মেঘের ওপারে মেঘ,পর্ব:৬

মেঘের ওপারে মেঘ | ছয়

প্রিয় সায়রা,
চিঠিটা লিখছি, বিয়ের রাতে। আজ আমাদের বাসর রাত। অথচ, তুমি এক শহরে। আমি অন্য শহরে। তুমি সদ্য বিবাহিত নতুন বউ। হয়তো লম্বা ঘোমটা টেনে বিছানায় বসে আছো। অপেক্ষা করছো নতুন মুহূর্তের, নতুন অনুভূতির, নতুন সুখের। কিন্তু যাকে ঘিরে তোমার এতসব স্বপ্ন, সেই মানুষটাই তোমার থেকে অনেক দূরে চলে এসেছে। তুমি হয়তো বিয়ের দু’-তিন দিন বাদে চিঠিটা হাতে পেয়েছ। কিংবা তারও পরে। ভাবছো, চিঠিটা বালিশের নিচে গেল কীভাবে?
বিয়ের পরদিন অনেকগুলো লোক তোমাকে দেখতে গিয়েছিল, মনে আছে? সেই অনেকগুলো মানুষের মধ্যে অনুও ছিল। মেয়েটাকে হয়তো তোমার মনে নেই। অনু তোমাকে দেখার ভান করে চিঠিটা বালিশের নিচে রেখে এসেছে। সে চারুশীলার বান্ধবী। এবার হয়তো ভাবছো চারুশীলা কে?

বলব। সব বলব। একে একে। কাহিনি শুরু হয়েছিল ছ’মাস আগে। তখন বিশেষ কারণে কলকাতা গিয়েছিলাম। সেই বিশেষ কারণটা চিঠিতে উল্লেখ করছি না। তবে শোনো, তখন প্রথমবার বাংলাদেশ ছাড়লাম। কলকাতায় একটা সস্তা হোটেলে উঠেছিলাম। ওখানে পরিচিত কেউ নেই। যাকে দেখি সে-ই অপরিচিত। তবে সবাই বাংলায় কথা বলে, এই যা। না হলে আমাকে খুব নাকানি চুবানি খেতে হত ওখানে। বাংলায় বলে এবং বাংলা বোঝে বলে সহজেই ওঁদের সঙ্গে কথা বিনিময় করে নিতে পারতাম। এটা ওটা জেনে নিতে পারতাম। ও ভাই, এই অ্যাড্রেসটা কোন দিকে? কলকাতার মাঝবয়েসী কিংবা বৃদ্ধ লোকটা মুখ চুলকে বলত, সোজা যান, দাদা। বাঁয়ে একটি গলি আছে। সেই গলির ভেতর প্রথম বাড়িটা।

প্রথম দিন বিকেলে একটু বেড়াব বলে ভাবলাম। পায়ে হেঁটে ঘুরে বেড়াব। তাই বাদামঅলা’র থেকে এক ঠোঙা বাদাম কিনে নিলাম। বাদামের ঠোঙা হাতে রাস্তা পার হব, ঠিক তখনই ঘটল এক দুর্ঘটনা। সেই একটি দুর্ঘটনা আমার পুরো জীবনটা বদলে দিলো। সাঁই করে একটি স্কোটার এগিয়ে এল আমার দিকে। কিছু বুঝে উঠার আগেই আমাকে ধাক্কা দিলো স্কুটারটা। হাতের ঠোঙাটা রাস্তায় পড়ে গেল। বাদামগুলো অসহায়ের মতো রাস্তায় গড়াগড়ি খেতে লাগল। আমি পড়ে রইলাম রাস্তার কাদাজলে। পা খানিকটা ছিলে গেল। একটু সময়ের জন্য সবকিছু ওলটপালট হয়ে গেল। যখন নিজেকে সামলে উঠে দাঁড়াব, ঠিক তখন স্কুটার থেকে নেমে এল একটি মেয়ে। এসেই শক্ত হাতে আমার কলার ধরে টেনে তুলল। এরপর দিলো এক চড়। মেয়ে মানুষের নরম হাতের শক্ত চড় খেয়ে আমি তাল সামলাতে পারিনি। মুখ থুবড়ে পড়ে গেলাম রাস্তার কাদাজলে। মেয়েটা সেই সুযোগে কয়েক দফা লাথি বসাল আমার পেটে, পিঠে, পায়ে। একসময় যখন শান্ত হয়ে দাঁড়াল, তখন আমি উঠলাম। মুখে কাদা, কাপড়ে কাদা, সারা শরীরে কাদা। মেয়েটা যেন আরো একটি চড় মারার জন্য এগিয়ে আসতে আসতে বলল, ‘দে, ফিরিয়ে দে বলছি। আমার ব্যাগ ফিরিয়ে দে। চোরের ঘরে চোর, ব্যাগ ফিরিয়ে দে আমার।’

কিন্তু আমার বিস্মিত মুখ দেখে মেয়েটা রিতীমতো স্তব্ধ হয়ে গেল। চারপাশে তখন লোক জমে গেছে। সবাই চোখ কপালে তুলে তাকিয়ে দেখছে, মেয়েটা আরো একবার চড় মারল কি না। মেয়েটা উৎসুক জনতাকে হতাশ করে দিয়ে আমার গায়ের কাদা, ধুলো নিজ হাতে পরিষ্কার করে দিতে লাগল। আমি তখনও হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছি। মেয়েটাই জিভ কেটে বলল, ‘এই রে! বড্ড ভুল করে ফেলেছি মশাই। চোর ব্যাটা লাল শার্ট পরেছে। আপনিও লাল শার্ট। আমি চোর ভেবেই আপনাকে এত মারলাম! কত কী বললাম! এরকম টকটকে লাল শার্ট কেউ পরে?’ মেয়েটা শাসন করেই বলল। যেন লাল শার্ট পরা বেআইনি। অপরাধ।

কালো ডোরাকাটা হলুদ শাড়ি পরা শ্যামলা বর্ণের মেয়েটা। চোখদু’টো লজ্জায় ছটফট করলেও মুখটা রাগে টগটগ করছিল। ঠোঁটদু’টো কাঁপছিল। সেই মেয়েটাই চারুশীলা। এভাবেই আমাদের পরিচয়। আমি এতটাই অবাক হয়েছিলাম যে, অনেক্ষণ কথাই বলতে পারলাম না। হাঁ করে তাকিয়ে রইলাম শুধু। চারুশীলা তার স্কুটারে করে হোটেলে পৌঁছে দিলো। স্যরি ট্যরি বলল। সেই সঙ্গে টকটকে লাল শার্ট পরার অহেতুক অপকারিতা বানিয়ে বানিয়ে শোনাল৷ আমি শুধু হাঁ করে শুনলাম। কিছু বলতে পারলাম না। চড় খেয়ে গাল কেটে গিয়েছিল। লাথি খেয়ে সারা শরীরে ব্যথা হয়ে গিয়েছিল।

কলকাতায় দ্বিতীয় দিনটা কাটল বড়ো অন্যরকমভাবে। ঘুম থেকে জেগে দেখি দু’টো বেজে গেছে। সারা রাত ঘুম হয়নি। তাই বলে দুপুর দু’টো পর্যন্ত ঘুমাব তা ভাবতেও পারি না। ঘড়ির দিকে চেয়েই ধড়ফড় করে উঠলাম। সেদিন বিশেষ কোনও কাজ নেই। ধীরে সুস্থে এক কাপ চা খেলাম। তারপর গোসল সেরে বেরিয়ে পড়লাম। তখন বিকেল পড়ে এসেছে। ঘুরে ঘুরে অনেকটা পথ দেখলাম। হাঁটতে হাঁটতে পা ব্যথা হয়ে গেল। আকাশটা অপরিষ্কার ছিল বলেই সঙ্গে ছাতা নিয়েছিলাম। সত্যি সত্যি বৃষ্টি নামল। ছাতা থাকায় বৃষ্টির মধ্যে হাঁটতে অসুবিধা হচ্ছিল না। তবে হঠাৎ কোত্থেকে যেন একটা স্কুটার এসে পাশাপাশি দাঁড়াল। আমি পাশ ফিরে তাকাইনি। পা’টা ব্যথা হয়ে গেছে। হোটেলে পৌঁছে বিছানায় গা এলিয়ে দিতে পারলে বাঁচি!

স্কুটার থেকে নেমে এল সেই চারুশীলা। চড়, লাথি মারা মেয়েটি। বৃষ্টির ফোঁটায় জর্জরিত মেয়েটি স্কুটার ছেড়ে ছুটে এল আমার কাছে। আমার ছাতার নিচে। অবশ্য নিজের গা খুব একটা আড়াল করতে পারল না। ছাতা তো অত বড়ো নয়। আমার শরীরই কোনো মতে বৃষ্টির থেকে আড়াল করে রেখেছে। তার উপর আরো একজন যদি সেই ছোট্ট ছাতার নিচে আশ্রয় নেয়…

মেয়েটি যেন বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচতেই আরো একটু কাছ ঘেঁষে দাঁড়াল। আমি দু’হাতে ছাতার স্টিক ধরে আছি। মেয়েটি তার কাঁপা হাত দু’টি আমার হাতের উপর রাখল। লোকে নিঃসন্দেহে বলবে, এটি একটি রোম্যান্টিক সিন। খুব রোম্যান্টিক। তবে আমার তেমন মনে হলো না। বরঞ্চ ইতস্তত করতে হলো। বুকের ভেতর হাঁফ ধরে যাচ্ছিল। যেন, উটকো, বাড়তি ওজন ঘাড়ে চেপেছে। আমিই বললাম, ‘সামনের ছাউনিতে চলুন। এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে আরো ভিজবেন।’

মেয়েটি অবাক হয়ে বলে, ‘আপনি তা হলে বোবা না?’

এ কথার জবাব দিতে পারলাম না। বললাম, ‘ছাউনিতে চলুন। বৃষ্টি বেড়েছে।’

‘ওখানে যাব? ওখানে দাঁড়িয়ে থাকা লোকগুলোকে দেখেছেন? পারলে চোখ দিয়েই চেটেপুটে খেয়ে ফেলে।’ মেয়েটি তাচ্ছিল্য করেই বলল। তার কথায় আমি ওদিকটা একবার চেয়ে দেখলাম। ওখানে দাঁড়িয়ে থাকা তিনটি যুবক আর মাঝবয়েসী দু’জন লোক সবাই এমনভাবে মেয়েটির দিকে তাকাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল যেন ভূত দেখছে। তাকানোর কারণ অবশ্য আছে। সালোয়ার কামিজ পরা মেয়েটি ভিজে চুপসে গেছে। গায়ের কাপড়গুলো জবজবা হয়ে গায়ের সাথে মিশে গেছে। একটা ওড়না পর্যন্ত নেই। আমার একটু লজ্জা হলো। এমন পরিস্থিতিতে একটি মেয়েকে যদি এতটুকু সাহায্য না করতে পারি তবে কেমন পুরুষ আমি?

ছাতার নিচ থেকে সরে গেলাম। সেদিন বৃষ্টি ফোঁটাগুলো অনেক বড়ো বড়ো ছিল। প্রতিটি ফোঁটা কাঁটার মতো বিঁধতে লাগল সারা গায়ে। আমি সাতপাঁচ না ভেবে গায়ের ফুলহাতা নেভি-ব্লু শার্টটা খুলে দিলাম। মেয়েটি অর্থাৎ চারুশীলা শার্ট গায়ে জড়াতে জড়াতে বলল, ‘উরিব্বাস! আপনার দেখছি হেব্বি বডি, অ্যা!’

জিমে যাওয়ার কিংবা শরীরচর্চা করার ব্যাপারটা একেক জনের একেক কারণে হয়। কেউ একটু ভালো থাকার জন্য শরীরচর্চা করে। কেউ প্রফেশন্যাল; তাই। কেউ আবার নিজেকে সুদর্শন দাবি করার জন্য। আরো অনেক কারণ আছে। তবে আমি জিম-এ যেতাম কেবলমাত্র নিজেকে সুদর্শন বলে দাবি করার জন্য। অন্যের সামনে বুক ফুলিয়ে নিজের বডি দেখিয়ে বেড়ানোর জন্য। তা-ও যদি কোনো মেয়ে মানুষ দেখে আশ্চর্য হয়, তা হলে তো আনন্দের বাঁধ থাকে না! অথচ, সেদিন চারুশীলার সামনে কী লজ্জাই না লাগল! মনে হতে লাগল, আর কিছু দিয়ে না হোক, অন্তত দু’টো হাত দিয়ে নিজের খালি গা’টা ঢেকে রাখি।

শার্ট গায়ে দিয়ে চারুশীলা নিজেই এগিয়ে এল। বলল, ‘আপনার ছাতার নিচে আমি আশ্রয় নিয়েছি। অথচ, আপনি ভিজবেন। এ-ও কি হয়? ভিজলে দু’জনে একসঙ্গে ভিজব।’ বলেই ছাতাটা হাত থেকে ছেড়ে দিলো। সঙ্গে সঙ্গে নড়বড়ে পাতলা ছাতা খানিক দূরে উড়ে গিয়ে কাদাজলে পড়ে রইল। চরুশীলা ভিজল। সঙ্গে আমিও। ছাউনিতে দাঁড়িয়ে থাকা লোকগুলো অবাক চোখে তাকিয়ে দেখল সেই দৃষ্টি। তবে কেউ এগিয়ে এল না। কিছু বললও না। চারুশীলা আমার মুখের সামনে হাত নেড়ে বলল, ‘আপনার মতলবটা কী, অ্যা?’

স্তিমিত গলায় বললাম, ‘কী?’

‘একটা মেয়ে বিপদে পড়েছে। তাকে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দেবেন না? দেখছেন না লোকজন কীভাবে হাঁ করে তাকিয়ে আছে?’

‘ওঃ, হ্যাঁ! চলুন।’

‘আরে এভাবে কেন! স্কুটার আছে তো!’

চারুশীলা স্কুটারে বসে বলল, ‘বসুন।’

‘কোথায়?’

‘কোথায় আবার! আমার পেছনে বোসুন। শক্ত করে ধরে বসবেন। পড়ে গেলে আমার দোষ নেই।’ বলে মুখ টিপে হাসল সে। আর কিছু বলল না।

এরপর প্রায়ই দেখা হতে লাগল। একজন আরেকজনের নাম্বার আদান প্রদানের পর ফোনে কথা বলতে শুরু করলাম। দিন নেই রাত নেই শুধু কথা আর কথা। প্রয়োজনের তাগিদে নয়, কথার জন্য কথা। শোনার জন্য কথা। ফোনে কথা বলারও যে এক সুপ্ত অনুভূতি থাকে, তা আমি প্রথমবার আবিষ্কার করলাম। এভাবে ধীরে ধীরে এক পা এক পা ফেলে আমরা এগোলাম। চেনাজানা থেকে বন্ধু হলাম। আমাদের বন্ধুত্ব গাঢ় হলো। আরো গাঢ় হলো। একসময় সেটা আর বন্ধুত্ব রইল না। বন্ধুত্ব পেরিয়ে নতুন এক সম্পর্কে রূপ নিল।

বাংলাদেশে ফেরার এক সপ্তাহ আগে চারুশীলা তার বাসায় আমাকে ডাকল। গেলাম তার বাসায়। চারুশীলার মা আমাকে দেখেই বললেন, ‘আরে তুমি! তুমি সত্যিই আমার সামনে, ভাবতেই পারছি না! মনে হচ্ছে স্বপ্ন। চারু তোমার কথা প্রতিদিন এতবার করে বলে যে, সব সময় মনে হয়, তোমার মতো কে যেন চোখের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আজ সত্যিই এলে।’

ভেতরের ঘরে চারুশীলার বাবা আগে থেকেই বসে ছিলেন। তিনি গম্ভীর মানুষ। পত্রিকায় মুখ গুঁজে রেখে বসতে বললেন। চারুশীলার মা নানান রকম খাবার এনে সামনে রাখলেন। খুশিতে গদগদ হয়ে পাশে দাঁড়িয়ে রইলেন। চারুশীলার বাবা পত্রিকা গুটিয়ে মনোযোগী ভঙ্গিতে বললেন, ‘চারুশীলা প্রায়ই বলে, তার খুব ভালো বন্ধু আছে। কিন্তু সেই বন্ধুটাকে সে জীবনসঙ্গী হিসেবেও চায়, সেটা কাল বলল। তাই বললাম, নিয়ে আয়। দেখি তোর বন্ধুটাকে।’ তিনি একটু হাসার চেষ্টা করলেন, ‘তা বাবা নাম কী তোমার?’

‘রাজিবুর রহমান। ডাকনাম সোহাগ।’

নাম শুনেই তিনি ভার হয়ে গেলেন। গম্ভীর ভাবে বললেন, ‘মুসলিম?’

‘জি।’

স্বামী-স্ত্রী মুখ চাওয়াচাওয়ি করলেন। তারপর দু’জনেই বেরিয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ পর কাজের মেয়ে এল। টেবিলে সাজিয়ে রাখা খাবারগুলো নিয়ে গেল। চারুশীলার মা এসে বললেন, ‘তুমি এখন আসতে পারো।’

রাগে, অপমানে গা জ্বলে গেল সেদিন। দ্রুত বেরিয়ে এলাম। তবে ভেবেছিলাম, চারুশীলা পেছন থেকে ডাকবে। কিংবা পিছু নেবে। এমন কিছুই হয়নি। আমিই বরং ফিরে ফিরে তাকালাম, চারুশীলাকে দেখা যায় কি না। কিন্তু না। সে জানালা দিয়ে পর্যন্ত উঁকি দিলো না। ছাদে গিয়েও দাঁড়াল না।

বাকি ক’টা দিন চারুশীলায় সঙ্গে দেখা হলো না। ওঁর ফোনটাও বন্ধ পেলাম। এর মধ্যে চারুশীলার বাসার সামনে ঘুরলাম ক’দিন। কাজের কাজ কিছুই হলো না। তার ছায়া পর্যন্ত দেখতে পেলাম না।

দেশে ফেরার পর ধীরে ধীরে ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করলাম তাকে। হয়তো একটু একটু ভুলেও গেলাম। মাঝে মাঝে খুব মনে পড়ত। তখন লুকিয়ে লুকিয়ে একটু আধটু চোখের জল ফেলতাম। এরই মধ্যে একদিন মা তোমার কথা বলল। ভাবলাম, এই সুযোগ। বিয়েটা করে নেই। তাতে যদি চারুশীলাকে ভুলতে পারি! কিন্তু কপাল দেখ, বিয়েটা ঠিকঠাক হয়ে গেল। তোমাকেও বাড়িতে নিয়ে এলাম। ঠিক এমন সময় ইন্ডিয়া থেকে ফোন এল। চারুশীলার ছোটো বোন লুকিয়ে ফোন করে বলল, চারুশীলা আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেছে। হাতের শিরা কেটে ফেলেছে। অবস্থা গুরুতর। এবার তুমিই বলো, সায়রা। আমার চলে আসাটা কি উচিত হয়নি? যে মেয়ে আমার জন্য নিজেকে শেষ করে দিতে পারে, তাকে ভুলে কিনা আমি নতুন সংসার করতে বসেছিলাম! এ কি কম বড়ো অন্যায় ছিল? অন্যায় আমি তোমার সঙ্গেও করেছি। এত বড়ো অন্যায় আর কারো সঙ্গে কেউ করেছে কি না জানি না। তবে জানি, এ অন্যায় ক্ষমা করার মতো নয়। তবুও যদি পারো, আমার মতো অপরাধীকে ক্ষমা করে দিও। আমি ইন্ডিয়া চলে যাচ্ছি। জানি না, চারুশীলা বাঁচবে কি না। যদি বেঁচে যায়, তবে তাকে নিয়েই সংসার পাতব।

আর একটা কথা, এসব কথা কাউকো বোলো না কিন্তু। মা যেন কোনো ভাবে জানতে না পারে, তার ছেলে পালিয়েছে। জানলে সে খুব দুঃখ পাবে। আর কিছু লিখতে পারছি না। চোখদু’টোর বাঁধ ভেঙে গেছে। জল গড়িয়ে পড়ছে অনবরত। আমি জানি, আমি ভুল করেছি। অনেক বড়ো ভুল করেছি। পারলে ক্ষমা করে দিও, সায়রা। ভালো থেক।

ইতি,
একজন পলাতক আমামি।

ছলোছলো চোখে পুরোটা চিঠি পড়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল সায়রা। তার ভেতরটা হঠাৎ দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। কলিজাটা শুকিয়ে যাচ্ছে। বুকটা বড়ো জ্বলছে। এতদিন সে জেনেছে, কোনো এক উন্মাদের অভিসাপে তার স্বামী নিখোঁজ হয়েছে। কিন্তু এ যে তার থেকেও হৃদয় বিদরক ঘটনা। অন্য এক মেয়ের জন্য সোহাগ নতুন বিয়ে করা বউকে ফেলে চলে গেছে। এ কি সহ্য করার মতো কথা? কোনও মেয়ে পারবে সহ্য করতে? অধিকার যদি দেবে না, সঙ্গে যদি থাকবে না, যদি ফেলেই যাবে তবে কেন বিয়ে করল? কেন একটি মেয়ের জীবন এভাবে শূন্যে ভাসিয়ে দিয়ে গেল? কী দোষ করেছিল সায়রা? কী অন্যায় করেছিল? সে তো উড়ে এসে জুড়ে বসেনি। আর সব বিয়ের মতো তারও বিয়ে হয়েছে। তাকেও আরসব নতুন বউয়ের মতো করে নিয়ে আসা হয়েছে। তবে কেন তার বেলায় এত অন্যায়? এত অবিচার?

সায়রা দুম করে মুখ থুবড়ে পড়ে যায় বিছানায়। বালিশে মুখ গুঁজে হুঁ হুঁ করে কেঁদে উঠে।

(চলবে)
মো. ইয়াছিন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here