মেঘের ওপারে মেঘ,পর্ব:২

মেঘের ওপারে মেঘ | দুই

‘এই!’

‘কী?’ মেহেদি মুখ তুলে তাকাল। ঘন অন্ধকারে রুমির মুখ ঠিকঠাক দেখা যাচ্ছে না। তবে সে মিটমিট করে হাসছে তা আন্দাজ করা যাচ্ছে। মেহেদির বিরক্ত লাগছে। আবার ভালোও লাগছে। সে অনেক আগেই চলে যেত। কিন্তু কিছু একটা আটকে রেখেছে। কিছু মায়া, বাড়ন্ত একটুখানি ছায়া, অল্প আদর আর আলতো ছোঁয়া যেন আষ্টেপৃষ্ঠে ধরেছে তাকে। রুমি তার চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে। আর সে ঘাসের বুকে শুয়ে আছে। মাথার উপর থালার মতো গোলাকার চাঁদ। হাতের কাছে রুমি। রুমির তুলতুলে আঙুলগুলো মেহেদির মাথার চুলের ফাঁকে ফাঁকে বিরচণ করছে। মেহেদি বাঁ হাত উঁচু করে চোখের সামনে ধরল। বারোটা সাত মিনিট। অনেক রাত। চারপাশে অন্ধকার। ঝিঁঝি পোকার ডাক শোনা যাচ্ছে।

‘এই!’ রুমি আহ্লাদ করে ডাকল।

‘বলো!’ মেহেদির গলায় বিরক্ত।

‘এবার তোমার পালা। না?’

‘মানে?’

‘আজ তোমার ভাইয়ের বিয়ে হয়ে গেল। এরপর তো তোমার বিয়ে হবে। তাই না?’

মেহেদি একটু দূরে সরে গেল, ‘না। ঘরে আমার ছোটো বোন আছে। মিলি। আগে মিলির বিয়ে হবে। তারপর আমার চিন্তা।’

রুমি মুখ কালো করে বলল, ‘তুমি এত রাতে আমার কাছে কেন এসেছো?’

‘তোমার কাছে আসিনি। এসেছি তোমার ভাইয়ের কাছে। আমার ভাই, মানে সদ্য বিবাহিত নতুন জামাই তার বউ ফেলে হাওয়া হয়ে গেছেন। তার ফোনটাও বন্ধ। তাই ভাবলাম, তোমার ভাইয়ের সাথে আড্ডা দিতে বোধহয়…’

‘তার মানে এতদিন পর তুমি আমার টানে আসোনি। তোমার ভাই না হারালে আজকেও তুমি এদিকে আসতে না। তার মানে এতদিন আমাকে তোমার মনে পড়েনি। তুমি শুধু শুধু বিয়ের ব্যস্ততার অযুহাত দিচ্ছিলে। আমিই ভুল ছিলাম৷ আমিই ভুল ছিলাম।’

মেহেদি রুমিকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘আবার শুরু করলে? শোনো রুমি, তোমার সাথে ঝগড়া করতে আমার আর ভালো লাগে না। বিরক্ত লাগে। বিরক্ত।’

এরপর আর কোনো কথা হলো না। রুমি গাল ফুলিয়ে চলে যেতে লাগল। দূরে গিয়ে একবার ফিরে তাকাল। মেহেদি যেন একটু চমকে গেল। চাঁদের আবছা আলোয় রুমিকে যেন কেমন দেখাল। তার সুন্দর পরিপাটি চুলগুলো কেমন যেন নোংরা নোংরা দেখাল। আর তার দাঁত, তার চকচকে পরিষ্কার দাঁতগুলো কেমন যেন ময়লা ময়লা দেখা গেল। মেহেদি পেছন থেকে ডাকল, ‘রুমি! এই রুমি!’
রুমি ফিরল না। হনহন করে চলে গেল।

জাহানারা বেগম অপেক্ষা করছিলেন। মেহেদি ঘরে পা রাখতেই তিনি উদ্বিগ্ন হয়ে ছুঁটে এলেন, ‘সোহাগকে এনেছিস? এতক্ষণ কোথায় ছিল?’

‘পেলে তো আনব। তোমার ছেলে নাই হয়ে গেছে। তার ফোনও বন্ধ।’

‘কী সাংঘাতিক ব্যাপার! আজকে রাতেই তাকে পালাতে হত? তুই কি নিশ্চিত সে পালিয়েছে?’

‘আরে না! পালাবে কেন?’

‘তা হলে?’

‘আমি কী জানি! আমাকে বলে গেছে নাকি!’

‘সত্যি করে বল তো মেহেদি, তোর ভাইয়ের আর কারো সাথে কিছু ছিল কি না? তার কি অন্য কোনো মেয়ে পছন্দ ছিল?’ জাহানারা বেগম সন্দেহ প্রকাশ করলেন।

‘না না। ভাইয়ের এমন কিছু থাকলে তো আমাদের জানা থাকত। কীরে মিলি, জানা থাকত না?’

মিলি দূরে দাঁড়িয়ে আগ্রহ নিয়ে মা-ছেলের কথা শুনছিল। হঠাৎ তার নাম শুনে কেঁপে উঠল। হড়বড় করে বলল, ‘হ্যাঁ, ভাইয়ার এমন কিছু থাকলে আমাকে অন্তত বলতো! মেহেদি ভাইয়ার আছে। সে তো আমাকে বলেছে…’

মেহেদি ধমক দিলো, ‘এত বলিস কেন? যা জিজ্ঞেস করেছি শুধু সেটা বলবি।’

‘মেহেদির কী আছে?’ জাহানারা বেগম আগ্রহ প্রকাশ করলেন।

মিলি গড়গড় করে বলেই দিচ্ছিল রুমির কথা। মেহেদি তাকে আটকে দিয়ে বলল, ‘কিছু না, মা। কিছু না।’

‘বৌমা’কে গিয়ে বল সোহাগ ফিরতে দেড়ি হবে। সে যেন ঘুমিয়ে পড়ে।’

‘আমি পারব না।’

‘কেন পারবি না?’

‘আগে একবার গিয়েছিলাম। তোমার বউ মুখ না দেখেই পা ছুঁতে তেড়ে এসেছিল। ভাগ্যিস দূরে সরে গিয়ে বলেছিলাম, আমি সোহাগ না। না হলে তো…’

‘তুই ও-ঘরে কখন গেলি?’

‘তুমিইতো বলেছিলে, কাপড় দিয়ে আসতে!’

‘এখন আবার যা। গিয়ে বল, সে যেন শুয়ে পড়ে।’

‘পারব না। মিলিকে বলো।’

উন্মাদটাকে এখন আর দেখা যাচ্ছে না।
ওপাশের ভাঙা দেয়ালে সায়রার দৃষ্টি। সে মনে মনে ভাবছে, উন্মাদটা আবার ফিরে আসবে। শূন্যে ভেসে আসবে চারতলায়। জানালার সামনে উড়ে এসে সায়রার মুখোমুখি দাঁড়াবে। বলবে, ‘বলেছিলাম না? শুনলি না তো? শুনলি না তো আমার কথা?’

সায়রা ব্যাকুল হয়ে বলবে, ‘তোমার যা চাই, তাই দেব। তুমি শুধু আমার জীবনটা স্বাভাবিক করে দাও। নাহয় আমাকে মৃত্যু দাও। আমি মুক্তি চাই।’

উন্মাদটা তখন এই অভিসাপ থেকে মুক্তি দেবে কি না কে জানে! সায়রার এখনও মনে আছে সেদিনের কথা। তার বয়স তখন আট বছর। হাফপ্যান্ট আর ফ্রক পড়ে ঘুরে বেড়ায়। একদিন দুপুরবেলা একটা পাগল এল। সে খাবার চাইল। মা তাড়িয়ে দিলেন। ঢং, তামাশা, নাটক এসব বলে বকাঝকা করলেন। সেই পাগল, সেই উন্মাদটাই যেতে যেতে বলেছিল, সায়রার কখনো বিয়ে হবে না। আর যদি হয়, তা হলে সায়রার সঙ্গে মিলিত হবার পরেই তার স্বামী মারা যাবে। আর সায়রার পুরো শরীরে লোম গজাবে। এবং সে আরো বলেছিল, সায়রার সঙ্গে যার বিয়ে হবে তার নামের প্রথম অক্ষর হবে এস।

সায়রা আড়ালে আড়ালে ক্ষুধার্ত উন্মাদটার পাশাপাশি অনেক পথ হাঁটল। একসময় তার পথ আটকে বলল, ‘পাগল বাবাজি দাঁড়াও। আমি তোমাকে বিয়ে করব।’

সায়রার রসিকতা করে বলা কথাটুকু শুনে উন্মাদটা এক লাফে তিন হাত দূরে চলে গেল, ‘দূর! পাগল আবার বিয়ে করে নাকি!’

‘ভাবি, আসতে পারি?’

সায়রা কোনো রকম কথা বলল না। অবাক হয়ে নিজের শরীরে চোখ বুলিয়ে গেল। হাত, পা, পেট… এখনও লোম গজায়নি। হয়তো গজাতে শুরু করেছে। তার চোখে ধরা পড়ছে না। সে নিজের শরীরে হাত বুলাতে বুলাতে বলল, ‘আমার গায়ের লোম ঘন দেখাচ্ছে কি?’

‘কী বলছেন ভাবি! গায়ের লোম ঘন হবে কেন? তাছাড়া আপনার শাড়ি কোথায়? গরম লাগছে কি? এসি চালু করব? আপনার ঘরে তো এসি আছে।’

সায়রা কথা পাল্টাল, ‘এসি লাগবে না। শাড়ির আঁচল বারবার খসে পড়ছিল। তাই খুলে রেখেছি।’

‘আমি ঠিক করে পরিয়ে দেব, ভাবি?’

‘পারবে?’

‘একবার সুযোগ দিয়েই দেখুন না!’

‘আচ্ছা, দাও।’

‘আমাকে চিনতে পেরেছেন?’

‘না।’

‘আমি মিলি। আপনার ননদ।’ মেয়েটি শাড়ির কুঁচি ঠিক করতে করতে বলল।

‘ওহ্।’

সায়রা বন্ধ দরজার দিকে তাকাল। মিলি এদিক দিয়ে আসেনি। পাশের ঘরের সঙ্গে আরো একটি দরজা আছে। সেই ঘরটা হয়তো মিলির। সেখানে ঘরে চলে গেল সে।

পুরুষ মানুষের আপনজন বলতে দু’টি মানুষই থাকে। প্রথম তার মা। আর দ্বিতীয় তার স্ত্রী। সোহাগের ক্ষেত্রে দু’জনই আছে। এই নিষ্প্রভ গভীর রাতে দু’জনেই নীরবে, নিঃশব্দে প্রহর গুণছে। সে কি ফিরবে? মাঝে মাঝে অজানা ভযে আঁতকে উঠছে দু’জনেই। সোহাগের মা বিছানায় বসে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে কান খাড়া করে রেখেছেন। যেকোনো মুহূর্তে সোহাগ এসে ডোরবের বাজাবে। তিনি একটুও দেড়ি না করে ছুটে যাবেন। ধমকের স্বরে বলবেন, ‘কই ছিলিরে তুই? ফোন বন্ধ কেন?’

সায়রা তার ঘরে পায়চারি করছে। তার মনে অন্য ভয়। ভয়ের কারণ সে জানে। তার স্বামী অর্থাৎ সোহাগের শেষ পরিণতিও সে জানে। সোহাগ মরবে। মরতে তাকে হবেই। উন্মাদটার কথাই সত্যি হবে। বিড়বিড় করে আওড়াচ্ছে সায়রা। কিন্তু সব সমস্যারই তো সমাধান থাকে। এই সমস্যার সমাধান কি নেই? আছে নিশ্চয়ই! সায়রার চোখ জ্বলজ্বল করে উঠে। সমাধান দিতে পারলে কেবল একটা মানুষই পারবে। সেই উন্মাদটা।

সায়রা দ্রুত জানালার কাছে গেল। ওপাশের রাস্তায় শুয়ে থাকা মানুষটাকে দেখে সে যেন একটু স্বস্তি পেল। ঘড়ি দেখল একবার। দুইটা আটচল্লিশ মিনিট। সায়রা দ্রুত শাড়ি খুলল। শাড়ি পরে হাঁটাচলা করা যায় না। সালোয়ার কামিজ-ই পারফেক্ট। সায়রা মেহেদির রেখে যাওয়া কাপড়গুলো গায়ে দিয়ে অন্ধকারে সিঁড়ির রেলিং ধরে নিঃশব্দে নিচে নেমে এল।

বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে পড়েছেন। সায়রার শাশুড়ি জাহানারা বেগম বিছানায় এপাশ ওপাশ করতে করতে উঠে এসেছেন। তার বাতের ব্যথা বেড়েছে। বেলকনিতে দু’টো বেতের চেয়ার রাখা। একটিতে তিনি বসলেন। অন্যটি ফাঁকা পড়ে আছে। একবার তিনি ভাবলেন, সায়রাকে ডেকে নিয়ে আসবেন। এটা সেটা গল্প করে মেয়েটির মন ভালো করার চেষ্টা করবেন। বলবেন, বুঝলে বউমা, তোমার মতো নতুন বউ সেজে আমি যখন তোমার শ্বশুরের ঘরে পা রেখেছিলাম, তোমার শ্বশুর তখন চব্বিশ বছরের যুবক। আর আমার বয়স তেত্রিশ। সে রোগা-সোগা মানুষ। আর আমি পঁচাত্তর কেজি ওজনের নাদুসনুদুস একজন। সেদিন রাতে তোমার শ্বশুর কী করল জানো? আমি শুধু বলেছিলাম, সে পাটখড়ির মতো চিকন। আর একজন্যই সে জেদ করে আমাকে দু’হাত দিয়ে শূন্যে তুলে নিল। সঙ্গে সঙ্গে দুড়ুম করে আমাকে নিয়ে পড়ে গেল। হা হা হা!

ভাবতে ভাবতে জাহানারা বেগমের চোখে জল আসে। তিনি তার মৃত স্বামীর কথা বাদ দিয়ে নতুন বৌমা’র কথা ভাবতে শুরু করেন। আজকের এই রাত মেয়েটির জীবনের শ্রেষ্ঠ রাত। অথচ, মেয়েটি একা নিঃসঙ্গ একটি রাত কাটাচ্ছে। মুখ দিয়ে কিছু বলতেও পারছে না। হুট করে কারোর সাথে মিশতেও পারছে না। জাহানারা বেগম ঠিক করলেন, তিনি উঠে যাবেন। সায়রাকে তার কাছে নিয়ে আসবেন। কিন্তু শেষমেশ আর যাওয়া হয় না। মেয়েটা হয়তো ঘুমিয়ে পড়ছে। ঘুমাক। ডেকে এনে তার দুঃখ আরো বাড়ানোর কোনো মানে হয় না। জাহানারা বেগম দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উঠে দাঁড়ান। শোবার ঘরে চলে যাওয়ার আগে কী যেন ভেবে একবার বাইরে তাকান। আর তখনই চোখে পড়ে, বাড়ির ভেতর থেকে কে যেন নিঃশব্দে বেরিয়ে যাচ্ছে। জাহানারা বেগম চশমা চোখে দিলেন। তখন সবকিছু স্পষ্ট হয়ে এল। যে বেরিয়ে যাচ্ছে, সে আর কেউ না, স্বয়ং সদ্য বিবাহিত সায়রা।

(চলবে)
মো. ইয়াছিন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here