রুপালির রূপ
সাইয়্যেদাতুন নেছা আফনান
পর্ব:-০৫
থমথমে পরিবেশ ড্রয়িংরুমে। রাদের মা মিসেস রাহি এসেছেন কিছুক্ষণ আগে। কুশল বিনিময় করে একসাথে বসলেন, বললেন,
– ভাইজান, সেদিন মাথা ঠিক ছিল না। হুট করেই রুপালির এমন অপরাধ শুনে বলে ফেলেছি।
হানিফ সওদাগর বলেন,
– দেখেন আপা, আমি আমার মেয়েকে স্বাধীনতা দিয়েছি। তাই বলে সে এমন একটা জঘন্য কাজ করবে সেটা বুঝি নি, আমরা দুঃখিত।
– রাদের থেকে আমি পরে সম্পূর্ণ ঘটনা শুনেছি, রুপালি নাকি সকালে উঠে নিষেধ করতে চেয়েছিল কিন্তু তার আগেই দুর্ঘটনা ঘটে।
– না, ব্যাপারটা ও মানা করা কিংবা না করার বিষয় না আপা, ও বিয়েতে রাজি না হতেই পারে এজন্য কারো পা ভাঙতে চাওয়া গুরুতর অন্যায়। আমি চেয়েছিলাম ওকে শাস্তি দিতে কিন্তু আমার একটা মাত্র মেয়ে,এজন্য পারি না, আমাকে ক্ষমা করবেন।
– ভাইজান, দয়াকরে ক্ষমা চাইবেন না। আমি আমার কৃতকর্মের জন্য লজ্জিত। যত বড় অন্যায় হোক না কেন আপনাদের সাথে এমন আচরণ করাটা উচিত হয় নি।
– থাক্, যেসব গিয়েছে সেসব নাহয় বাদ দেই। রেহানা নাস্তা হয়েছে?
– ভাইজান, আমি আরো একটা বিষয়ে কথা বলতে এসেছি।
– বলুন।
– রাদের আর রুপালির বিয়ের তারিখ নিয়ে…..
– না, না আপা। আসলে এমন ঘটনা ঘটার পরে আর যেহেতু আমার মেয়েটাও রাজি না বিয়েতে সেখানে আমি চাচ্ছি না ওর বিয়েটা আপাতত দিতে। আরো সময় যাক্ তারপর ভেবে দেখবো।
মিসেস রাহি মাথা নিচু করে বললেন,
– ভাইজান, বাবা খুবই শখ করেছেন রুপালিকে আমার ঘরের পুত্রবধূ করবেন।
– আপা, মেয়েটা যেখানে রাজি না সেখানে ওর মতামতের বাইরে গিয়ে বিয়েটা দেয়া কি উচিত হবে আপনি বলুন।
মিসেস রেহানা নাস্তার ট্রে টেবিলে রেখে বলেন।
– হানিফ,রুপালি যদি রাজি হয় তাহলে মেয়েটাকে আমার ঘরে দিবে?
রাইয়ান শেখের কথায় সবাই পিছনে তাকায়। রাইয়ান শেখকে কেউই আশা করে নি এখানে। হানিফ সওদাগর এগিয়ে গেলেন তার দিকে। মোলাকাত শেষে বসলেন একসঙ্গে। বিভিন্ন কথা বলার মাঝে ওয়াদাবদ্ধ হন রুপালি রাজি হলে বিয়েটা হবে।
——–
কৃষ্ণচূড়া গাছ থেকে বাতাসের দোলায় ফুল ঝরছে। রুপালি কুড়িয়ে নেয় স্বযত্নে। হিজাবের সেফটিপিন দিয়ে পাশে আটকে নেয়। আজ বান্ধবীদের কেউই আসে নি। অন্যদিন তো তারা কেউ মন খারাপ করতে দেয় নি তবে আজ যেন মন খারাপ পিছু ছাড়ছে না। রাদের বলা কথাগুলো বারবার মনে পরছে। এরকম ইঙ্গিতে কখনো কেউ বলে নি। ক্লাস না করেই হলে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
গেটের সামনে এসে রিক্সা খুঁজতে থাকে,হঠাৎ একটা গাড়ি এসে দাঁড়ায় কাছে। মিসেস রাহি বের হন গাড়ি থেকে। এই সময় মিসেস রাহিকে ভার্সিটির সামনে দেখে অবাক হয় রুপালি। নিজেকে সামলে বলে,
– আসসালামু আলাইকুম আন্টি,কেমন আছেন?
– ওয়ালাইকুমুস সালাম মা, আলহামদুলিল্লাহ ভালো, তুমি কেমন আছো?
– আলহামদুলিল্লাহ। এখানে কি করছেন?
– তোমার সাথে দেখা করতেই এসেছি।
– আমার সাথে?
– হুম, এসো গাড়িতে বসো।
– না না আন্টি, আমি হলে যাবো।
– তুমি হলে উঠেছো?
– হ্যাঁ।
– কেন?
রুপালি মাথা নিচু করে বলে,
– এমনিই, বাসায় পড়াশুনা হচ্ছিল না ঠিকমতো তাই ফ্রেন্ডদের সাথে থাকছি যাতে পড়াশোনায় ঘাটতি নাহয়।
– ওহহ আচ্ছা, আসে গাড়িতে বসো।
– না না আন্টি, আমি রিক্সা নিয়ে চলে যাবো।
– এই মেয়ে, দু’দিন পরে আমার বউমা হবে, এখনই শাশুড়ীর কথা অমান্য করছো? এসো বলছি।
শাসনের সুরে বললেন মিসেস রাহি। রুপালিও মাথা নিচু করে গাড়িতে উঠে বসে।
– সেদিন আমি যা বলেছি সেটা রাগের মাথায় বলেছি কিন্তু আমি তোমাকে পছন্দ করি, কিন্তু তুমি বলো যেই কাজ করেছো এবং করিয়েছো সেটা কি ঠিক?
– আন্টি আমি জানি অপরাধ করেছি, কিন্তু আপনারা আমার গুরুজনেরা যেটা করেছেন সেটা কি অপরাধ নয়? আমি একজন পূর্ণবয়সী বালেগা মেয়ে,সেখানে আমার অনুমতি ব্যতীত আপনারা বিয়ে নিয়ে আলোচনা করছেন, আমার মা-বাবা তো দোষ করেছেই সাথে আপনারা জেনেছেন আমি রাজি না তবুও আপনারা তাদের সাথে বিষয়টা এগিয়েছেন, এমন-কি আমাকে জানানও নি যে আপনার ছেলের সাথে আমার বিয়ে হবে! আপনার ছেলে সেদিন আমার সাথে দেখা না করতে এলে তো আমি জানতামই না। আর আমার দোষের ব্যপারটা হলো, আমি ওদের বলেছি আমার সমস্যাটা ওরা সমাধান স্বরূপ বললো আপনার ছেলের পা ভেঙে দিবে আমিও হাসি-তামাশায় রাজি হয়েছি কারণ ওদের এত সাহস নেই যে কারো পা ভাঙবে! কিন্তু ওরা আমার কথাটাকে সিরিয়াস নিয়েছে, আমি ওদেরকে তো আপনার ছেলের ছবি দেখাই নি ঠিকানা দেই নি ওরা বের করে নিয়েছে এক রাতের মধ্যে! এখন আপনি বলুন আমি এতে দোষী কোথায়? আমি কীভাবে জানবো ওরা তার ছবি,ঠিকানা এক রাতে বের করতে পারবে? এরপর আমার বান্ধবী মাত্র দু’জন কিন্তু ওরা যে ওদের ভাইদের নিয়ে যাবে আপনার ছেলেকে মারতে সেটাও তো আমি জানতাম না সেখানে আপনার ছেলে আমাকে কতটা বাজে ইঙ্গিত দিয়ে কথাগুলো বললো, আমার বাবা যে কীনা কখনো আমাকে কিছুই বলে নি সেও সেদিন আফসোস করলো আমি তার মেয়ে বলে! এত কিছুর পরেও সব দোষ আমার! যাক্ আপনারা বড়োরা যদি আমাকে দোষী বানিয়ে শান্তি পান তাহলে আমি মাথা পেতে নিলাম।
রুপালির কপোল গড়িয়ে জলের ছড়াছড়ি। হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে বারবার মুছেও থামছিল না, বাধ্য হয়ে থামিয়ে দেয় নিজের চেষ্টা। এতদিনের জমানো কথাগুলো বলতে পেরে শান্তিও লাগছিল।
মিসেস রাহি চুপচাপ বাইরে তাকিয়ে আছেন। এভাবে ভেবে দেখা হয় নি, আসলে ভাবার মতো মূহুর্তও আসে নি। ঘরের একমাত্র ছেলেকে এভাবে বিছানায় পরে থাকতে দেখে মিসেস রাহির একটুও ভালো লাগে না। অসহায়ের মতো ডাকে পানি দেয়ার জন্য। যেই ছেলে কখনোই কিছু চেয়ে নেয় নি নিজের কাজ নিজেই করেছে সেখানে ছেলের এমন অপারগতায় বুকটা ছিন্ন হয়ে যায়। দীর্ঘশ্বাস ফেলেন তিনি। কেউই কাউকে বুঝতে চেষ্টা করে নি তাই হয়তো এত ঝামেলা। রুপালির দিকে তাকিয়ে আগলে নেয়। যত্ন করে মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
– বুঝেছি, পাকনা মেয়ে। আর কখনো এমন পাকনামি করবে না, এখন ইচ্ছে করছে বাড়ির বউ বানিয়ে নিতে, স্বামীর সেবা করে সাড়িয়ে তুলতে। ঢের হয়েছে দু’টোর। শিক্ষা হয়েছে বেশ। ঝগড়া করলেই এভাবে পা ভেঙে দিবি আর তোমাকে কি করে কে জানে! প্রস্তুত হয়ে ঘরে এসো।
গাড়ি থেমেছে দেখে রুপালি বাইরে তাকিয়ে দেখে মিসেস রাহির বাসায় এসেছে। মিসেস রাহি মুচকি হেসে বাইরে বেরুতে বলে।
——–
রাদ মাহিকে ডাকছে অনেকক্ষণ ধরে। মাহির কোনো পাত্তাই নেই। এবার জোরে চিল্লিয়ে বলে,
– মাহি, আমার রুমের পানি শেষ, পানি নিয়ে আয়।
ফোন টিপতে থাকে আবারো, রুমে কারো আসার শব্দ পেয়ে বলে,
– এতক্ষণ কি কানে তুলা দিয়েছিলি? শুনতে পাস নি?
– আমাকে তো ডাকেন নি এতক্ষণ!
আচমকা অতি পছন্দের কন্ঠ শুনে চমকে তাকায়। তৃষ্ণার্থ চোখগুলো তৃষ্ণা মেটাতে মেটাতে মুখ থেকে বেরোয়,
– ‘ আমার রূপ’!
চলবে,
{ গঠনমূলক কমেন্ট করবেন আশাকরি }