#রাজমহল
#লেখিকা-শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-২
ডাক্তার চেকআপের পর সন্ধির প্র্যাগন্যান্সি নিশ্চিত করার সাথে একটা চাঞ্চল্যকর তথ্য দিল। ডাক্তার জানালো যে সন্ধি জমজ বাচ্চার মা হতে চলেছে। আর তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বা। ডাক্তারের কথা শোনে আমার মাথায় বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে লাগল। গলার স্বর ভারী হয়ে যেতে লাগল। সন্ধি কারও সাথে কিছু করেছে কিনা এটা ভেবে মনে হাজারটা প্রশ্নের ঝড় বইতে লাগল। তার উপর সন্ধি বলেছিল দুইমাস আগে তার পিরিয়ড হয়েছিল। তাহলে পেটে বাচ্চা থাকলেও তো সেটা দুইমাসের বেশি হওয়া সম্ভব না কিন্তু তিনমাসের অন্তঃসত্ত্বা কীভাবে হয়?তাহলে কি সন্ধি ভয়ে মিথ্যা বলল? প্রশ্নগুলো মাথায় তালগোল পাঁকাতে লাগল। পাশেই সন্ধির দিকে তাকিয়ে দেখলাম ভয়ার্ত মুখের আদল নিয়ে বসে আছে। আমি নিজেকে সামাল দিয়ে ডাক্তারকে স্থিত গলায় বললাম
– আপনি কি নিশ্চিত সন্ধি প্র্যাগন্যান্ট? আর ও তো বলেছিল ওর পরিয়ড হয়েছিল দুমাস আগে। তাহলে তিনমাসের অন্তঃসত্ত্বা হয় কী করে?
ডাক্তার জোর গলার জবাব দিল
– অবশ্যই নিশ্চিত। আল্ট্রা রিপোর্ট দেখুন। আর আমাকে ও ঠিক করে ডেটটা বলতে পারেনি। দুই তিনমাস আগে হয়েছে বলেছে আমি সেটার ভিত্তিতেই রিপোর্ট করেছি। জমজ বাচ্চার মা হতে চলেছে আপনার বোন। এত অল্প বয়সে কনসিভ করেছে ব্যাপারটা কিন্তু বেশ ভয়ের। তার উপর জমজ বাচ্চা হবে। সাবধানে রাখবেন আর ভালো মন্দ খেতে দিবেন।
আমি কোনোরুপ কথা না বলে মাথা নাড়িয়ে চেম্বার থেকে প্রস্থান নিলাম। সারা রাস্তা সন্ধিকে জেরা করতে লাগলাম। সন্ধি তার কথাতেই অটল রইল। একই কথা বারবার বলতে লাগল যে, সে কারও সাথে কিছু করেনি। বাসায় এসেও আমার রাগটা আমি থামাতে পারছিলাম না। তবুও রাগ নিবারণের যথেষ্ট চেষ্টা করছিলাম। সায়রা আপু জানলে বিষয়টা আরও গোলমেলে হবে। তবে এখন আমি কি করব? কীভাবে সন্ধির মুখ থেকে সত্যটা বের করব সেটাই চিন্তার বিষয়।
ড্রইং রুমে মনের অগোচরে সোফায় বসে আনমনে এসবেই ভাবছিলাম। এমন সময় সায়রা আপু মাথায় ধাক্কা দিয়ে বলল
– কি রে বসে বসে কি ভাবছিস? দুপুর গড়িয়ে বিকাল হতে চলল। খাবি কখন?
আমি ভাবনার অতল সাগর থেকে নিজেকে বের করে এনে বললাম
– হুম এখনেই খাব।
– তা তোর বান্ধবীর বাবা কেমন আছে?
– হ্যাঁ ভালো আছে এখন। কালকে আবার একটু হাসপাতালে যাব উনাকে দেখতে।
– সে না হয় যাস। এখন খেতে চল।সন্ধি কোথায়?
সন্ধির কথা বলতেই আমার মাথায় একগুচ্ছ প্রশ্ন চড়াও করে উঠল পুনরায়। চুপ করে ঘুরপাক খাওয়া প্রশ্নগুলোর উত্তর বের করার চেষ্টা করছিলাম। সায়রা আপু আমার নীরবতা দেখে মাথায় পুনরায় ধাক্কা দিয়ে বলল
– কি রে কি হয়েছে তোর? এত চুপচাপ কেন? আর কি এত ভাবছিস?
– নাহ কিছু না। ঐ তো আন্কেলের কথা ভাবছিলাম। আমি দেখছি সন্ধি কোথায়৷ ঘরেই আছে হয়তো। তুমি যাও টেবিলে। আমি সন্ধিকে নিয়ে আসছি।
বলেই সোফা থেকে উঠে দাঁড়ালাম। বরাবর আমার রুমের দিকে এগুলাম।দরজার সামনে যেতেই খেয়াল করলাম সন্ধি হাঁটু মুড়ি দিয়ে হাঁটুর উপর মাথা ঠেঁক দিয়ে খাটে বসে আছে। কাছে গিয়ে পিঠে হাত রাখতেই ভয় পেয়ে আমার দিকে তাকাল। লক্ষ্য করলাম অজোর ধারায় শ্রাবণের বৃষ্টি তার চোখ দিয়ে বইছে। কিছুটা অস্বস্তি হচ্ছিল তার কান্না দেখে। পাশে বসে তার চোখটা মুছে দিলাম। আমার আলতো হাতের স্পর্শ পেয়ে সে আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিয়ে বলল
– তন্দ্রা আপি সত্যিই আমি কিছু করিনি। তুই আমাকে ভুল বুঝিস না। এখন আমি কি করব?আমার তো কিছুই ভালো লাগছে না। আমি কিছু করলে তো তোকে বলতাম। আর আমি তো পড়ি গার্লস স্কুলে ছেলে কোথায় পাব? আর আমার তো মোবাইল নেই যে কোনো ছেলের সাথে প্রেম করব।
আমি বুঝতে পারছিলাম না কি বলব। সন্ধির কথাতেও বেশ যুক্তি ছিল।আবার প্র্যানেন্সির বিষয়টাও সঠিক। কোনটা বিশ্বাস করব কোনটা করব না সেটাই এখন বড় বিষয়।বেশ অসহায় লাগছিল তখন। সন্ধিকে অবিশ্বাস করতেও বেশ কষ্ট হচ্ছে আবার বিশ্বাস করতেও পারছি না।উভয় সংকটে পড়ে গেলাম মনে হচ্ছে। কিছু না বলে সন্ধির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললাম
– চিন্তা করিস না।কালকে ডাক্তারের সাথে কথা বলে গর্ভপাতের ব্যাবস্থা করে আসব। কারও সাথে কিছু না করলে প্র্যাগনেন্ট হতি না। অবশ্যই কিছু করেছিস। জানি তোকে জিজ্ঞেস করলে মিথ্যায় বলবি। এখন তো গর্ভাপাত ছাড়া কোনো উপায় নেই এটাই করিয়ে আসব আগে।আর যার সাথেই এ নিকৃষ্ট কাজটা করেছিস দ্বিতীয় বার করার আগে ভেবে করিস। কারণ নিজের সন্তান খুন করতে হচ্ছে তোকে আর যেন সেটা করতে না হয়।
সন্ধি আমার কথা শোনে জোরে কেঁদে দিয়ে বলল
– কেন যে তুই আমাকে বিশ্বাস করছিস না। তোকে তো আমি সব বলি এমন কিছু হলে তো লুকাতাম না। আমাকে বিশ্বাস কর প্লিজ।
আমি সন্ধির কথাটা এড়িয়ে গিয়ে বললাম
– এখন আর এসব বলতে হবে না। চল এবার খেতে চল। বিষয়টা সায়রা আপুর কানে যেন না যায়। সায়রা আপু জানলে প্রাণে মেরে ফেলবে তোকে, সেই সাথে আমাকেও। তাই বিষয়টা নিয়ে কোনো বাড়াবাড়ি কান্নাকাটি আর দেখতে চাই না। হাত মুখ ধুয়ে টেবিলে আয়। চুপচাপ খেয়ে উঠবি।
সন্ধি আমার কথা শোনে হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ গুলো মুছতে লাগল। আমি সন্ধির দিকে তাকিয়ে থাকার সাহস করলাম না কারণ তাকিয়ে থাকলে পুনরায় আবেগে গধোগধো হয়ে যাব।চুপ করে রুম থেকে বের হয়ে চলে আসলাম। টেবিলে গিয়ে খেয়াল করলাম আপু খাবার নিয়ে চুপ করে বসে আছে। আমি যেতেই আপু বলে উঠল
– আয় খেতে বস। সন্ধি আসবে না?
– আসতেছে ও।
– ভাইয়া আসবে কখন?
– তোর ভাইয়া ব্যবাসায়ের কাজে ঢাকায় গেছে আসতে কয়েকদিন দেরি হবে।
উল্লেখ্য যে ভাইয়া সায়রা আপুর সাথে আমাদের বাড়িতেই থাকে। কারণ আপু শ্বশুর বাড়ি চলে গেলে আমাদের দেখার মতো কেউ থাকবে না তাই আপু এ রাজমহলেই থাকে। রাজমহল বলতে এটা রাজাদের রাজমহল না। এটা আমাদের বসবাসকৃত বাসাটা।আমার বাবার শখ ছিল রাজাদেের মতো বাড়ি বানাবে। তাই শহর থেকে একটু দূরে নিরিবিলি একটা জায়গায় লোকালয়ের একটু আড়ালে স্বস্তায় জমি কিনে। জমিটা পানির দামে পেয়েছিল একদম। তারপর সে জমিতে এ বাড়িটা বানিয়েছিল আর নাম দিয়েছিল রাজমহল। দুঃখের বিষয় এটাই যে আমার মা বাবার কেউ এ বাড়িতে থাকতে পারেনি। যেদিন আমরা এ বাড়িতে শিফট হই সেদিন বড় একটা এক্সিডেন্ট হয়। সে এক্সিডেন্টে আমরা তিন বোন বেঁচে গেলেও বাবা মা মরে যায়। বাবা মা এ বাড়িতে এসেছিল তবে লাশ হয়ে। নিজের বানানো রাজমহলটা সাজানোর পর বাবা এ বাড়িটা দেখতে পারেনি এটা ভেবেই কষ্টে বুক ফেটে যায় এখনো। এরপর থেকে আমরা তিন বোনেই এ বাড়িতে থাকি। মা বাবা বিহীন এতিম মেয়ে। এর মধ্যে তিনমাস আগে সায়রা আপুর অনিক ভাইয়ার সাথে বিয়ে হয়। বেশ ভালোই চলছিল আমাদের জীবন। তবে সন্ধির বিষয়টা এখন ভাবাচ্ছে বেশি।
যাইহোক ঘটনায় আসা যাক। আমি আপুকে আমার মুখটা হালকা প্রশস্ত করে বললাম
– আচ্ছা তাই বলো।
এর মধ্যেই সন্ধি উপস্থিত হলো টেবিলের সামনে। চেয়ারটা টেনে বসলো। সায়রা আপু দুজনকে খাবার দিল। দুজনেই খাবারটা নিয়ে নাড়তে লাগলাম। গলা দিয়ে যেন খাবার নামছে না। সায়রা আপু কিছুটা দমক দিয়ে বলল
– তোরা খাবার না খেয়ে এমন ভাবে বাচ্চাদের মতো খাবার নাড়ছিস কেন?
সায়রা আপুর তীর্যক কন্ঠে দুজনের ভেতরেই ধক করে উঠল। দুজনেই আমতা আমতা করে একসাথে বলে উঠলাম
– খেতে ইচ্ছা করছে না।
সায়রা আপু গলাটা বজ্রপাতের ন্যায় কর্কশ করে বলল
– দশ মিনিটের মধ্যে সব খাবার শেষ কর। নাহয় পিটিয়ে পিঠের ছাল তুলব। সারাদিন খাবে না তারপর মাথা ঘুরে পড়বে আর বলবে আমার কেমন জানি লাগছিল। চুপ চাপ খেয়ে উঠ।
আমি আর সন্ধি সায়রা আপুর বকা শোনে চুপচাপ খেয়ে উঠলাম। যদিও জোর পূর্বক গিলেছি শুধু।রুমে এসে দুজনেই শুলাম। সন্ধি ঐদিক ফিরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে আর আমি একবার এপাশ আরেকবার ওপাশ হয়ে শুধু ভাবছি কি করব। বাচ্চা গর্ভপাত করাতেও মন সায় দিচ্ছে না। জমজ দুইটা বাচ্চার খুনী হব ভেবেই যেন বুকে কষ্টের বান বিদ্ধ হচ্ছিল। নিজেকে সামলাতে পারছিলাম না। হালকা পানি পড়তে লাগল চোখ দিয়ে। কাঁদতে কাঁদতেই মাথায় ঘুরতে থাকা সব এলোমেলো প্রশ্ন নিয়ে ঘুমিয়ে গেলাম।
আমি ঘুমিয়ে গেলেও সন্ধি ঘুমায়নি। হুট করে তার মনে হলো সন্তান খুনের চেয়ে মরে যাওয়া অনেক ভালো। তার উপর এতকিছু হচ্ছে যার কোনো ভিত্তি নেই। এসব ভেবে মনের অশান্তি বাড়ছিল তার। কচি বয়স, বাচ্চা মেয়ে তার চিন্তা ভাবনার বিস্তৃতিও কম। তাই সিদ্ধান্ত নিল যে,নিজেকে শেষ করে দিবে। যেই চিন্তা সেই কাজ। বুকের উড়নাটা ফ্যানে ঝুলিয়ে দিয়ে খানিকক্ষণ চুপ থেকে ঝুলে পড়ল।
সকাল বেলা এটুকু ঘটনা বলেই সন্ধি হাঁপাতে লাগল। সন্ধির মুখ থেকে এটুকু শোনে আমি অবাক হয়ে বললাম
– তুই যদি ফ্যানে ঝুলে পড়িস তাহলে তো তোর মরে যাওয়ার কথা কিন্তু বেঁচে আছিস যে?
সন্ধি গলার স্বরটা গম্ভীর করে বলল
– তারপর যা হয়েছিল সেটার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। এমন কিছু হবে আমি চিন্তা করেনি। কেনই বা এমন হলো সেটার যৌক্তিক কারণ আমার জানা নেই। জানিনা তুই বিশ্বাস করবি কিনা। তবে সত্যি যা ঘটেছে তা বিশ্বাস যোগ্য না।
আমি সন্ধির কথা শোনে অবাক চোখে তার দিকে খেয়াল করে দেখলাম তার কপালে ইষৎ ঘামের আভাস পড়েছে। নীচের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করছে। আমি হালকা হাতে তার বাহু ধরে বললাম
– কী হয়েছে?
সন্ধি আমার দিকে তাকাল। তাকতেই সন্ধির চোখগুলো দেখে ভয় পেয়ে গেলাম। খেয়াল করলাম চোখ দুটো লাল হয়ে ফুলে আছে। হুট করে চোখ ফুললো কীভাবে ব্যাপারটা বেশ অদ্ভুত লাগল।আর চোখটা এমনভাবে লাল হয়ে ফুলেছে যে চোখের মনি ছাড়া কিছুই দেখা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে এভ্রোথেভ্রো পাহাড়ের টিলা চারপাশে উঠে চোখটা গর্তে চলে গেছে। সন্ধির এ অবস্থা দেখে ভয় পেয়েও নিজেকে সামলে নিলাম। এর মধ্যে সন্ধি তড়িৎ গতিতে নিঃশ্বাসটা জোরে জোরে নিয়ে বলল-
চলবে?
।