েছিলাম কারণ এ মেয়ের মুখ অবয়বটায় হাসপাতালে সন্ধির মুখে ছিল। মেয়েটা আমার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। পেটের ফুলা দেখেই মনে হচ্ছে মেয়েটা প্র্যাগনেন্ট। মনে মনে ভাবতে লাগলাম এ কী আমার কল্পনা নাকি মতিভ্রম। বিষয়টা বুঝার জন্য কিছুক্ষণ চুপ হয়ে রইলাম। এর মধ্যেই মেয়েটার দিকে খেয়াল করে দেখলাম তার চোখ থেকে আষাঢ়ের মেঘ বয়ে চলছে। চোখের পানি দেখে নিজের মনে তার প্রতি একটা মায়া তৈরী হলো। চুপ থাকতে চেয়েও চুপ থাকতে পারছিলাম না। হুট করে বলেই ফেললাম

– তুমি কে? এখানে এসেছো কী করে? আর কাঁদছই বা কেন?

মেয়েটা আমার কথা শোনে আরও কান্নার আওয়াজ তুলল। আওয়াজটা কেন জানি বেশ অস্বস্তিকর লাগছিল আমার কাছে। কানটা চেপে ধরে বললাম

– কী হয়েছে বলবে তো? চুপ করে আছো কেন? আর এভাবে কান্না করলে বেশ অস্বস্তি লাগে। কে তুমি বলো?

মেয়েটা আমার কথা শোনে চোখটা হাত দিয়ে মুছতে মুছতে নিজেকে বেশ স্বাভাবিক করে বলল

– আমি রাণী জার্নিভা। রাজা মেহেদীরাজের সর্বকনিষ্ঠ স্ত্রী।

বলেই মেয়েটা চুপ হয়ে গেল।জার্নিভা নামটা শোনতেই সন্ধির কাহিনিটা মনে পড়ে গেল। সেও বলেছিল সে যেখানে গিয়েছিল সেখানে সবাই তাকে জার্নিভা বলে ডেকেছিল। তার মানে এ মেয়েটার জন্য আমাদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়ছে।আমি কিছুক্ষণ চুপ থেকে মেয়েটাকে বললাম

– কী চাও তুমি ? তোমার জন্য আমাদের জীবনে এত কালো ছায়া নেমে এসেছে। তোমার জন্য আজকে আমাদের পরিবারের কালো অধ্যায়ের সূচণা হয়ে আর সমাপ্তি হচ্ছে না।

জার্নিভা কিছুক্ষণ চুপ থেকে গম্ভীর গলায় বলল

– আমি প্রতিশোধ নিতে চাই। আমি তোমাকে এটাই বলতে এসেছি যে সন্ধির গর্ভের বাচ্চাটা আমার।যাকে এ পৃথিবীতে আসার পর মেরে ফেলা হয়েছিল।
সে আবার সন্ধির গর্ভ থেকে জন্ম নিয়ে তার মৃত্যুর প্রতিশোধ নিবে। আমি চাই আমার বাচ্চার কোনো ক্ষতি না হোক।পূর্বে কাউকে কিছু করতে পারেনি তবে এবার যদি তাকে আসতে কেউ বাঁধা দেয় তাহলে কাউকে ছাড়ব না।

– কাউকে ছাড়ব না মানে কী? কী ক্ষতি করেছি আমরা? কেন আমাদের সাথে এমন করছো তুমি? আর কাকে শাস্তি দিতে চাও? কিসের প্রতিশোধ নিতে চাও।আমরা তো কোনো দোষ করিনি।

– দোষটা তোমাদের পূর্বপুরুষদের যারা আমার সোনা বাচ্চাটাকে মেরেছে। এখন আমার এ বাচ্চাটা এসে এ বংশ ধ্বংস করে দিবে। পুরোপুরি নিঃশ্বেষ করে দিবে। কেউ আটকাতে পারবে না এ প্রতিশোধের খেলা থেকে।

– প্রতিশোধটা কিসের জন্য নিতে চাচ্ছ তুমি? কী করেছিল আমার পূর্বপুরুষ কেনই বা তারা তোমার বাচ্চাকে মেরে ফেলেছিল? কী হয়েছিল আমাকে খুলে বলো। কোনো সাহায্য করতে পারলে করব। তবে তার আগে আমাকে সবটা জানতে হবে। না জেনে কাউকে সাহায্য করা সম্ভব না। আমি চাই তুমি তোমার প্রতিশোধ নিতে সক্ষম হও। বলো কী হয়েছিল সেদিন।

জার্নিভা আমার কথাটা শোনে একটু আবেগী হয়ে জিজ্ঞেস করলো

– সত্যিই কি তুমি আমাকে সাহায্য করতে চাও?

– মিথ্যা কেন বলব?সত্যিই করতে চাই। বলো তুমি কী হয়েছিল সেদিন, যার জন্য তুমি এখনো অতৃপ্ত হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছ?

– তাহলে শোনো। তোমাদের বাড়িটা এখন যেখানে এককালে সেখানে ছিল রাজা মেহেদীরাজের রাজমহল। মেহেদীরাজের বংশধররা আমার মৃত্যুর পর এ বাড়ি ত্যাগ করে চলে যায়। আমাকে একশ বছরের জন্য এ বেলী ফুল গাছটায় আটকে রেখে যায়।

আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম

– তার মানে ঘটনাটা একশ বছর আগের?

– হ্যাঁ একশ বছর আগের। সময়ের পরিক্রমায় মেহেদীরাজের সকল বংশধররা ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে। তোমাদের বংশটা হচ্ছে রাজা মেহেদীরাজের বংশধর। এ জায়গাটাও সময়ের পরিক্রমায় পরিত্যাক্ত হয়ে পড়ে। একশ বছর পর আমার আত্না মুক্তি পায়। আর এ জায়গাটায় আমি অতৃপ্ত হয়ে ঘুরি ফিরি আর মেহেদীরাজের বংশধরদের অপেক্ষা করি। একটা সময় পর তোমার বাবা এ জায়গাটা কিনে নেয়।আমার বিচরণ এ জায়গায় ছিল বলে এ জায়গা যে দেখাশোনা করে সে এ জায়গাটা কমদামে বিক্রি করে দেয়। তোমার বাবা এ জায়গায় একটা বাড়ি করে যার নাম দেয় রাজমহল। বাড়ি করার সাথে সাথে আমার শক্তি বৃদ্ধি পায়।

তোমাদের বাড়ির পেছনের দিকে দেখবে একটা বকুল ফুল গাছ আছে। এক ভর সন্ধ্যায় সন্ধি সেখানে গিয়েছিল। দিন টা ছিল সেদিন যেদিন আমি জানতে পেরেছিলাম আমার কোল আলো করে একটা সন্তান আসবে। আর সন্ধির বয়সও ছিল একদম কম। আমিও পনের বছরে মা হয়েছিলাম তাই আমার বাচ্চাটা জন্ম দেওয়ার জন্য একটি পনের বছর বয়সী মেয়ে দরকার ছিল। যেহেতু সন্ধির বয়স পনের ছিল সেহেতু সন্ধি সেখানে যাওয়ায় আমি আমার সুযোগ কাজে লাগায়।তাই সেদিনেই সন্ধির গর্ভে আমার বাচ্চা আসে।

– কিন্তু কী হয়েছিল তোমার আর তোমার সন্তানের সাথে আমাকে খুলে বলো। কী প্রতিশোধ নিতে চাও সেটাও বলো।

– তাহলে শোনো অনেক আশা নিয়ে রাজা মেহেদীরাজকে বিয়ে করেছিলাম। আমি ছিলাম রাজা মেহেদীরাজের সর্বকনিষ্ঠ স্ত্রী। এর আগে উনার আরও তিনটে স্ত্রী ছিল তবে তারা কোনো উত্তরাধিকার দিতে পারেনি রাজা মেহেদীরাজকে। তাই আমাকে মূলত বিয়ে করেছিল উত্তরাধিকার পাবার আশায়। বিয়ের পর বছর ঘোরার আগেই আমি জানতে পারি যে আমি মা হতে চলেছি। চারদিক বেশ আনন্দ মুখর পরিবেশ। সারা রাজ্য তখন খুশির জোয়ারে ভাসছিল। এক দায়কে আনা হয় আমার পরীক্ষা করার জন্য। দায় আমার পরীক্ষা করে জানায় যে আমি দুই বাচ্চার মা হতে চলেছি। আস্তে আস্তে সময় যায়। এভাবে দুমাস কেটে যায়। আবারও দায়কে আনা হয় পরখ করার জন্য। এবার দায় জানায় যে আমার পেটে একটা বাচ্চায় হবে।

আমি অবাক হয়ে জার্নিভার কথা শোনে বললাম

– এজন্যই কি সন্ধির প্রথম রিপোর্টে জমজ বাচ্চা হবে বলেছিল আর দ্বিতীয় রিপোর্টে বলেছে জমজ বাচ্চা হবে না।

– হ্যাঁ এজন্যই।

– তাহলে আমি ঐরকম কেন দেখলাম যেখানে একটা বাচ্চা ভালো ছিল আরেকটা বাচ্চা দেখতে খারাপ। আমি তো ভেবেছিলাম সন্ধির পেটে শুভ অশুভ দুটো বাচ্চায় আছে এর ব্যাখা কি বলো? কেন এমনটা দেখেছিলাম।

– এর ব্যাখা হলো যখন বলা হয়েছিল যে আমার দুটো বাচ্চা হবে তখন একজন সাধক বলেছিল একটা বাচ্চা ভালো সবকিছুর প্রতীক হবে অপর বাচ্চা খারাপ সবকিছুর প্রতীক হবে। এ নিয়ে বেশ দুশ্চিন্তায় ছিলাম। কিন্তু পরে তো প্রমান হয় যে আমার গর্ভে একটা বাচ্চায় হবে। পূর্বে দায় পরখ করতে ভুল করেছিল।

– ওহ আচ্ছা তাই বলো। তারপর কি হয়েছিল বলো।

– তারপর সময় যেতে থাকে আমার সন্তান আমার গর্ভে বড় হতে থাকে। আমার সন্তান আমার পেটে খেলা করতে থাকে। আমি তার প্রতিটা স্পন্দন যেন শোনতে পারতাম। অনুভব করতে পারতাম তাকে। সে অদ্ভুত অনুভূতি প্রকাশ করার মতো না। রাজার বড় বউ গুলোও আমাকে বেশ আদর যত্ন করত এজন্য যে আমার গর্ভে বংশধর আসতে চলেছে৷ খুব সুখের সময় কাটিয়েছিলাম। কিন্তু সে সুখটা বেশিদিন টিকেনি।

বলেই জার্নিভা চুপ হয়ে গেল।আমি অস্থির গলায় বললাম

– কেন কী হয়েছিল? অন্য রাণীরা কি কোনো ষড়যন্ত্র করেছিল।

জার্নিভা দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস নিয়ে বলল

– নাহ অন্য রাণীরা আমাকে তাদের বোনের মতো আদর করতো। তারা কিছুই করেনি।

– তাহলে?

– সময় পার হয়ে আস্তে আস্তে বাচ্চা হওয়ার তারিখ আসলো। ইচ্ছা ছিল আমার ছেলে বাচ্চা হলে নাম রাখব রিদয়রাজ আর মেয়ে হলে নাম রাখব রিদি।সেদিন ছিল পূর্নিমার রাত আমার প্রসব ব্যাথা শুরু হয়। তাড়াহুড়ো করে দায় আনা হয়। অনেকক্ষণ প্রসব ব্যাথা সহ্যের পর আমার কানে বাচ্চার কান্না আসে। আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলি।

বাচ্চা হওয়ার সাথে সাথে সবাই আতঙ্কিত হয়ে বলতে থাকে এ বচ্চা অশুভ। মেহেদীরাজের কাছে সংবাদটা পৌঁছালে সেও আমার বাচ্চাটাকে খুন করার আদেশ দেয়। আমার কোল থেকে সেদিন আমার কলিজাটা কেড়ে নিয়ে আমার বাচ্চাটাকে মাথা আলাদা করে খুন করা হয়। কিছুক্ষণ পর আদেশ আসে আমাকে খুন করার। অপরাধ একটায় আমি অশুভ বাচ্চা গর্ভে ধারণ করে রাজার বংশকে কলঙ্কিত করেছি। সেদিন আমাকে টেনে হিচঁরে নিয়ে যায় আর আমার বাচ্চার মতো আমারও গলা আলাদা করে দেওয়া হয়। সেদিনের পর থেকেই আমার আত্না অতৃপ্ত হয়ে রাজবাড়িতে ঘুরতে থাকে। রাজা মেহেদীরাজের আদেশে এক সাধক আমায় বন্ধী করে এ বেলী ফুল গাছটার নীচে আটকে রাখে একশ বছরের জন্য। তারপর রাজা মেহেদীরাজ এ মহল পরিত্যাক্ত করে নতুন মহলে উঠে। একশ বছর পর আমার আত্না মুক্তি পায়। তবে প্রতিশোধের আগুন এখনো আমার মন থেকে যায়নি।

বলেই জার্নিভা চুপ হয়ে গেল। জার্নিভার কথা গুলো শোনে আমার চোখে যেন সব ঘটনা ভাসছিল। বুকটা কেঁপে উঠেছিল এসব ভেবে। তবে মনে প্রশ্ন জাগল জার্নিভার বাচ্চাকে কেন অশুভ বলল? তাই হালকা গলায় জার্নিভাকে বললাম

– কিন্তু তোমার বাচ্চাকে অশুভ বলার কারণ কী ছিল?

তারপর জার্নিভা যা বলল তা শোনে বুকটা কেঁপে উঠল।

(কপি করা নিষেধ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here