#রৌদ্রর_শহরে_রুদ্রাণী
#পর্বঃ৩৬
#Saiyara_Hossain_Kayanat
“আমি ডক্টর রোদকে ভালোবেসে ফেলেছি নীল।
নীল আরশির রুমে আসতেই আরশি নিম্ন স্বরে নীলকে কথাটা বলল। নীল অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আরশির দিকে। মাথা নিচু করে বসে আছে আরশি। চুল গুলো এলোমেলো হয়ে আছে। হাত দুটোর উপর অত্যাচার করছে বরাবরের মতোই। নীল আরশির পাশে এসে বিছানায় বসতেই আরশি জড়ানো কন্ঠে বলতে লাগলো-
“আমি নিজের মনকে অনেক বাধা দিয়েছি নীল। বার বার নিজের মনকে বুঝিয়েছি আমি কারও জন্য যোগ্য না। কাওকে বিয়ে করা বা ভালোবাসার যোগ্যতা আমার নেই। আমি অপরিপূর্ণ মেয়ে, আমার ব্যর্থতার জন্য আমি চাইলেও কাউকে ভালোবাসার সাহস করতে পারিনি। কিন্তু আমি হেরে গেছি নীল। আমি রোদের প্রতি দূর্বল হয়ে পরেছি। নিজেকে এসব অনুভূতি থেকে দূরে রাখতে চেয়েও আমি পারিনি। সব সময় নিজের অনুভূতি গুলোকে লুকিয়ে রাখতে চেয়েছি কিন্তু এখন আর পারছি না। আমি ভালোবেসে ফেলেছি রোদকে।ওনাকে ছাড়া আমি অন্য কাওকে বিয়ে করতে পারবো না। নীল তুই প্লিজ আব্বুকে বুঝিয়ে বল আমি এই বিয়ে করতে চাই না।”
আরশি কথা গুলো বলার সময় দুচোখ দিয়ে কয়েক ফোটা অশ্রুজল গড়িয়ে পরলো। কাসফিয়া দরজার কাছে দাঁড়িয়ে সব শুনছিলো। মুচকি হেসে আরশির পাশে বসলো। আরশির পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করছে। নীল আরশির দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বললো-
“শোন আশু তুই একটা মানুষ কোনো রোবট না। মানুষের অনুভূতির উপর কারও নিয়ন্ত্রণ থাকে না এমনি নিজেরও না। দুইবছর ধরে তোকে আমরা সব সময় রোবটের মতোই দেখে আসছি। তুই আমাদের সাথে স্বাভাবিক ভাবে থাকলেও প্রেম, ভালোবাসা, বিয়ে এসবের ক্ষেত্রে সব সময়ই তোকে অনুভূতিহীন দেখেছি। আগে হয়তো এসবের পেছনের কারন জানতাম না কিন্তু এখন তো জানি। আর সব জেনে শুনেই বলছি তুই এতোদিন বোকামি ছাড়া আর কিছুই করিসনি।”
আরশি মাথা তুলে অশ্রুসিক্ত চোখে নীলের দিকে তাকালো। নীলের আগের মতোই গম্ভীরতার সাথে বলতে লাগল-
“ভবিষ্যতে কি হবে না হবে না সেসব নিয়ে ভেবে নিজেকে এখন কতটা কষ্ট দিচ্ছিস তা একবারও ভেবেছিস তুই? কেন নিজের অনুভূতি গুলোকে নিজের ভিতর চাপা দিয়ে রাখছিস আশু? কাওকে ভালোবাসলে প্রকাশ করতে শিখ। নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে শিখ, মন খুলে বাঁচতে শিখ। রোবটের মতো অনুভূতি ছাড়া আর কতদিন থাকবি! এভাবে চলতে থাকলে তোর ভালোবাসা আর তোর কাছে থাকবে না। নিজের ভালোবাসাকে পাওয়া জন্য হলেও নিজের অনুভূতি প্রকাশ কর আশু।”
নীলের কথা শেষ হতেই কাসফিয়া আরশিকে বলল-
“আংকেল তোকে ড্রয়িং রুমে নিয়ে যেতে বলেছে আশু।”
আরশি আহত দৃষ্টিতে কাসফিয়ার দিকে তাকালো। তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে নিম্ন স্বরে বলল-
“আমি অন্য কাউকে বিয়ে করবো না। তোরা প্লিজ কিছু একটা কর। আমি এখন বাহিরে যাবো না। নীল তুই আব্বুকে ডেকে নিয়ে আয় আমি আব্বুর সাথে কথা বলবো।”
নীল আরশির কাধে হাত রেখে গম্ভীর গলায় বললো-
“এখন এসব বাদ দিয়ে আমাদের সাথে বাহিরে চল৷ ছেলে পক্ষ চলে গেলে না হয় তুই আংকেলের সাথে কথা বলিস।”
“কিন্তু নীল..”
আরশির কথা মাঝে থামিয়ে দিয়ে কাসফিয়া বলল-
“আশু নীল ঠিকই বলছে। এখন শুধু শুধু মেহমানদের সামনে ঝামেলা না করে বরং ওনারা যাওয়ার পরেই তুই যা করার করিস।”
আরশিকে নীল আর কাসফিয়া কোনো রকম বুঝিয়ে ড্রয়িং রুমে নিয়ে গেল। আরশি ড্রয়িংরুমের সোফায় মাথা নিচু করে বসে আছে। একবারের জন্যেও মাথা তুলে তাকাচ্ছে না। প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে তার। বার বার রৌদ্রের বলা কথা গুলো কানে বেজে উঠছে। চোখের সামনে সেই রঙিন চিরকুট গুলো আর রৌদ্রর মুচকি হাসি দেওয়া মুখটা ভাসছে। আরশির চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। মনে হচ্ছে এখনই সবার সামনে চোখের পানি ছেড়ে দিবে।
“আরে ক্রাশ ভাবি মাথা নিচু করে আছো কেন? আমাদের দিকে একটু তাকাও।”
আচমকা ‘ক্রাশ ভাবি’ নামটা শুনেই আরশি চমকে উঠলো। দ্রুত মাথা তুলে আশেপাশে তাকালো। আরশির সামনা-সামনি নির্বান দাঁড়িয়ে আছে। তার পাশের সোফায় রৌদ্র নীল রঙের শার্ট পরে অপলক দৃষ্টিতে আরশির দিকে তাকিয়ে আছে। নীল রঙের শাড়িতে একদম মায়াবতী লাগছে আরশিকে। চোখ গুলো লাল হয়ে ফুলে আছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে আরশি কান্না করেছে। চোখে কোনো কাজল নেই, আর না আছে মুখে কোনো মেকআপ তবুও এই মুহূর্তে রৌদ্রর চোখে আরশিকে বড্ড বেশিই মায়াবী লাগছে। বিশেষ করে আরশির লাল হয়ে যাওয়া ফোলা চোখ গুলো রৌদ্রর কাছে বড্ড বেশিই প্রিয় মনে হচ্ছে। রৌদ্র জানে আরশির এই অশ্রুসিক্ত চোখের পেছনে রৌদ্রই একমাত্র কারন। রৌদ্রর জন্য আরশির চোখ থেকে অশ্রুজল পরেছে সেটা ভেবেই রৌদ্রর নিজেকে সার্থক মনে হচ্ছে। আরশি যতই নিজের অনুভূতি গুলোকে লুকিয়ে রাখুক না কেন রৌদ্র ঠিকই তার রুদ্রাণীর চোখে তাকিয়ে সব বুঝে যায়। আরশি ড্যাবড্যাব করে রৌদ্রর দিকে তাকিয়ে আছে। পরপর কয়েকবার চোখের পলক ফেলে আবারও স্থির চোখে তাকালো রৌদ্রর দিকে। এই গুলো তার মনের ভুল তো নয়। কিন্তু তারা এখানে কিভাবে? সব কিছু আরশির মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। হতবাক হয়ে বসে আছে। রৌদ্র মা আরশির পাশে বসে আরশির মাথায় হাত বুলিয়ে বলল-
“রৌদ্র তোর পছন্দ আছে বলতে হবে।”
আরশি মাথা নিচু করে ফেলল। এই মুহূর্তে এখানে কোনো ভাবেই রৌদ্রকে আশা করেনি। আর এসব কথা তো কল্পনাও করেনি। আরশি খুশি হবে নাকি অবাক হবে কিছুই বুঝতে পারছে। অস্বস্তিতে হাত কচলানো শুরু করে দিয়েছে এতোক্ষনে। রৌদ্র আরশির হাতের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। সবাই কিছুক্ষন কথা বলার পর নির্বান রৌদ্রর মাকে উদ্দেশ্য করে বলল-
“ফুপি পাত্রপাত্রীকে তো আলাদা কথা বলতে দেওয়া উচিত কি বল!”
“হ্যাঁ তা তো বলবেই।”
“তার আগে আমার কিছু কথা আছে।”
আদিব হাসানের গম্ভীর কন্ঠে এই কথা শুনে সবাই চুপ হয়ে গেল। সকলের কপালে চিন্তার ভাজ পরেছে। আদিব হাসান আরশির কাছে এসে বলল-
“তোরা একে অপরকে পছন্দ করিস কিন্তু আমার ভয়ে এসব প্রেমের সম্পর্কে জড়াতে চাস না তা না হয় বুঝলাম। কিন্তু একবারের জন্য হলে-ও তো তুই আমার কাছে এসে বলতে পারতি তুই একজনকে পছন্দ করিস। আমি কি তোকে কখনো এতোটা কড়া শাসন করেছি যে তুই আমার ভয়ে রৌদ্রকে ভালোবেসেও তার থেকে দূরে সরে যেতে চাইছিস। ছেলেটা নিজেই তোকে বিয়ে করতে চায় আর তুই নাকি আমার ভয়ে ওর কথা পাত্তাই দিচ্ছিস না! তুই বড় হয়েছিস তোর আলাদা পছন্দ অপছন্দ থাকতেই পারে সেটা আমাদের সাথে শেয়ার করবি। তোর পছন্দ যদি ভালো হয় আমরা মেনে নিব আর যদি আমাদের মনে তোর পছন্দের জিনিস তোর জন্য ভালো না তাহলে আমরা তোকে বুঝিয়ে বলতাম কিন্তু তোকে তো আর মেরে ফেলতাম না তাই না! তোর ভালো মন্দ দেখার দায়িত্ব তো আমাদেরই কিন্তু তুই যদি আমাদেরকেই এতো ভয় পাস তাহলে কিভাবে হবে আশু?”
আরশি বিস্ফোরিত চোখে তার বাবার দিকে তাকালো। জড়ানো কন্ঠে বললো-
“কিন্তু বাবা..”
আদিব হাসান তার মেয়েকে থামিয়ে দিয়ে বলল-
“কিন্তু কি আশু? যদি নীল আর কাসফিয়া আমাকে রৌদ্রর সাথে কথা বলিয়ে না দিতো তখন কি হতো! তুই আমার ভয়ে চুপ থেকে একা একা কষ্ট পেয়ে যেতে তাই তো!”
আরশি জ্বলন্ত চোখে নীল আর কাসফিয়ার দিকে তাকালো৷ নীল মাথা চুলকে একটা মেকি হাসি দিলো। আমতা-আমতা করে বলল-
“আংকেল তুমি এখন একটু চুপ করো। শুধু শুধু আমাকে ফাসিয়ে দিচ্ছে কেন?”
রৌদ্রর মা ভদ্রতার সাথে বলল-
“হ্যাঁ ভাই এখন এসব বাদ দিন। ওদেরকে আলাদা কথা বলে সব কিছু মিটিয়ে নিতে দিন।”
————————
নীলা আরশি আর রৌদ্রকে ছাদে একা রেখেই চলে গেল। আরশি বেশ কিছুটা সময় চুপ করে থাকার পর শান্ত গলায় বললো-
“কিভাবে কি হয়েছে সব কিছু আমাকে খুলে বলুন।”
আরশি রৌদ্রর দিকে না তাকিয়ে কথাটা বলল। রৌদ্র সরু চোখে আরশির তাকিয়ে আছে। এই মুহূর্তে আরশির এমন শান্ত থাকাটা স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না তার কাছে। রৌদ্র শান্ত গলায় বলতে লাগল-
“আমি আরও তিনদিন আগেই নীল আর কাসফিয়ার সাথে দেখা করেছিলাম। তাদের সাহায্যেই আংকেলের সাথে পরিচিত হয়েছি। আংকেল আমার সম্পর্কে সব কিছু জেনে শুনেই আব্বু আম্মুর সাথে কথা বলতে রাজি হয়েছে। সবাই মিলে ঠিক করেছে এক সাথে বসে কথা বলে সব ঠিক করবে আর আম্মুও আপনাকে দেখতে চেয়েছিল তাই তাড়াহুড়ো করেই আপনাকে এখানে আসতে বলা হয়েছে। ব্যস এতটুকুই।”
আরশি রৌদ্র দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বলল-
“ব্যস এতটুকুই?”
রৌদ্র ভ্রু বাঁকিয়ে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকাতেই আরশির রাগ মাথায় উঠে গেল। প্রচন্ড রাগে গর্জে উঠে বলল-
“আমাকে কি একবারের জন্যেও কিছু বলেছেন আপনি! জানেন কতটা ভয় পেয়েছিলাম? এই দু’দিন চিন্তায় চিন্তায় একটুও ঘুমাতে পারিনি আমি। আমাকে কি একটুও বলার প্রয়োজন মনে করেননি আপনি?”
রৌদ্র বরাবরের মতোই শান্ত গলায় বলল-
“আপনাকে বললে কি আপনি রাজি হতে নাকি! এই জন্যই তো বলিনি।”
রৌদ্র এমন সহজ উত্তর পেয়ে আরশির রাগ ধপধপ করে জ্বলে উঠলো। রৌদ্র দিকে তেড়ে গিয়ে আঙুল উঁচু করে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললো-
“থাকুন আপনি এখানে। আমি আপনাকে বিয়েই করবো না। এখনই সবাইকে গিয়ে না করে দিব। আপনি আসলেই একটা অসভ্য ডাক্তার। আস্ত এক বজ্জাত লোক।”
আরশি রাগে গজগজ করে কথা গুলো বলে রৌদ্র পায়ে পারা দিয়ে চলে যেতে লাগলো। রৌদ্র মৃদুস্বরে আর্তনাদ করে লাফিয়ে উঠলো। আরশিকে যেতে দেখে দ্রুত পায়ে গিয়ে আরশির হাত ধরে হেঁচকা টান দিয়ে নিজের কাছে নিয়ে আসলো। আচমকা হাতে টান পরায় আরশি তাল সামলাতে না পেরে রৌদ্রর বুকে যেয়ে পরলো। রৌদ্র আরশির কোমড় জড়িয়ে ধরে কানে ফিসফিস করে বলল-
“হবু মিসেস রৌদ্র উরফে আরু বিয়ে না করার কথা যেন দ্বিতীয় বার তোমার এই মুখ থেকে বের না হয় আজকেই লাস্ট ওয়ার্নিং দিলাম। কথাটা মাথায় ঢুকিয়ে রাখো ভালো করে। জানো তো তোমাকে রাগলে একদম রুদ্রাণীর মতো লাগে। আর রুদ্রাণীকে শুধু মাত্র রৌদ্রর সাথেই মানায়। তুমি হলে এই রৌদ্রর শহরের রুদ্রাণী।”
রৌদ্র আরশিকে ছেড়ে দিয়ে কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে দাড়ালো। আরশি মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে। দম বন্ধ হয়ে আসছে তার। চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। চোখের পলক ফেলতেও ভুলে গেছে আরশি। কি থেকে কি হয়ে গেল! হঠাৎ করেই আরশি চোখ বন্ধ করে বড় করে একটা শ্বাস নিল। পরক্ষনেই লজ্জায় লাল বর্ন ধারণ করেছে আরশির গাল দুটো। বড় বড় করে শ্বাস নিচ্ছে বার বার। তার হার্ট মনে হচ্ছে পাজরের হাড্ডি ভেঙে এখনই বাহিরে এসে লাফানো শুরু করবে। আরশি অন্য দিকে ফিরে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করছে। রৌদ্র আরশির কান্ডকারখানা দেখে ঠোঁট চেপে হেসে যাচ্ছে। খানিকটা সময় পর রৌদ্র গম্ভীর গলায় বলল-
“মিস আরু একটা কথা শুনেছেন!”
আরশি ভ্রু জোড়া কুচকে রৌদ্রর দিকে ফিরে তাকালো। সন্দিহান কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো-
“কি কথা?”
রৌদ্র হাল্কা হেসে শান্ত গলায় বললো-
“রুদ্রাণী না-কি রৌদ্রকে ভালোবেসে ফেলেছে!”
আরশি বিষম খেয়ে কাশতে লাগলো। রসগোল্লার মতো গোলগোল চোখে রৌদ্রর দিকে তাকিয়ে আমতা-আমতা করে বলল-
“আপনি কিভাবে জেনেছেন?”
রৌদ্র হাসলো। আরশির প্রশ্নের জবাব দেওয়ার আগেই ছাদের দরজা দিয়ে নীল আর বাকি ফ্রেন্ড সবাই হাসতে হাসতে এগিয়ে আসলো। নীল রৌদ্রর পাশে দাঁড়িয়ে চুল ঠিক করতে করতে ভাব নিয়ে বলল-
“এটার ক্রেডিট আমাকে দেওয়া উচিত। আমিই তো এই সুখবরটা রৌদ্র ভাইকে দিয়েছে।”
আরশি নীলের দিকে কটমটিয়ে তাকালেই নীল চুপসে যায়। নীলের চুপসে যাওয়া দেখে সাবাই উচ্চস্বরে হাসলো। হাসির মাঝেই কাসফিয়া বলল-
“হাসাহাসি থামিয়ে সবাই নিচে চলো। আংকেল আন্টিরা কি যেন ইম্পর্ট্যান্ট কথা বলবে। তাড়াতাড়ি নিচে যেতে বলেছে।”
#রৌদ্রর_শহরে_রুদ্রাণী
#পর্বঃ৩৭
#Saiyara_Hossain_Kayanat
“এই আপনি আমাকে ধাক্কা দিলেন কেন?”
নীলা ক্ষিপ্ত হয়ে নির্বানের উদ্দেশ্যে কথাটা বলল। নির্বান ভ্রু কুচকে বিরক্তি প্রকাশ করে বলল-
“আমি ধাক্কা দিয়েছি নাকি আপনি আমাকে ধাক্কা দিয়েছেন। সব সময় গাঁয়ে পড়ে ঝগড়া করতে আসেন কেন অদ্ভুত!”
নির্বানের কথায় নীলা প্রচন্ড ক্ষেপে গেল। আঙুল উঁচু করে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল-
“আপনি কিন্তু বড্ড বেশিই বাড়াবাড়ি করছেন মিস্টার।”
সবাই এক সাথে হাসতে হাসতে ছাদ থেকে চলে আসার সময় ভুলবশত নীলার সাথে নির্বানের ধাক্কা লেগে। আর সেই সাথেই শুরু হয়ে যায় তাদের তর্কাতর্কি। বাকি সবাই বিস্ময়ের দৃষ্টিতে তাদের দুজনের ঝগড়া দেখে যাচ্ছে। আরশি নীলার হাত ধরে চাপা কন্ঠে বললো-
“নিলু কি করছিস কি এসব! ওনারা এখন আমাদের মেহমান ঝগড়া বন্ধ কর।”
নীলা আরশির দিকে তাকিয়ে রাগে ফুসতে ফুসতে বলল-
“উনিই তো আমাকে ধাক্কা দিল। ওনাকে কিছু বলিস না কেন?”
“আমি কি আপনার জামাই লাগি না-কি বার উনি উনি বলছেন কেন আমাকে?”
নির্বানের কথায় সবাই হেসে উঠলো। হাসিতে গড়াগড়ি খাওয়ার মতো অবস্থা। কিন্তু নীলার রাগে গাঁ জ্বলে যাচ্ছে। রাগান্বিত চোখে নির্বানের দিকে তাকিয়ে আছে। রৌদ্র হাসি থামিয়ে নির্বানের পিঠে আস্তে করে এক চাপড় মেরে বলল-
“নির্বান ফাজলামো বন্ধ কর তো। শুধু রাগাচ্ছিস কেন নীলাকে!”
কাসফিয়া নীলার কাছে এসে বলল-
“নিলু ধাক্কাটা হয়তো ভুলে লেগেছে তুই শুধু শুধু রাগ করিস না প্লিজ। দেরি হচ্ছে নিচে যেতে হবে তো। আংকেল আন্টিরা হয়তো অপেক্ষা করছে আমাদের সবার জন্য।”
“হ্যাঁ নিলু। নীড় হয়তো ইচ্ছে করে তোকে ধাক্কা দেয়নি।”
আরশির কথায় নীলা একটা তপ্ত শ্বাস ফেলে। নির্বানের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করেই গটগট করে চলে গেল। আরশি নির্বানের দিকে তাকিয়ে নম্র ভাবে বললো-
“নীড় আপনি নিলুর ব্যবহারে কিছু মনে করবেন না।”
“আরে ক্রাশ ভাবি এসব তো বেয়াই-বেয়াইনদের মধ্যে কমন ব্যাপার। আমি কিছু মনে করিনি বরং আরও এনজয় করেছি।”
নির্বান আরশিকে চোখ টিপ মেরেই নিচে চলে যায়। তার সাথে সাথে আদ্রাফ, নীল আর কাসফিয়াও সিড়ি দিয়ে নেমে যাচ্ছে। আরশি তাদের পেছন পেছন যাওয়ার সময় হঠাৎ করেই রৌদ্রর আরশির হাত নিজের মুঠোয় বন্দী করে ফেলে। আরশি হকচকিয়ে উঠলো। রৌদ্রর দিকে হতভম্ব হয়ে তাকালো। রৌদ্র নিজের মতো করেই নিচের দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিক ভাবে সিড়ি দিয়্ব ধীর পায়ে নেমে যাচ্ছে। রৌদ্রর এমন ব্যবহারে আরশির ভ্রু জোড়া কুচকে এলো। সরু চোখে তাকিয়ে রৌদ্রর মতিগতি বোঝার চেষ্টা করছে।
“আমাকে দেখার আরও অনেক সময় পাবে আরু। এখন নিচের দিকে তাকিয়ে হাঁটো। এমনিতেই বাচ্চাদের মতো যখন তখন হোচট খেয়ে পরে যাও। আর আজকে তো আবার শাড়ী পরেছো। যদিও বা শাড়ির খুব সুন্দর লাগছে তবুও তোমাকে নিয়ে আমি কোনো রিক্স নিতে চাই না। আমার একটা মাত্র ভালোবাসার বউ। তাকে তো সাবধানে রাখতেই হবে। বিয়ের আগেই যদি বউ হারা হয়ে যাই তাহলে তো পাগল হয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে হবে আমাকে।”
আরশি লজ্জায় চোখ নামিয়ে নিল। রৌদ্রর বলা সব কথা গুলো অগোছালো ভাবে আরশির কানে এসে বারি খাচ্ছে। আর তার থেকেও তীব্র গতিতে তীরে মতো আরশির মনে আঘাত হানে ‘ভালোবাসার বউ’ ডাকটা। ধকধক করে আরশি বুকে ধুকপুকানি শুরু হয়ে গেল। আরশি রৌদ্রর হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে দ্রুত পায়ে সিড়ি দিয়ে নেমে যেতে লাগলো। তখনই কানে ভেসে আসলো রৌদ্রর হুমকি সরূপ কথা-
“বাচ্চা মতো লাফালাফি করছো করো। নেক্সট টাইম যদি পরে গিয়ে ব্যথা পেতে দেখি তাহলে দু পা ভেঙে সারাক্ষণ আমার সামনে বসিয়ে রাখবো। মনে থাকে যেন মিস আরু।”
আরশি কথা গুলো শুনেও থামলো না। দ্রুত পায়ে নিচে চলে গেল। রৌদ্র আরশির যাওয়ার পথে তাকিয়ে ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলল।
————————
সবাই ড্রয়িং রুমে চুপচাপ গম্ভীরমুখে বসে আছে। পুরো রুম জুড়ে পিনপতন নীরবতা। রৌদ্র বাবা শাহরিয়ার হাসান গলা খেকরিয়ে নীরবতা ভেঙে গম্ভীর গলায় বললো-
“রৌদ্র আমরা সবাই মিলে একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”
রৌদ্র তার বাবার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই আরশির বাবা বলল-
“আমরা সবাই ঠিক করেছি আজকেই তোমাদের আকদের কাজ শেষ করে ফেলবো। আর বিয়ের বাকি অনুষ্ঠান কখন করবে তা তোমরা সবাই মিলে ঠিক করে নিও। তবে যা প্ল্যানিং করার তাড়াতাড়ি করবে।”
আরশি চমকে তার বাবার দিকে তাকালো। তার বাবা একদিনের সব ঠিক করে ফেলছে! আরশি চোখ ঘুরিয়ে রৌদ্রর দিকে তাকালো। নির্বান, নীল ওরা রৌদ্রকে জড়িয়ে ধরে অভিনন্দন জানাচ্ছে। রৌদ্র আড় চোখে আরশির দিকে তাকিয়েই একটা তৃপ্তির হাসি দিল। নীলা আর কাসফিয়া এসে আরশির দু পাশে বসে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। আরশি এখনো রৌদ্রর হাসিমাখা মুখটার দিকে অপলক দৃষ্টি তাকিয়ে আছে। পরক্ষনেই আরশির ঠোঁট প্রসারিত হয়ে হাল্কা হাসি রেখে ফুটে উঠলো।
“নীল আর আদ্রাফ তোমাদেরকে কিছু কথা বলার ছিল।”
আদিব হাসানের কথায় সবাই স্বাভাবিক হয়ে গেল। আদ্রাফ আর নীল ভদ্রতার সাথে বলল-
“জ্বি আংকেল বলুন।”
“তোমরা তো জানো আরশির কোনো ভাই নেই। তোমরা দুজন আরশিকে বোনের মতো করে আগলে রেখেছো। বিশেষ করে নীল তুমি! তুমি আমাকে রৌদ্রর সম্পর্কে সব কিছু বলাতেই আমি জেনেছি তা না হলে হয়তো কিছুই জানতে পারতাম না। যাইহোক এসব কথা না হয় থাক। যদি তোমরা চাও তাহলে তোমাদের দুজনকে আমি আরশির বিয়ের সকল দায়িত্ব দিতে চাই।”
নীল আদিব হাসানের কাছে এসে আশ্বাস দিয়ে বললো-
“আংকেল তুমি এসব নিয়ে চিন্তা করো না আমরা সবাই মিলে এসব কিছু সামলে নিব।”
কাসফিয়া আরশির পাশ থেকে উঠে দাড়িয়ে বলল-
“হ্যাঁ আংকেল আমরা সবাই আছি তো। তোমার এতো চিন্তা করতে হবে না।”
“আচ্ছা ঠিক আছে এখন রুমে গিয়ে সবাই ফ্রেস হয়ে আসো। কিছুক্ষনের মধ্যেই আকদের কাজ শুরু করা হবে। তোমরা ছোটরা এই বাসায় রেস্ট নাও আমরা বড়রা না হয় কাসফিদের বাসায় যাই।”
আদিব হাসান কথা গুলো বলেই রৌদ্রর বাবা মা আর মামা-মামীকে নিয়ে কাসফিয়াদের বাসায় চলে গেল। বড়রা সবাই চলে যেতেই নীল আরশির পাশে সোফায় বসে বলল-
“কংগ্রেস বেবি। বিয়াইত্তা জীবনের অগ্রীম শুভেচ্ছা। দেখলি তো আমি তোর কত বড় একটা উপকার করে দিলাম। আমি কিন্তু তোর কাছ থেকে অনেক বড় একটা ট্রিট পাওনা রইলাম।”
আরশি রক্তিম চোখে নীলের দিকে তাকালো। নীলের পিঠে পরপর কয়েকবার থাপ্পড় আর ঘুষি মারতে মারতে বলল-
“হারামি তুই ফ্রেন্ড নাকি আর কিছু! আমার পিঠ পিছে আমার বিয়ে ঠিক করে ফেললি অথচ আমাকে কিছুই বললি না! এতো বড় ড্রামা কিভাবে করলি তুই? ফাজিল তোকে কে বলেছে এতো পাকনামি করতে?”
নীল আরশির থাপ্পর খেয়ে চেচামেচি করতে করতে বলল-
“দুলাভাই বলেছে এসব কিছু করতে। আমি আর কাসফি তো শুধু মাত্র তার কথা রাখতেই এসব করেছি। কিরে কাসফি কিছু বল।”
কাসফি ভয়ে আরশির কাছ থেকে দূরে সরে আমতা-আমতা করে বলল-
“হ্যাঁ হ্যাঁ নীল সত্যিই বলছে আশু।”
আরশি কাসফিয়ার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। নীল আরশির দু হাত ধরে রেখেছে যেন মারতে না পারে। আরশি এক ঝাটকায় হাত ছাড়িয়ে নিল। কিছুটা দূরেই রৌদ্র আর নির্বান সোফায় বসে আছে। আরশি রৌদ্রর দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই নির্বান আর রৌদ্র শুকনো ঢোক গিলে। নির্বান রৌদ্রর কাধে হাত রেখে দাঁত কেলিয়ে বললো-
“ভাই পাশের বারান্দা বহুত বাজে ভাবেই ক্ষেপেছে আজ। তোমার আর রক্ষা নেই।”
রৌদ্র নির্বানের দিকে সরু চোখে তাকিয়ে নিম্ন স্বরে দাঁতে দাঁত চেপে বলল-
“যা পারলে তুইও আরেকটু ক্ষেপিয়ে দিয়ে আয় ফাজিল।”
রৌদ্র আরশির দিকে তাকিয়ে গম্ভীর মুখ করে বলল-
“বাচ্চাদের মতো ঝগড়াঝাটি না করে এখন সবাই রুমে গিয়ে রেস্ট নাও।”
আরশি রৌদ্রর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করেই রাগে গজগজ করে উপরে চলে গেল। নীল আরশির দিকে তাকিয়ে থেকেই বলল-
“দুলাভাই আপনি দেখি আরশির রাগ আরও বাড়িয়ে দিলেন।”
রৌদ্র একটা মুচকি হাসি দিল। শান্ত গলায় বললো-
“রুদ্রাণীকে তো রাগলেই বেশি ভালো লাগে।”
সবাই রৌদ্রর দিকে সন্দেহর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। রৌদ্র তাদের চাহনি পাত্তা না দিয়ে টেবিলের উপর রাখা খাতা আর কলম নিয়ে কিছু একটা লিখেতে লাগলো৷ কিছুক্ষণ পর পৃষ্ঠাটা ছিড়ে ভাজ করে কাসফিয়ার কাছে দিয়ে বলল-
“এটা আরু দিয়ে আসো।”
কাসফিয়া চোখ ছোট ছোট করে কাগজটার দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর মাথা নাড়িয়ে নীলাকে নিয়ে আরশির রুমে চলে যায়। আরশি গাল ফুলিয়ে বিছানায় বসে পা তুলে বসে আছে। কাসফিয়া আরশির দিকে কাগজটা এগিয়ে দিয়ে বলল-
“আশু একটা দুলাভাই দিয়েছে তোকে দেওয়ার জন্য।”
আরশি রাগান্বিত চোখে কাসফিয়ার দিকে তাকাতেই কাসফিয়া আমতা-আমতা করে বলল-
“মানে রৌদ্র ভাই দিয়েছে এটা।”
আরশি ছো মেরে কাসফিয়ার হাত থেকে কাগজটা নিয়ে নিল।
চলবে…
(