#শত্রু_শত্রু_খেলা
#পর্ব_৩৭
#মেঘা_সুবাশ্রী (লেখিকা)
জমকালো অনুষ্ঠানের মাধ্যমে গৌরব আলিশবার রিসিপশনের আয়োজন করা হয়েছে। আলিশবার বাবা-মা গতকালই বাংলাদেশ এসে পৌঁছান। তাই মাসুদ পরেরদিনেই রিসিপশনের আয়োজন করে।
আলিশবা বউয়ের সাজে সজ্জিত হয়ে চুপটি হয়ে বসে আছে। তার পাশে শোভা আর প্রিয়াকে বসিয়ে রেখেছে। চারপাশে মানুষে গিজগিজ করছে। প্রিয়ার ভীষণ অস্বস্তি লাগছে এভাবে বসে থাকতে। সে উঠতে চাইলে শোভা তাকে ধরে রাখলো। শোভা প্রিয়ার কানে ফিসফিস করে বললো,
আমার ভাইকে বুঝি খুব মিস করছো। চিন্তা করো না, একটু পর এসে যাবে তোমার জামাই।
শোভার কথাতে বেশ লজ্জা পেলো প্রিয়া। উঠতে গিয়েও আর উঠলো না। চুপটি করে বসে পড়লো। কিন্তু সত্যিই তার হাঁসফাঁস লাগছে একজনকে দেখার জন্য। সকাল থেকেই তাকে দেখেনি। এভাবে প্রায় আধাঘন্টা অতিবাহিত হওয়ার পর আচমকা প্রিয়ার দু’আঁখি কারো হাতের বলিষ্ঠ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে গেল। অতর্কিতে এমন হওয়াতে প্রিয়া ভড়কে গেলো। লজ্জায় বলতেও পারছে না কে হতে পারে? প্রিয়ার এমন অসহায় অবস্থা থেকে শোভা হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেলো। আলিশবাও মুখ টিপে হাসছে। আহ! বেচারি।
প্রিয়া অবশেষে না পেরে অজ্ঞাত ব্যক্তির হাতখানা চেপে ধরে ছুটালো। কিন্তু চোখ খুলে যাকে দেখলো তাতেই মেজাজ বিগড়ে গেলো। মুখ খুলে কিছু অশ্রাব্য ভাষাও প্রয়োগ করলো তার উপর। প্রীতি সেই তখন থেকেই দাঁত কেলিয়ে হেসেই যাচ্ছে। প্রিয়ার মেজাজ তুঙ্গে এই মেয়ে সবার সামনে তাকে লজ্জায় না ফেললে চলে না। অসভ্য একটা। প্রীতি প্রিয়ার হাত ধরে আফসোসের সুরে বললো,
আহারে বেচারি মনে মনে জামাই ভাবছিলো।
প্রিয়া কপালের রগ ফুলিয়ে সেখান থেকে প্রস্থান করলো। সবগুলাই একঘাটের মাঝি তার মজা উড়ানো ছাড়া আর কিছুই পারে না।
মাসুদ আরাভকে কোলে নিয়ে বসে আছে। নাজমা আত্নীয়-স্বজনের তদারকি করছেন। সৌরভের বন্ধুরা প্রধান ফটকের সামনে দাঁড়িয়ে আছে অতিথিদের অভ্যর্থনা জানাতে। সবার মাঝে সানির অক্ষি জোড়া একজনকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। তার দেখা পেলেই হলো আজ। রকি নির্বাক দাঁড়িয়ে আছে পাশে। তাদের মধ্যে আসলজন এখনো মিসিং। সৌরভ গৌরব এখনো হলে এসে উপস্থিত হয়নি।
নীল, শ্রাবণ আর লুবনা এসেছে বন্ধুরা মিলে। সবগুলাই প্রিয়াকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। প্রিয়া হলের এককোণে বসে থাকে চুপ হয়ে। নীল, শ্রাবণ আর লুবনা গিয়ে তাকে ডাক দেয়। প্রিয়া এদের দেখে আলতো করে হাসে। নীল সৌরভের কথা জিজ্ঞেস করে। প্রিয়া আনমনা হয়ে বলে জানি না। গাড়ি করে একসাথে হলে এসেছি কিন্তু এরপর কোথায় হাওয়া হয়েছে কে জানে। আর দেখিনি আমি।
শ্রাবণ অনেক আফসোস করলো প্রিয়ার জন্য। লুবনার মুখে হাসি হলেও মনের মাঝে এক সমুদ্র পরিমাণ কষ্ট। সৌরভ কেনো তাকে ভালোবাসলো না। খুব কি ক্ষতি হতো তাকে ভালোবাসলে? তাদের আলাপনের মাঝে রাঢ়ী উপস্থিত হয়। বেনারসি শাড়ি পড়ে একদম নববধূ সেজে পরশের সাথে দাঁড়িয়ে আছে সে। প্রিয়া, নীল, শ্রাবণ, লুবনা মুগ্ধ হয়ে তাদেরকে দেখছে। দু’জনকে অসম্ভব সুন্দর লাগছে। রাঢ়ী লাজুক ভঙ্গিতে তাদের সামনে আসলো। প্রিয়া এক ভ্রু উঁচিয়ে তাকে বললো,
আসসালামু আলাইকুম ভাবী। ভালো আছেন।
রাঢ়ী প্রিয়ার সালাম পেয়ে চমকে উঠলো। তার মনেও দুষ্টবুদ্ধি চাপলো। সে সালাম নিলো প্রিয়ার। তারপর উল্টো সেও বললো,
জ্বী, ভাবী ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন ভাবী?
এদের দু’জনের কথোপকথনে বাকি’রা হতবাক। কিন্তু বেচারি লুবনা আবারও একরাশ হতাশায় ডুবে গেলো। ইশ! সেও যদি এরকম কাউকে বিয়ে করতে পারতো।
পরশ দু’বান্ধুবীর খুঁনসুটি দেখে মুগ্ধ হয়ে গেল। অবশ্যই রাঢ়ীকে বউ হিসেবে পেয়ে সে ধন্য। মেয়েটা অনেক বুঝদার। এত অল্প বয়সে খুব সহজে তাদের পরিবারকে গুছিয়ে নিয়েছে। সে রাঢ়ীকে একপাশে ডাকলো। রাঢ়ীও গুটি গুটি পায়ে তার দিকে এগিয়ে এলো। পরশ তার দিকে মিষ্টি করে হেসে বললো,
তুমি এখানেই থাকো। দূরে কোথাও যেও না। আমি সৌরভের কাছে আছি। কেমন? কিছু প্রয়োজন হলে কল দিও। মনে থাকবে তো।
রাঢ়ীও মিষ্টি করে হেসে মাথা নাড়ালো। তাদের দু’জনের গোপন আলাপন দেখে প্রিয়া তাদেরকে উদ্দেশ্য করে বললো,
রাঢ়ী তোরা এখানে এসেও রোমান্স করছিস? বাসায় কি করিস সারাদিন?
প্রিয়ার মুখে এমন কথা শুনে রাঢ়ী অবাক হয়ে গেলো। তবে মনে মনে পরশকে দুষলো। সব তার দোষ, কি দরকার ছিল সবার সামনে কথা বলার? পরশ কিছু বললো না। হাসতে হাসতে সেখান থেকে প্রস্থান করলো।
প্রিয়ার নির্লিপ্ত ছাউনি প্রধান ফটকের দিকে। তার সৌরভ কবে আসবে? তাকে দেখছে না অনেক্ষণ ধরে। তার ভাবনার মাঝেই চোখ পড়লো অতি সুদর্শন শ্যামবর্ণ বলিষ্ঠ এক যুবকের দিকে। গায়ে কালো স্যুটকোট পরা, গলায় মেরুন রঙের ট্রাই বাঁধা আর পায়ে কালো বুট। এই অত্যন্ত অপরুপ পুরুষটি তার নিজের একান্তই প্রিয় মানুষ। সে আরও একবার এই পুরুষটির প্রেমে পড়লো। সেই প্রথমদিনের মত। সেদিন তিন তলার বারান্দা থেকে সদ্য জগিং করে আসা এই যুবককে দেখে সে থমকে গিয়েছিলো। তার পরনে সেদিন শুধু টাউজার আর গায়ে টিশার্ট ছিলো। কত মুগ্ধতায় সে তাকিয়ে ছিল সেই অপরূপ যুবকের দিকে। তবে বেশিক্ষণ থাকাতেই পারিনি লজ্জায়। কিন্তু লুকিয়ে লুকিয়ে কতবার এই পুরুষকে দেখেছে। সে হিসেব কি এই পুরুষ জানে। সে মুচকি হাসলো নিজের কথা ভেবে। তার নিজেরই তো সাহস নেই বলার,
আমি যে আপনাকে ভালোবাসি সেই তখন থেকে। আমিও তো আপনার অন্তরালের প্রেমিকা।
প্রিয়া ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে এখনো। কিন্তু ততক্ষণে হৈচৈ লেগে গেছে। সৌরভ গৌরব দু’জন একরকম সাজ দিয়ে এসেছে। দু’জনেই আলিশবার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আলিশবাকে পরীক্ষা করার জন্য। বলতে হবে এখানে গৌরব কে?
আলিশবা কেনো যেনো দ্বিধায় পড়ে গেলো। সত্যিই আজকে দু’জনকে একদমই আলাদা করা যাচ্ছে না। প্রিয়া এগিয়ে এলো সামনে। কিন্তু তাকে পরশ নিষেধ করলো। আজকে প্রিয়া ভাবী কোনো কিছু বলতে পারবে না। আলিশবা ভাবীর পরীক্ষা চলছে।
আলিশবা মনে মনে হাসলো। এই বদ দু’ভাইকে পিঠানো দরকার। এভাবে ভরা মজলিসে তার সম্মান নিয়ে টানাটানি। কিন্তু সে বিচক্ষণতার সাথে কিছু ভাবলো।
তারপর এগিয়ে এসে সে গৌরবের নাক টেনে ধরলো। গৌরব চিৎকার দিয়ে উঠল।
ওমাগো! কি বউরে তার।
উপস্থিত সবাই হো হো করে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো। গৌরব বউয়ের হাত ধরে স্টেজে গিয়ে উঠে। আলিশবার পাশে বসে ফিসফিস করে বললো,
বউ তুমি কিন্তু ইদানীং ভীষণ খারাপ হয়ে যাচ্ছো। এভাবে কেউ জামাইয়ের নাক ধরে টানে। ছিঃ! কি লজ্জার কথা। আমি এই মুখ কেমনে দেখাবো বলো।
আলিশবা রক্তিম চোখে তাকালো গৌরবের দিকে। তারপর ফিসফিস করে বললো,
তোমাদের দু’ভাইকে গণধোলাই দেওয়া উচিৎ। তোমরা আমাদেরকে কনফিউশানে রাখো শুধু। প্রথমে তো আমিও ভয় পেয়েছিলাম। যদি ভুল করি তো মান-সম্মান সব যাবে আজ। কিন্তু কথায় বলে না। একরকম দেখতে হলেও তোমাদের মাঝেও কিছু ভিন্নতা আছে। তাই তো আমিও তোমাকে ধরে ফেলেছি।
গৌরব আলিশবার কথা শুনে হেসে উঠল। কিন্তু পরক্ষণে আবার বলে উঠল,
জমজ হয়ে যদি মানুষকে একটু কনফিউশানে না রাখি কেমনে হবে। এটাই তো জমজ হওয়ার আসল ফায়দা।
খাওয়া দাওয়ার মাঝে চলছে জমজমাট আয়োজিত গৌরব আলিশবার রিসিপশানের অনুষ্ঠান। এত মানুষের ভীড়ে আকস্মিক এক ছেলে এসে প্রিয়াকে বলে,
হ্যাই, মিস আপনার নাম্বার পাওয়া যাবে।
প্রিয়া প্রথমে চমকালো অচেনা ছেলেটির কথা শুনে। কিন্তু মুখে কিছু বললো না। কারণ তার থেকে অদূরে দাঁড়ানো তার একমাত্র ব্যক্তিগত পুরুষ আছে। সে মনে মনে হেসে কুটি কুটি। দেখা যাক তার জামাই কি করে? সৌরভ প্রিয়ার দিকে তাকাতেই দেখলো অচেনা ছেলেটি তার কাছে নাম্বার চাইছে। তার মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষে চাপ পড়লো। আরে তার বউ নিয়ে টানাটানি। ভাবা যায়। সে দৌঁড়ে আসে প্রিয়ার কাছে। তারপর তার পাশে দাঁড়িয়ে ছেলেটিকে প্রশ্ন করলো,
পছন্দ হয়েছে।
ছেলেটি সৌরভের কথায় ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় প্রথমে। পরে লাজুক ভঙ্গিতে বলল হুম হয়েছে। সৌরভও সুযোগ বুঝে বললো,
তাহলে মেয়ের বাড়িতে প্রস্তাব পাঠাবে?
ছেলেটি এটা শুনে ভড়কে গেলো। সে তো মেয়েটির সাথে মজা করতে এসেছিল। বিয়ে নিয়ে তো কিছু ভাবে নি এখনো। আগে মেয়েটির সাথে আলাপ করবে তারপর না হয় অন্যচিন্তা ভাবনা করবে। সে সৌরভের জবাব দিতে ইস্ততঃবোধ করছিল। তাই দেখে সৌরভ বললো,
কি ব্যাপার! এত ছোট প্রশ্ন করলাম উত্তর দিতে পারছো না।
ছেলেটা আমতা আমতা করছিলো তখনো। কিন্তু সৌরভ প্রিয়ার কাঁধে হাত রেখে বললো,
সী ইজ ম্যাই ওয়াইফ। আর কিছু জানা লাগবে।
ছেলেটি বিস্ফোরিত চোখে তাকালো সৌরভের দিকে। তারপর দু’হাত জোড় করে তার কাছে ক্ষমা চাইলো।
ভাই আমার ভুল হয়ে গেছে। আর কখনো এমন ভুল হবে না। তারপর প্রিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল সর্যিই ভাবী ভুল হয়ে গেছে, আসি।
ছেলেটা যাওয়ার পর সৌরভ প্রিয়ার হাত শক্ত করে ধরলো। তারপর কপাল কুঁচকে বলল একদম আমার সাথে সাথে থাকবে। দূরে যাবে না। কখন অন্য কেউ এসে আমার বউ নিয়ে চলে যায় তার কোনো ঠিক নেই। আমার একটাই বউ শুধু।
চলবে,,,,,,,,,,,,,#শত্রু_শত্রু_খেলা
#পর্ব_৩৮
#মেঘা_সুবাশ্রী (লেখিকা)
কোচিং শেষ করে মাত্রই বেরিয়েছে সৌরভ। বাইকে দু’পা তুলে যেই চাবি ঘুরাতে যাবে আচমকা অপরিচিত এক পুরুষালি যুবকের কন্ঠস্বর শুনে থমকালো।
ভাই, আমি কি আপনার সাথে দু’মিনিট কথা বলতে পারি। খুব জরুরি ছিল।
সৌরভ বাইক থেকে নেমে পড়লো ছেলেটা কি বলতে চাই তাকে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে একবার ভালো করে পরখ করে তাকে। শুভ্রবর্ণ গায়ে আধা পুরানো ঢিলেঢালা ছাই রঙা শার্ট আর পরনে কালচে বর্ণের জিন্সপ্যান্ট। বলিষ্ঠ সুঠাম দেহ আর প্রশস্ত চওড়া কাঁধ। উচ্চতা তার সমান কিন্তু মুখভর্তি খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি আর উষ্কখুষ্ক চুল। চক্ষুদ্বয় কেমন ঘোলাটে আর লালচে হয়ে আছে দেখে মনে হচ্ছে এই ছেলের চোখ বিষাদের সরোবর। দেখতে অনেকটাই উদ্বাস্তুর মতই লাগছে। সে একধ্যানে তাকিয়ে আছে অচেনা এই যুবকের দিকে। সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
কিন্তু আমি তো আপনাকে চিনি না, কখনো দেখেছি বলেও মনে হচ্ছে না। কে আপনি?
অচেনা ছেলেটি দীর্ঘ এক শ্বাস ছাড়ে। মুখে তার মলিনতার ছাপ। সে সৌরভের দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের এক হাসি দিয়ে বলল,
আপনি আমাকে চিনবেন না। কিন্তু আমি আপনাকে চিনি। খুব ভালো করেই চিনি। আমি কি আপনার সাথে কোথাও বসে কথা বলতে পারি। খুব বেশি সময় নেবো কিন্তু। বলবেন তো ভাই।
সৌরভ কিছুক্ষণ ভাবলো। তারপর বলল ঠিক আছে চলুন।
দু’জন একটা রেষ্টুরেন্টে এসে বসে। সৌরভ কিছু অর্ডার করার আগেই সেই ছেলেটাই অর্ডার করে। সৌরভ নিষেধ করতে গিয়েও থেমে যায়। চুপচাপ ছেলেটার কার্যক্রম দেখে যাচ্ছে। বেশ কিছুক্ষণ নিরাবতার পর ছেলেটি বলে উঠল,
আমার নাম আর্দ্র সায়মন। আমি প্রিয়ার কাজিন হয়। তবে এর পরে অনেক কিছুই বলবো। তার জন্য আপনার কাছে বিশেষ অনুমতি চাইছি যাতে আপনি উত্তেজিত না হোন আমার পুরো কথা শুনেন।
সৌরভের ভ্রু আপনা আপনি কুঞ্চিত হয়ে গেলো আর্দ্রের কথা শুনে। কি এমন কথা বলবে যার জন্য সে উত্তেজিত হবে। সে উদ্বিগ্ন হলেও মুখে প্রকাশ করলো না। নিজেকে যথেষ্ট শান্ত রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে সে।
আর্দ্র কিছুক্ষণ ইতিউতি করছিলো পরে নিজের চাপ দাঁড়িতে হাত দিয়ে বললো,
আমি প্রিয়াকে ভালোবাসি গত চার বছর ধরে। দু’বছর আগে আমি প্রিয়াকে প্রপোজ করি। প্রিয়াও আমার প্রপোজ একসেপ্ট করে। আমাদের মাঝে ধীরে ধীরে প্রণয়ের সম্পর্ক গড়ে উঠে। কিন্তু এর মাঝে বাঁধ সাধে আমার বাবা। তিনি আমাদের সম্পর্কের তীব্র বিরোধিতা করেন। কারণ আমি প্রিয়াকে বিয়ে করার জন্যই প্রিয়ার বাবাকে প্রস্তাব দিয়েছিলাম। আমার বাবা শুধু বিরোধিতা করে ক্ষান্ত হননি বরং রীতিমতো প্রিয়ার বাবাকে অপমান শুরু করেন। যার রেশ ধরে পরিবারে ভাঙ্গনের শুরু হয়। আমি বাবার এসব তিক্ততার সম্পর্কের জন্য রেগে ঘর থেকে বের হয়ে যাই। নিজেকে নষ্ট করে দেয় বাবার উপর রাগ করে। কিন্তু আমি ভুলেই গেছিলাম সঙ্গদোষে লোহা ভাসে। আমার মন মস্তিষ্ক তখন এতটাই বিষিয়ে গিয়েছিল কোনটা খারাপ আর কোনটা ভালো বুঝতে পারছিলাম না। বাবার উপর প্রতিশোধ নিতে গিয়ে আমি আমার নিজসত্তাকেই হারিয়ে ফেললাম। কখন যে অপরাধের অতলে ডুবে গেলাম টেরই পায়নি। নেশা থেকে শুরু করে নারী কেলেংকারীতেও জড়িয়ে গেলাম। যতক্ষণে আমার হুঁশ হলো তখন অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। পুলিশ হাজতে ছিলাম দীর্ঘ তিন মাস। আমার মা প্রচুর কাঁদলেন। গ্রামের আশেপাশের মানুষ আমার বাবাকে ছিঃ ছিঃ করে ধিক্কার করলেন। আমার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন উঠলো চর্তুদিকে। মনে মনে তৃপ্তির হাসি দিলাম। কথায় বলে না নিজের নাক কেটে অপরের যাত্রা ভঙ্গ করা। ঠিক তেমনটাই আমার মনে হলো। নিজের চরিত্রকে কলুষিত করে বাবাকে শিক্ষা দিলাম। কিন্তু কি হলো দিনশেষে? আমার ভালোবাসার মানুষটাকে হারিয়ে ফেললাম চিরতরে। জানেন আমি যখন জেল হাজত থেকে বাড়ি আসলাম প্রিয়া একবারের জন্যও আমাকে দেখতে আসেনি। আমার হৃদয় রক্তক্ষরণ হলো এটা ভেবে। প্রিয়া আমাকে দেখলে মুখ লুকিয়ে রাখতো। অথচ এই মেয়েটাকে দেখার জন্য আমি সারাদিন মুখিয়ে থাকতাম। আমি আবার নিজেকে আগের রূপে ফিরে পেতে চাইলাম। নিজেকে সংশোধন করতে চাইলাম। নেশার কালো গ্রাস থেকে ফিরতে চাইলাম। তার আগে প্রিয়ার বাবার কাছে সময় চাইলাম। তার পা’ ধরে সেদিন প্রিয়াকে ভিক্ষে চাইলাম। তিনি আমাকে আশস্ত করলেন আমি যেদিন একদম আগের মত সেই আর্দ্র সায়মন হয়ে ফিরে আসতে পারবো সেদিন তিনি আমাকে প্রিয়াকে আমার হাতে তুলে দিবেন। আমিও তার কথা পাগলের মত বিশ্বাস করলাম। চলে গেলাম সংশোধন হতে। আগের সেই আর্দ্র সায়মন হতে। কিন্তু কি হলো সংশোধন হয়ে। যার জন্য নিজেকে নষ্ট করলাম আবার যার জন্য নিজেকে সংশোধন করে ফিরে এলাম সেই তাকেই আমি হারিয়ে ফেললাম। আপনি আমাকে বলবেন আমি ভালোবেসে খুব অন্যায় করেছিলাম। আমি কেনো প্রিয়াকে পেলাম না। সে কেনো আমার হয়েও হলো না।
আর্দ্র দু’চোখের পানি ছেড়ে দিয়েছে। ঝরঝর করে তার দু’চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। সে সৌরভের দু’হাত আঁকড়ে ধরে বলে উঠল,
আপনি কত ভাগ্যবান। এই দু’হাত দিয়ে প্রিয়াকে ছুঁতে পারেন। চাইলে নিজের বাহুবন্ধি করতে পারেন। কিন্তু অথচ আমার তার দিকে তাকানোর অধিকারও নেই। এত বড়ো শাস্তি কেনো পেলাম আমি। জানেন এই হৃদয়টা খুব পুড়ছে তাকে একবার দেখার জন্য। কিন্তু চাইলেও তাকে আমি দেখতে পারি না। এই জীবনে আমি তাকে পায়নি সেই জীবন রেখেই কি লাভ বলেন।
সৌরভ নির্বাক হয়ে আর্দ্রের কথা শুনছিলো। সান্ত্বনার ভাষা সে কিভাবে দিবে। আর কি বলেই দিবে। প্রিয়া তার স্ত্রী হয়। তবুও সে আর্দ্রকে সান্ত্বনা স্বরূপ বললো,
দেখুন আমি আপনার ভালোবাসাকে সম্মান করি। কিন্তু সে হয়তো আপনার ভাগ্যেই ছিলো না। তার জুটি আমার সাথেই ছিল। তাই আমিই তাকে পেয়েছি দিনশেষে। আপনার জন্যই হয়তো এমন কেউ আসবে যে আপনাকে ভালোবাসবে।
সৌরভের মুখে ভালোবাসার কথা শুনে আর্দ্র মুখে তাচ্ছিল্যের হাসি দিল। সে আনমনা হয়ে সৌরভকে অপলক দেখেই যাচ্ছে। আচমকা একটা প্রশ্ন করে বসলো,
প্রিয়া আপনাকে ভালোবাসে?
সৌরভ ইস্ততঃবোধ করছিল কি উত্তর দিবে। প্রিয়া তাকে ভালোবাসি না বললেও সে জানে তার প্রিয়ারানী তাকে ভালোবাসে। সে কিছুটা সময় নিয়ে বললো,
প্রিয়া শুধু আমার স্ত্রী নয়, আমার প্রেমিকাও বটে। হ্যাঁ তাকে ভালোবাসে।
আর্দ্র তপ্ত নিশ্বাস ছাড়লো। সে আবার পুনরায় জিজ্ঞেস করলো,
আপনাদের মধ্যে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক আছে।
সৌরভ কিছুটা অস্বস্তিতে পড়লো এমন প্রশ্নে। তবে তাকে যে এর মোক্ষম জবাবও দিতে হবে। তাই নিজেকে ধাতস্থ করলো উত্তর দিতে।সেও বিচক্ষণতার সাথে বললো,
স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক মানে বুঝেন। স্বামী স্ত্রী একে অপরের পোশাক স্বরূপ। আমি যেমন প্রিয়ার পোশাক ঠিক তেমনি ও আমারও পোশাক। আর কিছু জানতে চান।
আর্দ্র মলিন হাসলো। তারপর উঠে দাঁড়ালো তার দু’চোখ লুকাতে। খুব কাঁদবে সে। তার জীবনটাই বিষিয়ে গেছে। সবকিছু শেষ হয়ে গেছে তার। এলোমেলো কদমে সে হেঁটে চলেছে ব্যস্ত রাস্তার মাঝে। পেছনে সৌরভের বেদানার্ত দু’চোখ। আজকে ছেলেটা কাঁদছে বলে প্রিয়া তার। কিন্তু ছেলেটার চোখে হাসি থাকলে হয়তো তার জীবনে কখনো প্রিয়ার আগমন ঘটতো না। কত অদ্ভুত তাই না!
সৌরভও উঠে দাঁড়ালো বাড়ির উদ্দেশ্য। বাইক ছুটে চলছে দ্রুত গতিতে। তার মনেও আজ বিষাদের ছায়া। আচমকা তার বাইকের সামনে প্রচন্ড গতিতে একটা ট্রাক এসে ধাক্কা মারলো তাকে। সে কিছু বুঝার আগেই ছিটকে পড়লো বাইক থেকে রাস্তার পাশে।
______________________
প্রিয়ার পরীক্ষা শেষ হওয়ার আপাতত সে বাড়িতেই অবকাশ যাপন করছে। সারাদিন এটা সেটা করে তার কাটছে। মারিয়া আজকাল প্রিয়াকে রান্না করতে বলেন যাতে সে রান্নার কাজে কিছুটা পটু হয়। অবশ্য সে নিজ থেকেও রান্না করে। সৌরভকে লুকিয়ে লুকিয়ে সে রান্না করে খাওয়ায়। পড়ন্ত বিকেলের গোধূলী লগ্ন এখন। একটু পর সৌরভ ফিরে আসবে বাসায় তাই সে তার জন্য পাস্তা বানাচ্ছে।
প্রিয়া আনমনে পাস্তা বানাচ্ছে আর মুচকি হাসছে। তাদের বিয়ের একমাস হয়ে গেছে কিভাবে সে টেরই পায়নি। সময়গুলো কি দ্রুতই চলে যাই। তার পূর্ণ মনোযোগ যখন রান্নার দিকে। তখন আনোয়ার হন্তদন্ত হয়ে বাসায় আসেন। দ্রুতই মারিয়াকে ডাক দেন। প্রিয়া কিচেন থেকে এসে তার বাবাকে জিজ্ঞেস করে কি হয়েছে আব্বু?
আনোয়ার আমতা আমতা করছিল তখন। কিন্তু মুখ ফসকে বলে ফেলেন হাসপাতালে যেতে হবে আমাদের জলদি। তাদের কথোপকথনের মাঝে হঠাৎ নাজমার চিৎকার ভেসে আসে প্রিয়ার কানে। সবাই হন্তদন্ত হয়ে ছুটে যাচ্ছে নিচে। প্রিয়া দিগবিদিক হয়ে সেও ছুটে যায়। সবাইকে জিজ্ঞেস করে কি হয়েছে? কেউ তাকে উত্তর দিতে পারে না। আলিশবা বলে তুমি যাবে আমাদের সাথে তাহলে দ্রুতই গাড়িতে উঠো।
গাড়ি মাঝ রাস্তায় যাওয়ার পর আচমকাই ফোনকল আসে হাসপাতাল থেকে। রোগীর অবস্থা খুবই সিরিয়াস। তাকে ঢাকা নিয়ে যেতে হবে। এর পর আধা ঘন্টা না পেরুতেই আবার ফোনকল আসে রোগী মারা গেছে। গাড়ির মাঝে পিনপতন নীরবতা। নাজমা বেহঁশ হয়ে আছে।
প্রিয়া এখনো স্তব্ধ হয়ে গেছে কে রোগী তাকে কেউ কিছু বলছে না কেনো?
চলবে,,,,,,,,,,,,