#রৌদ্রর_শহরে_রুদ্রাণী
#পর্বঃ৭
#Saiyara_Hossain_Kayanat
“আরশি বেবি তুমি ঠিক আছো তো?? কাসফির কাছে শুনলাম তোমার নাকি পা মচকে গিয়েছিলো?? তুমি একদমই নিজের খেয়াল রাখতে পারো না আশু বেবি।”
আরশির গোলগোল আঁখিদুটি দিয়ে তার সামনের সুদর্শন যুবকটার দিকে তাকিয়ে আছে। আহহহ.. কি সুন্দর বেবি ফেস!! একদমই চকলেট বয়। ছেলেটার এমন বেবি ফেস দেখলে যে কেউ তার মায়ায় পরে যাবে। একদমই নিরীহ মাসুম বাচ্চা দেখা যাকে বলে তবে এর ভিতর যে আস্ত এক হারামি লুকিয়ে আছে সেটা শুধুমাত্র তার ফ্রেন্ডরাই জানে। আরশি ছেলেটার হাত নিজের কাঁধের উপর থেকে সুন্দর করে সরিয়ে ছেলেটার চুল গুলো আলতো হাতে বুলিয়ে দিতে দিতে বলল-
“আমি একদম ঠিক আছি নীল বেবি। তুমি আমাকে নিয়ে চিন্তা করো না বেবিইইইইইই।”
আরশি নীলের চুলগুলো নিজের মুঠোয় শক্ত করে আঁকড়ে ধরে বলল-
“তোর নেকামি বন্ধ কর হারামি। যা সর সামনে থেকে।”
নীল চুলের ব্যথায় চেচিয়ে বলে উঠলো-
“আশু প্লিজ চুল ছাড় ব্যথা পাচ্ছি তো।”
আরশি নীলের চুল ছেড়ে দিয়ে নীলকে পাশ কেটে বেঞ্চিতে বসে রাগী কন্ঠে বললো-
“নেক্সট টাইম আমাকে বেবি বললে তোর চুল একটাও থাকবে না। মনে রাখিস।”
কাসফিয়া আরশির পাশে এসে বসতেই। নীল কাসফিয়া আর আদ্রাফের মাঝে বসে আদ্রফের কাধে হাত রেখে অতি বিশ্রি মাত্রায় ডং করে বলল-
“দেখ আদ্রাফ আমাদের বাবুটা লাগ কলেছে। আয় বাবুটার জন্য তকলেট কিনে নিয়ে আসি।”
নীলের কথা বলার ধরন দেখে আদ্রাফ, কাসফিয়া আর নীলা সবাই হাসিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে প্রায়। আর আরশি সরু চোখে তাকিয়ে আছে নীলের দিকে। নীল কথা গুলো বলে মুহুর্তের মধ্যেই কন্ঠে খানিকটা রাগী ভাব এনে বললো-
“বার বার বাচ্চা পোলাপানের মতো উস্টা খাবি। রাস্তাঘাটে যেখানে সেখানে পরে পা ভাইঙ্গা বইসা থাকবি আর আমি বেবি বললেই তেলে বাগুনে ছ্যাঁত কইরা উঠবি এটা কি ঠিক না-কি!! কিরে তোরা কিছু বল!!”
নীলের সাথে তাল মিলিয়ে আদ্রাফও গম্ভীর গলায় বললো-
“নীল তো ঠিকই বলছে। তুই বড্ড বেখেয়ালি আশু নিজের একটু খেয়াল রাখতে পারিস না!! কিছুদিন আগেও একবার হাতে ব্যথা পেলি। আর এখন আবার পা মচকালি। কাসফিয়া না থাকলে যে তোর কি হতো আল্লাহ জানে।”
আরশি নীলার দিকে তাকিয়ে সন্দিহান কন্ঠে বললো-
“তুই বাকি আছিস কেন তুইও কিছু বল!!”
নীলা কিছু বলার জন্য মুখ খুলবে তখন-ই নীল ধারালো কন্ঠে বলে উঠলো-
“তোকে কিছু বলেও বা কি লাভ!! তোর শরীরের চামড়া গন্ডারের মতো তাই আমাদের কারও কথা তোর গায়ে লাগে না।”
আরশি ভ্রু বাঁকিয়ে নীলার দিকে তাকিয়ে বলল-
“নীলা তোর ভাইকে কিছু বল। বার বার আমাকে অপমান করে যাচ্ছে।”
এবারও নীলা কিছু বলার আগেই কাসফিয়া ওদের এমন ঝগড়া দেখে অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বলল-
“কি শুরু করেছিস তোরা!! থাম তো এখন।”
নীলার ধৈর্যের বাধ ভেঙেছে এবার। কোলে রাখা সাইড ব্যাগটা জোরে শব্দ করে বেঞ্চির উপর রেখে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। রেগেমেগে দাঁতে দাঁত চেপে বলল-
“ওইইইই তোরা কি আমাকে কিছু বলার সুযোগ দিবি??? বার বার আমার কথা কেড়ে নিচ্ছিস তোরা। তোরা নিজেরাই কথা বল আমি থাকবো না তোদের সাথে।”
কথা গুলো বলে নীলা গাল ফুলিয়ে তাদের ভবনের দিকে এগিয়ে গেল। সবাই চোখ বড় বড় করে নীলার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। কয়েক সেকেন্ড পাড় হতেই সবাই উচ্চস্বরে হাসতে লাগলো। নীলার এমন বোকাসোকা আচরণেই এরা সবাই যে কোনো পরিস্থিতিতে হাসতে বাধ্য হয়। নীলা আর নীল যমজ হলেও এদের মধ্যে আকাশ পাতাল তফাত। নীল হচ্ছে হারামি টাইপ আর নীলা হচ্ছে বোকাসোকা অল্পতেই গাল ফুলিয়ে বসে থাকা মানুষ। আর আদ্রাফ হচ্ছে ভদ্র সয়তান। যত সয়তানি করবে ভদ্রতার সাথেই করবে কেউ বিশ্বাসই করবে না যে এই ফাজলামো গুলো আদ্রাফ করেছে। ভার্সিটিতে ভর্তির অল্প কয়দিন পরই তাদের সবার পরিচয়। একদিন আড্ডা দিয়েই যেন একজন আরেকজনের খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে গেছে। একজন আরেকজনকে ছাড়া যেন তদের চলেই না। আরশি তাদের মাঝে থেকেই নিজের সব কষ্ট ভুলে থাকে।
————————
“ভাই কিসের জন্য হঠাৎ করে আমাকে ট্রিট দিতে চাইচ্ছো একটু বলবা?? আমার কেমন যেন সন্দেহ হচ্ছে। তুমি কি আবারও আমাকে বোকা দিবা না-কি ওই চিঠির জন্য!! আরে ভাই কিছু তো বলো সেই কখনো থেকে চুপচাপ কাজ করেই যাচ্ছো আর আমাকে এখানে বসিয়ে রাখছো।”
আরশিকে চিঠির মানুষ হিসেবে পেয়ে রৌদ্র বেশ খুশি। তাই সে ঠিক করেছে নির্বানকে ট্রিট দিবে। তার জন্যই তো চিঠির আদান-প্রদান শুরু হয়েছে। আর এই কারনেই নির্বানকে ফোন করে হসপিটালে আনিয়েছে। কিন্তু রৌদ্ররের মতো গম্ভীর মানুষের কাছ থেকে হঠাৎই বিনা কারনে ট্রিট পাবে এটা নির্বানের ঠিক হজম হচ্ছে না। নির্বানের কথায় রৌদ্র ফাইল থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নির্বানের দিকে তাকিয়ে একটা রহস্যময়ি হাসি দিয়ে আবারও ফাইলে নজর দিল। রৌদ্রের এমন হাসি দেখে নির্বানের সন্দেহ আরও বেড়ে গেলো। ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছে রৌদ্রের দিকে। রৌদ্রের এমন ব্যবহার তার কাছে স্বাভাবিক বলে মনে হচ্ছে না। নির্বান কিছু একটা ভেবে পকেট থেকে ফোন বের করে কাওকে কল দিলো। ফোন রিসিভ হতেও নির্বান জোরালো ভাবে বললো-
“ফুপি তোমার ছেলে মনে হয় ডাক্তারি করতে করতে পাগল হয়ে গেছে। কেমন যেন অদ্ভুত আচরণ করছে আবার শুধু শুধু হাসছে।”
নির্বানের কথা শুনে রৌদ্র চেয়ার থেকে উঠে তাড়াতাড়ি করে নির্বানের কান থেকে ফোন ছিনিয়ে নিল। রৌদ্র চেয়ারে বসে ফোন কানের কাছে নিয়ে নির্বানের দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে বললো-
“মা তুমি নির্বানের কথা শুনো না তো। এই ফাজিলটা সব সময় উল্টাপাল্টা কথা বলে।”
ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে রৌদ্রের মা সন্দেহের গলায় বললো-
“সত্যি বলছিস তো!!”
রৌদ্র গম্ভীর গলায় বললো-
“হ্যাঁ মা সত্যি। এসব বাদ দাও তোমারা কেমন আছো??”
“আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি, তুই কেমন আছিস?? কবে আসবি বাসায়??”
“সময় পেলেই আসবো মা। এখন রাখছি পরে ফোন দিব।”
রৌদ্র ফোন রেখে নির্বানের দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বললো-
“ভেবেছিলাম তোকে ট্রিট দিব কিন্তু এখন আর ইচ্ছে করছে না তোর মতো ফাজিলকে কিছু খাওয়াতে।”
নির্বান ফোনটা হাতে নিয়ে মিনমিনিয়ে বলল-
“এটাই তোমাকে দিয়ে আশা করা যায়। আমি গেলাম আর হ্যাঁ আম্মু তোমাকে সময় করে দেখা করে আসতে বলেছে।”
রৌদ্র নির্বানের দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বললো-
“আজ রাতে সময় করে দেখা করে আসবো।”
নির্বান ‘ওকে’ বলেই কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল। রৌদ্র একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কপালে হাত ঠেকিয়ে মাথা নিচু করে বসে রইলো। ডাক্তারি পেশায় জড়িত হওয়ার পর থেকেই রৌদ্র নিজের ফ্যামিলি থেকে আলাদা থাকে। বাসায় খুব কমই যাওয়া হয় তার। এতোদিন তার মামার বাসায় থাকলেও এখন নিজের ফ্ল্যাট কিনে সেখানেই উঠেছে। রৌদ্র একা থাকবে ভেবে সবাই মানা করেছিল কিন্তু রৌদ্রের জন্য তার মামার বাসা থেকে হসপিটাল দূরত্ব বেশি হওয়ায় অবশেষে রৌদ্রের কথায় রাজি হয়ে যায়। সারাক্ষণ হসপিটালে এতো ব্যস্ততায় থেকেই রৌদ্র গম্ভীর প্রকৃতির হয়ে উঠেছে। হসপিটাল, রোগী, অপারেশন এসব ছাড়া যেন তার জীবনে আর কিছুই নেই। কিন্তু এখন তার ইচ্ছে এসবের বাহিরেও কিছু একটা অনুভব করার। রোদে ঝলসানো এই দুপুর অনুভব করতে চাইছে। রৌদ্রর এই শহরে রুদ্রাণীকে চাইছে।
—————————
প্রিয় রুদ্রাণী,
সবে মাত্র গ্রীষ্মের তান্ডবলীলা শুরু হয়েছে। আকাশে তেজস্বী সূর্য। রোদের তাপে আমার মাথা উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল ঠিক তখনই ফুটপাতের পাশের দোকানের এই পাখি দুটোর দিকে আমার নজর আটকে গেল। পাখি গুলোকে দেখে আমার মনে প্রশান্তির স্রোত বয়ে গেল। জানি না কেন তবে পাখিগুলোর প্রতি আমার মন আটকে গিয়েছিল তাই পাখিগুলো কিনে নিয়েছিলাম। আর নাম দিয়েছিলাম রৌদ্র আর রুদ্রাণী। আর হ্যাঁ এই ময়না পাখিটার নাম হলো আরু। এই নাম রাখার কারন না হয় আপনাকে অন্যদিন বলবো।
বিঃদ্রঃ ‘আপনার পাশের বারান্দা’ নামটা কেমন যেন উদ্ভট দেখায়। তাই আপনাকে প্রিয় রুদ্রাণী বলেই সম্মোধন করলাম। অবশ্য আপনার যদি আপত্তি থাকে তাহলেও কিছু করার নেই। এই নামেই মানিয়ে নিবেন আশা করি।
ইতি,
রৌদ্র
আরশি ভ্রু কুচকে চিরকুটটা দু তিনবার ভালো করে পড়ে ফেললো। চিরকুটটা পড়ে ভালোই লাগছিল কিন্তু ময়না পাখির নামটা দেখে বেশ অবাক হলো। আর শেষের লাইন গুলো কি তার অনুরোধ হিসেবে নেবে না-কি অধিকার খাটানো হিসেবে নেবে তা ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না আরশি। ভার্সিটি থেকে এসেই গোসল করেই দুপুরে শেষ সময়টায় বারান্দায় এসেছিল রোদে দাঁড়িয়ে চুল শুকনোর জন্য। বন্ধুদের সাথে আড্ডা আর ক্লাসের পড়া সব কিছু মিলিয়ে আরশি চিরকুটের কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছিল। বারান্দায় এসে চিরকুট পেয়ে খানিকটা উত্তেজনা কাজ করছিল। কিন্তু চিরকুটটা পড়ার পর এখন হতভম্ব হয়ে রইলো। রুমে এসে টেবিলের উপর লাল রঙের কাগজ নিয়ে চিরকুটের উত্তর লিখতে শুরু করলো আরশি।
প্রিয় রৌদ্র,
প্রিয় সম্মোধনটা আমাদের সাথে যায় কি না জানি না। তবে আপনি যেহেতু প্রিয় সম্মোধন করেছেন তাই আমিও প্রিয় লিখেই শুরু করলাম। আপনার চিঠি সব সময় আমি দুপুরের এই উত্তপ্ত রোদের মধ্যেই পাই। আর আমিও চিঠির উত্তর এই তপ্ত দুপুরেই দেই সে হিসেবে রৌদ্র আর রুদ্রাণী নামটা পাখিগুলোর মতো আমাদের সাথেও মিলেছে। কিন্তু আপনার শেষের লেখা লাইন গুলো পড়ে আমি হতভম্ব হয়ে গেছি। আপনি কি আমাকে অনুরোধ করেছেন না-কি অধিকার খাটাচ্ছেন ঠিক বুঝতে পারছি না।
বিঃদ্রঃ ময়না পাখির নাম আরু কেন রেখেছেন তা জানার ভয়ংকর কৌতুহল জাগ্রত হয়েছে আমার মনে। আর আমার এমন কৌতুহলের কারনটাও না হয় আপনাকে অন্যদিন বলবো।
ইতি,
রুদ্রাণী
চিরকুটটা লিখে বরাবরের মতোই বারান্দা গিয়ে ছুড়ে দিল তার পাশের বারান্দায়। পাখিগুলোর সাথে নানানরকম কথা বলে রুমে এসে পরলো। ময়না পাখির নামটা নিয়ে এখনো তার মধ্যে কৌতুহল কাজ করছে। আরু নামটা দেখেই সর্বপ্রথম ডক্টরের বলা ‘মিস আরু’ ডাকটাই কানে বেজে উঠছে বার বার। রৌদ্র আর আরু এই নাম গুলো নিয়ে বেশ ঘোরপ্যাঁচ লেগে যাচ্ছে আরশির মাথায়। ডক্টর আর এই চিঠির আগন্তুকটার সাথে কথার ধরন মিল না পেলেও নাম গুলো নিয়ে কিছুটা চিন্তায় পরে গেল আরশি।
————————
গ্রীষ্মের রাত। অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিষ্কার আকাশ। চারপাশে ভাপ্সা গরম। আর হাল্কা মৃদু বাতাস বইছে। এমন সময় ছাদে অস্থিরতায় পায়চারি করছে রৌদ্র। চিঠির অপেক্ষায় তার মন সন্ধ্যা থেকে উত্তেজনায় ছটফট করছে। এই মুহূর্তে অপেক্ষা করা তার কাছে ভয়ংকর রকমের বিরক্ত লাগছে। সন্ধ্যায় হসপিটাল থেকে তাড়াতাড়ি বেড়িয়ে পরেছিল নির্বানদের বাসার উদ্দেশ্যে। কিন্তু এখানে এসেই পরলো মহা বিপদে। তার মামা মামি আজ তাকে ছাড়তে নারাজ। হাজার বাহানা দেখিয়েও সে আজ বাসায় যেতে পারেনি। সেই থেকেই চলছে অপেক্ষা, তার রুদ্রানীর চিঠির অপেক্ষা। নিজের এমন ছটফটানি দেখে নিজেই বড্ড অবাক হচ্ছে। মেয়েটা অল্প কয়দিনেই তাকে নাস্তানাবুদ করে ছেড়েছে। রুদ্রাণীর মতো ঝলসে দিচ্ছে তাকে।
চলবে….
(