মেঘের ওপারে মেঘ,পর্ব:১

অবশেষে সায়রার বিয়ে হলো!

উনিশ বছর আগে এক উন্মাদ বলেছিল, সায়রার কখনো বিয়ে হবে না। আর যদি হয়, তা হলে সায়রার সঙ্গে মিলিত হবার পরেই তার স্বামী মারা যাবে। আর সায়রার পুরো শরীরে লোম গজাবে। এবং সে আরো বলেছিল, সায়রার সঙ্গে যার বিয়ে হবে তার নামের প্রথম অক্ষর হবে এস।

বিকেল চারটায় বিয়ে। কনের গাড়ি রংধনু কনভেনশন সেন্টারে গিয়ে পৌঁছাল সাড়ে তিনটা নাগাদ। বিয়ের সাজে সজ্জিত সায়রা গাড়ি থেকে নামতেই ক্যামেরাম্যান তার ক্যামেরা নিয়ে ছুঁটে এল। সায়রা এদিক ওদিক, এভাবে সেভাবে দাঁড়িয়ে পোজ দিচ্ছিল। দূরে ডান দিকের দেয়ালে চোখ পড়ল হঠাৎ। দেয়ালের আড়ালে কেউ দাঁড়িয়ে আছে কি?
সায়রা স্পষ্ট দেখল দেয়ালের আড়ালে লুকিয়ে থাকা মানুষটাকে। পুরো শরীর নয়, কেবল মাথাটা দেখা যাচ্ছে। মাথায় এক ঝাঁকড়া নোংরা চুল। মুখে কালি মাখা। লোকটা হাসছে। তার ময়লা দাঁতগুলো দূর থেকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। লোকটা আর কেউ না, স্বয়ং সেই উন্মাদ। যে কিনা উনিশ বছর আগে বলেছিল, সায়রার বিয়ে হবে না। আর যদি হয়, তা হলে তারা একসঙ্গে মিলিত হবার পরেই তার স্বামী মারা যাবে। আর সায়রার পুরো শরীরে লোম গজাবে। কিন্তু, এত বছর কোথায় ছিল লোকটা? আজকেই কেন আসতে হলো তাকে? সে কি তবে এই দিনটার অপেক্ষাই করছিল? তবে কি তার কথাই ঠিক?

ভাবতে ভাবতে সায়রার মাথা ভনভন করতে লাগল। সে সবকিছু ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করল। এসব উটকো ভাবনা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে উন্মাদটার সঙ্গে একবার কথা বলবে ঠিক করল। কিন্তু ততক্ষণে চারপাশে ভিড় জমে গেছে। ক্যামেরাম্যানের সহকারী লোকজনকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। ক্যামেরাম্যান একের পর এক ছবি তুলছে। সায়রার বাবা মনজুরুল ইসলাম এবং মা জিন্নাতুন নুর ভীড় ঠেলে এগিয়ে এসেছেন। সায়রার সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। সে সবাইকে উপেক্ষা করে জটলা ডিঙিয়ে এগিয়ে গেল। গাদাগাদি ভিড়ের মাঝে সবাইকে দেখা গেলেও উন্মাদটাকে আর পাওয়া গেল না। দেয়ালের আড়ালেও না। ওপাশের খোলা বাউন্ডারিতেও না।

সায়রা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। যাক! হয়তো মনের ভুল ছিল! এই ভেবে সে এক পা এক পা ফেলে কনভেনশন সেন্টারের ভেতরে চলে যেতে লাগল। কিন্তু সে জানত না, কী অপেক্ষা করছে তার জন্য। কতটা ভয়ানক সময় এগিয়ে আসছে তার দিকে।

বিয়ে শেষ হলো বিকেল পাঁচটায়। ততক্ষণে সূর্য পশ্চিম দিকে হেলে পড়েছে। দূরের মসজিদের মিনার থেকে আজানের আওয়াজ ভেসে আসছে। সায়রার মা জিন্নাতুন নুর সায়রাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছেন। সায়রার দৃষ্টি তখন সেই শেওলা জমা দেয়ালের ওপাশে। আড়াল থেকে কে যেন তাকিয়ে আছে। সেই উন্মাদটা। এখন আর তার মুখে হাসি নেই। সে বোধহয় কাঁদছে! সায়রা ভালো করে তাকাল। উন্মাদটা ঘেমে একাকার। সে বারবার দু’হাতের পিঠ দিয়ে চোখ মুছছে। আর উৎসাহ নিয়ে জটলার দিকে তাকাচ্ছে। তার হাতে একটা শপিং ব্যাগ। সায়রা দূর থেকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখল উন্মাদের হাতে থাকা ব্যাগের উপর। ধবধবে সাদা ব্যাগের উপর লাল ছাপা রঙে লেখা, লতিফ স্টোর। এখানে পাইকারি ও খুচরা মূল্যে কাফনের কাপড় বিক্রি করা হয়।

‘সায়রা মা, ওমা, মা আমার, কাঁদ না মা! একটু কাঁদ। এক ফোঁটা চোখের জল ফেল। মা, ওমা! কাঁদ না!’ জিন্নাতুন নুর আবেগে লুটিয়ে পড়ছেন সায়রার গায়ে। সায়রা কাঁদছে না। হাসছেও না। তার চোখ-মুখে উদ্বেগ, উৎকন্ঠা। জিন্নাতুন নুর মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে পুনঃপুন কেঁপে উঠছেন। এমন কেন তার মুখ? তার চোখদু’টো হঠাৎ এমন হয়ে গেল কেন? জিন-ভূতের আসর নয় তো! অজানা ভয়ে আঁকতে উঠছেন তিনি। বিয়ের দিন কনেকে ভূতে ধরেছে এমন ঘটনা তিনি অনেক শুনেছেন। শুনতে শুনতে তার ধারণা হয়েছে, বিয়ে বাড়িতে কনেকে সাজানো হয় সবচে’ বেশি। আর এই বেশি সাজগোজের ফলেই কনেকে জিনের ভালো লেগে যায়। যার ফলে সেই জিন কনের উপর ভর করে। তাকে জিনেদের দুনিয়ায় নিয়ে যাবার চেষ্টা করে।
জিন্নাতুন নুর ড্যাবড্যাব করে সায়রার মুখের দিকে তাকাচ্ছেন আর মনে মনে আয়াতুল কুরসি পড়ছেন।

বরের গাড়িটা মৃদু কম্পন তুলে কনভেনশন সেন্টার পেরিয়ে মূল সড়কে উঠেছে। গাড়িতে এয়ার কন্ডিশন চলছে। তবুও সায়রার গা থেকে দরদর করে ঘাম ঝড়ছে। সে অনেক চেষ্টা করেও উন্মাদটার কথা ভুলতে পারছে না। একবার সে মা’র কথা ভাবল। এতে যদি উন্মাদটাকে ভুলা যায়!
মা কাঁদছেন। কে জানে, মা’র এখন কেমন লাগছে! হয়তো কষ্টে বুক ফেটে যাচ্ছে। হয়তো তিনি এখনও বাচ্চা শিশুর মতো হাউমাউ করে কাঁদছেন। হয়তো… এই। এক মিনিট। সায়রা হঠাৎ ভাবতে ভাবতে থেমে গেল। বাবা, বাবা কোথায়? আসার সময় সায়রা বাবাকে দেখেনি। শেষ যখন দেখেছে, তখন মোনাজাত চলছে। বাবা দূরে দাঁড়িয়ে অসহায়ের মতো দু’হাত শূন্যে তুলে রেখেছেন। তারপর আর তাকে দেখা যায়নি। চলে আসার আগে কি বাবাকে দেখাটা দরকার ছিল না? বাবার পা ধরে না হোক, মুখে অন্তত সালাম করার প্রয়োজন ছিল না? বাবাকে জড়িয়ে ধরে মন প্রাণ উজাড় করে কেঁদে ফেলা উচিৎ ছিল না? অজান্তেই সায়রার বুক থেকে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে যায়। অনেক্ষণ চেপে রাখা সেই দীর্ঘশ্বাসটুকু এয়ার কন্ডিশনের হিম শীতল বাতাসে মিশে যায়।

সায়রা আনমনে তাকিয়ে থাকে রাস্তার দিকে। হঠাৎ দূরে দাঁড়িয়ে থাকা কেউ একজনের উপর চোখ আটকে যায়। সেই উন্মাদটা! সে তো কনভেনশন সেন্টারে ছিল। মূল সড়কে এল কখন! সায়রা চোখ কচলে আবার তাকায়। তাকিয়ে নিশ্চিত হয়, সেই উন্মাদটাই। রাস্তার এক পাশে শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। গাড়িটা যখন উন্মাদের খুব কাছ দিয়ে গেল, তখন সায়রা ভালো করে দেখে নিল। উন্মাদটার হাতে থাকা সাদা ব্যাগের বড়ো বড়ো অক্ষরে লেখাগুলো আবার পড়ে নিল, লতিফ স্টোর। এখানে পাইকারি ও খুচরা মূল্যে কাফনের কাপড় বিক্রি করা হয়।

আবাদপুর গ্রামে আসতে আসতে রাত নেমে এল। ঘড়ির কাটা জানান দিলো, নয়টা বেজে গেছে। অবশ্য অতটা সময় লাগার কথা না। মাঝপথে বিড়ম্বনা না হলে অনেক আগেই তারা চলে আসত। বিড়ম্বনা হলো এরকম, দুরন্ত বেগে ছুটে চলছিল একসঙ্গে অসংখ্য গাড়ি। সামনের গাড়িটা বরের। পেছনের সবগুলোতে গাদাগাদি বরযাত্রী। হঠাৎ বোম ফাটার মতো শব্দ হলো। সবগুলো গাড়ি ব্রেক কষল একসঙ্গে। বরের গাড়ির ড্রাইভার কুৎসিত ভঙ্গিতে বলল, ‘ধুর ধুর, এক্ষণি আমার টায়ার যাওন লাগত!’

বর কনের মাঝখানে জড়োসড়ো হয়ে বসে থাকা বাচ্চা একটা মেয়ে সন্দেহ প্রকাশ করল, ‘আপনারও টায়ার আছে?’

ড্রাইভার ফিক করে হেসে ফেলল, ‘ইয়ে, না মানে, গাড়ির টায়ার।’

দ্বিতীয় টায়ারও গেল আরো কিছুটা পথ যাবার পর। দু’বার টায়ার (চাকা) বদলে ড্রাইভার ক্লান্ত শরীর নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বিড়বিড় করে বলল, ‘কোন কুফায় নাগাল পাইছে, আল্লা জানে।’

এ বাড়ির মানুষজন হয়তো বাসরঘর সাজাতে ভুল গেছে। কোনো সাজসজ্জা নেই। কোনো রকম আয়োজন নেই। এমনকি ফুলও নেই। ফুলের নাম-গন্ধও নেই। খুব স্বাভাবিক একটা ঘর। এক পাশে বিছানা। যার উপর সায়রা বসে আছে। বিছানা থেকে খানিক দূরে একটি টেবিল। টেবিলের উপর বইয়ের স্তুপ। একটি চেয়ার। আরো একটু দূরে একটি ড্রেসিং টেবিল। ড্রেসিং টেবিলের সামনে একটি ছোটো টুল। বিছানার ঠিক উল্টো পাশে একটি স্টিলের আলমারি। আর…
সায়রা হাঁটুর আড়ালে মুখ গুঁজে নিল। তার পেটটা ব্যথা করছে। চিনচিনে ব্যথা। সারাদিন সে কিছু খায়নি। অনেকে জোরজবরদস্তি করেছে। তবুও সে খায়নি। খিদে ছিল না। এখন আছে। হয়তো খিদের চোটেই পেটটা ব্যথায় অস্থির করে তুলছে।

দরজা ঠেলে একটি ছায়া ভেতরে এল। সায়রা বিছানা ছেড়ে এগিয়ে গেল। ক্লান্ত শরীরটা ভারী গয়না আর শাড়ির ভার বইতে পারছে না। চোখদু’টো লেগে আসছে। এক্ষুণি বিছানায় গা এলিয়ে দিতে পারলে শান্তি লাগত। তবে তা কী করে হয়! আজ যে বিয়ের রাত। বাসর রাত।

সায়রা পা ছোঁয়ার আগেই মানুষটা তিন হাত দূরে সরে গেল, ‘ভাবি ভাবি, আমি মেহেদি। ভাইয়া এখনও আসেনি। আমাকে মা পাঠিয়েছে। বলেছে, কাপড়গুলো আপনাকে দিতে। আপনি যেন এই ভারী কাপড়চোপড় পরিবর্তন করে এগুলো পরে নেন…’

পুরো কথা বলার আগেই সায়রা ঘোমটা টেনে নিচু স্বরে বলল, ‘ওহ্।’

মেহেদি বোধহয় একটু লজ্জা পেয়েছে। সে কাপড়ের ব্যাগ সায়রার হাতে দিয়ে দ্রুত প্রস্থান করতে যাচ্ছিল। সায়রা ডাকল, ‘শুনুন।’

‘জি?’ মেহেদির গলায় কাঁপন।

‘আপনার ভাইয়ার নাম যেন কী?’

‘রাজিবুর রহমান।’

‘ওহ্।’

সায়রা নিশ্চিন্ত হলো। উন্মাদটা বলেছিল, সায়রার সঙ্গে যার বিয়ে হবে, তার নামের প্রথম অক্ষর হবে এস। অথচ, রাজিবুর রহমান নামের কোথাও এস নেই। যাক! এই জিনিসটা অন্তত মিলেনি। শুধু শুধু সে এতক্ষণ ভাবছিল! সায়রা মনে মনে খুশিই হলো। এতক্ষণে তার সবকিছু স্বাভাবিক হলো।

মেহেদি চলে গেল। যাবার আগে একবার এ ঘরে উঁকি দিয়ে বলল, ‘তবে রাজিব ভাইয়াকে সবাই সোহাগ বলেই ডাকে।’

কথাটুকু তিরের ফলার মতো বিঁধল। একদম বুক বরাবর। তা হলে উন্মাদটার কথাই সত্যি! সায়রার গায়ের লোম অজান্তেই দাঁড়িয়ে গেল। সে দ্রুত দরজা বন্ধ করে নিল। তারপর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে নিজেকে দেখতে লাগল। শাড়ির আঁচল সরিয়ে দু’টো হাত দেখল আগে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মুখ, গলা দেখল। পা থেকে শাড়িটা একটু সরিয়ে দেখল। একসময় পুরো শাড়িটাই খুলে ফেলল। তার মনে হচ্ছে, উন্মাদের কথামতো এবার সত্যি সত্যি তার শরীরে লোম গজাবে। কুচকুচে কালো লম্বা লম্বা লোমে ভরে যাবে তার দেহ।

সায়রা কী যেন মনে করে জানালার কাছে গেল। কাচের জানালা সরিয়ে বাইরে দৃষ্টি রাখল। সে দাঁড়িয়ে আছে চারতলায়। সেখান থেকে বাইরের অংশটা স্পষ্ট দেখা যায়। উঁচু দেয়ালের বাউন্ডারির বাইরে সরু রাস্তার পরিসর। তারপর ভাঙা দেয়ালের ওপাশে ফাঁকা জমি। জমিতে পানি জমে আছে। রাস্তার পাশের বৈদ্যুতিক পিলারে ঝুলে থাকা বাতির টিমটিমে আলো সেই পানিতে পড়ে সোনালি বর্ণ ধারণ করেছে। সবকিছু উপেক্ষা করে সায়রার দৃষ্টি পড়ল সেই ভেঙে যাওয়া দেয়ালটায়। দেয়ালে কে যেন বসে আছে।এমনিতেই অল্প আলো। তার উপর লোকটা মাথা নিচু করে আছে। তাই কিছু আন্দাজ করা যাচ্ছে না। সায়রা একটু ভালো করে তাকাল। লোকটা হঠাৎ মুখ তুলে তাকাল। তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি পড়ল চারতলায় দাঁড়িয়ে থাকা সায়রার চোখ বরাবর। সায়রা তখন স্পষ্ট দেখল, ভাঙা দেয়ালে বসে থাকা সেই লোকটাকে। সে আর কেউ না, স্বয়ং সেই উন্মাদ, যে বলেছিল, সায়রার কখনো বিয়ে হবে না। যদি হয়, তা হলে সায়রার সঙ্গে মিলিত হবার পরেই তার স্বামী মারা যাবে। আর সায়রার পুরো শরীরে লোম গজাবে।

(চলবে)
মেঘের ওপারে মেঘ | এক
মো. ইয়াছিন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here