মেঘের ওপারে মেঘ,পর্ব:৭

মেঘের ওপারে মেঘ | সাত

সেদিনও তাদের কত ভাব ছিল! কত কাছাকাছি ছিল দু’জন! মনে হচ্ছিল, একজন আরেকজনকে ছাড়া বাঁচবেই না। মনে হচ্ছিল, তারা দু’জনই বুঝি মেড ফর ইচ আদার। অথচ, আজ তারা দু’জনেই অচেনা, অজানা হয়ে গেল।

এইতো ক’দিন আগে রাস্তার মোড়ে পথ আটকাল রুমি। তখন সন্ধ্যে নেমে এসেছে। চারপাশ অন্ধকার। অন্ধকারেই তাকে দেয়ালে ঢেস দিয়ে ধরে রেখে বলল, ‘আমাকে পেয়েছোটা কী, বলো তো?’

মেহেদি কথাই খুঁজে পেল না। বলল, ‘কী হলো আবার?’

‘কী হয়নি, তাই বলো। আজকেও একদল এসেছিল আমাকে দেখতে।’

‘সে তো রোজ আসে।’

‘অত সহজ নয়। এবার কিন্তু পার পাচ্ছি না। ওঁরা আমাকে পছন্দ করে গেছে। আংটিও পরিয়েছে। এই দ্যাখো।’ বলে হাতের আঙুলটা দেখায় রুমি।

‘তা আমি কী করতে পারি?’

‘কী করবে মানে! তোমার কি কিছু করার নেই? তুমি চাইছো, আমার বিয়ে হয়ে যাক?’

‘তা কেন চাইব? তবে জানো তো, দিনকাল খুব একটা ভালো যাচ্ছে না। ভাইয়ার খোঁজ-খবর এখনও মিলেনি। মা ভীষণ অসুস্থ। এই অবস্থায় বিয়ের কথা কীভবে বলি বলো তো?’

‘থাক। আমারই ভুল হয়েছে।’ বলে রুমি চলে যাচ্ছিল। মেহেদি খপ করে তার হাতটা ধরে আলতো টান দিলো। মুখোমুখি তারা দু’জন। চারপাশ অন্ধকার। মেহেদি বলল, ‘শোনো, রুমি। মাথা ঠান্ডা করো।’

‘বলো, কী বলবে?’

‘আমাকে আর ক’টা দিন সময় দাও।’

‘আর কিছু বলবে?’

মেহেদি অনেক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রুমির দিকে চেয়ে থাকে। একসময় নিচু গলায় বলে, ‘আমাকে ভুলে যেতে পারবে?’

এ কথার জবাব রুমি দেয়নি। হাতটা হেঁচকা টান দিয়ে মেহেদির থেকে ছাড়িয়ে নেয়। তারপর এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে হনহন করে চলে যায়।

আরো একবার এসেছিল সে। গতকাল সকালে। বিয়ের দাওয়াত দিলো। আর কেউ না যাক, মেহেদি অবশ্যই যেতে হবে। মেহেদি ফের একই প্রশ্ন করল, ‘আমাকে ভুলে থাকতে পারবে?’

রুমি অবশ্য তখনও এই প্রশ্নের জবাব দিলো না। বলল, ‘তুমি আসবে কিন্তু। না এলে রাগ করব।’ বলে চলে গেল। মেহেদি তাকিয়ে রইল নিষ্পলক।

অনেক্ষণ আটকে রাখা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল বুকের ভেতর থেকে। আজ রুমির বিয়ে হয়ে গেল। যাক, ভালোই হয়েছে। রুমির ডাক্তারি পড়ার ইচ্ছে ছিল। পারেনি। তার বাবার অতো টাকা নেই। সে-ও অতোটা মেধাবী নয়। তবে জামাই হিসেবে ডাক্তার-ই পেয়েছে। ভালোই হয়েছে। ভালোই হয়েছে। ছাদের রেলিং ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায় মেহেদি। তখনই তার মনে হয়, দূর থেকে কে যেন তার দিকে তাকিয়ে আছে। খুবই তীক্ষ্ণ, মায়াবী একজোড়া চোখ। তার ছোটো বোন। মিলি।

মিলিকে দেখে আড়ালে আড়ালে চোখ মুছে নিল মেহেদি। মিলি ডাকল, ‘ভাইয়া, একটু নিচে আয়। খাবার রেডি। ভাবিকে ডাক।’

‘তুই ডাক না! আমি কেন?’

‘আমার সঙ্গে ভাব নেই। তুই-ই ডাক।’

‘আমার সঙ্গে বুঝি খুব ভাব?’

‘না, তা নয়। তবুও। ভাবিকে আমার একটু ভয় ভয় করে।’

‘কেন রে, ভাবি তোকে মারবে নাকি?’

‘কী জানি, মারতেও পারে!’ বলে হি হি করে হেসে ফেলে মিলি। হাসতে হাসতে চলে যায়। মেহেদি উদাসীন ভাবে এগোতে থাকে। আর বিড়বিড় করে, ভালোই হয়েছে। ভালোই হয়েছে।

ঘরের দরজায় এসে যখন মেহেদি ডাকল, তখনও সায়রা বালিশে মুখ গুঁজে শুয়ে আছে। ডাক শুনেই ধড়ফড় করে উঠে বসল। তার চোখের কোলে জল। গাল ভিজে জবজবা। চোখ দু’টো লাল এবং ফোলা ফোলা। মেহেদি একটু অবাক হলো, ‘কী হয়েছে ভাবি?’

সায়রা চোখের জল মুছতে মুছতে উঠে দাঁড়াল। ধরা গলায় জবাব দিলো, ‘ও কিছু না। চোখে কী একটা পড়েছে।’

কথাটুকু শুনেই মেহেদি দ্রুত ছুটে এল। ‘দেখি দেখি।’ বলে সায়রার চোখ মেলে ধরল দু’হাত দিয়ে। বলল, ‘কোন চোখে ভাবি, ডান চোখে না বাঁ চোখে?’ তারপর যখন একটু ভালো করে তাকাল এবং সায়রার আতঙ্কিত চেহারা দেখল, তখনই তার ঘোর কেটে গেল। সে লজ্জায়, ভয়ে তিন পা দূরে সরে গিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। এ কী করল সে! এভাবে হুট করে ভাবিকে স্পর্শ করা কি তার ঠিক হয়েছে? তা-ও না জিজ্ঞেস করে!

অনুতাপ, অনুশোচনায় মেহেদির মুখটা আরো নিচু হয়ে গেল। এতক্ষণ তার মাথা ঠিক ছিল না। সারাক্ষণ শুধু রুমির কথা মাছির মতো ভোঁ ভোঁ করছিল। এখন সে বুঝতে পারছে, সে যা করেছে, তা মোটেই উচিত হয়নি।

একটি বিছানা আর দু’টো বালিশ। এই তিনটি জিনিসই জাহানারা বেগমের সঙ্গী। তার জন্য দিন রাত সবই সমান। সব সময়েই বিছানায় পড়ে থাকা। দেহে আর জোর নেই। শরীরটা থরথর করে কাঁপে। বিষাদ বেদনা তার নিত্য সঙ্গী। মাঝে মাঝে মনে হয়, ইচ্ছে করলেই যদি এ জীবন ত্যাগ করা যেত, তবে বড়ো ভালো হত। চোখ খুললেই শুধু চারপাশের দেয়াল। দেহটা পড়ে আছে বিছানায়। এসব একঘেয়েমি আর ভালো লাগে না। তবুও যখন সায়রা এসে পাশে বসেছিল, যখন নিজ হাতে খাইয়ে দিচ্ছিল, কতইনা ভালো লাগছিল তখন! জাহানারা বেগম অবাক হয়েই তাকিয়ে ছিলেন সায়রার দিকে। মেয়েটার মাঝেই তার ছেলে সোহাগ ভর করেছে কি? কার মুখের দিকে তাকালে পুত্রশোক পানি হয়ে যায় যে!

সায়রা এল। চুপটি করে বসল পাশে। চুপ থেকেই খাইয়ে দিলো। আজকাল জাহানারা বেগম কিছু খেতে পারছেন না। কিছু মুখে দিলেই বমি করে ফেলে দিচ্ছেন। অথচ, আজ পেট ভরে খেলেন। এখন তো মনে হচ্ছে, সায়রা যদি আরো দেয় তা-ও তিনি খেতে পারবেন। একটুও তেতো লাগবে না। একটুও বমি পাবে না।

এ ঘর থেকে ডায়নিং রুম দেখা যায়। জাহানারা বেগম বিছানায় শুয়ে শুয়ে মাথাটা একটু উঁচু করলেন। সায়রা টেবিলের পানির গ্লাসে জগ থেকে পানি ঢালছে। মেহেদি তার পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। পাশে নয়, হয়তো একটু দূরেই দাঁড়িয়ে আছে। এ ঘর থেকে মনে হচ্ছে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে। খারাপ লাগছে না। জাহানারা বেগম বিছানায় শুয়ে শুয়ে আকাশ পাতাল ভেবে নিলেন। সায়রার ঘর থেকে উড়ে আসা এক টুকরো কাগজ কুড়িয়ে এনেছিল মিলি। সেই কাগজের লেখা পড়ে শুনিয়েছিল সে। জাহানারা বেগম কানে হাত দিলেন। ইন্ডিয়ার একটি মেয়ের সঙ্গে সোহাগের কিছু একটা ছিল তা তিনি জানতেন। মেয়েটা হিন্দু বলে তাদের সম্পর্ক বেশিদূর গড়ায়নি, তা-ও তিনি জানতেন। কিন্তু সেই মেয়েটির জন্য সোহাগ সদ্য বিবাহিত বউ ফেলে পালাবে, তা তিনি ভাবতেও পারেন না। আজ জানতে পেরে পাপবোধ হচ্ছিল। সবটা না জেনে তিনি রাহাদের বিয়ে করিয়ে দিলেন। এবার সায়রার কী হবে! আকাশ পাতাল ভেবেও তিনি কিছু পেলেন না। একসময় দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবলেন, আর ক’টা দিন যাক, সায়রাকে ভালো একটা ছেলের হাতে তুলে দেবেন।

এখন মেহেদির পাশে সায়রাকে দেখে জাহানারা বেগম মনে মনে জ্বলে উঠলেন। ঘরের মেয়ে ঘরেই রেখে দিলে হয় না! কিন্তু একটা অসম্ভব খটকাও থেকে যাচ্ছে। সায়রা মেহেদির বড়ো ভাই সোহাগের বউ। সোহাগ তো এখনও বেঁচে আছে। এমনকি তাদের বিভোর্সও হয়নি। এমন অবস্থায়…

জাহানারা বেগম চোখ বুজেছিলেন। যখন চোখ খুললেন, সায়রা তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। হাতে পানির গ্লাস। সায়রা পানির গ্লাস এগিয়ে দিলো। জাহানারা বেগম পানি খেয়ে গ্লাসটা এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘বোসো।’

সায়রা বসল। কথা বলল না। মেয়েটা শান্ত, স্নিগ্ধ, কোমল। গায়ের রং ফরসা। তবে ধবধবে নয়। চোখদু’টো এতটাই টলটলে, সব সময় মনে হয় চোখের কোলে জল জমে আছে। উপরের ঠোঁটে তিল আছে। কপালের বাঁ পাশে আরো একটি তিল। এই তিলদুটো তাকে আরো মায়াবী করে তুলেছে। জাহানারা বেগম হাত বাড়িয়ে সায়রার গাল স্পর্শ করলেন। বললেন, ‘তোমার খুব দুঃখ, না মা?’

সায়রা ডানে বাঁয়ে মাথা নেড়ে হাসতে চেষ্টা করল। তার শুকনো হাসির আড়ালে লুকিয়ে রাখা দুঃখগুলো ফ্যাকাশে মুখখানায় স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে। জাহানারা বেগম অনেক ভেবেও বলার মতো কিছু পেলেন না। চুপ করে সায়রার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। একসময় যখন সায়রার গাল ছুঁয়ে নিজ হাতে চুমু খেলেন, সায়রা না চাইতেও হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। কাঁদতে কাঁদতে ছুঁটে পালাল নিজের ঘরে। জাহানারা বেগম আটকালেন না। দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন শুধু।

মেহেদি যখন জাহানারা বেগমের ঘরে এল, তখন রাত নেমে এসেছে। মেহেদি ঘরে এসে অভ্যস্ত ভঙ্গিতে বলল, ‘বাতি নিভিয়ে দেই, মা?’

জাহানারা বেগম হাত দিয়ে ইশারা করে ডাকলেন, ‘এদিকে আয়।’

মেহেদি এল। বসল পাশে। জাহানারা বেগম মেহেদির হাতের উপর হাত রাখলেন, ‘একটা কথা বলি, বাবা?’

‘কী কথা?’

জাহানারা বেগম কিছুক্ষণ ভেবে বললেন, ‘আমি তোর বিয়ে দেখে যেতে চাই।’

মেহেদি ইতস্তত করল, ‘কোথায় যাবে?’

‘হায়াত-মউতের কথা বলা যায় না। কখন ডাক পড়ে!’

‘ও-কথা বোলো না মা।’

‘সত্য কথা শুনতে হয়। তুই বল।’

‘কী বলব?’

‘আমি যদি তোর জন্য মেয়ে পছন্দ করি, তোর কোনো অমত থাকবে?’

মেহেদি না ভেবেই বলল, ‘না, কোনো আপত্তি থাকবে না। এখন ঘুমাও।’

‘সত্যি বলছিস?’

‘হ্যাঁ, সত্যি।’

‘জিজ্ঞেস করবি না, কোন মেয়ের কথা বলছি?’ জাহানারা বেগম তার ছেলের দিকে অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকালেন।

‘কোন মেয়ে?’

‘সায়রা।’

‘সায়রা!’ মেহেদি চেঁচিয়ে উঠে দাঁড়াল। ‘কোন সায়রা?’

‘আমাদের সায়রা।’

(চলবে)
মো. ইয়াছিন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here