লাল পাঁড়ের সাদা শাড়ি
*পর্ব ২২
সামিরা আক্তার
রাফসান চৈতালীর ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। কি হতো এই মেয়ে আরও কয়েক বছর আগে জন্মালে?? তাহলে তো রাফসানের জীবনে কোন তিক্ত স্মৃতি থাকতো না। চৈতালী কে শক্ত করে জরিয়ে ধরে রাফসান ফিসফিস করে বললো- আমাকে ছেড়ে তুই কখনো যাস না চৈতী। তাহলে আমি পাগল হয়ে যাবো। তোর সাথে কাটানো এই এক বছর আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়। আমি বাকি দিনগুলোতে এই খুশি নিয়ে বাঁচতে চাই।
চৈতালী ঘুমের মধ্যে অস্ফুট শব্দ করলো শুধু।
রাফসান ওর কপালে একটা চুমু দিয়ে বললো- কালকের দিনটা আমি তোর জন্য স্পেশাল করার চেষ্টা করবো।
পরীক্ষার হল থেকে বের হয়ে গাড়িতে বসে সিটে মাথাটা এলিয়ে দিলো চৈতালী। রাফসান বললো- খারাপ লাগছে তোর??
– হুম মাথাটা ব্যাথা করছে। তাছাড়া পরীক্ষা টাও ভালো হয় নি। তাই মনটা খারাপ।
রাফসান চিন্তায় পড়ে গেলো। আজকের দিনটা তো গেলোই রাতটাও যদি চৈতালীর মনের মত না করতে পারে তাহলে আফসোস লাগবে।
গাড়ি সাইড করে চৈতালীর দিকে এগিয়ে এলো রাফসান। তারপর ওর মাথা টিপতে শুরু করলো।
– ছাড়ো অতোটাও ব্যাথা না। বললো চৈতালী।
– তুই চুপ থাক।
চৈতালী চুপ করে গেলো। মানুষটার ছোট ছোট কেয়ার মন্দ লাগে না। বরং মনের ভিতর আলাদা ভালবাসার জন্ম দেয়।
এভাবে কিছুটা সময় যাওয়ার পর চৈতালী কে ডাকলো রাফসান। চৈতালী উত্তর দিলো না। মুচকি হেঁসে গাড়ি স্টার্ট করলো রাফসান। পাগলিটা ঘুমিয়ে পড়েছে।
**চৈতালীর যখন ঘুম ভাঙলো তখন সে নিজেকে আবিষ্কার করলো চোখ বাঁধা অবস্থায়। তার ভয় লাগতে শুরু করলো। তার মনে আছে সে পরীক্ষা দিয়ে গাড়িতে চড়েছিলো। রাফসান তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলো। তারপর হঠাৎই তার চোখ দুটো লেগে গেলো।
একটা ঢোক গিললো চৈতালী। তারা কি কিডনাপ হয়েছে?? রাফসান কই? তারা এখন কোথায় আছে।
হঠাৎ নিজের শরীরে হাত পড়তেই কথা বন্ধ হয়ে গেলো চৈতালীর। তার স্পষ্ট মনে আছে সে বাসা থেকে থ্রি পিস পড়ে বের হয়েছিলো। এখন তো তার মনে হচ্ছে সে একটা ব্লাউজ আর পেটিকোট পড়ে আছে।
তবে কি তাকে যারা তুলে এনেছে তারা তার সাথে খারাপ কিছু করছে??
চৈতালীর আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে কান্না আসতে লাগলো। কিন্তু সে অনুভব করলো তার কান্না আসছে না।
আচমকা তার কোমড়ে কারো হাত পড়তেই সে লাফিয়ে উঠলো। সাথে সাথে তার গলা দিয়েও স্বর বের হলো। কোনরকমে বললো- কে আপনি? আমাকে কোথায় এনেছেন?? আমার রাফসান ভাই কোথায়??
ওপাশ থেকে কোন উত্তর এলো না। বরং সে এবার আবার তার কোমড়ে স্পর্শ অনুভব করলো। চিৎকার দিতে গিয়েও থেমে গেলো।
কারণ ততহ্মণে চৈতালী বুঝতে পেরেছে মানুষটা রাফসান।
কিন্তু রাফসান করছে টা কি? তার চোখই বা বাঁধা কেন?
আর তাকে পেটিকোট ব্লাউজই বা পরিয়েছে কেন??
চৈতালীর এতহ্মণ রাফসানের কর্মকান্ডে রাগ লাগলেও রাফসান তার ড্রেস চেন্জ করছে চিন্তা করতেই লজ্জায় মিইয়ে গেলো সে। হাঁসফাঁস লাগতে শুরু করলো। চৈতালীর চিন্তার মাঝেই তার চোখের বাধন খুলে দিলো রাফসান।
রাফসান বাধন খুলতেই চৈতালী আশেপাশে তাকিয়ে চোখ বড়বড় করে ফেললো। কারণ সে দাঁড়িয়ে অাছে বাসার ছাঁদে। ছাদের মেঝেতে বড় লাভ শেপের বিছানা। চৈতালী অবাক হয়ে গেলো এই বিছানা কিভাবে বানালো রাফসান??
বিছানার আশেপাশে অসংখ্য লাভ শেপের বেলুন। আর পুরো বিছানায় গোলাপের পাপড়ি। আর পুরো ছাঁদের লাইটিং করা হয়েছে মোমবাতি দিয়ে। একপাশে টেবিলের উপর একটা লাভ শেপের কেক। উপরে লেখা হ্যাপি ম্যারেজ ডে মাই লাভলি ওয়াইফ।
চৈতালী চমকে গেলো আজ তাদের ম্যারেজ ডে? অথচ সে কি না ভুলে বসে আছে? অবশ্য পরীক্ষা থাকলে আর কি বা হবে?
হাতে রাফসানের ছোয়া পেতেই সেদিকে তাকালো চৈতালী। রাফসান তার হাতে চুড়ি পরিয়ে দিচ্ছে। লাল কাঁচের চুড়ি। নিজের দিকে এবার সে নজর দিলো তার পড়নে লাল পাঁড়ের সেই সাদা শাড়িটা। কে পড়ালো??
রাফসান??
এই জন্যই তখন কোমড়ে হাত দিয়েছিলো? এই লোক শাড়ি ও পড়াতে পারে?? নিশ্চয়ই আফরিন কে পড়াতো??
চৈতালীর মন খারাপ হয়ে গেলো। সে ছাড়া রাফসান আরও কাউকে ভালবেসেছে ভাবতেই তার মনটা কেমন করে উঠলো। তবে সে নিজেকে সামলে নিলো।
রাফসানের সব জেনেই তাকে বিয়ে করেছে, ভালবেসেছে চৈতালী।
আজ যেন চৈতালীর চমকাবার পালা। কারণ তার সামনে একটা সাদা পান্জাবি পড়ে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে রাফসান।
রাফসান কে চৈতালী মেবি ছোট বেলায়ই পান্জাবি পড়তে দেখেছিলো। এরপর আর দেখে নি।
অনেক বছর পর আবার দেখলো।
(ক্রমশ)লাল পাঁড়ের সাদা শাড়ি
*পর্ব ২৩
সামিরা আক্তার
-সারপ্রাইজ পছন্দ হয়েছে তোর চৈতী??
রাফসান ডাকলো চৈতালী কে। চৈতালীর এতহ্মণে হুশ ফিরলো। আর ফিরতেই রাগ হলো তার। এইভাবে ভয় পাইয়ে কেউ সারপ্রাইজ দেয়?? সে কতটা ভয় পেয়েছিলো।।
– কি হলো মুখ ফুলিয়ে বসে আছিস কেন?? বললো রাফসান।
– তুমি জানো আমি কতটা ভয় পেয়েছিলাম??
– সে জন্য সরি রে। কানে ধরলো রাফসান। কিন্তু এরকম না হলে তো সারপ্রাইজ হতো না ম্যাডাম
চৈতালী হেঁসে ফেললো। প্রান খোলা হাঁসি। ওর হাঁসির দিকে মুগ্ধ নজরে তাকিয়ে রইলো রাফসান।
চৈতালী হাঁসি থামিয়ে বললো- খুব পছন্দ হয়েছে সব কিছু। আর সবচেয়ে বেশি পছন্দ হয়েছে লাভ শেপের এই বেডটা। জাস্ট ওয়াও। বলেই শুয়ে পড়লো সে।
ওর পাশে শুয়ে রাফসান বললো- এটা স্পেশালই তোর জন্য অর্ডার দিয়ে বানানো হয়েছে।
চৈতালী মুচকি হেঁসে বললো- জানো আমার মনেই ছিলো না আজ আমাদের বিবাহবার্ষিকী। ভাগ্যিস তোমার মনে ছিল। না হলে এই সুন্দর সময়টা মিস করে যেতাম।
– কিভাবে ১ বছর কেটে গেলো তাইনা চৈতী?
– হুম। তবে তুমি আমার শাড়ির বেলায় কিপ্টামি করলে কেন? চৈতালী গাল ফুলালো।
– তোকে এই শাড়িটায় অসম্ভব সুন্দর লাগে চৈতী। রাফসান ঘোর লাগা কন্ঠে বলে উঠলো।
চৈতালী লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেললো। রাফসান বললো- আমি তোকে এই শাড়িটায় দেখতে চেয়েছিলাম। এই শাড়িটা আমার কাছে স্পেশাল। যত স্পেশাল ডে আসবে সামনে তুই এই শাড়িটাই পড়বি। আমার জন্য।
চৈতালী ঘাড় কাত করে সায় জানালো। রাফসান আর একটু কাছে এগিয়ে আসলো। চৈতালী যেন লজ্জায় কুকড়ে গেলো। রাফসান আঁকড়ে ধরলো ওকে। চৈতালীর শ্বাস প্রশ্বাস ঘন হতে শুরু করলো। রাতটা ওদের কেটে যায় ভালবাসাময়।
**গতকাল চৈতালীর পরীক্ষা শেষ হওয়ায় এক রকম হাফ ছেড়ে বেঁচেছে সে। আজ একদম ফ্রি। বাড়ি থেকে অবশ্য সবাই বলছে কিছুূদিন গিয়ে থেকে আসতে। তবে রাফসান রাজি হয়নি। বলেছে এমনি একদিন নিয়ে গিয়ে ঘুরিয়ে আনবে। চৈতালীর যেতে ইচ্ছা করলেও রাফসানের কথা ভেবে চুপ করে গেছে।
রাফসান অফিসে যাওয়ার পর একটা উপন্যাস পড়ার চিন্তা করলো চৈতালী। বইয়ের তাকে গিয়ে একটা বই টান দিতেই পায়ে কাছে এসে পড়লো একটা ডাইরি।
চৈতালী নিচু হয়ে ডাইরিটা তুললো। ডাইরির কভার পেজে মার্কার দিয়ে লেখা পারমিশন ছাড়া হাত দেওয়া নিষেধ। তার মানে পার্সোনাল। কার এটা? রাফসানের??
চৈতালী একবার রেখে দিতে চাইলো। কিন্তু কেন জানি দিলো না। ডাইরির কভার পেজটা উল্টাতেই বেরিয়ে এলো আফরিনের হাঁসিমাখা একটা ছবি। চৈতালীর চিনতে একটুও ভুল হলো না।
রাফসান এত যত্ন করে ছবিটা রেখে দিয়েছে?? ভাবতেই বুকের ভিতর চিন চিন করে উঠলো চৈতালীর। কাঁপা কাঁপা হাতে পরের পৃষ্ঠা উল্টালো।
পুরো পাতা জুরে আফরিনের প্রতি অগাধ ভালবাসার সরল স্বীকারোক্তি। চৈতালীর মনে হলো তার ভিতরটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে।
সে তো সবটা জানতো। তারপরও কেন এত কষ্ট হচ্ছে? সেদিন ছাঁদে রাফসান আফরিন কে শাড়ি পরিয়ে দিয়েছে ভেবেও খুব কষ্ট হচ্ছিল তার।
ডাইরির বাকি পাতা গুলো আর পড়ার সাহস হচ্ছিল না চৈতালীর।
রাফসান যখন বাসায় পৌছালো তখন সন্ধ্যা নেমেছে। তার হাতে বেলি ফুলের গাজরা। চৈতালীকে নিজ হাতে খোপায় পড়াবে বলে এনেছে।
কলিং বেল বাজিয়ে চৈতালী কে না পেড়ে নিজেই দরজা খুললো সে। খুলেই অবাক হলো৷ সারা ঘর অন্ধকার। চৈতালী কি ঘুমিয়ে? লাইট জ্বালায়নি কেন??
ডাইনিংয়ের লাইট জ্বালিয়ে বেডরুমে আসলো। আর বেডরুমের লাইট জ্বালাতেই থমকে গেলো সে।
দু পায়ে মাথা গুজে বিধ্বস্ত অবস্থায় বসে আছে চৈতালী। রাফসানের দুনিয়া যেন দুলে উঠলো। দৌড়ে চৈতালীর পাশে গিয়ে বসলো। ওর মুখটা তুলে নিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বললো- কি হয়েছে তোর চৈতী??
চৈতালী ফ্যাল ফ্যাল করে তাকালো রাফসানের মুখের
দিকে। তার পর আচমকা তাকে জরিয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠলো।
রাফসান চৈতালীর কান্নার কারণ না খুঁজে পেয়ে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে জানতে চাইলো..
– কি হয়েছে চৈতী? কেউ কিছু বলেছে??
বিনিময়ে চৈতালী মাথা নাড়লো শুধু। রাফসান হঠাৎ পাশে তাকাতেই মেঝেতে তার নিজের ডাইরি আর আফরিনের ছবি পড়ে থাকতে দেখলো।
একটা দীর্ঘ শ্বাস নিলো সে। যা বুঝার বুঝে গেছে। অতীত তো সে কবেই ভুলে গেছে। তবুও কেন সেই অতীত এসে তার বর্তমান সুখকে নাড়া দিচ্ছে??
রাফসান শান্ত গলায় বললো- তুই ডাইরিটা পড়ে কাঁদছিস তাইতো??
– তুমি কেন আমার একার হলে না রাফসান ভাই?? কেন তুমি অন্য কাউকে ভালবেসেছিলে?? কেন আমি ছাড়া অন্য কাউকে ছুয়েছিলে? কেন?
সেদিন আমাকে যেভাবে শাড়ি পরিয়েছিলে আফরিন কেও বুঝি ওভাবে পড়াতে???
রাফসানের বুকের ভিতর চৈতালী পাগলের মত কাঁদতে লাগলো। রাফসান শান্ত কণ্ঠে বললো- একটু শান্ত হ চৈতালী। তোকে অনেক কিছু বলার আছে।
(ক্রমশ)লাল পাঁড়ের সাদা শাড়ি
**পর্ব ২৪
সামিরা আক্তার
** আফরিনের সাথে যখন আমার দেখা হয় তখন আমি অনার্স ৩য় বর্ষের ছাত্র। একই ডিপার্টমেন্টের ছিলো। এজন্য বোধ হয় বেশি দেখা হতো। ও এখানে মামার বাসায় থাকতো। ওর বাবা ছিল না। মা আর ভাই গ্রামে থাকতেন।
আফরিন ওর ক্লাসে একটু বেশিই পপুলার ছিলো। একটু বেশি সুন্দর ছিলো কিনা।
আর প্রচুর হাঁসতো। ওর এই হাঁসি আর সৌন্দর্যের জন্য অনেক ছেলের নজরে ছিলো ও। আমি এসব জানতাম না। জেনেছি পরে।
এটুকু বলে থামলো রাফসান।
– তারপর?? জানতে চাইলো চৈতালী।
-আমার বন্ধু সাঈদ কে মনে আছে তোর??আমাদের ব্যাচের সবচেয়ে হ্যান্ডসাম ছেলে সাঈদ।
চৈতালী দুপাশে মাথা নাড়লো তার মনে নেই। সে তখন ছোট ছিলো।
– এই আজকের সুদর্শন রাফসান কে দেখছিস তখন সুদর্শন থাকলেও এতটা গুছানো ছিলাম না। এলোমেলো থাকতেই ভালো লাগতো। সাঈদ আমাদের ব্যাচে পপুলার ছিলো হ্যান্ডসাম হিসাবে। আর আমি বাপের টাকা আছে এজন্য।
অবশ্য আমরা বাকিরা সাঈদ কে অতটাও পছন্দ করতাম না ওর মেয়েবাজির জন্য। ওর মেইন কাজ ছিলো মেয়েদের সাথে ফ্লাট করা।
সাঈদের নজরে পরে গেলো আফরিন। দিন পনেরো মত আফরিনের পিছনে ঘুরঘুর করলো।
কি হলো জানি না একদিন আফরিন এসে সাঈদের সামনে আমাকে প্রপোজ করলো।
আমরা উপস্থিত সবাই বোকা বনে গেলাম। কারণ আমরা সাঈদের ব্যাপারটা জানতাম।
সেদিন আমি আফরিন কে কিছু বলি নি। বলার ইচ্ছে ও ছিলো না।
কয়েকদিন পরে সাঈদ এসে জানালো আমি যেন আফরিনের ব্যাপারটা ভেবে দেখি। আমি একটু অবাক হলাম।
সাঈদ আমাকে বললো ওর জাস্ট আফরিন কে ভালো লেগেছিল। এর বেশি কিছু না। এখন ওর অন্য ডিপার্টমেন্টের একটা মেয়েকে ভালো লেগেছে তার পিছনেই ছুটছে।
কথাটা আমরা সবাই বিশ্বাস করলাম। কেননা আমরা সাঈদের স্বভাব সম্পর্কে জানতাম।
-তারপর?? চৈতালী প্রশ্ন করলো।
-তারপর আর কি?? সুন্দরী মেয়েদের প্রত্যাখান করার হ্মমতা বোধহয় সৃষ্টিকর্তা কাউকে ও দেয় নি। আমিও তার ব্যাতিক্রম ছিলাম না।
মাস্টার্স পর্যন্ত দুজনে চুটিয়ে প্রেম করলাম। ইচ্ছা ছিলো বাবাকে জানিয়েই বিয়ে করবো। কিন্তু এর মাঝেই ও একদিন বাড়ি গেলো। ফিরে এলো পালিয়ে।
ওখানকার এক স্থানীয় স্কুল মাস্টারের সাথে না কি বিয়ে ঠিক করেছে ওর ভাই আর মা।
কিন্তু ও আমি ছাড়া কাউকে বিয়ে করবে না। যাই হয়ে যাক আমার সাথেই থাকবে। আর আমার তখন আফরিন ছাড়া মরে যাই এমন অবস্থা। কোন কিছু না ভেবেই কাজী অফিসে গিয়ে বিয়ে করি ওকে।
তার পরের ঘটনা তোদের জানা থাকলেও সংসার কেন ভাঙলো এটা কেউ জানে না।
-কেন?? জিজ্ঞাসু চোখে চাইলো চৈতালী।
– আফরিন কে বিয়ে করে বাড়িতে আনার পরই বাবা বলেছিল আমি না কি মানুষ চিনতে ভুল করেছি। কিন্তু আমি তার বিরোধিতা করেছিলাম। কি করে জানবো বল যার সাথে ৩ বছর সুখ দুঃখ ভাগ করে চললাম সে একটা বেঈমান।
বাবা সেদিন আমাকে এক উদ্ভট শর্ত দিয়েছিলেন। কেন দিয়েছিলেন আজ বুঝতে পারি।
বাবার কথা ছিলো বাবার কোম্পানি তে এক বছর সাধারণ কর্মচারীর মত থাকতে হবে। সেরকমই বেতন পাবো।
তা দিয়েই আমার চলতে হবে। আমাদের বিষয় সম্পত্তি সম্পর্কে ও আফরিন অবগত থাকবে না। আমি মেনে নিয়েছিলাম।
কারণ আফরিনের প্রতি আমার অগাধ বিশ্বাস ছিলো।
প্রথম দু এক মাস ভাল কাটলেও পরে আফরিন যখন বুঝতে পারলো আমি আমার বাবার অফিসের একজন সাধারণ কর্মচারী সমস্যা শুরু হলো তখন থেকে।
আমি ঠিকমত ওর চাহিদা পূরণ করতে পারছিলাম না।
তাছাড়া অধিক পরিশ্রমের কারণে শরীর ঘামে ভিজে থাকতো। ঐ অবস্থায় বাসায় আসলে ও নাক চেঁপে দূরে দাঁড়িয়ে থাকতো।
আমার তখন প্রচন্ড অসহায় লাগতো। এছাড়া জিম করার অভ্যাস ছিলো না। এজন্য না কি আনস্মাট লাগতো। অথচ আমি শুরু থেকেই এমনটা ছিলাম। ও সব জেনেই ভালবেসেছিলো।
আমার গাড়ি ব্যবহার করার অভ্যাস কম ছিল। এটাও সে পছন্দ করতো না।
মা রান্না করতো সেগুলো খেতে পছন্দ করতাম বলে বলতো এইসব তেল মসলা খেয়ে না কি আমি কাকুদের মত হয়ে যাচ্ছি।
ও রাতে ঘুমালে আমি আয়নায় দেখতাম আমার খুত কোথায়? কি এমন চেন্জ হলো এই ৬-৭ মাসে। বিশ্বাস কর আমার নিজেকে আগের মতই লাগতো।
বিস্ফোরণ ঘটলো সেদিন যেদিন ও জানতে চাইলো নিজের বাবার কোম্পানি তে আমি এত ছোট চাকরি কেন করি??
বাবার কথা মতো বলেছিলাম কোম্পানির অবস্থা ভাল না। অথচ বাবা সেই সময়ে আমাকে ৩০ হাজার টাকা স্যালারি দিতেন। সব ওর জন্যই খরচ হতো।
ওকে যখন আমি বলেছিলাম কোম্পানির অবস্থা ভাল না তখন ও আমার সাথে চুড়ান্ত অশান্তি শুরু করলো। আমি না কি ওকে মিথ্যে বলেছি। ওকে ঠকিয়েছি।
অথচ ও আমাকে বলেছিলো ওর একটা সাধারণ জীবন আর আমি হলেই চলবে।
কি বোকা ছিলাম। সব কথা বিশ্বাস করে নিয়েছিলাম।
সাঈদ ততদিনে মডেলিং শুরু করেছে। ওর সাথে আফরিন কিভাবে যোগাযোগ করেছিলো জানি না। তবে ওকে মডেলিংয়ের অফার সাঈদই দিয়েছিলো।
মডেলিং শুরু করার পর রাত করে বাড়ি ফিরতে শুরু করলো।
কি সব ড্রেস পড়তো। আমি কিছু বললেই বলতো তুমি তো দিতে পারো নাই। ফকিরের মত রাখছিলা।
সেদিনই বুঝেছিলাম বাবাই ঠিক ছিলো। তবে কাউকে কিছু না জানিয়ে সব ঠিক করে নিতে চেয়েছিলাম।
আমার ষোলকলা সেদিন পূর্ণ হলো যেদিন অফিস থেকে ফেরার পথে সাঈদ আর আফরিন কে হাত ধরাধরি করে একটা আবাসিক হোটেলে ঢুকতে দেখলাম।
আমার মনে হলো এই দৃশ্য দেখার থেকে যদি মরে যেতাম।
সেদিন বাড়ি ফিরিনি আমি। জুনায়েদের কাছে ছিলাম। ও আমাকে কিভাবে সামলেছে ওই জানে। জুনায়েদ ছাড়া এই কথা আজ অবধি কেউ জানে না।
পরদিন কোন ভণিতা ছাড়াই ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম সাঈদের সাথে কতদিনের সম্পর্ক??
হয়তো অবাক হয়ছিলো কিন্তু উত্তর দিয়েছিলো কি জানিস??
ও না কি আমার মত হাড়হাভাতে, আনস্মাট, ফকিরের সাথে থাকবে না। ওর ডিভোর্স চাই।
আমি অবাক হয় নি। জানতাম ও এটাই বলবে।
তবে সময় চেয়েছিলাম। কারণ এর মাঝে জুনায়েদ আর রাফিয়ার বিয়ের কথা হচ্ছিলো।
বাড়ির কাউকে না জানিয়ে আমরা কোর্টে ডিভোর্সের আবেদনও করেছিলাম।
তারপর রাফিয়া চলে গেলো জার্মানি। আর আফরিনও চলে গেল। ও যেদিন চলে গেলো সেদিন আমাদের কোর্টে শেষ শুনানি ছিলো।
সম্পর্ক শেষ করে এসে পুরো একদিন ঘরবন্দী ছিলাম।
মা বাবা এখন পর্যন্ত জানে সেদিন আমি আফরিন কে ফিরিয়ে আনতে গিয়েছিলাম। কিন্তু সেদিন যে সম্পর্কের শেষ দিন ছিলো তা শুধু জুনায়েদই জানতো।
তার পর বাবার কাছে মাফ চেয়ে জীবনটা নতুন করে শুরু করলাম। জিমে যেতে শুরু করলাম। খাবার দাবারে পরিবর্তন আনলাম। নিজেকে নতুন করে তৈরি করলাম।
বাবা ব্যবসার দায়িত্ব আমাকে দিয়ে দিলেন।
একটা সময় এমন হলো যে অনেক কোম্পানি তাদের পণ্যের মডেল হিসেবে আমাকে কাজ করতে বলতো।
অনেকে আফসোস করতো কেন মডেলিং করি না। আফরিন হয়তো পরে সব জানতে পেরেছিলো। তাই জুনায়েদ কে নক করেছিলো।
কিন্তু বেঈমান দের রাফসান শিকদার হ্মমা করে না এটা ওর জানা ছিলো না।
ওর জন্য আমার সেই সহজ সরল এলেবেলে জীবনটা হারিয়ে গেছিলো, অনুভূতি গুলো ভোতা হয়েগেছিলো।
চৈতালী লহ্ম করলো রাফসানের দুচোখ দিয়ে পানি পড়ছে।
(ক্রমশ)