#রুপকথা। পর্ব-৫
লেখক- ইতি চৌধুরী
গাল বেয়ে পরা চোখের পানি আর হাত বাড়িয়ে মোছার চেষ্টা করে না রোদ। পড়ুক তারা নিজের মতো।
ডায়েরির পাতায় আবার মনোনিবেশ করে সে। তারপর,
আমি আমার রুপকথার রাজ্য, রুপকথার রাজকুমার কে ছেড়ে পাড়ি জমিয়েছি বহু দূর।
হাসপাতালের বিছানায় মৃত্যুর প্রহর গুনতে গুনতে, শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের অপেক্ষায় তোমার জন্য আমার পার্থিব জীবনের শেষ লেখা। আমার প্রথম ও শেষ চিরকুট তোমার নামে।
রিতুকে বলে দিয়েছি আমি মরে যাওয়ার পর যেন কোনো একদিন ডায়েরিটা তোমার কাছে পৌঁছে দেয়। সঙ্গে যেন তোমার হাতে গুঁজে দেয় আমার লেখা শেষ চিরকুটটাও।
জানো তোমাকে কেনো এসব লিখছি?
তোমাকে দেখার বা জানার সময়টা হয়তো অল্প ছিল। কিন্তু এই অল্প সময়ে আমি আমার সবটা দিয়ে তোমায় চেয়েছি। ভীষণ চেয়েছি। আমার জীবনের ভালোলাগা, প্রেম, ভালোবাসা শুধুই তুমি। আমার মনের জমিনে তোমাকে দাফন করে চলে যেতে চাইনা বলেই এই বলে যাওয়া। আমি চাই তুমি জানো, তোমাকে কেউ একজন তার জীবনের শেষ দিন অব্দি ভালোবেসেছিল। কেউ একজন মৃত্যুশয্যায় নিজের মৃত্যুর অপেক্ষা করতে করতে তোমায় ভালোবেসেছে। কেউ একজন তার জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত তোমায় ভালোবেসে গেছে।
ভেবো না আমি আমার ভালোবাসা তোমার ওপর চাপিয়ে দিয়ে যাচ্ছি। চাপিয়ে দিয়ে ভালোবাসা হয় না। তোমার আমায় ভালোবাসতে হবে না। তুমি শুধু জেনে রাখো কেউ একজন তোমায় ভালোবেসে ছিল। তোমায় ভালোবাসতে বাসতেই চলে গেছে সে। চলে যাওয়ার সময়ও সে তোমার ভালোবেসেছে। আমি শুধু চাই আমার ভালোবাসা আমার সাথে হারিয়ে না যাক। তুমি জেনে রেখো। যেন কোনো একদিন, কোনো এক পড়ন্ত বিকেলে কেউ জিজ্ঞেস করলে তুমি বলতে পারো তোমাকেও কেউ ভালোবাসে। আমার ভালোবাসাটা বেঁচে থাকবে তোমার জানার মধ্য দিয়ে। সেই ভালোবাসার কথায় বেঁচে থাকবো আমিও।
তোমার কোনো দায় নেই। আমাকে ভালোবাসার দায় তোমাকে নিতে হবে না। তোমাকে ভালোবাসার দায় কেবল আমার। তুমি শুধু জেনে রেখো আমি ভালোবাসি তোমায়। তোমার পৃথিবীতে আমার অস্তিত্ব নেই তবু আমার ভালোবাসা ছিড়িয়ে ছিটিয়ে থাকবে তোমার নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাসে।
রোদ শুনছ? ইতি ভালোবাসে তোমায়।
ডায়েরির এরপরের পাতাগুলো সাদা। ইতি হয়তো আর সময় পায়নি তার রোদকে লিখবে বলে। সময়ে ফুরিয়ে গেছে তার।
ডায়েরিটাকে খুব শক্ত করে বুকের সাথে ঝাপটে ধরে রোদ। ইচ্ছে হচ্ছে বুক দাপটে কাঁদতে কিন্তু সেই সাধ্য আপাতত তার নেই। তার মনের ঘরে খুব সন্তপর্ণে জন্ম নেয়া ভালোবাসা হারিয়ে গেছে বহুদূর। তার ধরা ছোঁয়ার সীমানার অগোচরে। ভাবতেই বুকের ভেতরের হু হু টা বেড়ে ওঠে। কান্নার দমকটা বেড়ে ওঠে। মনে হচ্ছে যেন তার ভালোবাসাটা ঠিকঠাক বেড়ে ওঠার আগেই তা কেউ পায়ের পিষ্ঠে মাড়িয়ে দিয়েছে। আর কিছু ভাবতে পারে না সে। দুনিয়া ভাঙচুর হয়ে আসছে তার। ভালোবাসার মানুষকে ভালোবাসি বলতে না পারার কষ্ট জানান দেয় তার বুকের ভেতর। একবার ভালোবাসার মানুষটাকে কাছ থেকে দেখার, ছুঁয়ে দেয়ার ইচ্ছা তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে ওঠে যেন। ভালোবাসার মানুষকে ভালোবাসি বলতে পারবো না। তাকে এক দন্ড দেখতে পারবো ছুঁয়ে দেখা তো বহু দূরের কথা। এসব ভাবনাই যেন সব ওলোট পালোট করে দেয়। খুব সূক্ষ্ম একটা কষ্ট কমড়ে ধরে বুকের ভেতর। এত কঠিন কষ্টও আছে পৃথিবী। যা কাউকে দেখানো যায় না কিন্তু ভেতরা ক্ষতবিক্ষত করে দেয়। এই কষ্টের হাহাকার কাউকে দেখানো যায় না। ভালোবাসি বলতে না পারার কষ্ট যেন এক জীবন ভালোবেসেও পোষাবার নয়। রোদের ভেতর থেকে হু হু করে চিৎকার আসে। সে বলতে চায়, আমিও ভালোবাসি তোমায়। কিন্তু শুনার মানুষটা আজ আর নেই তার পৃথিবীর কোথাও।
পাঁচ বছর পর।
বর্ষাকাল বলেই এখন নয় তখন, যখন নয় তখন বৃষ্টি। তুমুল বৃষ্টি না হলেও টিপটিপ বর্ষণ চলতেই থাকে। কোনো থামাথামি নেই।
রোদ দাঁড়িয়ে আছে আজিমপুর কবরস্থানে। ঠিক ইতির কবরের সামনে দাঁড়িয়ে সে। পাঁচ বছর আগে সেদিন তার সাহস হয়নি এই মানুষটার কবরের সামনে এসে দাঁড়ানোর। হয়তো দূর্বল হয়ে পরতো সে। দূর্বল হতে চায় না বলেই তখন আর আসেনি। দীর্ঘ পাঁচ বছর অপেক্ষা করেছে এই দিনটার জন্য। তাই এয়ারপোর্ট থেকে সোজা এখানে এসেছে তার না হওয়া প্রিয়তমার সঙ্গে দেখা করতে। তাকে বলতে, আমি এসেছি প্রিয়া।
পাঁচ বছর আগে সেই ডায়েরির সঙ্গে থাকা চিরকুটে ইতির কবরস্থানের ঠিকানা লেখাছিল। সেই সঙ্গে আরও লেখাছিল,
তুমি আসবে কি একবার আমায় দেখতে? একবার আমায় প্রিয়তমা বলে ডাকতে?
বলাবাহুল্য ইতি বলে গিয়েছিল বলে সেই মোতাবেক এই চিরকুটে রিতুই তার কবরস্থানের ঠিকানাটা লিখে দিয়েছিল।
রোদের মাথায় কোনো ছাতা নেই। সে অনুভব করতে পারছে সে একা নয়। তার সঙ্গে তার প্রিয়তমাও ভিজছে টিপটিপ বৃষ্টির পানিতে। এই মুহূর্তে ঝুম বৃষ্টি হলে ভালো হতো। দু’জনে প্রাণ ভরে ভিজতে পারতো এই খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে।
হাত বাড়িয়ে চোখের গ্লাসটা নামিয়ে মস্তো এক হাসি মুখে টেনে রোদ বলে,
‘তুমি দায় দিয়ে যাওনি তবু তোমাকে ভালোবেসে সে দায় আমি বয়ে বেরিয়েছি। ভালোবাসলে সে দায় নিতে হয়। আমিও নিয়েছি। তুমিও জেনে রেখো, তোমাকে পাবো না, ছুঁয়ে দেখতে পারবো না জেনেও এই আমি তোমায় ভালোবেসে যাচ্ছি প্রতি মুহূর্ত। তাই ওপারে থাকলেও জেনে রাখো, এপারে কেউ তোমায় ভীষণ রকম ভালোবাসে। রুপকথা আমিও বিশ্বাস করতাম না। তবে যখন থেকে জানলাম আমি কারো রুপকথার রাজপুত্র তখন থেকে বিশ্বাসটা হয়েই গেল। এখন কেউ জিজ্ঞেস করলেই বলি আমি আমার প্রিয়তমার রুপকথার রাজপুত্র। নাহলো আমাদের রুপকথার হ্যাপি এন্ডিং। দিনে শেষে আমরা একে অপরকে ভালোবাসি তাই যথেষ্ট নয় কি?
জেনে রাখো প্রিয়তমা, ভালোবাসি আমিও।
সমাপ্তি।