লাল পাড়ের সাদা শাড়ি পর্ব -২৫+২৬+২৭

লাল পাঁড়ের সাদা শাড়ি
*পর্ব ২৫
সামিরা আক্তার

– আমাকে হ্মমা করে দাও। আমি আর কখনো তোমাকে কষ্ট দেবো না।
রাফসান কে জরিয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললো চৈতালী।
– তুই আমার স্ত্রী চৈতী। আমার উচিত ছিলো তোকে আগেই সব কিছু জানানো। আসলে তখন তো ভাবি নাই তোর সাথে এভাবে নিজেকে জরিয়ে ফেলবো।
– কেন? জরিয়ে ফেলেছো বলে আফসোস লাগছে না কি?? নাক ফুলিয়ে বলে উঠলো চৈতালী।

রাফসান মৃদু হাসলো। তার পর চৈতালী জরিয়ে ধরে বললো- আমি স্বীকার করছি চৈতী তুই ছাড়া আমার জীবনে অন্য কেউ ছিলো। তুই ছাড়া আমি অন্য কাউকে স্পর্শ করেছি। আমি মানছি তুই আমার প্রথম ভালবাসা না।
কিন্ত চৈতী তুই কি জানিস?? তুই আমার প্রথম মাদকতা। প্রথম ভালবাসা না তো কি হয়েছে তুই আমার শেষ ভালবাসা। সত্যিকার ভালবাসা।
আর আমি কখনো তুই ছাড়া অন্য কাউকে শাড়ি পড়াই নাই। গল্পের হিরোদের মত আমি শাড়ি পড়াতে পারতাম না।
বিবাহবার্ষিকীর দিন সারা দিন ইউটিউব দেখে শিখেছি।

চৈতালী মুখ তুলে চাইলো। রাফসান ওর কপালে একটা চুমু দিয়ে বললো- আমি পুরোটাই তোর চৈতী। তোর মত আমি আর কাউকে ভালবাসি নাই। আর বাসবোও না।

-এখন তো বড় বড় কথা বলছো। বিয়ের পর তো পাত্তাই দিতে না। গাল ফুলিয়ে বললো চৈতালী।
– তখন ভাবতাম আমি এত বয়স্ক লোক। তোর সাথে কিভাবে নিজেকে জড়াই।
– তো জড়ালে কেন??
– কারণ তুই যে নেশার মত চৈতী। মাদকতা আমার। ঘোর লাগা কন্ঠে বললো রাফসান।
চৈতালী এবার লজ্জায় অন্যদিকে তাকিয়ে ফেললো। রাফসান মৃদু হেঁসে বললো- তোর এই লজ্জা মাখা মুখ দেখেই ডুবেছি চৈতী।
চৈতালী আরেক দফা লজ্জা পেলো।

সময় গড়িয়ে কেটে গেছে আরও ২ মাস। প্রকৃতি তে শীত ঋতু বিরাজমান। রাফসানের ব্যাস্ততা বাড়লেও চৈতালী কে সময় দিতে ভোলে না সে।
এর মাঝে চৈতালীর প্রথম বর্ষের থেকে ২য় বর্ষে উত্তীর্ণ হয়েছে। এজন্য নিজেও একটু ব্যাস্ত।
চৈতালীর পাসপোর্ট তৈরী হয়েছে। প্রথমে সুইজারল্যান্ড যাওয়ার ইচ্ছা থাকলেও চৈতালীর এখন ইচ্ছা রাফিয়ার কাছে যাবে।
কারণ কিছুদিন আগে রাফিয়া আর জুনায়েদের একটা মেয়ে হয়েছে। তাকে দেখবার বায়না তার।

রাফসান তাই নিজের কাজ গুছিয়ে নিচ্ছে। কারণ দুদিন পড়েই তারা উড়াল দিবে জার্মানির উদ্দেশ্য।
পুরো দুমাসের ট্যুর।
এর আগে চৈতালী কে নিয়ে বাড়ি থেকেও ঘুরে আসতে হবে। কিছু শপিং করতে হবে।
সব মিলিয়ে নিঃশ্বাস ফেলার সময় নেই।

**এয়ারপোর্টে শিকদার পরিবারের সবাই দাঁড়িয়ে আছে চৈতালীদের বিদায় জানানোর জন্য। রেবেকা মেয়েকে এক গাঁদা উপদেশ দিচ্ছে। আর চৈতালী শুধু হু হা করছে।
আয়শা বেগমের মন খারাপ। ওনার নাতনী কে দেখার ইচ্ছা ছিলো। কিন্তু আসমাত শিকদারের শরীর খারাপ হওয়ায় যেতে পারলেন না। অবশেষে এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ।
রাফসান আর চৈতালী উড়াল দিলো জার্মানির উদ্দেশ্য।

চৈতালীর এটাই প্রথম এয়ার জার্নি। প্রথমে একটু ভয় পেলেও পরে সে মানিয়ে নিলো।

জার্মানির শহর বার্লিন। এখানেই জুনায়েদ আর রাফিয়া থাকে। কিছুদিন হলো এদেশের নাগরিকত্বও পেয়েছে তারা।
বার্লিনের এয়ারপোর্টে ওদের রিসিভ করতে এসে জুনায়েদ পারলে এক লাফে রাফসানের কোলে উঠে যায়। দুই বন্ধুর প্রায় দের বছর পরে দেখা।
যার কারনে দুজনেই উচ্ছ্বসিত।
রাফসানের সাথে কোলাকুলি শেষে জুনায়েদ চৈতালী কে বললো- ভালো আছো চৈতালী।
চৈতালী মাথা নেড়ে সায় জানালো।

বাসায় যাবার পথে গাড়িতে বসে রাফসান প্রথম যে কথাটা ওকে ফিসফিস করে বললো সেটা হলো – চৈতী ইস্ লি বে ডিস্।
চৈতালী বুঝতে না পেরে হা করে তাকিয়ে রইলো। পাশ থেকে জুনায়েদ উচ্চস্বরে হেঁসে ফেললো।
রাফসান একটু ইতস্তত বোধ করলো। জুনায়েদ শুনে ফেলবে সেটা তার ধারণায় ছিলো না।

– কি বললে?? আবার বলো বুঝি নি। বললো চৈতালী।
জুনায়েদ আবার হেঁসে ফেললো। রাফসান ওর দিকে চহ্মু কটমট করে তাকালো। তারপর চৈতালীর দিকে অসহায় চোখে তাকিয়ে বললো- কিছু না।
– কিন্ত আমি তো শুনলাম ইস না ফিস বললা।
– আমি বলছি কি বলেছে তোমাকে। পাশ থেকে বললো জুনায়েদ।
চৈতালী আগ্রহী হয়ে ওর দিকে তাকালো।
রাফসান এবার একটু বিপদে পড়লো। চৈতালী জার্মান ভাষা জানে না বলে ওর সাথে একটু মজা করতে চেয়েছিল। যথেষ্ট আস্তেই বলেছে এই জুনায়েদ কিভাবে শুনলো কে জানে?
জুনায়েদ বলার জন্য মুখ বাড়িয়েছিল। রাফসান আচমকা ওর মুখ চেপে ধরে বললো- আমার বউকে যখন কথাটা আমি বলেছি। মানেটাও আমি বলবো।তোর এত কষ্ট করতে হবে না।
চৈতালী কিছু না বুঝতে পেরে ভ্রু কুচকে ওদের দিকে তাকিয়ে রইলো।
(ক্রমশ)লাল পাঁড়ের সাদা শাড়ি
* পর্ব ২৬
সামিরা আক্তার

রাফিয়ার বাসায় যখন ওরা পৌছালো তখনও মিটিমিটি হাঁসছে জুনায়েদ। রাফসান কটমট করে বললো- একদম হাঁসবি না বললাম।
– হেঁ হেঁ। আমি হাঁসি না দোস্ত বিশ্বাস কর। আজকাল আমার চেহারাটাই এমন দেখতে লাগছে।
– এই তোমরা কি ফিসফিস করছো??চৈতালী জানতে চাইলো।
-কিছু না। ওর যত ফাউ কথা। তুই এদিকে কান দিস না। বললো রাফসান।

অনেক দিন পর ভাইকে দেখে রাফিয়া নিজের কান্না থামাতে পারছে না। গত ২০ মিনিট সে রাফসান কে জরিয়ে ধরে কাঁদছে।
– রাফু আমি ঠিক আছি। দেখ ভালো আছি। তুই এভাবে কাঁদলে কিভাবে হবে??

রাফিয়া এবার রাফসানকে ছেড়ে চৈতালী কে জরিয়ে ধরলো। চৈতালী গাল ফুলিয়ে বললো- তাও ভালো তুমি আমাকে দেখলে রাফিয়া আপু। আমি তো ভাবলাম তুমি আমি অদৃশ্য হয়ে গেছি। তাই তুমি তোমার ভাই ছাড়া কাউকে দেখতে পাচ্ছ না। আমাকেও দেখতে পাচ্ছ না।বলে মুখটা দুঃখী দুঃখী করলো চৈতালী।
রাফিয়া হেঁসে ফেললো। বললো – একদম আগের মত আছিস।
– কেন? তুমি চাইছো আমি চেন্জ হই?? কৌতুক করে বললো চৈতালী।
-না। তুই এভাবেই থাক। ভালো থাক।
– আচ্ছা খুব সেন্টি খাওয়া হয়েছে। এবার বাবুকে আনো তাড়াতাড়ি। দেখি কেমন হয়েছে।

রাফিয়া মেয়েকে নিয়ে আসতেই রাফসান আগে কোলে নিলো। চৈতালী কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেলো। কারণ বাবুকে কোলে নিয়ে রাফসানের মুখ ঝলমল করছে।
আচ্ছা মানুষটার কি বাচ্চা পছন্দ?? তাকে তো কিছু বলে নি। এই মানুষটার জীবন এলোমেলো না হয়ে গেলে বোধ হয় তার ও একটা বাচ্চা থাকত।
চৈতালী চিন্তা করলো এখান থেকে গিয়ে বাচ্চার কথা বলবে রাফসান কে।

– কি রে চৈতালী কি চিন্তা করছিস?? বাবুকে কোলে নিবি না? রাফিয়া ডাক দিলো।
চৈতালী এগিয়ে গিয়ে বাবুকে কোলে নিয়ে চিৎকার দিয়ে বললো- রাফিয়া আপু!!! বাবু কি সফট্। একদম তুলতুলা৷ তোমরা ওর যাই নাম দাও আমি কিন্তু ওকে তুলতুল বলে ডাকবো।

জুনায়েদ হেঁসে বললো- আচ্ছা ডেকো। তবে ওর নাম রেখেছি ফ্লোরা।
– ফ্লোরা?? রাফসান জিজ্ঞেস করলো।
-হ্যাঁ তোর পছন্দ হয় নি?
– নাহ ঠিক আছে।
– আসলে ভাইয়া নামটা ওর পছন্দের। তাই আমি আপত্তি করি নাই।
পাশ থেকে চৈতালী বললো- ভাইয়া আমার পছন্দ হয়েছে।

রাতে ডিনার করার সময় রাফসান দেখলো রাফিয়া পারলে সব খাবার একসাথে রান্না করছে। মনে মনে হাঁসলো সে। তার মা নিশ্চয়ই বলেছে সে এখন স্বাভাবিক খাবার খায়। আর বোন আবেগে আপ্লূত হয়ে রান্না করছে।
রাফসান একটা গিল্টি ফিল করলো। কেন যে সে এত দিন নিজের লোকদের কষ্ট দিয়েছে কে জানে।

জুনায়েদ আঁড়চোখে রাফসানের খাওয়া দেখছিলো। বেশ স্বাভাবিক ভাবে খাচ্ছে। নিজের কাছেই ভাল লাগলো তার৷
রাফসান স্বাভাবিক জীবনে ফিরবে এই আশা সে ছেড়েই দিয়েছিলো। সত্যি ভালবাসা সব পারে।
আফরিন যখন রাফসানের ভালবাসা কে পা মারিয়ে সাঈদের সাথে সম্পর্কে গিয়েছিল তখন একমাত্র জুনায়েদ জানে সে কিভাবে রাফসান কে সামলেছে।
মাঝে মাঝে তো রাফসানের অবস্থা দেখে সে নিজেও কেঁদে ফেলতো।
চৈতালীর প্রতি এজন্যই তাদের কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।

হঠাৎ জুনায়েদের মাথায় দুষ্ট বুদ্ধি চলে আসলো। হাঁসি হাঁসি মুখ করে রাফিয়ার দিকে তাকিয়ে বললো- রাফিয়া ইস্ লি বে ডিস্।
রাফসান খাবার মুখে দিয়েছিলো। জুনায়েদের কথায় তার হেঁচকি উঠে খাবার সব বাইরে ছড়িয়ে পড়লো। রাফিয়া প্রথমে ভাইয়ের সামনে জুনায়েদের এমন কথায় থতমত খেয়ে গেছিলো।
এখন রাফসানের অবস্থা দেখে হতভম্ব হয়ে গেলো। তাড়াতাড়ি রাফসান কে পানি এগিয়ে দিলো।

রাফসান কিছুটা শান্ত হয়ে জুনায়েদের দিকে তাকিয়ে বললো- তোর কপাল ভালো আমার বোন বিয়ে করেছিস। তবে মনে রাখিস এক মাঘে শীত যায় না।

বলে চলে গেলো সে৷ জুনায়েদ তখনও মিটিমিটি হাঁসছে। চৈতালী এতহ্মণ হা করে পুরো কাহিনি দেখছিলো। এবার বললো- এই কথাটাই তখন আমায় রাফসান ভাই গাড়িতে বলছিলো রাফিয়া আপু?? এর মানে কি? খুব খারাপ কিছু??
জুনায়েদ এবার উচ্চস্বরে হেঁসে ফেললো। রাফিয়া এবার বুঝলো জুনায়েদের হঠাৎ একথা বলার কারন। আর তার ভাইয়ের ওরকম করার কারণ।

চৈতালীর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেঁসে বললো- যে কথা টা বলেছে তাকেই মানে জিজ্ঞেস কর না।

**চৈতালী রুমে এসে দেখলো রাফসান মোবাইলে কিছু করছে। জার্মানিতে প্রচুর শীত। রুম হিটার চলছে যদিও। চৈতালী চুপ করে রাফসানের কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়লো।
– তা ম্যাডাম আপনার এতহ্মণে আমার কথা মনে হলো?? বললো রাফসান।
– আমি তো এমনি এসেছি। আবার চলে যাব।
– মানে কি?? কই যাবি?? ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করলো রাফসান।
– আমি এখানে যতদিন থাকবো ততদিন রাফিয়া আপুর কাছে ঘুমাবো।

চৈতালীর কথায় রাফসানের মনে হলো যেন তার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। কোনরকমে বললো- একদম না চৈতী। খুব খারাপ হবে।
চৈতালী বেশ মজা পেলো। বললো – কেন??
রাফসান ইতস্তত করে বললো- আমার ঘুম আসে না চৈতী তোকে ছাড়া।
শেষ দিকে তার কন্ঠ অসহায় হয়ে গেলো।
-আচ্ছা থাকবো না। তবে শর্ত আছে। বললো চৈতালী।
– এখন নিজের বউকে কাছে রাখার জন্য শর্ত পালন করা লাগবে?? আচ্ছা বল। অধৈর্য হয়ে বললো রাফসান।

– তুমি গাড়িতে যে কথাটা বলেছিলে তার মানে বলো।
এবার যেন রাফসান মজা পেলো। আস্তে করে শুয়ে চৈতালী কে পিছন থেকে জরিয়ে ধরলো। তারপর কানের কাছে ফিসফিস করে বললো- সত্যি বলবো?

রাফসান এরকম জরিয়ে ধরায় চৈতালী এমনি লজ্জায় কুঁকড়ে গিয়েছিল। তারপর ওর কথার ধরণ ওকে আরও লজ্জায় ফেলে দিলো। কোন রকমে মাথা নাড়িয়ে হুম বললো।
রাফসান এবার চৈতালীর চুলে মুখ ডুবিয়ে ঘোর লাগা কন্ঠে বললো – আমি তোমাকে ভালবাসি। জার্মান ভাষায় ইস্ লি বে ডিস্।

চৈতালী চুপ করে গেলো। এর আগেও রাফসান তাকে ভালবাসি বলেছে। তবে আজ তার মনে যেন অন্যরকম শিহরণ বয়ে গেলো। সেটা কি জন্য?? এই ভাষার জন্য?? না কি এই রোমাঞ্চকর আবহাওয়ার জন্য??
না কি রাফসান আজ এত কাছে এসে এভাবে বলছে বলে??
রাফসান তখন তৃষ্ণার্ত। আর কিছু না ভেবে চৈতালী ওর ডাকে সাড়া দিতে শুরু করলো।
(ক্রমশ)লাল পাঁড়ের সাদা শাড়ি
*পর্ব ২৭
সামিরা আক্তার

চৈতালীর ঘুম ভাঙলো মুখের উপর ঠান্ডা কিছু পরার কারনে। চোখ মেলে তাকাতেই নিজেকে আবিষ্কার করলো শূন্যে।
রাফসান তাকে কোলে তুলে নিয়ে হাঁটছে। কিন্তু কেন?? এত সাত সকাল বেলা কোলে নিয়ে ঘুরার মানে কি??

চৈতালী কে চোখ মেলে তাকাতে দেখে রাফসান বললো
-ঘুম ভাঙলো ম্যাডাম??
-হ্যাঁ কিন্তু তুমি আমাকে এরকম কোলে নিয়ে ঘুরছো কেন?? আর এটা কোথায়??
– এটা রাফিয়াদের গার্ডেন। সবাই ঘুমাচ্ছে। তুই ও ঘুমে ছিলি তাই কোলে করে আনতে হয়েছে।
– কিন্তু কেন??

রাফসান এবার চৈতালী কে নামিয়ে দিলো। এতহ্মণে চৈতালী খেয়াল করলো তার পা অবধি শীতের পোষাক। পায়ে সু। এমনকি রাফসানের ও তাই।
নীচে তাকিয়ে দেখলো ঘাসের উপর বরফ। এবার উপরের দিকে তাকালো অনেকটা বৃষ্টির মত করে বরফ পড়ছে। অদ্ভুত সুন্দর।
চৈতালী লাফিয়ে রাফসান কে জরিয়ে ধরলো। গদগদ কন্ঠে বললো- এই স্নো দেখার জন্য এই ভাবে এসেছো না??
-হুম। ভালো লেগেছে?
– অনেক বেশি। বলে বরফের উপর ছোটাছুটি শুরু করলো সে।

রাফসান অবাক চোখে চৈতালী কে দেখছে। দু’হাতে স্নো নিয়ে খেলছে মেয়েটা। ঠিক যেন বাচ্চা।
আচমকা এক মুঠো বরফ চৈতালী রাফসানের দিকে ছুড়ে দিলো। রাফসান এবার যেন নিজের বয়স ভুলে নিজেও একমুঠো বরফ ছুড়ে মারলো।
এ যেন বরফ ছোড়াছুড়ির খেলা। দুজনেই দৌড়াদৌড়ি করে একে অন্যকে বরফ ছুড়ে মারতে লাগলো।
উপর থেকে সবটাই দেখলো রাফিয়া। খুশিতে কেঁদে ফেললো সে। তার ভাইয়ের এই খুশি কতদিন পর দেখলো সে।
এই খুশিতে যেন কারো নজর না লাগে।

** প্রায় সপ্তাহ খানেক ঘরে থাকার পর আজ ঘুরতে বেরিয়েছে চৈতালী আর রাফসান।
বার্লিন জার্মানির রাজধানী। আগে এক থাকলেও বর্তমানে ইস্ট বার্লিন আর ওয়েস্ট বার্লিন নামে দু ভাগে ভাগ করা হয়েছে।
রাফসানরা ওয়েস্ট বার্লিন থেকে ইস্ট বার্লিন যাবে। এখানে ঢুকতে চেক পোস্ট থেকে চেক করা হয়।
চেক করা হয়ে গেলে রাফসান বললো- কাউকে আবার কিছু জিজ্ঞেস করতে যাস না যেন।
– কেন?? ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করলো চৈতালী।
– তুই তো জার্মান ভাষা পারিস না।
– তো কি আমি ইংরেজিতে কথা বলবো।

রাফসান ওর মাথায় একটা গাট্টা মেরে বললো- ফর ইউর কাইন্ড ইনফরমেশন জার্মানিরা তাদের ভাষা কে প্রচন্ড ভালবাসে। তারা জার্মান ছাড়া অন্য ভাষায় কথা বলতে নারাজ। এদের কাছে গিয়ে খুব অনুরোধ করে যদি বলিস আপনি কি আমার সাথে ইংরেজিতে কথা বলবেন??
আমি খুব বিপদে পড়েছি তাহলে হয়তো বলতে পারে।

– আর আমাদের ভাষার মধ্যে ৫০শতাংশ ইংরেজি। অথচ আমরা ভাষার জন্য যুদ্ধ করেছিলাম। হতাশ কন্ঠে বললো চৈতালী।

চৈতালীরা প্রথম গেল কনসাল্ট হাউজে। চৈতালী বললো
– এতো রাজকীয় ভবন।
– হুম অনেক পুরোনো। ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময় অনেক কিছুই ধ্বংস হয়ে গেছে। যা আছে তার মধ্যে এটা একটি।
এর পর ওরা গেলো টেলিভিশন ভবনে। রাফসান জানালো এখান থেকে পুরো জার্মানিতে স্যাটালাইট সার্ভিস দেওয়া হয়।
– তুমি এত কিছু জানো কিভাবে?? জানতে চাইলো চৈতালী।
– জুনায়েদ জার্মান শিহ্মার জন্য কোর্স করেছিল। শখের বসে ওর সাথে আমিও করেছিলাম।
– ওহ।

চৈতালীরা আরো অনেক জায়গা ঘুরলো। আলেকজেন্ডার প্লাস, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মারা যাওয়া শহীদ দের স্মৃতিস্তম্ভ, বার্লিনের সবচেয়ে বড় ইউনিভার্সিটি, অসংখ্য লেক আর মিউজিয়াম।

দুপুরে ওরা খেতে গেলো একটা বাঙালি রেস্টুরেন্টে। নাম ভোজন বিলাস। চৈতালী আশ্চর্য হয়ে দেখলো রেস্টুরেন্টের গায়ে বাংলায় লেখা “মৃত্যু এবং ভালবাসা দুইটা জিনিসই না জানিয়ে আসে”
খেতে খেতে চৈতালী বললো- এখানে এত জাদুঘর কেন??
– হুম অনেক জাদুঘর। এজন্যই তো বার্লিন কে মিউজিয়াম নগরীও বলে। বার্লিন কে ইউরোপের রাজধানী বললেও ভুল হবে না।

খাওয়া দাওয়ার পর রাফসান বললো- চল দোতালা বাসে উঠবো।
– দোতলা বাস কেন? ইস এখানে যদি রিকশা পাওয়া যেত। এত সুন্দর শহরে তোমার সাথে রিকশায় ঘুরতে পারলাম না। এই আফসোস আমার কোনদিন যাবে না।

রাফসান হেঁসে ফেললো। তারপর বললো – এরপর যখন আসবো তখন এদেশের রাষ্ট্র প্রধান কে বলবো তোর জন্য একটা রিকশার ব্যবস্থা করতে।
– তুমি আমার সাথে মশকরা করছো?? রেগে গিয়ে বললো চৈতালী।
– অত সাহস আমার নেই ম্যাডাম। আমার ঘাড়ে একটাই মাথা।
রাফসানের কথায় চৈতালী আরেক দফা রেগে গেলো।

দোতালা বাসের দোতালায় রাফসান চৈতালী কে নিয়ে বসলো। রাফসান বললো- এই বাস গুলো সাধারণত সব জায়গায় যায়। দোতালায় বসতে পারলে শহরের অর্ধেক ভিউ দেখা যায়।
তারপর ওরা গেলো বার্লিন ক্লক দেখতে। চৈতালী খেয়াল করলো এই ক্লকে ১৪৮ টি দেশের বর্তমান সময় দেখা যাচ্ছে। তার বার্লিন গেট, বার্লিন গেট থেকে একটু সামনে পার্লামেন্ট ভবন।

চৈতালীদের ঘুরতে ফিরতে রাত হয়ে গেলো। রাতে ডিনার করার সময় রাফিয়া জানতে চাইলো বার্লিন কেমন লেগেছে?? কি কি দেখলি??
চৈতালী উচ্ছ্বাসের সাথে কি কি দেখেছে তার বর্ণনা দিতে লাগলো।
রাফিয়া চৈতালী কে জরিয়ে ধরে বললো- এভাবেই ভাল থাক চৈতালী। সারাজীবন আমার ভাইকে নিয়ে খুশি থাক।

চৈতালী একটু থমকালো। সত্যিই তো সে একটু বেশিই সুখী না? সব কেমন তাড়াতাড়ি পেয়ে গেছে। এত সুখ সইবে তো?
ভেতরে ভেতরে চৈতালী কি একটু কেঁপে উঠলো??
(ক্রমশ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here