রৌদ্রর শহরে রুদ্রাণী পর্ব -৩৪+৩৫

#রৌদ্রর_শহরে_রুদ্রাণী
#পর্বঃ৩৪(It’s Love)
#Saiyara_Hossain_Kayanat

“ভালোবাসি আরু”

আচমকা রৌদ্র আরশির কাছে এসে হাটু গেড়ে বসেই এই অপ্রত্যাশিত কথাটা বলে ফেলল। পেছন থেকে একটা কাচের জার আরশির সামনে এনে ধরলো। আরশি অবাক দৃষ্টিতে রৌদ্রর হাতের কাচের জারটার দিকে তাকিয়ে আছে। পুরো কাচের জার ভর্তি রঙিন চিরকুট। রৌদ্র নানান রংবেরঙের কাগজে চিরকুট লিখে মুচড়ে গোলাকার করে পুরো জার ভরেছে। রৌদ্রর চোখে মুখে হাল্কা লজ্জার আভা। শীতল চোখে চেয়ে নরম গলায় আবারও বলে উঠলো রৌদ্র-

“আমি তোমাকে ভালোবাসি রুদ্রাণী। কতটা ভালোবাসি তা প্রকাশ করতে পারবো না। আর প্রকাশ করতেও চাই না। আমি চাই আমার ভালোবাসা তোমাকে অনুভব করাতে। কতটা ভালোবাসি জানি না। কিন্তু আমার ভালোবাসার পরিমাণ কখনো কোনো শব্দে ব্যাখ্যা করতে পারবো না। তবে এই রঙিন চিরকুট গুলোর মতো তোমার সকল অনুভূতি গুলোকে রাঙিয়ে দিতে চাই।”

রৌদ্র আরশির হাতে রঙিন চিরকুটে ভর্তি কাচের জার ধরিয়ে দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। সাথে সাথেই আরশি মুখে একরাশ লজ্জা এসে হানা দিন। লজ্জায় মাথা নুয়ে ফেলল। স্থির চোখে তাকিয়ে আছে হাতের রঙিন চিরকুট গুলোর দিকে। রৌদ্র আরশির দিকে এক নজর তাকিয়ে পাশ ঘুরে দাঁড়ালো। পুরনো জর্জরিত হয়ে উঠা ব্রিজের রেলিঙের উপর আলতো করে হাত রাখলো। ছোট একটা শ্বাস ফেলে শীতল চোখে দূরের আকাশে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। সহজ গলায় বলল-

“তোমাকে কিছু বলতে হবে না আরু। আমি তোমার কাছ থেকে কোনো উত্তর চাইনা। তাই এসব নিয়ে নিজের উপর কোনো প্রকার চাপ সৃষ্টি করো না। তুমি স্বাভাবিক ভাবেই থাকতে পারো। আর হ্যাঁ এখন থেকে এসবের প্রতি অভ্যস্ত হয়ে যাও। অবশ্য অভ্যস্ত না হয়ে প্রতিবার আমার কথায় এভাবে লজ্জায় নুয়ে পরলে আরও বেশিই ভালো হবে। বাসে তোমাকে লজ্জায় অস্থির হতে দেখেই আমার মাথা আর মন দুটোই এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল। তারপর থেকে তোমাকে যতবারই লজ্জায় নুয়ে পরতে দেখি ততবারই তোমার ভালোবাসায় নতুন করে নিজেকে আবিষ্কার করি। আমার সামনে যতবার তোমার মুখ লজ্জায় লাল হয়ে নুয়ে পরবে ঠিক ততবার আমার মনে তোমার প্রতি ভালোবাসা নতুন করে জন্ম নিবে।”

রৌদ্রর কথায় আরশি হকচকিয়ে উঠলো। বিস্ফোরিত চোখে রৌদ্রর দিকে তাকালো। রৌদ্রর দৃষ্টি এখনো দূর আকাশেই স্থির। কপালের চুল গুলো বাতাস বার বার চোখে সামনে এসে পরছে। দুই হাত আড়াআড়ি ভাবে ভাজ করে রেখেছে। রৌদ্রর ফর্সা ত্বকে যেন কালো শার্টটা খুব বেশিই মানিয়েছে। আরশি চোখ নামিয়ে ফেলল। রৌদ্রর শীতল কন্ঠে এসব কথা শুনে আরশিকে আরও দ্বিগুণ পরিমাণ লজ্জা আঁকড়ে ধরেছে। নিচের দিকে তাকিয়ে ঘনঘন চোখের পলক ফেলছে। আরশি নিজেকে সামলানোর জন্য বড়বড় করে কয়েকবার শ্বাস নিল। ধীর পায়ে রৌদ্রর পাশে যেয়ে দাঁড়ালো। ব্রিজের মোটা ইঁট সিমেন্টের তৈরি রেলিঙের এক পাশে কাচের জারটা রেখে দিল। দু হাত এক করে অনবরত হাত কচলাতে লাগলো। রৌদ্র আরশির হাতের দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দিয়ে বলল-

“হাত কচলানোর জন্যই জারটা রাখতে আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছো বুঝি!!”

আরছি চমকে রৌদ্রর দিকে তাকালো। মুখে দূষ্টু হাসি রেখে আবারও বলল-

“সমস্যা নেই। অস্থিরতায় তোমার হাত কচলানো দেখলেও আমি ফিদা হয়ে যাই। তবে একটা রিকুয়েষ্ট একটু আস্তে যত্ন করে হাত কচলিও নাহলে হাতের অবস্থা নাজেহাল হয়ে যাবে।”

কথা গুলো বলে রৌদ্র শব্দ করেই হেসে দিল। আরশি হাত কচলানো বন্ধ রৌদ্রর হাসি দেখতে ব্যস্ত হয়ে পরলো। রৌদ্রর দিকে শান্ত চোখে দৃষ্টি দিতেই আনমনে আরশির ঠোঁটের কোণে একটা মুচকি হাসি ফুটে উঠলো। কিছুটা সময় পর রৌদ্র আবারও চুপ হয়ে গেল। সামনে দিকে তাকিয়ে আছে শান্ত চোখে। আরশিও চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে রৌদ্র পাশে। দুজনের মধ্যেই নিরবতা বিরাজমান। কারও মুখে কোনো কথা নেই। রৌদ্র আরশির দিকে তাকালো। আরশির খোলা চুল গুলো মৃদু বাতাসে একটু পর পর উড়িয়ে দিচ্ছে। চোখে পাপড়ি গুলো ঘনঘন পলক ফেলছে। রৌদ্র ঘোরলাগা দৃষ্টিতে কিছুক্ষন আরশির দিকে তাকিয়ে থাকার পর রেলিঙের উপর রাখা আরশির হাতের দিকে তাকালো। এই মুহূর্তে আরশির হাত খুব শক্ত করে ধরতে ইচ্ছে করছে কিন্তু এক ঝাঁক অস্বস্তি এসে রৌদ্রর ইচ্ছেকে চাপা দিয়ে দিচ্ছে। বার বার হাতের কাছে হাত নিয়েও আবার দূর সরিয়ে নিচ্ছে। আরশির হাত ধরতে চেয়েও সাহস পাচ্ছে। আরশি আড় চোখে রৌদ্রর এমন কাজ দেখে অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে ফেললো। রৌদ্রর চোখের আড়ালেই ঠোঁট চেপে হাসতে লাগলো। কিছুক্ষন আগেই বিনা দ্বিধায় কত কথা বলে দিল আর এখন সেই মানুষটাই হাত ধরতে লজ্জা পাচ্ছে। লোকটা বড্ড বেশিই অদ্ভুত। আরশি নিজের ভাবনায় রৌদ্রকে নিয়ে নানানরকম জল্পনাকল্পনা করে মনে মনেই হাসছে। ভাবনার মাঝে হঠাৎই আরশির কানে ভেসে আসলো এক শান্ত শীতল সুরেলা কন্ঠ। আরশি কৌতুহলী চোখে রৌদ্রর দিকে তাকালো। রৌদ্র সুর তুলে গান গাইছে।

চলতি সময়, থমকে দাঁড়ায়
জেগে জেগে স্বপ্ন দেখি হায়
তোমার এই হাত ধরতে চায়
ফাগুন হাওয়ায়।

কি মায়ার কোন, সে নেশায়
বারে বার মন ছুঁতে চায়
চেনা মুখ ঘুরপাক খায় চোখের পাতায়।

আমি বার বার বহুবার তোমাকে চাই
আমি বার বার হাজার বার তোমাকে চাই।

তুমি আমি আর নিরবতা,
শুনতে কি পাও এই মনে কথা
ভোর আঁধারেও তোমায় দেখি,
তুমি কবিতা, তুমি কবি।

আজকাল মন ডুবে যায়
অনুভবে তুমি ভাসো তাই
এই আমি না চিনি আমায়,
চেনা আয়নায়।

আমি বার বার বহুবার তোমাকে চাই
আমি বার বার হাজার বার তোমাকে চাই।

আরশি মুগ্ধ হয়ে রৌদ্র গান শুনছে। রৌদ্রর পুরোটা গান আরশির দিকে তাকিয়েই গেয়েছে। রৌদ্রর কন্ঠস্বর আরশির কাছে নেশার মতো লাগছে। আরশি মনে হচ্ছে রৌদ্রর গানের মাঝেই হারিয়ে গেছে। রৌদ্র কিছুটা এগিয়ে এসে ঝুঁকে আরশির চোখের দিকে তাকিয়ে বলল-

“মৃত্যু আমৃত্যু আমি শুধু তোমাকে চাই। তোমার ব্যর্থতা, মন খারাপ সব কিছু চাই। তোমার চোখের অশ্রুজল, তোমার ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা হাসি দুটোই চাই। তোমার লজ্জা, অস্বস্তি, রাগ সব কিছু চাই। শুধু তোমার ঘৃণা নয় ভালোবাসাটা-ই চাই।”

আরশি লজ্জায় রৌদ্রর কাছ থেকে খানিকটা দূরে সরে গেল। আরশিকে লজ্জা পেতে দেখে রৌদ্র হাসতে হাসতে বলল-

“তুমি লজ্জা পেয়ে আবারও আমাকে বাধ্য করছো তোমার ভালোবাসায় নতুন করে নিজেকে আবিষ্কার করতে। আর কতো শত বার তোমার ভালোবাসায় নিজেকে হারাতে বাধ্য করবে আরু??”

পশ্চিম আকাশে সূর্য ডুবে সন্ধ্যা নেমে এসেছে। চারপাশ অন্ধকারে আবছা হয়ে গেছে। ঝিঝি পোকার ডাক আস্তে আস্তে বাড়েই চলছে। নিরবতা ভেঙে আরশি নিম্ন স্বরে বলল-

“ডক্টর রোদ!!”

রৌদ্র আরশির দিকে জিজ্ঞাসুক দৃষ্টিতে তাকাতেই আরশি বলল-

“রাত হয়ে যাচ্ছে এখন আমাদের এখন থেকে যাওয়া উচিত।”

রৌদ্র মাথা দুলিয়ে হ্যাঁ জানাতেই আরশি রেলিঙের উপর থেকে কাচের জারটা নিয়ে গাড়ির দিকে এগিয়ে হাঁটা শুরু করলো। রৌদ্র পেছন থেকে উচ্চস্বরে বলল-

“তোমার ডাকা নামটা আমাকে জানিয়ে দিচ্ছে তোমার মনে আমাকে নিয়ে থাকা সকল অনুভূতির উপস্থিতি।”

আরশি থমকে দাঁড়িয়ে গেল। স্থির হয়ে কিছুক্ষন একই জায়গায় দাঁড়িয়ে থেকে দ্রুত পায়ে গাড়ি এসে বসে পরলো। জানালা দিয়ে রৌদ্রর দিকে তাকিয়ে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।

—————————

বেশ কিছুক্ষন ধরে জ্যামে বসে আছে রৌদ্র আর আরশি। বিরক্তিতে আরশি চোখমুখ কুচকে বসে আছে। আর রৌদ্র ফোনে কথা বলা নিয়ে ব্যস্ত। হসপিটাল থেকে হয়তো কল এসেছে। আরশি বার বার ক্লান্তচোখে রৌদ্রর দিকে তাকাচ্ছে আবার বাহিরে তাকাচ্ছে। রৌদ্রর কথা বলা এখনো শেষ হচ্ছে না দেখে প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে জানালা দিয়ে বাহিরের দিকে নরজ দিল। মুখ গোমড়া করে বসে আছে আরশি।

“আরশি আমি তোমাকে ভালোবাসি। অনেক চেষ্টা করেও আমি তোমাকে ভুলতে পারছি না। আমি তোমার সব কিছু মেনে নিয়েই বিয়ে করতে রাজি আরশি।”

হঠাৎ পুরুষালী কন্ঠে এমন কথা শুনে রৌদ্র তৎক্ষনাৎ মানুষটার দিকে তাকালো। সুদর্শন এক যুবক আরশির জানালার কাছে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছে। চোখমুখে খুশির ঝলক স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। রৌদ্র ফোন কেটে দিয়ে শক্ত চোখে আরশির দিকে তাকালো। আরশি লোকটার দিকে নির্লিপ্ত ভাবে তাকিয়ে আছে। এই মুহূর্তে হয়তো এই মানুষটাকে এখানে আশা করেনি। আরশি একটা জোড়ালো শ্বাস ফেলে বলল-

“আহান আপনি এখানে!!”

আরশির মুখের নিজের নাম শুনে আহান অতিমাত্রায় উত্তেজিত হয়ে বলল-

“আমি ভেবেছিলাম তুমি হয়তো আমাকে ভুলে গেছো।”

“আমি এত তাড়াতাড়ি কাউকে ভুলে যাই না আহান।”

আহান উৎকন্ঠিত হয়ে বলল-

“তোমাকে এখনই এখানে দেখতে পাবো আশা করিনি। বিজনেসর কাজে বিদেশ গিয়েছিলাম। তোমাকে কতবার ফোন দিয়েছি কিন্তু প্রতিবারই ফোন বন্ধ এসেছে। এইকয়দিনে মনে হচ্ছে আমি তোমাকে আরও বেশি ভালোবেসে ফেলেছি। আমি আজকেই দেশে ফিরেছি ভেবেছিলাম কাল তোমার সাথে দেখা করবো।”

আরশি শান্ত গলায় বললো-

“মিস্টার আহান শান্ত হোন। উত্তেজিত হচ্ছেন কেন??”

আহান আগের মতোই উত্তেজনা নিয়ে বলল-

“এই মুহুর্তে তোমাকে এখানে দেখে কতটা খুশি হয়েছি তোমাকে বলে বোঝাতে পারবো না। আমি সব কিছু মেনে নিয়েই তোমাকে বিয়ে করতে চাই আরশি। তোমার ওইদিনের কথায় আমার কোনো আপত্তি নেই। তুমি চাইলে আমি এখনই তোমার বাসায় বিয়ের জন্য কথা বলতে পারি।”

“আমি এখন এসব নিয়ে কথা বলতে চাচ্ছি না আহান। ভালো থাকবেন।”

আরশি রৌদ্রর দিকে ফিরে রৌদ্রর হাতে আলতো ছুঁয়ে চোখের ইশারায় গাড়ি চালাতে বলল। জ্যাম ছুটে গেছে কিছুক্ষণ আগে। পেছনের গাড়ি গুলো অনবরত হর্ন বাজিয়ে চলছে। রৌদ্র সাথে সাথেই ড্রাইভ শুরু করলো। আহান আহত দৃষ্টিতে আরশির গাড়ির দিকে তাকিয়ে আছে। পুরো রাস্তা আরশি গম্ভীরমুখে বসে ছিল। রৌদ্র রাগে দ্রুত ড্রাইভ করে বাসায় চলে আসলো। আরশি চুপচাপ কিছু না বলে বাসায় চলে এসেছে। রৌদ্র রক্তিম চোখে আরশির দিকে তাকিয়ে আছে। আরশির চুপ করে থাকাটা রৌদ্রর রাগ আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে।

আরশি নিজের রুমে এসে খুব যত্ন সহকারে কাচের জারটা রেখে দিল। রঙিন চিরকুট গুলোর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দিয়ে ফ্রেশ হতে চলে গেল। ওয়াশরুম থেকে বের হতেই আরশির ফোন বেজে উঠলো। ফোন রিসিভ করতেই অপরপ্রান্ত থেকে আরশির আব্বু বলল-

“আশু কাল বিকেলের মধ্যে তুমি আর তোমার বন্ধুরা সবাই বাসায় আসবে।”

“কিন্তু বাবা হঠাৎ করে বাসায় যেতে বলছো কেন??”

আরশির আব্বু গম্ভীর গলায় বললো-

“যা বলেছি তা করো। এতো বেশি প্রশ্ন করতে হবে না। এখন রাখছি আর কাল বিকেলে মধ্যে যেন অবশ্যই তোমাদের সবাইকে আমার সামনে দেখতে পাই।”

আরশিকে কিছু বলার আগেই ফোন কেটে কেটে গেল। প্রচন্ড চিন্তা এসে আরশির মাথায় ঝেকে বসলো। এভাবে হঠাৎ করে বাসায় যেতে বলার কারন কি হতে পারে??
#রৌদ্রর_শহরে_রুদ্রাণী
#পর্বঃ৩৫
#Saiyara_Hossain_Kayanat

“আম্মু বাবা কাল বাসায় যেতে বলেছে কেন?? বাসায় কি কিছু হয়েছে?? সব কিছু ঠিক আছে তো!!”

আরশির আব্বু ফোন কেটে দেওয়ার কিছুক্ষণ সময় বাদেই আরশির ওর আম্মুকে কল করে। ফোন রিসিভ হতেই আরশি চিন্তিত গলায় এক সাথে সব গুলো প্রশ্ন ছুড়ে দিল ওর আম্মুর দিকে।

“আমি কিছু জানি না আশু। তোর আব্বু আমাকে কিছু বলে নি। তুই বরং কাল বাসায় এসেই জেনে নিস।”

আরশি ওর আম্মুর কথা শুনে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। হতাশ হয়ে বলল-

“আচ্ছা ঠিক আছে এখন এখন রাখছি। ভালো থেকো।”

আরশি ফোন কেটে বিছানায় ধপাস করে বসে পরলো। দু পা আড়াআড়ি ভাজ করে বসলো। গালে হাত রেখে ভাবতে লাগলো কি এমন জরুরি কাজ হতে পারে যার জন্য তার বাবা এমন কড়া হুকুম দিয়েছে!! মিনিট পাঁচেক চিন্তা ভাবনা করে কোনো কারন খুঁজে বের করতে না পেড়ে আবারও একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। ফোন হাতে নিয়ে নীলদেরকে গ্রুপে কল দিল। সবাই কলে জয়েন হতেই আরশি মলিন কন্ঠে বললো-

“নীল, কাসফি, আদ্রাফ আর নিলু তোরা সবাই ব্যাগ গুছিয়ে নে। কাল বিকেলের মধ্যে আব্বু আমাদের সবাইকে ওনার সামনে দেখতে চায় বলে কড়া হুকুম দিয়েছেন।”

সবাই চমকে উঠে একসাথেই মৃদুস্বরে চেচিয়ে বলল-

“কিইইইই???”

আরশি বিরক্তিমাখা কন্ঠে বললো-

“উফফফ আস্তে কথা বলতো তোরা।”

“কিন্তু হঠাৎ করে তোদের বাসায় কেন যেতে বলেছে আশু??”

আদ্রাফের প্রশ্নে আরশি নির্লিপ্ত কণ্ঠে বললো-

“জানিনা রে। আব্বুকে জিজ্ঞেস করেছিলাম কিন্তু কিছু বলেনি।”

“আশু তুই কি কোনো গন্ডগোল পাকিয়েছিস না-কি!! দেখিস নিজের সাথে সাথে আবার আমাদেরকেও ফাঁসিয়ে দিস না।”

নীলের কথা শুনে আরশি রাগান্বিত কন্ঠে বললো-

“চুপ কর হারামি। আমি আবার কি গন্ডগোল পাকাবো?? ফালতু কথা বলিস না।”

নীল এবার কাসফিয়াকে উদ্দেশ্য করে সন্দেহের গলায় বলল-

“কাসফি তুই আর আদ্রাফ মিলে কোনো আকাম-কুকাম করিস নি তো!!”

কাসফিয়া ভড়কে উঠে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললো-

“নীলের ডিব্বা বাজে কথা বলা বন্ধ কর। আশুর আব্বু ফোন দিয়েছে হয়তো কোনো জরুরী কাজ বলে। আংকেল তো আর বিনাকারণে আমাদের যেতে বলবে না তাই না।”

নীলা বিরক্ত হয়ে গম্ভীর গলায় বললো-

“উফফ তোরা এভাবে ঝগড়া করছিস কেন আজব!! কাল গেলেই তো জানতে পারবি কেন যেতে বলেছে। এখন সবাই চুপ থাক।”

আরশি ক্ষিপ্ত হয়ে বলল-

“হুম তোরা সবাই এখন ফোন রাখ। তোদের আজাইরা প্যাচাল শুনতে ভালো লাগছে না আমার। অসহ্যকর।”

আরশি রাগে গজগজ করে কথা গুলো বলেই ফোন কেটে দিল। রাতে ডিনার করে বারান্দায় এসে দাঁড়াতেই ময়না পাখি “পাশের বারান্দা” “পাশের বারান্দা” বলে চেচামেচি করতে লাগলো। আরশি পাখিগুলোর শব্দে ভ্রু কুচকে পাশের বারান্দায় তাকালো। রৌদ্র রেলিঙে হাত রেখে সামনের দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে আছে। আরশির উপস্থিতি টের পেয়েও তার দিকে ফিরে তাকালো না। আরশি রৌদ্র দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে নম্র কন্ঠে বললো-

“গাড়ির বিব্রতকর ঘটানার জন্য দুঃখিত। আমি বুঝতে পারিনি এমন কিছু হবে।”

রৌদ্র আরশির দিকে ফিরে তাকালো৷ শীতল চোখে তাকিয়ে আছে আরশির মুখের দিকে। নরম গলায় বললো-

“লোকটা কে মিস আরু??”

“ওনার সম্পর্কে আমি তেমন কিছু জানি না। উনি প্রতিদিন ভার্সিটিতে এসে আমার জন্য দাঁড়িয়ে থাকতেন, ভালোবাসার কথা বলতেন ব্যস এটুকুই। তারপর একদিন আমার ব্যর্থতার কথা বলি সেদিনের পর থেকে তার সাথে আর দেখা হয়নি। কিন্তু আজ হঠাৎ করে কোথা থেকে আমার সামনে চলে আসলো কিছুই বুঝতে পারছি না।”

রৌদ্র আর কিছু বললো না। আবারও আকাশের দিকে দৃষ্টি দিল। আরশিও চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। কিছুটা সময় পর নিরবতা ভেঙে রৌদ্র জিজ্ঞেস করলো-

“আপনি কি রাজি লোকটাকে বিয়ে করতে??”

আরশি হকচকিয়ে উঠলো এমন প্রশ্নে। রৌদ্রর দিকে তাকিয়ে গম্ভীরমুখে বলল-

“আমি কাউকে বিয়ে করতে চাই না।”

“আর আমাকে!!”

আরশি চমকালো। কিছু বলতে পারছে না। গলার মধ্যেই শব্দ গুলো গুলিয়ে ফেলছে। রৌদ্র আবারও বলে উঠলো-

“অনেক রাত হয়েছে। এখন আপনার ঘুমিয়ে পরা দরকার। এখানে দাঁড়িয়ে না থেকে রুমে যান মিস আরু।”

আরশি রৌদ্রর গম্ভীরমুখের দিকে এক ঝলক তাকালো। এই গম্ভীর চেহারায় তাকে বড্ড বেমানান লাগিছে। লোকটার মুখে তো হাসি খুব বেশিই মানায়। তবুও যে কেন সব গম্ভীর হয়ে থকে!!আরশি কোনো কথা না বলে চুপচাপ রুমে চলে আসলো। রৌদ্র এখনো আরশির বারান্দার দিকে তাকিয়ে আছে। মনে চলছে হাজারো চিন্তা ভাবনা আর ভয়। বুক চিড়ে বেরিয়ে আসলো এক দীর্ঘশ্বাস।

—————————

সকাল সকাল আরশি আর ওর বন্ধুরা সবাই মিলে বেরিয়ে পরলো তাদের গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। চিন্তায় আরশির মাথা পুরো এলোমেলো হয়ে আছে। পুরো পথ কেউ কোনো কথা বা দুষ্টুমি কিছুই করেনি। সবাই চিন্তিত মুখে বসেছিল। দুপুরের দিকে সবাই বাসায় পৌঁছে গেল। আরশি বাসার কাছে এসেই থমকে দাঁড়িয়ে যায়। অস্বস্তিতে হাত কচলানো প্রায় শুরু হয়ে গেছে তার। নীল আরশির অবস্থা দেখে ওর কাধে হাত রেখে বলল-

“আরে এতো চিন্তা করছিস কেন?? বাসায় তো এসেই পরেছিস এখন ভিতরে চল।”

আরশি নীলের দিকে তাকিয়ে একটা জোড়ালো শ্বাস ফেলে বাসার ভিতর চলে গেল। আরশি আর কাসফিয়ার বাবা মা সবাই ড্রয়িং রুমে বসে তাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। আরশি আর ওর বন্ধুরা সবার সাথে কুশল বিনিময়ের পর আরশি আদিব হাসানের সামনে এসে নিম্ন স্বরে জিজ্ঞেস করলো-

“বাবা হঠাৎ করে আসতে বলেছো কেন আমাদেরকে?? কিছু হয়েছে??”

আদিব হাসান মুখে গম্ভীরতা এনে বললো-

“আমার মেয়েকে আমি যখন ইচ্ছে আসতে বলতে পারি কিন্তু এর জন্য যে আমাকে এতো কৈফিয়ত দিতে হবে তা তো জানতাম না।”

আরশি ওর বাবার পাশে বসে শালীন গলায় বলল-

“আহহ বাবা আমি কি তা বলেছি না-কি!! এভাবে হঠাৎ করে আসার কথা বলেছো তাই আমার চিন্তা হচ্ছে। তুমি তো এর আগে কখনো এমন করনি”

আদিব হাসান তার মেয়েকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে বললেন-

“আসলে মা তোকে না জানিয়ে আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি।”

আরশি কৌতূহলী চোখে আদিব হাসানের দিকে তাকালো। সন্দিহান কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো-

“কিসের সিদ্ধান্তের কথা বলছো বাবা??”

“তোর বিয়ের।”

আদিব হাসানের এমন সহজ জবাব শুনে আরশি চমকে গেল। আরশির পায়ের নিচ থেকে মনে হচ্ছে মাটি সরে গেছে। আরশি প্রচন্ডরকম অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। বিস্মিত হয়ে বলল-

“বিয়ে মানে!! কি বলছো তুমি বাবা!!”

আদিব হাসান সোফা থেকে উঠে দাড়িয়ে গম্ভীর গলায় বললেন-

“যা বলেছি ঠিক শুনেছো। আগামীকাল তোমাকে ছেলে পক্ষ দেখতে আসবে। তার আগে তুমি নিজেকে সব কিছুর জন্য রেডি করে নাও। আগামীকাল আমি কোনো প্রকার ঝামেলা চাই না। আশা করি আমার কথা বুঝতে পেরেছো।”

আদিব হাসান গম্ভীরভাবে পা ফেলে দোতলায় চলে গেলেন। আরশি আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার বাবার দিকে। চোখ পানিতে টলমল করছে। আরশি ভেজা চোখে ওর আম্মু দিকে তাকিয়ে মলিন কন্ঠে বললো-

“আম্মু এসব কি হচ্ছে!!”

আরশির আম্মু আরশির কাছে এসে মাথায় বুলিয়ে দিয়ে বললেন-

“তুই তো জানিস তোর আব্বু এক বার যা বলে সেটাই করে। তুই চিন্তা করিস না আমি দেখছি তোর আব্বুর সাথে কথা বলে।”

আরশির আম্মু চলে গেলেন। কাসফিয়ার বাবা-মা আরশিকে নানানরকম সান্ত্বনার বানী শুনিয়ে তারাও চলে গেলেন। আরশি মাথা নিচু করে সোফায় বসে আছে। এতোক্ষন নীল ওরা সবাই চুপ থাকলেও এখন সবাই যাওয়ার সাথে সাথেই আরশির পাশে এসে বসে পরলো। সবাই এক প্রকার হামলে পড়েছে আরশিতে সান্ত্বনা দিতে। নীল আরশিকে শান্ত করার জন্য বলল-

“আশু চিন্তা করিস না। পাত্রপক্ষ দেখতে আসলেই তো আর বিয়ে হয়ে যাচ্ছে না তাই না।”

নীলের কথায় সবাই তাল মিলিয়ে আরশিকে বোঝাতে লাগলো। আরশি আগের মতোই চুপচাপ মাথা নিচু করে বসে আছে। কারো কথার কোনো পাত্তা না দিয়ে দাঁড়িয়ে ভাবলেশহীন ভাবে বললো-

“তোদের সবার কষ্ট করে আমাকে মিথ্যা আশ্বাস দিতে হবে না।”

আরশি আর কোনো কথা না বলে নিজের রুমে চলে গেল। সারাদিন চুপচাপ রুমের মধ্যেই কাটিয়েছে। কারও সাথে কথা বলেনি। আর রুমের বাহিরেও যায়নি। নির্ঘুম সারারাত কাটিয়ে দেওয়ার পর সকালে একটু ঘুমিছে আরশি। কিন্তু ঘন্টা খানেক পেরুতেই কাসফিয়া আর নীলা এসে আরশিকে টেনেহিঁচড়ে ঘুম থেকে তুলে দিল। আরশি প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে ধমকের স্বরে বলল-

“উফফফ নিলু কি হয়েছে তোদের?? এভাবে গরুর মতো ধাক্কাধাক্কি করছিস কেন??”

কাসফিয়া আরশিকে তাড়া দিয়ে বলল-

“আংকেল আমাদের দু’জনকে কড়া গলায় হুকুম দিয়েছে তোকে এক ঘন্টার মধ্যে সাজিয়ে দিতে হবে।”

আরশি কিছু বলার আগে নীলা অসহায় কন্ঠে বললো-

“আশু প্লিজ তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে আয়। দেরি হলে আংকেল আমাদের দুজনকে বকা দিবে। তুই না আমাদের খুব ভালো বন্ধু প্লিজ আমাদের বকা খাওয়ার মতো কিছু করিস না। তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নে বোন।”

আরশিকে এক প্রকার জোর করেই কাসফিয়া আর নীলা রেডি করিয়ে দিল। আরশি গোমড়া মুখে বসে আছে। তার বাবার উপর প্রচন্ড রাগ হচ্ছে তার। কিন্তু মুখ ফুটে কিছু প্রকাশও করতে পারছে না। আরশি খুব ভালো করেই জানে তার বাবা কাওকে একবার কথা দিয়ে দিলে সে কথা কখনো ফেলে না। ঘন্টা খানেক পর কাসফিয়ার আম্মু এসে বলল-

“কাসফি আর নিলা বাহিরে আসো। মেহমান এসেছে তাদের খেয়াল রাখো যাও।”

আরশিকে রেখে সবাই চলে গেল। আরশি হতভম্ব হয়ে বসে আছে। বুক ফেটে কান্না আসছে তার। কি থেকে হয়ে গেল আরশি কিছুই বুঝতে পারছে। মূর্তি ন্যায় স্তব্ধ হয়ে বসে আছে আরশি। চোখের সামনে বার বার সেই রঙিন চিরকুট গুলো ভেসে উঠছে। দুই চোখ পানিতে চিকচিক করছে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here