#শত্রু_শত্রু_খেলা
#পর্ব_৪
#মেঘা_সুবাশ্রী (লেখিকা)
নিস্তব্ধ নিশুতি রাত। ঘড়ির কাটায় মধ্যরাত পেরিয়েছে অনেক আগে। বিক্ষিপ্ত মন নিয়ে প্রিয়া বসে আছে বারান্দার এককোণে। দুপুর থেকে অভুক্ত থাকলেও রাতে আনোয়ার এসে ভাত খাইয়ে দিয়েছে। বাবার কাছে অঝোরে কেঁদেছে প্রিয়া। মা তাকে শুধু শুধু ভুল বুঝেছে। বাবা আদর করে বলে গেছে না কাঁদতে। তার মা’কে সে বুঝাবে।
প্রিয়ার মন বিক্ষিপ্ত হলেও তার ভাবনায় অন্যকিছু ভর করছে এখন। টিটু ছেলেটা বাড়ি যায়নি সে শ্রাবণের সাথে আছে। কি করছে কে জানে। টিটু বলেছে সে পরেরদিন যাবে। একটা দিন সে ফেণী শহরে ঘুরতে চাই। রাঢ়ী রেগে থাকলেও অনেক অনুরোধের পর তাকে একটা দিন থাকার অনুমতি দিয়েছে। সকালে সবাইকে উৎসবে আসতে বলেছে। সেখানে কিছুক্ষণ আড্ডা দিবে আর খাওয়া-দাওয়া করে টিটু তার শহর সিলেটের উদ্দেশ্য রওনা দিবে।
প্রিয়া আকাশের দিকে তাকিয়ে তপ্ত নিশ্বাস ছাড়ে। শহরের মানুষ গভীর নিদ্রায় নিমগ্ন। কিন্তু প্রিয়া নিদ্রাহীন বিমূর্ত বসে আছে। তার চোখ পড়ে সৌরভের বারান্দার দিকে। ঐ ব*জ্জাত কত শান্তির ঘুম দিচ্ছে। কিন্তু সে আছে এক নরক যন্ত্রণা নিয়ে। বারান্দা থেকে তার চোখ পড়ে নিচে পার্ক করা সৌরভের বাইকের উপর।
প্রিয়ার মাথায় কি আসলো সে নিজেই জানে না। আনমনে হুঁশ-জ্ঞান খুঁইয়ে নিচে নেমে আসে। বাইকের সামনে দাঁড়িয়ে ভাবে সে, এই বাইককে কি করা যায়। আচমকা চোখ যায় নালার কালচে বিদঘুটে দুর্গন্ধময় পানির দিকে। তারপর কুটিল হাসে আপনমনে।
নালার পাশে অসংখ্য ব্যাঙের ছড়াছড়ি। সে একটা পলিব্যাগ খুঁজে কয়েকটা ভরে নেয়। তারপর তিনতলার ঘুমন্ত সৌরভের বারান্দার দিকে তাকিয়ে কুটিল হাসে। মনে মনে বিড়বিড় করে।
অ্যাব তো ম্যাজা আইগ্যা।
_________
প্রিয়ার ঘুম ভা*ঙে তার মায়ের হাসির আওয়াজে। দেওয়াল ঘড়িতে সময় দেখে সকাল ৭টা বাজে। বিছানা ছেড়ে ড্রয়িং রুমে আসে দেখার জন্য তার মা এত হেসে হেসে কার সাথে কথা বলছে। কিন্তু সে যা দেখলো তাতে স্তব্ধ হয়ে গেল। মনে মনে একশ একটা গা*লি ছুড়লো সৌরভের দিকে। এই সার্কাস তাদের ঘরে সকাল সকাল কি করছে?
সৌরভ অদ্ভুতভাবে প্রিয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। কিছুটা আঁকাবাঁকা পিঠে ছড়ানো উষ্কখুষ্ক চুল আর চোখমুখ ফোলা ফোলা। গায়ে লং গেঞ্চির সাথে কুঁচকানো ওড়না আর পরনে প্লাজু। এই প্রথম এলোমেলো প্রিয়াকে দেখছে সে। তার কাছে ভীষণ অন্যরকম লাগছে।
মারিয়াও অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে আছে প্রিয়ার দিকে।
প্রিয়া ভাবলেশহীন তাকিয়ে আছে দুজনের দিকে। মুখে কিছুই বললো না। সে আবার চলে যেতেই লাগলো আগের মত। পিছন থেকে মারিয়া ডাক দিলেন।
প্রিয়া যা তো সৌরভের জন্য এক বাটি নুডলস নিয়ে আয় তো।
সৌরভ আৎকে উঠলো মারিয়ার কথা শুনে। মুখে বার বার নিষেধ করলো। কিন্তু মারিয়া চুপ করে বসতে বললো তাকে। অগত্য বসতে হলো সৌরভকে। সে নিজেই জানে না তার জন্য কি অপেক্ষা করছে।
প্রিয়া গজগজ করতে করতে কিচেনে আসে। এক বাটিতে নুডলস নিয়ে আসার পথে মরিচের দিকে তার দৃষ্টি পড়ে। আনমনে হেসে উঠে। খাওয়াচ্ছি নুডলস দাঁড়াও।
একবাটি নুডলসের সাথে এক গ্লাস পানিসহ সৌরভের সামনে টেবিলে রাখে। সৌরভ নুডলসের বাটি হাতে নিয়ে কেমন দো’টানায় পড়ে যায় খাবে কি খাবে না। কিন্তু মারিয়ার অনুরোধ সে ফেলতেও পারছে না। তাই বাটি থেকে এক চামুক মুখে দিতেই তার সারা শরীর জ্বালে শিরশির করে উঠলো। মুখে কিছু প্রকাশ করলো না তবে সামনে দাঁড়ানো প্রিয়ার দিকে তাকিয়ে মেকি এক হাসি দিলো।
মারিয়া তখন একটা ফোনকলের জন্য অন্যরুমে গিয়েছেন।
সৌরভ শান্ত গলায় বললো প্রিয়া তুমি কি লবণ দিতে ভুলে গেছো? লবণ কিন্তু কম হয়েছে নুডলসে।
প্রিয়া চক্ষুদ্বয় গোল গোল করে ভাবতে লাগলো আমি তো মরিচ দিয়েছি লবণ আসলো কোত্থেকে? আমতা আমতা করে বললো লবণ কম হয়েছে? সত্যিই!
কেনো বিশ্বাস হচ্ছে না আমার কথা তাহলে একচামুক খেয়ে দেখো। এক চামুচ প্রিয়ার দিকে এগিয়ে দিলো সে। প্রিয়াও না বুঝে সেই চামুক মুখে নিলো। ব্যস, প্রিয়ার মুখ জ্বালে লাল হয়ে উঠলো। মুখে কোনো কথা না বলে সে বেসিনের দিকে দৌড় দিলো।
জ্বালে হিস হিস করতে থাকা সৌরভ হাসতে হাসতে ঘর থেকে বেরিয়ে আসলো।
নিচে এসে বাইকে করে সে কোচিং এর উদ্দেশ্য রওনা করে। কিন্তু বাইক চলাকালীন তার কাছে খুব বি*শ্রী এক দুর্গন্ধ এসে নাকে লাগলো। গন্ধ ক্রমান্বয়ে বাড়তেই লাগলো। সে হাজার ভেবেও বুঝতে পারে না এই গন্ধ আসছে কোত্থেকে?
কোচিং করাতে গিয়ে স্টুডেন্টরা বার বার নাক চেপে ধরছে। পরে গন্ধে টিকতে না পেরে একজন স্টুডেন্ট বললো ভাইয়া আপনার প্যান্ট থেকে কেমন বিদঘুটে গন্ধ আসছে।
সৌরভ অবিশ্বাস্য নয়নে তাকালো। কি বলছে এই ছেলে। না চাইতেও সে প্যান্ট শুঁকে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো। ল*জ্জায় চোখ মিলাতে পারছে না সে। তার মত এত পরিস্কার গোছানো ছেলের পোশাক থেকে গন্ধ বের হওয়া নিঃসন্দেহে তার জন্য চরম বিব্রতকর। সে উঠে দাঁড়ালো বাড়ির উদ্দেশ্য। আজকে আর কোচিং করানো যাবে না।
__________
রেস্টুরেন্ট উৎসবে বসে আছে টিটুসহ বাকি চার বন্ধু। আড্ডায় আর খাওয়ার মাঝে তাদের সময় যাচ্ছে।
গোল টেবিলে সবাই এক সাথে বসেছে। টিটু বসেছে রাঢ়ী আর প্রিয়ার মাঝে। টিটু খাওয়ার মাঝে মাঝে প্রিয়ার সাথে কথা বলছে।
ঢাকা থেকে আগত দীর্ঘদিন পরে বন্ধুর সাথে দেখা করতে সেই রেস্টুরেন্টে সৌরভও এসেছে। তারা অন্য এক টেবিলে বসে দীর্ঘ আলাপনে ব্যস্ত। তখন সৌরভের বন্ধু পরশ বলে দোস্ত ঐ মেয়েটাকে দেখ অসাধারণ না! সৌরভ পরশের কথা শুনে চকিতে মাথা ঘুরায় দেখার জন্য কোন মেয়ে। কিন্তু যা দেখে তাতে তার চক্ষু ছানাবড়া। প্রিয়াকে দেখে পরশ অসাধারণ বলছে। সে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকালো প্রিয়ার দিকে। চিরুনি অভিযান চালিয়েও সে এই মেয়ের মধ্যে কোনো অসাধারণ কিছু পেলো না।
সৌরভ ব্যঙ্গাত্মক এক হাসি দিলো পরশের উদ্দেশ্য। তারপর বলে উঠল তুই আর মেয়ে খুঁজে পেলি না। পরশ বিস্মিত হয়ে বলল তুই মেয়েটাকে চিনিস? সৌরভ আবার হেসে বললো শুধু মেয়েটাকে না তার বাসায় কয়টা হাড়ি-পাতিল আছে তাও জানি। আজকে কি রান্না করেছে তাও জানি। পরশ খুশিতে বাক-বাকুম করতে লাগলো। কিন্তু তার খুশিতে সৌরভ এক বালতি পানি ঢেলে দিলো। চোখমুখ খিচে বললো অন্য মেয়ে দেখ ঐ মেয়েটাকে ছাড়া। পরশ মেকি হাসি দিয়ে বললো তাই নাকি? মেয়েটার সবকিছু জানিস, তাকে ভালো করে চিনিসও। তাহলে আমাকে বলতে কি সমস্যা? না-কি নিজের জন্য ঠিক করে রেখেছিস? তাই আমাকে কিছুই বলছিস না।
পরশের এহেন বাক্য শুনে সৌরভ রাগে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো। হাতের বাহু ধরে বললো চল তোকে ঐ মেয়ের সাথে পরিচয় করাবো। তবে এরপর যদি কিছু হয় তার জন্য আমি দায়ী নয়।
পরশ এক চিলতে হাসি দিয়ে প্রিয়ার সম্মুখে দাঁড়ালো। প্রিয়া ভড়কে গেলো এভাবে তার সামনে এক অজ্ঞাত ছেলেকে দেখে। কিন্তু পাশেরজনকে দেখে মুখশ্রী শক্ত করে রাখলো। উষ্ণ শ্বাসের সাথে রাগ থরথর করে বাড়লো তার। এই ছেলে আজকেও তাকে ফলো করছে। কিন্তু যাই হয়ে যাক সে আজকে ভয় পাবে না।
পরশ কোমল গলায় বলল তুমি সৌরভকে চিনো তাই না। প্রিয়া মুখে কোনো কথা না বলে চুপচাপ শুনে যাচ্ছে। এই ছেলের মতলব কি বুঝার চেষ্টা করছে।
পরশ পুনরায় বললো তুমি সৌরভের কি হও?
প্রিয়ার মেজাজ চটে গেল পরশের কথা শুনে। কপাল কুঁচকে বললো কি হয় মানে? কি বোঝাতে চাইছেন আপনি? উনাকে আমি চিনি না বুঝতে পারছেন। আপনি কোথায় থেকে উদয় হয়েছেন এসব ফালতু কথা বলার জন্য। যান তো এখান থেকে।
পরশ আলগোছে হেসে উঠল। বাহ্! তোমরা তো দেখি ভালোই অভিনয় করো দুজনে। তা দুজনের সম্পর্ক কত দিনের? কোনো সমস্যা নেই আমার ভাবী পছন্দ হয়েছে।
বিস্ফোরিত নয়নে তাকালো প্রিয়া, সৌরভসহ উপস্থিত থাকা বাকি সবাই।
রাঢ়ী ফিসফিস করে বললো তাহলে এই জন্য তুই আমাদের সামনে সৌরভ ভাইয়ার নাম শুনলে রেগে যেতি।
শ্রাবণ আর নীল তখনো ঘোরের মধ্যে আছে।তাদের বন্ধুত্বের এই প্রতিদান দিলো প্রিয়া। এভাবে চেপে গেছে তার আর সৌরভের সম্পর্ক। টিটু বেচারা চুপচাপ খেয়ে যাচ্ছে তার মাথা ব্যথা নেই এখানে কি হচ্ছে?
পরশ দাঁত কেলিয়ে তখনও হেসে চলেছে।
হতভম্বের মত একে অপরের দিকে চেয়ে আছে প্রিয়া আর সৌরভ। দুজনেই কিংকর্তব্যবিমূঢ়।
চলবে,,,,,,,,,
এই পরশ কি এদের সম্পর্কের মোড় ঘুরাবে নাকি আরো তিক্ত করে তুলবে? আপনাদের কি মতামত?
বি:দ্রঃ রাঢ়ী নামটা আসলে সমাস পড়তে গিয়ে পেয়েছিলাম। আমার ভালো লেগেছিল তখন। তবে সত্যি দুঃখিত! আপনাদের হয়তো অনেকের ভালো লাগেনি। কিন্তু এখন চাইলেও চেইঞ্জ করতে পারবো না। চেইঞ্জ করতে গেলে গল্পের সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে যাবে। তবে চিন্তা করবেন না ওতো আর গল্পের নায়িকা না। খুব বেশি তাকে নিয়ে আর লেখাও হবে না। তাই একটু কষ্ট করে পড়ে নিয়েন প্লিজ।