মেঘের ওপারে মেঘ,পর্ব:৩

মেঘের ওপারে মেঘ | তিন

দু’দিন হলো সায়রার বিয়ে হয়েছে। এর মধ্যে একটি বারের জন্য সে তার বরের দেখা পায়নি। কখনো পাবে কি না তা-ও জানে না। সকালে সূর্য উঠে। দুপুর হয়। একসময় বিকেল পেরিয়ে রাত নেমে আসে। নিঃশ্বাস ভারী হয়। আরো একটি দিন কেটে যায়। সায়রার বর সোহাগ ফিরে না। সায়রা আশায় আশায় বুক বাঁধে। আরো একটি সকালের অপেক্ষায় থাকে। সকাল হয় ঠিকই, সোহাগ ফিরে না।

আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো, এর মধ্যে এ বাড়ির কেউই সায়রাকে দোষারোপ করেনি। অপমান, অপদস্ত করেনি। এমনকি একটি কটু কথাও বলেনি। সব স্বাভাবিক। যেন কিছুই হয়নি। অথচ সায়রা জানে। একদিন না একদিন, কেউ না কেউ তো বলবে। নিশ্চয়ই বলবে, সোহাগ হারিয়ে যাওয়ার পেছনে সায়রাই দায়ী। সে এ ঘরে পা রাখার পরেই এমন অঘটন ঘটেছে। আর কেউ না বলুক, সায়রার শাশুড়ি অন্তত বলবেন। এ কথা সে জানে।

আরো অনেক কথা সে জানে। অনেক কথা জানে না। অজানা হিসেবের খাতায় একটি প্রশ্ন হলো, এ বাড়িতে সে কেন আছে? কী কারণে? তার স্বামীই যদি না থাকে তা হলে সে কেন থাকবে? কোন অধিকারে? অধিকারের কথা সায়রা জানে না, তবে এমন একটি জীবন সে কখনোই চাইবে না, যেখানে সব আছে শুধু গুরুত্বপূর্ণ মানুষটাই নেই।

বুকের ভেতর থেকে আরো একটি দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে যায়। ফোলা ফোলা চোখের ভেতর থেকে আরো এক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। আর আর… সায়রা একসময় সিদ্ধান্ত নেয়, সে সুইসাইড করবে। আত্মহত্যা। সে গায়ের শাড়িটা এক টানে খুলে ফেলে। দু’টুকরো কাপড়ের আড়ালে লুকিয়ে থাকা দেহটা নিজ হাতে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠে। কিছুক্ষণের জন্য ফ্লোরে ঢলে পড়ে। একসময় যখন চোখের পানি শুকিয়ে যায়, কান্না থেমে যায়, বুকের দুঃখ-কষ্ট কিছুক্ষণের জন্য ধুয়ে-মুছে সাফ হয়ে যায়, তখন সে উঠে দাঁড়ায়। পাথুরে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে ঝুলন্ত সিলিং ফ্যানের দিকে হা করে তাকিয়ে থাকে। একসময় ড্রেসিং টেবিলের সামনের টুলটা হাত বাড়িয়ে নেয়। বিছানায় টুলের উপর দাঁড়িয়ে সিলিং ফ্যানে শাড়ির এক মাথা পেঁচিয়ে নেয়। অন্য মাথা সে নিজের গলায় পেঁচায়। চোখ বন্ধ করে টুলটা ঠেলে দেবে, ঠিক সেই মুহূর্তে তাকে কে যেন ডাকে, ‘সায়রা, এই সায়রা! রাগ করলে বুঝি! আরে, আমি তো মজা করে লুকিয়ে ছিলাম! দেখছিলাম, তোমার ধৈর্য কতখানি! আর তুমি তো দেখছি বাচ্চা মেয়ের মতো কেঁদে কেঁদে বুক ভাসাচ্ছো। আহারে, আমার বউটা!’

এই ঘোর বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। সায়রা ঠিকই বুঝতে পারে, কেউ তাকে ডাকেনি। এটা কেবল তার মনে ভুল। সেদিন আর আত্মহত্যা করা হয় না।

খাবার সময় শুধু ডাক পড়ে। সায়রার বরের ছোটো বোন মিলি এসে ডেকে যায়। খাবার টেবিলে বসেও কারোর সঙ্গে কথা হয় না। সায়রা চুপচাপ খাবার প্লেটে হাত বুলায়। মাঝে মাঝে আড়চোখে এদিক ওদিক তাকায়। মেহেদি ছেলেটা বোধহয় সারাক্ষণ সায়রার দিকেই পিটপিট করে তাকিয়ে থাকে। সায়রা তার দিকে তাকাতেই সে চোরের মতো চোখ সরিয়ে নেয়। মেহেদি সায়রার বরের ছোটো ভাই। বয়সে সায়রার সমবয়সি কবে। কিংবা সায়রার থেকে বছর দু’-একের বড়ো। তার চোরা দৃষ্টিতে তাকানোর ভঙ্গি সায়রার মনে সন্দেহের সৃষ্টি করে। মেহেদি অমন করে কী দেখে সারাক্ষণ? সে কি সায়রার প্রতি খানিকটা দুর্বল? না কি অনেকটাই দুর্বল? সোহাগ নিখোঁজ হওয়ার পেছনে মেহেদির হাত নেই তো? সায়রাকে পাবার আশায় সে-ই তার ভাইকে…

না না! এসব কী ভাবছে সে! সায়রা নিজের মনকে সংযত করে যথাসম্ভব এসব বিষয় মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করে। হঠাৎ দেখে, তার শাশুড়ি একমুঠো ভাত মুখের সামনে ধরে বলছেন, ‘হাঁ করো তো!’

সায়রা আনমনে হাঁ করে। তার মা কখনো এভাবে মুখে তুলে খাইয়ে দেননি। অথচ, শাশুড়ি নিজ হাতে খাইয়ে দিচ্ছেন। হতে পারে, সায়রার জন্যই তার ছেলের আজ এই অবস্থা। হতে পারে, সায়রাই এ-সব কিছুর জন্য দায়ী। কিন্তু তার পরও… জীবন কত বিচিত্র! কত বিস্ময়কর! ভাবতে ভাবতে সায়রার চোখে জল আসে। সায়রার শাশুড়ি জাহানারা বেগম সায়রাকে বুকের ভেতর ঠাঁই দিয়ে বলেন, ‘কেঁদ না। একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। আমার ছেলের কিছু হয়নি। সে একদিন ঠিকই ফিরে আসবে। মায়ের টানে আসবে। তোমার টানে আসবে। নিশ্চয়ই ফিরবে আমার সোহাগ, নিশ্চয়ই।’

বলতে বলতে জাহানারা বেগমের গলার স্বর ভেঙে আসে। চোখদু’টো জলে ভরতি হয়ে যায়। তবুও তিনি বলেন, ‘তুমি দেখ, আমার ছেলে একদিন ঠিক ফিরবে। তুমি দেখে নিও।’

বউ শাশুড়ি দু’জনেই কাঁদেন। তাদের কান্না দেখে মিলি নীরবে চোখের জল ফেলে কাঁদতে শুরু করে দেয়। কাঁদে না শুধু মেহেদি। তার এসব কান্নাকাটি দেখতে ভালো লাগে না। সে খাবার ফেলে রেখে চলে যায়। একসময় মিলির কান্না থামে। সায়রার চোখের জল পড়া বন্ধ হয়। শুধু জাহানারা বেগমের পরিবর্তন হয় না। মা তো! তিনি আরো জোরে কেঁদে উঠেন। একসময় বিলাপ করে কেঁদে উঠে টেবিলে কপাল ঠুকে দেন।

কপাল বেয়ে টপটপ করে রক্ত গড়িয়ে পড়ে। টকটকে লাল রক্ত। মিলি তেড়ে আসে। সায়রা দ্রুত কেটে যাওয়া স্থানে হাত চেপে ধরতে চায়। জাহানারা বেগম তাদেরকে দূরে সরিয়ে দেন, ‘সরো, সরো তোমরা। আমার ছেলে আসার আগ পর্যন্ত রক্ত পড়ুক। আমি জানি, আমার ছেলে আসবে। এসে আমার কপালে ব্যান্ডেজ করে দিবে। তোমরা সরো। সরে যাও।’

ধমক শুনে মিলি সরে আসে। সায়রাও। জাহানারা বেগম আবারো টেবিলে কপাল ঠুকেন। আবার। আবার। মিলি কাঁদতে কাঁদতে সেখান থেকে চলে যায়। সায়রা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে শুধু। একসময় জাহানারা বেগম উঠে আসেন। সায়রাকে জড়িয়ে ধরে আরো এক দফা কাঁদেন।

আত্মীয় স্বজন নতুন বউ দেখতে আসে। প্রতিবেশীরাও আসে।
নতুন বউ দেখে যায়। কেউ কেউ আবার কানাঘুষা করে। এই মেয়েটাই কাল, জম, অলক্ষ্মী। এ’র জন্যই এমন হয়েছে। এ’র জন্যই ছেলেটা নিখোঁজ হয়েছে। এ’র জন্যই… কত আজেবাজে কথা, কত অকথ্য কুকথ্য ভাষা কানে আসে। সায়রা নিরুপায় হয়ে শুধু প্রহর গুণে। গুণতে গুণতে ভাবনার রাজ্যে হারিয়ে যায়। একদিন সোহাগ আসবে। তার হাতে থাকবে তাজা দু’টো রজনীগন্ধা। সোহাগ ফুলগুলো সায়রার দিকে এগিয়ে দেবে। সায়রা ফুলগুলো তো নেবেই না উল্টো মুখ কালো করে বলবে, ‘কোথায় ছিলে এতদিন? কার কাছে ছিলে? এসো, আজ তোমাকে শিক্ষা দেব।’

সোহাগ যেন একটু ভয় পেয়ে বলবে, ‘ও বাবা! কী শিক্ষা দেবে তুমি?’

আরো কত কী ভাবে সায়রা! কত কী! এসবের কুল কিনারা নেই। শুধুই স্বপ্ন। স্বপ্ন বলেই সম্ভব হচ্ছে। বাস্তবে তো আর এতকিছু সম্ভব নয়। বাস্তবে সোহাগ ফিরলে হয়তো দেখা যাবে, সায়রা ঘোমটা টেনে দ্রুত ছুটে গিয়ে পা ছুঁবে সোহাগের। সোহাগ দু’হাত দিয়ে সায়রার কাঁধ স্পর্শ করে টেনে দাঁড় করাবে। কিংবা…

ছাদে উঠল সায়রা। ভর দুপুর। সূর্যটা একদম মাথার উপর। সে রেলিং ধরে ধরে পুরো ছাদ ঘুরে একটা জায়গায় থামল। দূরে একটি কাক দেখা যাচ্ছে। সেই কালো কুচকুচে কাকটা পানির তৃষ্ণায় কা-কা করছে। সায়রা একবার ভাবল কাকটাকে পানি খাওয়াবে। কিন্তু কীভাবে? কাক যে সেই নারকেল গাছের ডগায়! অত উঁচুতে কে নিয়ে যাবে পানি? কিংবা, পানি নিয়ে গাছে উঠতে উঠতে কাকটা যদি উড়ে যায়? সায়রা কি এখান থেকে আগে বলে দেবে, ‘এই কাক দাঁড়াও। আমি তোমার জন্য পানি নিয়ে আসছি। কোথাও যেও না।’
এসব বললে কাকটা শুনবে তো তার কথা?

সায়রার দৃষ্টি দূরের আঁকাবাঁকা পথটায় আটকে যায়। দু’হাতে মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে কে যেন এগিয়ে আসছেন। চেনাজানা মানুষটাকে নতুন করে চিনতে বেশিক্ষণ সময় লাগল না। মিষ্টির প্যাকেট হাতে যিনি এগিয়ে আসছেন, তিনি সায়রার বাবা মনজুরুল ইসলাম।

জাহানারা বেগম আহ্লাদী গলায় বলেন, ‘এসব আনতে গেলেন কেন! আপনি আমাদের এখানে এসেছেন, এটাই তো অনেক বড়ো পাওয়া!’

সায়রার বাবার মুখে হাসি ফুটে। তিনি কৃতজ্ঞতা স্বরূপ হাসেন। এটা সেটা বলেন। একসময় তার জায়গা হয় বসার ঘরে। জাহানারা বেগম বসেন তার সামনে। এটা সেটা কথা হয়। ইনি হাসেন। তিনিও হাসেন। খুব স্বাভাবিক কথাবার্তা। হঠাৎ সায়রার বাবা বলেন, ‘সায়রা কোথায় বেয়াইন?’

সায়রা আড়াল থেকে বেরিয়ে যায় বাবার সামনে। মনজুরুল ইসলাম আহ্লাদী গলায় বলেন, ‘জামাই কোথায়? তাকে দেখছি না যে?’

জাহানারা বেগম প্রসঙ্গ পাল্টান, ‘আগে মেয়েকে তো দেখুন! আপনাদের ছেড়ে এসে চিন্তায় চিন্তায় মেয়েটা কেমন শুকিয়ে গেছে দেখেছেন?’

বাবা এবার ভালো করে সায়রাকে দেখেন। তারপর বলেন, ‘তা তো দেখছি। তা তো দেখছি। তবে জামাইকে দেখার জন্য মনটা কেমন যেন করছে। এই সায়রা, ডাক না। তোদের দু’জনকে আরো একবার চোখের দেখা দেখি।’

সায়রা জবাব দেয় না। জাহানারা বেগম বলেন, ‘সোহাগ তো বাইরে গেছে।’

‘ও আচ্ছা। আসুক তা হলে। এলেই না হয় দেখব। ততক্ষণ বেয়াইন সাহেবার সঙ্গে একটু আলাপ সালাপ করে নেই।’

জাহানারা বেগমের মুখ ছোটো হয়ে আসে। তিনি জবাব দেন, ‘সোহাগ তো আজ আসবে না। দু’-তিন দিন পরে আসবে।’

‘সেকি! আমি যে মেয়ে আর মেয়ের জামাই দু’জনকেই নিয়ে যেতে এলাম!’ মনজুরুল ইসলাম অবাক হয়ে বলেন।

‘মেয়েকে নিয়ে যান। এমনিতেই মেয়েটা হঠাৎ এখানকার পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিতে পারেনি। আপনাদের ওখান থেকে ঘুরে আসুক। এতে তার মনও ভালো থাকবে। আর আপনারাও নিজেদের মেয়েকে আরো ক’টা দিন কাছে পাবেন।’

সায়রা দ্রুত সেখান থেকে চলে যায়। বাবার সামনে কেঁদে ফেললে বাবা টের পেয়ে যাবেন। তাই সে শোবার ঘরে নিজেকে আবদ্ধ করে নেয়। দুম করে বিছানার উপর পড়ে যায়। বালিশে মুখ গুঁজে হু হু করে কেঁদে উঠে। কাঁদতে কাঁদতে সিদ্ধান্ত নেয়, সে বাবার সঙ্গে চলে যাবে। আর কখনো এ বাড়িতে ফিরবে না। যাকে ঘিরে তার অস্তিত্ব, যাকে ঘিরে এ সংসার সে-ই যদি না থাকে, তবে সায়রাও থাকবে না। সে আজকেই বাবার সাথে চলে যাবে। আর কখনো ফিরবে না। কখনোই না।

সিদ্ধান্ত নিয়ে সায়রা শক্ত হয়ে যায়। বালিশের উপর থেকে মুখ তুলে নেয়। অশ্রুসিক্ত ঘোলাটে চোখদু’টো মুছে নিয়ে ফিরে তাকাতেই চমকে যায়। ঘরের এক কোণে বাবা দাঁড়িয়ে আছেন। বাবার চোখে ভয়, বিস্ময়, সন্দেহ। তিনি হয়তো সায়রার কান্নার কারণ আন্দাজ করতে চাইছেন। কিংবা…

(চলবে)
মো. ইয়াছিন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here