#রৌদ্রর_শহরে_রুদ্রাণী
#পর্বঃ৩২
#Saiyara_Hossain_Kayanat
“হ্যাঁ আমি আরুকে ঠকাচ্ছি তবে এতে বিন্দুমাত্র আক্ষেপ আমার নেই।”
রৌদ্র কফির মগ তুলে এক চুমুক দিয়ে শান্ত চোখে নীল আর কাসফিয়ার দিকে তাকালো। তাদের চোখেমুখে কৌতূহলের ছাপ। চোখে ফুটে উঠেছে জানার তীব্র আগ্রহ। রৌদ্র একটা মুচকি হাসি দিয়ে বলল-
“আমার যতটুকু ধারন আরু অন্য কারও কষ্টের কথা শুনলেই অস্থির হয়ে পরে। এমনকি অন্য কারও মন খারাপে আরু নিজেও মন খারাপ করে ফেলে। তাই আমি জানতাম আমি বাবা হতে অক্ষম এই কথা শুনে আরু মন খারাপ করে ফেলবে। আমার জন্য কষ্ট পাবে এমনকি আমার এই কথাটা নিয়ে এতটা-ই মন খারাপ করবে যে আরু এটাও যাচাই করবে না আমি সত্যি বলেছি নাকি মিথ্যা।”
রৌদ্রর কথা শুনে নীল আর কাসফিয়া দুজনের চোখ বিস্ময়ে গোলাকৃতি হয়ে গেল। নীল জোড়ালো কন্ঠে জিজ্ঞেস-
“আপনি আরু মানে আমাদের আশুকে মিথ্যা কথা বলেছেন??”
রৌদ্র সহজ গলায় উত্তর দিল-
“এটা ছাড়া আর কোনো উপায় রাখেনি আরু।”
কাসফিয়া কিছুটা নেড়েচেড়ে বসলো। খানিকটা ইতস্ততভাবে বলল-
“আপনি নিজেকে নিয়ে এত বড় মিথ্যা কথা বলেছেন কেন?? আপনি কি বুঝতে পারছেন আপনি কতো বড় একটা বিষয় নিয়ে মিথ্যে বলেছেন??”
রৌদ্র ঠোঁটের কোণে এক তৃপ্তিদায়ক হাসির রেখা টেনে বলল-
“এটা তেমন কোনো বড় কথা না। আমার কাছে ফাস্ট প্রায়োরিটি হচ্ছে আমার ভালোবাসা। আর আমার ভালোবাসা মানেই আরু। তার মানে আরু হচ্ছে এখন আমার জীবনের ফাস্ট প্রায়োরিটি। আরুর মনে আমার জন্য অনুভূতি আছে সেটা জেনেও কিভাবে আমি ওর প্রত্যাখ্যান গ্রহণ করি তোমরাই বল!! আরু মা হতে পারলো কি পারলো না এই তুচ্ছ কারনে আমি আমার ভালোবাসা থেকে পিছিয়ে যাবো ওতটা কাপুরষ এই রৌদ্র নয়। আমি জানি প্রতিটি মেয়েই চায় মা হতে। একটা মেয়ের জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হলো নিজের সন্তানের মুখ থেকে মা ডাক শুনতে পারা। আমার সম্পূর্ণ বিশ্বাস আছে আরুও সেই সুযোগটা পাবে। আরু নিজের সমস্যাটাকে যতটা বড় করে দেখছে সমস্যা পুরপুরিই তার উল্টো৷ সামান্য চিকিৎসার মাধ্যমেই এই প্রব্লেম ঠিক হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। যাই হোক আমি এসব নিয়ে ভাবতে চাই না। এখন তোমাদের কাছে একটাই অনুরোধ আমার এই কথা গুলো যেন আমাদের তিনজনের মধ্যেই থাকে।”
রৌদ্রর কথা শুনে কাসফিয়ার চোখ পানিতে চিকচিক করে উঠলো। কাসফিয়ার বলা সেই রাজকুমারকে এখন নিজের সামনে দেখে খুশিতে চিকচিক করে উঠেছে তার চোখ। কাসফিয়া রৌদ্রর চোখে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে আরশির প্রতি তার অসীম ভালোবাসা। এইটাই সেই রাজকুমার যে কি-না সকল বাধাবিপত্তি পেরিয়েই আরশিকে তার রাজকুমারীর করে নিয়ে যাবে। নিজের কাল্পনিকতাকে এভাবে বাস্তবিক রূপ পেতে দেখে কাসফিয়ার খুশি উপচে পরতে চাইছে সুখের অশ্রুপাত হয়ে। নীল চুপচাপ চেয়ার ছেড়ে রৌদ্রর কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। রৌদ্রর সাথে সাথে দাঁড়িয়ে গেল। কিছুটা ভ্রু কুচকে নীলের দিকে তাকাতেই নীল ঝড়ের বেগে রৌদ্রকে জড়িয়ে ধরলো। রৌদ্র হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নীল এভাবে হুট করেই তাকে জড়িয়ে ধরবে সেটা রৌদ্র বুঝতে পারেনি। নীল খানিকটা আবেগী কন্ঠে বললো-
“আপনাকে অনেক ধন্যবাদ আমাদের আশুর জীবনে আসার জন্য। আশুকে আপনার থেকে বেশি আর কেউ ভালোবাসতে পারবে না তা আমি বুঝে গেছি। আমরা সবাই আশুকে নিয়ে ভয়ে ছিলাম কিন্তু এখন বিন্দুমাত্র ভয় নেই। আমার বিশ্বাস আপনি আশুকে সারাজীবন আগলে রাখবেন।”
রৌদ্র মুচকি হেসে নীলের পিঠে আস্তে আস্তে চাপড় মেরে বলল-
“এবার তোমরাও আমাকে একটু হেল্প কর। তোমাদের ফ্রেন্ড তো খুব পাজি মেয়ে। আমার কাছে নিজেকে ধরা দিতেই চায় না।”
নীল রৌদ্রকে ছেড়ে দিয়ে দুষ্টামি করে বলল-
“আপনি আশুকে পটানোর কাজ চালিয়ে যান। আর আপনাদেরকে বিয়ে পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব আমাদের।”
কথাটা বলেই নীল উচ্চস্বরে হেসে উঠলো। নীলের সাথে সাথে রৌদ্র আর কাসফিয়াও তাল মিলিয়ে হেসে যাচ্ছে। রেস্টুরেন্টের চারপাশের টেবিলের কয়েক জোড়া উৎসুক চোখ তাদের তাকিয়ে আছে। কাসফিয়া আশেপাশে তাকিয়ে কিছুটা বিব্রত হয়ে নীলকে চাপা কন্ঠে বললো-
“নীল হাসি বন্ধ করে চুপচাপ বসে পর। আশেপাশে তাকিয়ে দেখ সবাই অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে।”
কাসফিয়া কথা শুনে রৌদ্র আর নীল হাসি থামিয়ে চারদিকে এক নজরে চোখ বুলিয়ে নিল। সবাইকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে কিছুটা অস্বস্তিবোধ করছে। রৌদ্র আর নীল একে অপরের দিকে তাকিয়ে একটা মেকি হাসি দিয়ে আবারও নিজেদের জায়গায় বসে পরলো।
————————
শেষ বিকেলের শান্ত শীতল পরিবেশ। পশ্চিম আকাশে ক্লান্ত হয়ে ঢলে পরা সূর্যের রক্তিম আভা। কিছুটা সময় পরপর বয়ে যাওয়া ধমকা হাওয়া সব মিলিয়ে আরশির মন বার বার প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে ফেলছে। একাকিত্বের সময় এই প্রকৃতিই তার একমাত্র সঙ্গী হয়ে ওঠে। কাসফিয়া বাসায় না থাকায় আরশি একা একা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। নিজেকে বিলিয়ে দিচ্ছে প্রকৃতির মুগ্ধতার মাঝে। নিঃস্তব্ধতা ঘিরে ধরেছে আরশির চারপাশে। পাখিগুলোও আজ কেমন যেন চুপচাপ হয়ে আছে, কোনো কিচিরমিচির শব্দ করছে না। আরশি এক মনে তাকিয়ে পশ্চিমা আকাশের এই রক্তিমা আভা গুলোর কালো হয়ে যাওয়া দেখিছে।
“এই পাশের বারান্দা এখানে চুপচাপ দাঁড়িয়ে কি করছো??”
আচমকা নির্বানের কন্ঠ শুনে আরশি কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পরলো। আরশি গোলগোল চোখ চোখ দিয়ে নির্বানের দিকে তাকাতেই নির্বান বলল-
“উফফফ.. পাশের বারান্দা আমাকে এতো ভয় পাও কেন বলো তো!! আমি রোদ ভাইয়ের মতো এতো গম্ভীর আর রাগী না তাই আমাকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। তুমি আমাকে নিজের ফ্রেন্ড মনে করতে পারো।”
আরশি ভ্রু কুচকে নির্বানের দিকে তাকিয়ে সন্দিহান কন্ঠে বললো-
“এভাবে আচমকা ডাক দিলে তো ভয় পাবোই।”
“তুমি নিজেই তো গভীর ভাবনায় ডুবে ছিলে তাই আমার উপস্থিতি টের পাওনি এটা কি আমার দোষ!!”
আরশির ভ্রু জোড়া আগের চেয়েও কিছুটা কুচকে এলো। নির্বানের সামনা-সামনি দাঁড়িয়ে বলল-
“আপনি-ও আপনার রোদ ভাইয়ের মতো কথা প্যাচান। যাই হোক এসব বাদ দিয়ে আপনার সম্পর্কে কিছু বলুন পরিচিত হই।”
নির্বান একটা অমায়িক হাসি দিয়ে বলল-
“বাহহহ ভাবি না মানে তুমি তো দেখছি আমার স্বাভাবিক ভাবেই কথা বলছো। ভালো লাগলো দেখে। আমি নির্বান হাসান নীড়। বাবা মায়ের একমাত্র ছেলে আর রোদ ভাইয়ের একমাত্র মামাতো ভাই। এবার মাস্টার্স ফাইনাল ইয়ারে। এবার তুমি বলো।”
নির্বানের কথায় আরশি বিস্মিত হয়ে বলল-
“কিহহ আপনি মাস্টার্স ফাইনাল দিবেন!!”
নির্বান মাথা দুলিয়ে হ্যাঁ জানালো। আরশি অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল-
“কিন্তু আমি ভেবেছিলাম আপনি আমার বয়সি হবেন। আপনার কথাবার্তা আর চালচলন দেখে তো মনে হয় আপনি আমার থেকে-ও ছোট।”
নির্বান সরু চোখে আরশির দিকে তাকিয়ে বলল-
“তোমাকে দেখেও আমার মনে হয়েছে তুমি বাচ্চা মেয়ে।”
নির্বানের কথা শুনে আরশি হেসে দিল। আরশির সঙ্গে তাল মিলিয়ে নির্বানও হাসতে লাগলো।
————————
“আচ্ছা তাহলে এখন আপনার কি প্ল্যান রৌদ্র ভাই?? আশুকে কিভাবে লাইনে আনবেন?”
নীলের কথায় রৌদ্র কিছুক্ষন চুপ করে থেকে গম্ভীর গলায় বললো-
“তোমাদের ফ্রেন্ড লাইনে না আসলেও ওকে লাইনে কীভাবে আনতে হবে তা আমার খুব ভালো করে জানা আছে। কালকের দিনটা শুধু অপেক্ষা করবো তারপর সব আমার মতো হবে। সোজা আঙুলে ঘি না উঠলে আঙুল বাঁকা করতে।”
কথা গুলো বলেই রৌদ্র একটা রহস্যময় হাসি দিল। কাসফিয়া একটা শুকনো ঢোক গিলে বলল-
“মানে কি করবেন?”
“আজ সময় নেই৷ পরে সব জানিয়ে দিব৷ তোমরা দুজন শুধু আমাকে একটু হেল্প করো তাহলেই হবে। বাকি আমি ম্যানেজ করে নিব।”
নীল রৌদ্রকে আস্বস্ত করে বলল-
“আপনি কোনো চিন্তা করবেন না। আমরা আপনার কথা মতোই সব কাজ করবো।”
“আচ্ছা তাহলে আজ উঠছি।”
রৌদ্র নীল আর কাসফিয়ার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল। কাসফিয়া চিন্তিত গলায় নীলকে জিজ্ঞেস করল-
“দোস্ত রৌদ্র ভাই কি করবে রে??”
“যা-ই করুক না কেন এতটুকু বিশ্বাস রাখ আমাদের আশুর কোনো ক্ষতি হবে না। বুঝলি গাধি!!”
নীলের ভ্রুক্ষেপহীন প্রতিত্তোর শুনে কাসফিয়া অবাক দৃষ্টিতে নীলের দিকে তাকালো। নীল কিছুটা বিরক্তি প্রকাশ করে বলল-
“উফফফ এতো চিন্তা করিস না তো কাসফি। ওনার বলা কথা গুলো মনে মনে ভাব সব চিন্তা এমনিতেই গায়েব হয়ে যাবে।”
কাসফিয়া কিছুটা সময় চুপ থেকে মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল-
“আচ্ছা চল এখন। আশু বাসায় একা।”
——————————
আরশি নির্বানের সাথে জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছে আর রৌদ্র আবছা আলোয় আরশির দিকে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে আছে। আরশিকে আগে কখনো তার সামনে এতটা হাসিখুশি থাকতে দেখেনি। সব সময় লজ্জায় আর না হয় অস্বস্তিতে চুপটি মেরে থাকতো। কিন্তু আজ কথার ঝুলি নিয়ে বসেছে। অবশ্য নির্বানের মতো পাজি ছেলের সামনে কেউ-ই চুপচাপ বসে থাকতে পারবে না। আরশি রুম থেকে কয়েকটা চকলেট এনে নির্বানের দিকে ছুড়ে মারলো। নির্বান একটা চকলেট রৌদ্রর দিকে এগিয়ে দেয় কিন্তু রৌদ্র এখনো মুগ্ধ হয়ে আরশির দিকে তাকিয়ে আছে।
“এই যে মুগ্ধ প্রেমিক একটু ভাবনার জগৎ থেকে ফিরে আসুন।”
নির্বানের কথায় রৌদ্র আর আরশি দুজনেই কিছুটা লজ্জা পেল। রৌদ্র নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে বলল-
“তুই দিন দিন অনেক ফাজিল হয়ে যাচ্ছিস নির্বান।”
নির্বান কিছু ভাব নিয়ে বলল-
“আমি একদম পারফেক্ট আছি। কিন্তু তুমিই দিন দিন বয়ষ্ক মানুষদের মতো গম্ভীর হয়ে যাচ্ছো। আমি ঠিক বলেছি না পাশের বারান্দা???”
নির্বান আরশির দিকে জিজ্ঞাসুক দৃষ্টিতে তাকাতেই আরশি একটা মুচকি হাসি বলল-
“হুম এই জন্যই তো ওনার নাম এ্যাংরি বার্ড রেখেছি।”
“ভাবি তুমি তো খুব ভালো নাম রাখতে পারো। ভাইয়ের সাথে একদম মিলে গেছে।”
কথাটা বলেই নির্বান ঝংকার তুলে হাসতে লাগলো। আরশিও ঠোঁট চেপে হাসছে।
“নির্বান তুই কিন্তু এখন আমার হাতে মাইর খাবি ফাজিল কোথাকার।”
রৌদ্রর রাগী কন্ঠ শুনে নির্বান দৌড়ে রুমে চলে গেল। রৌদ্র আরশি দিকে তাকিয়ে বলল-
“আপনি এখানেই দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করুক আমি আসছি।”
রৌদ্র কথা বলে এক মুহূর্ত দেরি না করে নির্বানের পেছনে ছুটে গেল। আরশি হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে তাদের যাওয়ার পথের দিকে।
#রৌদ্রর_শহরে_রুদ্রাণী
#পর্বঃ৩৩
#Saiyara_Hossain_Kayanat
“মিস আরু??”
“হুম বলুন। আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে বলেছিলেন কেন!!”
রৌদ্র আরশির মুখোমুখি হয়ে দাঁড়ালো। আরশির দিকে তাকিয়ে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। আরশির আজ রৌদ্রর সাথে কোনো দ্বিধাবোধ ছাড়াই কথা বলছে। তা দেখে রৌদ্রর মনে কিছুটা আশার আলো খুঁজে পেল। রৌদ্র একটা মুচকি হাসি দিয়ে বলল-
“কাল বিকেল থেকে আপনি আমার।”
রৌদ্রর কথায় আরশি হকচকিয়ে উঠলো। হতভম্ব হয়ে ছোট ছোট চোখ করে জিজ্ঞেস করলো-
“কি বললেন! আমি ঠিক বুঝিনি আপনার কথা।”
রৌদ্র ডান হাতে সামনের চুল গুলো পেছনে ঢেলে দিলো। একটা রহস্যময় হাসি দিয়ে বলল-
“মানে কাল বিকেলে আপনার কোনো প্ল্যান থাকলে সেটা ক্যান্সেল করে দিন৷ আপনি কাল বিকেলে শুধু আমার মানে আপনাকে কিছু সময়ের জন্য বাহিরে নিয়ে যাবো। এখন যান ঘুমিয়ে পরুন।”
আরশিকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়েই রৌদ্র চলে গেল। আরশি হতাশ হয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রুমে চলে আসলো। “এই লোক কখনো ঠিক হবে না। কোনো কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সব সময় নিজের মতো হুকুম দিয়েই চলে যায়। অসভ্য ডাক্তার।” আরশি বিছানায় বসার সাথে সাথে ফোনের মেসেজ টোন বেজে উঠলো। আরশি টেবিলের উপর থেকে ফোন হাতে নিয়ে ইনবক্স ওপেন করতেই রৌদ্রর মেসেজ স্কিনে ভেসে উঠলো।
“চিরকুট দেওয়া নেওয়াটা কমে গেছে। তবে ভাববেন না যে বন্ধ হয়ে গেছে অনুভূতির চিঠি লেখা। অপেক্ষা করুন সব একসাথে ফিরে দিব আপনাকে।”
আরশি মেসেজটা পড়ে আনমনেই হেসে ফেলল। ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা নিয়েই বিছানায় শুয়ে পরলো। ফোনটা সামনে নিয়ে আবারও মেসেজটি পড়ে মুচকি হেসে ফোন রেখে দিল।
—————————
নীলা আজ ভোর সকালেই আরশির আর কাসফিয়ার জন্য নাস্তা নিয়ে এসেছে। আরশি নীলাকে রুমে বসিয়ে রান্না ঘরে কাসফিয়ার সাথে খারাব রেডি করছে। হয়তো নীলাকে কাসফিয়া থেকে দূরে রাখার ব্যর্থ চেষ্টা করছে আরশি। নীলা রুমে কিছুক্ষন বসে থেকে বারান্দায় চলে আসলো। রেলিঙের উপর হাত রেখে আনমনে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। নিজেকে যতটা পারছে শক্ত রাখার চেষ্টা করছে। আদ্রাফ এখন অন্য কারও মনকে বার বার এই কথাটাই বোঝাচ্ছে। নির্বান শার্ট পরতে পরতে তাড়াহুড়ো করে বারান্দায় আসলো। শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে পাশের বারান্দায় তাকিয়ে ভ্রু কুচকে ফেলল। এটা তো তার পাশের বারান্দা নয়। মেয়েটার দিকে তাকানোর ফলে শার্টের বোতাম গুলোও উল্টাপাল্টা লাগিয়ে ফেলেছে নির্বান। সাথে সাথেই মাথায় ঝেকে বসলো একরাশ বিরক্তি৷ এই মুহূর্তে পাশের বারান্দায় আরশির জায়গায় অন্য কাউকে দেখে মেজাজ যেন কিছুটা বিগড়ে গেল। এমনিতেই দেরি হয়ে যাচ্ছে তার উপর আবার কাঙ্ক্ষিত মানুষের জায়গায় অন্য কেউ। সকাল থেকেই সব কিছু গুলিয়ে ফেলছে নির্বান। সব হয়েছে তার রোদ ভাইয়ের জন্য। সকালে তাকে ঘুম থেকে না তুলে দিয়েই হসপিটালে চলে গেল আর এইদিকে নির্বানের ভার্সিটি যাওয়ার জন্য খুব বেশির দেরি হয়ে গেছে। নির্বান তেজি কন্ঠে বললো-
“এই মেয়ে আপনি আমার পাশের বারান্দায় এসেছেন কেন?? আমার ক্রাশ ভাবি কোথায়?? পাশের বারান্দা কোথায় ডাকুন ওকে।”
নীলা হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। কিছুটা বিস্ময় নিয়ে নির্বানকে জিজ্ঞেস করলো-
“কি সব আবোলতাবোল বলছেন আপনি!! পাশের বারান্দাকে আবার ডাকবো কিভাবে? আর আপনার ক্রাশ কে আমি কিভাবে জানবো?? পাগল না-কি আপনি??”
নির্বান শার্টের কলার ঠিক করতে করতে তীক্ষ্ণ গলায় বললো-
“আপনার এতো প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার সময় আর ইচ্ছে কোনোটাই আমার নেই। আপনি এখানে এসেছেন কেন?? আমার পাশের বারান্দা কোথায়??”
নীলে এবার প্রচন্ডরকম ক্ষেপে গেল। রাগে তেঁতে উঠে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল-
“আপনি তো ভারি অসভ্য লোক। আমাদের বারান্দায় আমি দাঁড়িয়ে আছি তাতে আপনার কি?? আর একটা অপরিচিত মেয়ের সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় সেই ভদ্রতাও দেখছি আপনি জানেন না। যত্তসব পাগল।”
নির্বান তাড়াহুড়ো করে শার্টের হাতা ভাজ করতে লাগলো। নীলার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে শক্ত গলায় বলল-
“আপনার সাথে ফালতু ঝগড়াঝাটি করার সময় নেই। তাড়াতাড়ি পাশের বারান্দাকে ডাকুন আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে।”
নীলার রাগ জ্বলজ্বল করে জ্বলে উঠলো। রাগান্বিত কন্ঠে বললো-
“কি বার বার পাশের বারান্দা পাশের বারান্দা করছেন!! কাকে ডাকতে বলছেন আপনি?”
নির্বান বিরক্তি প্রকাশ করে আরশিকে নিজেই ডাকতে লাগলো-
“ধুর অকর্মা মেয়ে। পাশের বারান্দা… এই পাশের বারান্দা… তাড়াতাড়ি বারান্দায় আসো। আমি চলে যাচ্ছি।”
নীলা ধমকে বলল-
“আজব তো এভাবে ষাড়ের মতো চেচাচ্ছেন কেন??”
নির্বানের চেচামেচির শব্দ শুনে আরশি রান্নাঘর থেকে দৌড়ে বারান্দায় আসলো। নীলা আর নির্বানকে একে অপরের দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে আরশি ভ্রু কুচকে ফেললো। নির্বানের দিকে তাকিয়ে বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করল-
“কি হয়েছে এভাবে ডাকছেন কেন নীড়??”
নির্বান আরশির দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বললো-
“আমি চলে যাচ্ছি তাই ভাবলাম তোমার সাথে দেখা করে যাই। কিন্তু তোমার বারান্দায় এসব ঝগড়াটে মেয়ে কিভাবে আসলো সেটাই বুঝতে পারছি না।”
“আপনি কিন্তু…”
নীলা রেগেমেগে কিছু বলতে যাবে তার আগেই আরশির নীলার হাত চেপে ধরে চোখের ইশারায় চুপ করিয়ে দিল। নির্বানের দিকে তাকিয়ে বলল-
“ওর নাম নীলা আমার ফ্রেন্ড। আপনি কি এখনই চলে যাবেন!!”
নির্বান নীলার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। আবারও আরশির দিকে শান্ত চোখে তাকিয়ে বলল-
“হুম.. এখন ভার্সিটিতে যাবো তারপর বাসায়।”
“ওহহ আচ্ছা। চুল ঠিক করুন এলোমেলো হয়ে আছে। মানুষ পাগল ভাববে।”
নির্বান নিজের চুল ঠিক করে আবারও রাগান্বিত চোখে নীলার দিকে তাকালো। নীলার থেকে চোখ ফিরিয়ে আরশির দিকে চেয়ে একটা মুচকি হাসি দিল। তাড়াহুড়ো করে যেতে যেতে বলল-
“আচ্ছা পাশের বারান্দা আজ আসি। আবারও দেখা হবে। ভালো থেকো ক্রাশ ভাবি।”
নির্বার চলে গেল। আরশি আর নীলা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দুজনেই অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নির্বানের যাওয়ার পথে। আরশি নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে বলল-
“বাদ দে নিলু উনি এমন-ই দূষ্টু আর অস্থির মানুষ। তুই রুমে চল।”
আরশির কথায় নীলা নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে পাশের বারান্দার দিকে একবার তাকিয়ে রুমে চলে আসলো। রুমে এসেই আরশিকে জিজ্ঞেস করলো-
“এই ছেলেটা কে আশু?? পাগলের মতো কি সব উদ্ভট কথাবার্তা বলছিল।”
আশু চুলে খোপা করতে করতে আয়নার দিয়ে তাকিয়ে নির্লিপ্ত কণ্ঠে বললো-
“ডক্টরের মামাতো ভাই। উনিই এই চিঠির আদান-প্রদান শুরু করেছিলেন। খুবই চঞ্চল স্বভাবের একজন মানুষ। সব সময় হাসিঠাট্টা করতেই থাকে। কিন্তু আজ হয়তো দেরি হয়েছে বলে মেজাজ চড়ে আছে। তুই কিছু মনে করিস না।”
নীলা আর কথা বাড়ালো না। তবে মনে মনে নির্বানকে ধুয়ে দিচ্ছে বকা দিয়ে। “হুটহাট করে একটা অচেনা মেয়ের সাথে কেউ এভাবে ব্যবহার করে না-কি!! আস্ত একটা বজ্জাত ছেলে। মাথায় বুদ্ধি বলতে কিছুই নেই!! অসহ্যকর লোক।”
————————
“আরু নিচে আসো আমি দাঁড়িয়ে আছি।”
আরশি ফোন রিসিভ করতেই অপরপাশ থেকে রৌদ্রর শীতল কন্ঠে তুমি সম্মোধন করা কথা গুলো কানে এসে তীরের মতো বিধলো। আরশি মনে হচ্ছে কোনো এক ঘোরের মধ্যে চলে গেছে। রৌদ্রর আরশির কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে আবারও নরম গলায় বললো-
“আরু শুনতে পাচ্ছো আমাকে!! চুপ করে আছো কেন!! তাড়াতাড়ি নিচে নামো আমি অপেক্ষা করছি।”
আরশি জোড়ালো কন্ঠে বললো-
“হুম আসছি।”
আরশি ফোন কেটে দিয়ে বুকে হাত রেখে বড় বড় করে কয়েকবার শ্বাস নিলো। আয়নায় নিজেকে একবার দেখে নিয়ে রৌদ্রর উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পরলো। গাড়ির সামনে রৌদ্রকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে থমকে দাঁড়ালো আরশি। বড় বড় চোখ করে রৌদ্রর দিকে তাকিয়ে আছে। কালো শার্ট-প্যান্ট পরা, হাতে কালো ঘড়ি। রৌদ্র আজ সব কিছুই কালো রঙের পরেছে। রৌদ্র গাড়িতে হেলান দিয়ে বেশ ভাব নিয়ে ফোন টিপছে। এই মুহূর্তে কোনো নায়ক থেকে কম মনে হচ্ছে না রৌদ্রকে। আরশি নিজের ড্রেসের দিকে তাকিয়ে মনে মনে কাসফিয়া ইচ্ছে মতো বকতে লাগলো। কাসফিয়ার কথাতেই আজ কালো রঙের ড্রেস পরেছে আরশি। যদি জানতো আজকেও রৌদ্রর সাথে তার ড্রেসের রঙ মিলে যাবে তাহলে কখনো এই কালো জামা পরতো না। আরশি রৌদ্রর দিকে এগিয়ে গেল। রৌদ্র ফোনের স্ক্রিন থেকে দৃষ্টি তুলে আরশির দিকে তাকালো। মুহুর্তের মধ্যেই রৌদ্রর মুখের ভঙ্গি বদলে গেল। চোখ দুটোতে হানা দিক অসীম মুগ্ধতা। মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে আরশির দিকে। আজ মেয়েটাকে বড্ড বেশিই মোহনীয় লাগছে। রোদের তীর্যক রশ্মির মতো আরশির মুখে মায়া উপচে পরছে। রৌদ্র তার রুদ্রাণীর মায়ায় হারিয়ে ফেললো নিজের হুশ জ্ঞান। নিজের মধ্যে থেকেও যেন নিজেকে খুজে পাচ্ছে না। ঘোর লাগা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার রুদ্রাণীর দিকে। আরশি রৌদ্রকে একবার ডাক দিয়ে কোনো সাড়া না পেয়ে এবার খানিকটা জোরেই ডাক দিল-
“ডক্টর স্যার… আপনি কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন না!!”
আরশির ডাকে রৌদ্রর ঘোর ভেঙে গেল। অপ্রস্তুত হয়ে আমতা-আমতা করে বলল-
“গাড়িয়ে উঠে বসো আরু।”
আরশি রৌদ্রর ব্যবহার দেখে অবাক হলো। কিন্তু তা প্রকাশ না করে চুপচাপ রৌদ্রর কথা মতো গাড়িতে উঠে বসে পরলো।
আরশি বার বার রৌদ্রর দিকে আড় চোখে তাকাচ্ছে। রৌদ্র আরশির তাকানোর কারন বুঝতে পেরে বলল-
“কিছু জিজ্ঞেস করতে চাইলে কোনো প্রকার দ্বিধাবোধ না করে জিজ্ঞেস করো আরু।”
আরশি নিম্ন স্বরে মিনমিনিয়ে বলল-
“আমরা কোথায় যাচ্ছি??”
“কিছুটা সময় অপেক্ষা করো তুমি নিজেই দেখতে পারবে কোথায় যাচ্ছি।”
আরশি নিরাশাজনক দৃষ্টিতে রৌদ্রর দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিল। মুখ গোমড়া করে জানালা দিয়ে বাহিরের দিকে তাকিয়ে আছে আরশি। রৌদ্র আরশির দিকে তাকিয়ে একটা মুচকি হাসি দিয়ে গাড়ি চালানোয় মনোযোগ দিল। প্রায় আধঘন্টা পর গাড়ি ব্রেক কষলো। আরশি জিজ্ঞাসু চোখে রৌদ্রর দিকে তাকাতেই রৌদ্র বলল-
“এসে পরেছি। এখন গাড়ি থেকে নেমে দেখতে পারো কোথায় নিয়ে এসেছি তোমাকে।”
আরশি চুপচাপ গাড়ি থেকে নেমে গেল। চারদিকে চোখ বুলিয়ে নিয়েই আরশির মুখে মুচকি হাসি ফুটে উঠলো। উৎসুক কন্ঠে বলল-
“আগে বললেই তো হতো আপনি আমাকে এই ব্রিজে নিয়ে আসবেন। তাহলেই তো আমাকে আর এতো ভাবতে হতো না।”
রৌদ্র আরশির কাছে এসে বলল-
“বলে দিলে কি আর সারপ্রাইজ থাকতো না-কি!!”
আরশি সরু চোখে রৌদ্রর দিকে এক ঝলক তাকিয়ে ব্রিজের দিকে এগিয়ে গেল। রৌদ্র আরশির পিছু পিছু যাচ্ছে। আরশিকে আজ একটু বেশিই হাসিখুশি লাগছে তার কাছে। আরশি ব্রিজের উপর এসে দাঁড়িয়ে সামনের দিকে দৃষ্টি দিয়ে শান্ত গলায় বলল-
“প্রথম দিন এখানে নিয়ে এসেছিলেন তখন আমার সকল মন খারাপ সাক্ষী ছিল এই জায়গায়। কিন্তু এবার আর কোনো মন খারাপ নেই। আচ্ছা আজ হঠাৎ করে এখানে নিয়ে এসেছেন কেন??”
রৌদ্র কিছু বলল না। চুপচাপ আরশির পাশে দাঁড়িয়ে আছে। একটু পর পর আরশির দিকে আড় চোখে তাকাচ্ছে। আরশি রৌদ্রকে বার বার আড় চোখে তাকাতে দেখে খানিকটা ভাব নিয়ে বলল-
“কিছু জিজ্ঞেস করতে চাইলে কোনো প্রকার দ্বিধাবোধ না করে জিজ্ঞেস করো রোদ।”
রৌদ্র আরশির কথা শুনে চমকে আরশির দিকে বড় বড় চোখে তাকালো। রৌদ্রর চাহনি দেখে আরশি খিলখিল করে হেসে দিল। আজ আরশির সকল অস্বস্তিবোধ যেন রৌদ্রর উপর এসে হামলে পড়েছে। রৌদ্র নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে আরশির হাসির দিকে তাকিয়ে আছে। “মেয়েটাকে এই হাস্যজ্বল মুখেই বেশ মানায়। ইশশ.. কেন যে এই মেয়েটা সব সময় হাসে না!! এই হাসির জন্য আমি সব কিছু করতে রাজি। নিজের সব কিছুর বিনিময়ে হলেও এই হাসি দেখতে চাই।” আরশির হাসির মাঝে রৌদ্র শান্ত গলায় বললো-
“আমি তোমাকে কিছু বলতে চাই আরু।”
আরশি হাসি থামিয়ে রৌদ্রর দিকে চেয়ে বলল-
“হুম বলুন।”
“একটু দাঁড়াও আমি আসছি।”
রৌদ্র দৌড়ে গাড়ির দিকে চলে গেল আরশি ভ্রু কুচকে রৌদ্রর দিকে তাকিয়ে আছে। আরশি বুঝতে পারছে না রৌদ্র কি করতে চাইছে। মনে মনে নানানরকম চিন্তা ভাবনা করছে রৌদ্র এমন অদ্ভুত আচরণের জন্য। রৌদ্র দু এক মিনিটের মধ্যেই আরশির দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো।
চলবে….