#রৌদ্রর_শহরে_রুদ্রাণী
#পর্বঃ৯
#Saiyara_Hossain_Kayanat
কিছুটা লজ্জা আর কিছুটা বিস্ময়ে দু’জনই চুপচাপ নিচের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দুজনের অনুভূতি এক হলেও তার কারন হলো ভিন্ন। নির্বান লজ্জা পাচ্ছে তার বোকামির জন্য। পাখি দেখাশোনার জন্য তখন কিছু না ভেবেই অচেনা একজনকে চিঠি লিখেছিল কিন্তু এখন চিঠির পাঠিকাকে সামনে দেখে খানিকটা অস্বস্তি হচ্ছে নিজের করা বাচ্চামো স্বভাবের জন্য। আর পাশের বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা রমনী লজ্জা পাচ্ছে এতোদিনের অদেখা তার সেই চিঠির মানুষটাকে প্রথমবার দেখে। চিঠির মাধ্যমে নানান কথা বললেও এখন সামনা-সামনি দেখে খুব অদ্ভুত রকমের অনুভূতি হচ্ছে। কথা বলার ভাষাই এখন খুঁজে পাচ্ছে না। লজ্জা আর অস্বস্তি তাকে ঘিরে ধরে আছে। নির্বান পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য ভদ্রতার সাথে বলল-
“আসলে আমি খুবই দুঃখিত আপনাকে চিঠি লিখে বিরক্ত করার জন্য। আসলে আমার কাজিন রৌ…”
নির্বানের কথার মাঝেই কাসফিয়া ভিতর থেকে আরশিকে চেচিয়ে ডেকে উঠলো। কাসফিয়ার আকর্ষনময়ি ডাকে নির্বান থেমে গেল। আরশি কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে তাড়াতাড়ি করে বলল-
“বার বার দুঃখিত বলার কিছু নেই আমি কিছু মনে করিনি। এখন আসছি ভালো থাকবেন।”
আরশি কথা গুলো বলে দ্রুত পায়ে রুমে চলে আসলো। বিছানায় বসে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। হাফ ছেড়ে বাচঁলো এতক্ষন ধরে হয়তো এই মুহূর্তেরই অপেক্ষায় ছিল। এই অস্বস্তিকর পরিস্থিতি থেকে পালিয়ে আসতে পেরেই এখন স্বস্তি পেল। মনে মনে কাসফিয়াকে ধন্যবাদ দিচ্ছে আরশি। হাতে থাকা নীল রঙের চিরকুটটা একপলক দেখে যত্ন করে রেখে দিল আগের চিরকুট গুলোর সাথে।
নির্বান এখনো স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বারান্দায়। তার দৃষ্টি এখনো পাশের বারান্দার দিকে আটকে আছে। মেয়েটাকে দেখে মনে হচ্ছে মেয়েটা তার থেকেও বেশি বাচ্চাদের মতো আচরণ করে। নির্বান সেসব কিছু মাথা থেকে সরিয়ে নিজের মতো করে কাজ করতে লাগলো। রৌদ্র পাখি গুলোর দায়িত্ব নির্বানের উপর দিয়ে গেছে। আর সেই দায়িত্ব পালন করতেই সকাল সকাল নির্বানের এখানে আসা।
————————
“আদ্রাফ তুই কি পাগল হয়েছিস?? বন্ধুত্বের মধ্যে কিসের ভালোবাসা টেনে নিয়ে আসছিস বার বার?”
কাসফিয়া বেশ রেগেমেগেই কথাটা বলল। আদ্রাফ কাসফিয়ার রাগ পাত্তা না দিয়ে শান্ত গলায় বললো-
“আমি তোকে ভালোবাসি এখানে তো আমি কোনো ভুল দেখছি না কাসফি।”
আদ্রাফের কথায় কাসফিয়া ছোট করে একটা শ্বাস ফেলে নরম গলায় বললো-
“আমি চাই না তোর এই ভালোবাসার জন্য আমাদের ফ্রেন্ড সার্কেলে কোনো প্রকার পরিবর্তন হোক। তুই প্লিজ দয়া করে এসব কথা কখনো বলিস না। আমি সত্যিই চাইনা আমাদের ফ্রেন্ড সার্কেলটা নষ্ট হোক।”
আদ্রাফ আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে কাসফিয়ার দিকে। আদ্রাফ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো-
“আমি অপেক্ষা করবো তোর জন্য। আমার ভালোবাসা এতো ঠুনকো নয় যে অল্পতেই হার মেনে নিব। আজও ফ্রেন্ড সার্কেলের দোহাই দিয়ে কাটিয়ে দিলি। তবে একদিন না একদিন আমি তোকে রাজি করিয়েই ছাড়বো। আর আমাদের ফ্রেন্ড সার্কেলেও কোনো পরিবর্তন হবে না দেখে নিস।”
আদ্রাফ কথা গুলো বলেই গম্ভীর হয়ে ক্লাসে চলে গেল। কাসফিয়া এখনো বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে আগের মতোই। কাসফিয়া প্রথম থেকে বুঝতে পেরেছিলো আদ্রাফ তাকে অন্য নরজে দেখে। কিন্তু কাসফিয়া সব সময় এড়িয়ে চলতেই চেষ্টা করতো। কাসফিয়া তাদের বন্ধুত্বের মাঝে এসব ভালোবাসা নিয়ে আসতে চায় না। আদ্রাফ সবার সামনে কিছু প্রকাশ না করলেও কাসফিয়া কে একা পেলেই তার ভালোবাসার কথা বলে কিন্তু কাসফিয়া প্রতিবারই বন্ধুত্বের দোহাই দিয়ে আদ্রাফকে থাময়ে দেয়। তবে কাসফিয়া ভালো করেই বুঝতে পারছে আদ্রাফের প্রতি সে ধীরে ধীরে দূর্বল হয়ে পরছে। তাই যতটা পারছে আদ্রাফের এই অনুভূতি গুলোকে এড়িয়ে চলছে। কাসফিয়া একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ক্লাসে চলে গেল। বারান্দায় আদ্রাফের বলা কথা গুলো শুনেই সিড়ির দিকটায় থমকে দাঁড়িয়ে গেল এক যুবতী। তার টলমলে চোখ দুটো থেকে দু ফোটা অশ্রুজল গাল বেয়ে গড়িয়ে পরলো। বুকের ভিতর চিনচিনে ব্যথা অনুভব করছে। হঠাৎ করেই যেন তার পুরো পৃথিবী এলোমেলো হয়ে গেল। ভালোবাসা প্রকাশ করার আগেই মানুষটাকে হারিয়ে ফেললো ভাবতেই তার বুক ফেটে কান্না আসছে।
“এইইই নিলুউউউ তুই আমাকে ওয়াশরুমে রেখেই চলে আসলি কেন??”
পেছন থেকে আরশির চেচিয়ে বলা কথা গুলো শুনেই নীলা দ্রুত তার চোখের পানি গুলো মুছে ফেললো। আরশি নীলার কাছে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বললো-
“চুল গুলো ঠিক করতে একটু সময় লাগছিল বলে আমাকে রেখেই চলে আসলি তুই!!”
নীলা নিজেকে সামলিয়ে স্বাভাবিক হয়ে মুখে হাসি ফুটিয়ে বললো-
“কেন তোকে কি কোলে তুলে নিয়ে আসার কথা ছিল না-কি আমার??”
আরশি গাল ফুলিয়ে ভ্রু বাঁকিয়ে বললো-
“তুইও দিন দিন তোর ভাইয়ের মতো হয়ে যাচ্ছিস নিলু।”
নীলা হাসি দিয়ে আরশির গাল টেনে বললো-
“হয়েছে এখন বাচ্চাদের মতো গাল ফুলাতে হবে না। ক্লাসে চল কাসফি হয়তো অপেক্ষা করছে।”
আরশি আর নীলা ক্লাসে আসতেই কাসফিয়া অভিমানী কন্ঠে বললো-
“এতক্ষন লাগে নাকি একটু চুল ঠিক করতে!!”
নীল পেছনের বেঞ্চে বসে মাথা দু হাতের উপর রেখে নুয়ে থাকা অবস্থাতেই খোচা মেরে বললো-
“হয়তো কোন নায়ক আসবে তাই আটা ময়দা মেখে এসেছে।”
নীলের কথায় আরশি রাগে ফুসতে ফুসতে নীলের কাছে গিয়ে ওর পিঠে একটা থাপ্পড় দিল। নীল সাথে সাথেই মাথা তুলে আরশির দিকে কিছুক্ষন স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে চিৎকার দিয়ে পাশে বসে থাকা আদ্রাফের গাঁ ঘেঁষে বসে ভয়াতুর কন্ঠে বললো-
“আদ্রাফ এই পেত্নি আমাকে থাপ্পড় দিলো রে। আমার পিঠ জ্বলে যাচ্ছে রে ভাই।”
এতক্ষণ পরে নীলের প্রতিক্রিয়া দেখে আরশি বিরক্তিতে ভ্রু কুচকে ফেললো। নীলের চেচিয়ে ওঠায় আশে পাশের কয়েকজন তাদের দিকে তাকিয়ে আছে খেয়াল করতেই কাসফিয়া চাপা কন্ঠে বললো-
“এই তোরা থাম তো। নীলা আর আরশি তোরা বস। স্যার আসবে এখন।”
নীলা আদ্রাফের দিকে একপলক তাকিয়ে নীলের মাথায় একটা চাটি মেরে তাদের সামনের বেঞ্চে কাসফিয়ার পাশে বসে পরলো। আরশিও নীলকে ভেংচি কেটে চুপচাপ নীলার সাথে বসে পরলো।
—————————
প্রচন্ড গরমে ক্লান্ত শরীরে আরশি বিরক্তিতে চোখমুখ কুচকে কাসফিয়ার হাত ধরে হাটছে। বাসার পাশে আসতেই নির্বানকে তাদের সামনা-সামনি হেটে আসতে দেখে আরশি থমকে দাঁড়িয়ে গেল। কাসফিয়া হঠাৎ করে আরশিরকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুচকে হাতে টান দিয়ে জিজ্ঞেস করলো-
“কি হলো এই রোদের মধ্যে এভাবে দাঁড়িয়ে পরলি কেন আশু??”
আরশি নির্বানের দিকে তাকিয়ে অবাক দৃষ্টিতে আছে। নির্বান আরশিকে দেখে একটা অমায়িক হাসি দিয়ে তার সামনে এসে বলল-
“আরে পাশের বারান্দা!! কোথা থেকে আসলেন??”
আরশি কাসফিয়ার হাত ছেড়ে স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়িয়ে বললো-
“ভার্সিটি থেকে আসলাম। আপনি কোথাও যাচ্ছেন না-কি??”
“হ্যাঁ.. বাসায় যাচ্ছি।”
নির্বানের কথা শুনে আরশি ভ্রু কুচকে বিস্ময়ের সাথে বললো-
“বাসায় যাচ্ছেন মানে!!”
নির্বান স্বাভাবিক ভাবেই বললো-
“হুম বাসায় যাচ্ছি এখানে এসেছিলাম পাখিগুলোর দেখাশোনা করতে। আসলে আমার কাজিন বাসায় নেই তো তাই আমাকে পাখিগুলোর দায়িত্ব দিয়ে গেছে।”
আরশি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে নির্বানের কথা শুনে। তার মানে উনি সেই কাজিন যে কি-না প্রথম চিরকুট লিখে দিয়েছিল!! আর সে কি-না এতক্ষন তাকে পাখিগুলোর মালিক ভেবেছিল। চিঠির রৌদ্রকে মনে করেছিল। আরশি মনে মনে নিজেকে গালি দিচ্ছে চিঠির মানুষটাকে নিয়ে এমন গোলমাল লাগিয়ে ফেলার জন্য। রোদের উত্তপ্ত ঝলসানো তাপে কাসফিয়া বিরক্ত হয়ে বলল-
“আশু প্লিজ তাড়াতাড়ি চল। প্রচন্ড গরম লাগছে।”
নির্বান আরশিকে উদ্দেশ্য করে বলল-
“আচ্ছা আজ আসছি আবার দেখা হবে। ভালো থাকবেন।”
নির্বানের কথায় আরশির হুশ আসতেই আরশি একটা মেকি হাসি দিয়ে বললো-
“জ্বি আপনিও ভালো থাকবেন।”
আরশির কথার বিনিময়ে নির্বান একটা হাসি উপহার দিয়েই চলে গেল। আর কাসফিয়া আরশির হাত ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। বাসায় এসে দুজনে সোফায় বসতেই কাসফিয়া আড়চোখে আরশির দিকে তাকিয়ে বললো-
“এটা তোর সেই চিঠির মানুষ??”
আরশি ভাবলেশহীন ভাবে বললো-
“শুনলি না এটা পাখিগুলোর মালিকের কাজিন। তার মানে উনি চিঠির মানুষ না বুঝতেই পারছিস।”
কাসফিয়া কিছুক্ষণ চুপ থেকে ভাবুক হয়ে বলল-
“হুম তা না হয় বুঝলাম। কিন্তু এই ছেলেটার কাজিন মানে পাখি গুলোর মালিক ছেলে না-কি মেয়ে??”
“জানি না।”
কাসফিয়া আরশির এমন ছোট উত্তর শুনে সন্দিহান কন্ঠে বললো-
“জানি না মানে কি!! তুই চিঠি দেওয়া নেওয়া করিস অথচ জিজ্ঞেস করবি না!! আর আমাকে বললেই তো আমি এই ছেলের কাছ থেকে জেনে নিতাম।”
আরশি শান্ত গলায় বললো-
“প্রয়োজন মনে করছি না এটা জানার।”
কাসফিয়া আরশির এমন কথা শুনে একটা ছোট্ট শ্বাস ফেললো।
—————————
“রৌদ্র তোর কি হয়েছে বলবি?? তুই নাকি অদ্ভুত আচরণ করছিস!! সব ঠিক আছে তো!!”
রৌদ্র তার মায়ের কথা শুনে বিরক্তিতে বললো-
“আহহহ মা কি শুরু করেছো বলো তো!! তুমি ওই ফাজিল ছেলের কথায় বিশ্বাস করে আমাকে এখানে আসতে বলেছো?? আমি ভাবলাম তুমি হয়তো আমাকে মিস করছিলে।”
রৌদ্রের মা রৌদ্রের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন-
“আমার তোকে নিয়ে চিন্তা হচ্ছিলো তাই আসতে বলেছি।”
রৌদ্র গম্ভীর গলায় বললো-
“হুম…তা কাল না বুঝলেও এখন খুব ভালো করেই বুঝতে পারছি।”
“আচ্ছা এসব বাদ দে এখন। ডাইনিং টেবিলে তোর বাবা অপেক্ষা করছে। খেতে আয়। আমি যাচ্ছি।”
রৌদ্র মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। রৌদ্রর এখন ইচ্ছে করছে নির্বানকে আচ্ছা মতো বকা দিতে। এই পাজি ছেলের উল্টাপাল্টা কথার জন্য এখন তাকে এখানে আসতে হয়েছে। রৌদ্র মনে মনে তার রুদ্রাণী কথা ভাবছে।
“আচ্ছা রৌদ্র তুই কি কারও প্রেমে পরেছিস না-কি!!”
আচমকা রৌদ্র তার মা’য়ের মুখে এমন কথা শুনে বিস্ফোরিত চোখে তাকালো ওনার দিকে। রৌদ্রের মা রুম থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল কিন্তু পেছন ফিরে তার ছেলে গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে থাকতে দেখেই কৌতুহল হয়ে প্রশ্নটা করে বসলো।
চলবে…