#শহরজুড়ে_বিষন্নতা |০৬|
সাদিয়া মেহরুজ
সারতাজকে বেশ ব্যাস্ত দেখাচ্ছে।সে তাড়াহুড়ো করে নিজের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ব্যাগে রাখছে। এ লহমায় তার মুখশ্রী দেখে মনে হবে যেন রাজ্যের সব ব্যাস্ততা তার ঘাড়ে চেপে বসেছে। ভীষণ ভীষণ ব্যাস্ততার মাঝেই তার মুঠোফোনে কল এলো। কিঞ্চিৎ বিরক্তি নিয়ে কলদাতা ব্যাক্তির নাম না দর্শণ করেই ফোন রিসিভ করে কানে লাগাল। অপাশ হতে তৎক্ষনাৎ চাপা গলায় কেও শুধাল,
-‘ বাড়ি ফিরেছ শুনলাম। থাকাও শুরু করেছ নাকি! কি ব্যাপার ভাই? এতো এতো সম্পত্তির লোভ বুঝি এবার মাথা চাঁড়া দিয়ে উঠেছে? খুব তো বড় গলায় বলছিলে বাবার কোনো সম্পত্তি তোমার চাই না। ‘
সটান হয়ে দাঁড়াল সারতাজ। এটা তার ছোট ভাই শারাফের কন্ঠস্বর। যাকে কোলেপিঠে করে মানুষ করা তার। সারতাজ ধাক্কা সামলে নিল। গলার স্বর খাদে নামিয়ে বলল,
-‘ কাজে এসেছি। চলে যাচ্ছিলাম আর তোর ফোন।’
-‘ সত্যি বলছো নাকি মিথ্যা কিভাবে বুঝব? ‘
-‘ ইউজলেস কথাবার্তা! যেভাবে আমার আসার খবরটা পেয়েছিস সেভাবে নিশ্চয়ই আমার চলে যাওয়ার খবরটাও জানতে পারবি। ‘
-‘ রাখছি তবে। ‘
শারাফ কল কা টা র পূর্বেই সারতাজ ফোন কা টল। কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল শূন্যে। অতঃপর ধীরস্থ গতীতে বিছানায় গিয়ে বসলো। দৃষ্টিপাত ফেললো চারপাশে। তার ভীষণ পরিচিত কামড়াটা। ছোট থাকতে যখন এ বাড়িতে ছিলো তখন নিজের মতো করে গুছিয়ে নিয়েছিলো কক্ষটা। এ বাড়িটা যেখানে তার অজস্র সৃতি মিশে রয়েছে, বাড়ির সামনের সেই বাগানটা যেখানে তার কাটানো হাজারো বিকেলের সাক্ষী সবশেষে বাড়ির মানুষ গুলো?অথচ পৃথিবীর কি কঠিন সত্যত্যা দেখো, এসব কিছুই নাকি তার আপন নয়! সে কেবল এই বাড়ি এবং মানুষ গুলোর নিকট ছিল ক্ষণস্থায়ী মেহমান।
_
সালমার সামনে জড়তা নিয়ে বসে আছে মেহতিশা। অন্তঃকরণে তার ভীতি, সঙ্কোচ! নত মস্তকে নিশ্চুপ হয়ে ছিল সে। সালমার নীরবতা পালন তাকে আরো বেশি অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছে। তার অন্তরালে জমা হয়েছে একঝাঁক প্রশ্ন। সালমা কি তবে ভুল বুঝলেন তাকে? কথা কেনো বলছেন না? কয়েক প্রহর মৌন রূপেই কে টে গেল। অতঃপর নৈঃশব্দ্যে ধস নামাল মেহতিশা নিজেই। জড়তা নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-‘ আন্টি কিছু বলছেন না যে? ‘
সালমার থমথমে মুখোশ্রী স্বাভাবিক হলো। তিনি দুই, তিনবার লম্বা শ্বাস ফেললেন। নেত্রপল্লব ঝাপটালেন ঘন ঘন। শুষ্ক গলদেশ সিক্ত করলেন ঢোক গিলে। বলে উঠলেন,
-‘ তোকে কি আর বলবো? আসলে দোষটা আমারই মেহতিশা। আমি হয়তো তোর সাথে অতোটা ফ্রী হতে পারিনি তাই তুই সব কথা আমায় খুলেও বলতে পারিসনি দ্বিধায়। ‘
-‘ প্লিজ আন্টি। নিজেকে দোষারোপ করবেন না। আমি আসলে..আপনাকে বলবো ভাবছিলাম কিন্তু পরে মনে হলো অযথা আপনাকে টেনশন কিংবা কষ্ট দেয়ার কি দরকার। তাই আর বলিনি। ‘
-‘ আচ্ছা বুঝলাম! এখন কি করবি? অনিককে তোর শা স্তি দেওয়া উচিত না মেহতিশা। ছেলেটা কতোটা জ ঘ ন্য! না জানি আরো কতো মেয়ের জীবন এভাবে ধ্বংস করেছে। তুই যদি এখন চুপ থাকিস তাহলে ও প্রশয় পাবে। তোকে হয়তো আর জ্বালাবে না ভয়ে কিন্তু অন্যকেও কিন্তু ছাড় দেবেনা। ‘
-‘ জানি আন্টি। আমি অনিককে কখনোই এভাবে সুখে থাকতে দিবোনা। ও আমার জীবন নষ্ট করেছে, কষ্ট দিয়েছে, মিথ্যা বলেছে। অন্য একটা মেয়ের জীবন নষ্ট করার আগে আমি ওকে আইনের হাতে তুলে দিব। কিছু প্রমাণ জোগাড় করা দরকার। ‘
-‘ কোনো সাহায্যের প্রয়োজন হলে বলিস। ‘
বিরস চেহারা নিয়ে সালমা উপরে চলে গেলেন। রেখে গেলেন অনুশোচনায় ভোগা মেহতিশাকে।
_
চাকরির একমাস পূর্ণ হয়েছে আজ মেহতিশার। ১০ হাজার টাকা বেতন ঠিক হয়েছিল তার। পারিশ্রমিক হাতে নিয়ে সে সর্বপ্রথম বাবা – মা’র কথা মনে করলো। তার বাবা ছেঁড়া, শত তালি দেয়া পাঞ্জাবি পড়তো। অভাবের সংসার তাদের, যেখানে খাবার জোগাড় করতেই হিমশিম খেতে হতো বাবা – মার সেখানে পোশাক কেনা তো স্বপ্ন কেবল! তবুও মেহতিশার বাবা মা চেষ্টা করতো মেয়েদের ইচ্ছে পূরণ করতে। নিজেরা তালি দেয়া পোশাক পড়লেও মেয়েদের পড়াতো ভালো পোশাক। মেহতিশা কেবল ভাবতো তখন, যখন সে চাকরি করবে তখন চাকরির প্রথম মাসিক বেতন দিয়ে বাবাকে পাঞ্জাবি আর মাকে শাড়ী কিনে দেবে। আজ তার হাতে টাকা আছে কিন্তু বাবা মা পাশে নেই।
সালমার জন্য একটা শাল এবং মেহজার জন্য স্বল্প দামে একটা সোয়েটার কিনে বাড়ি ফিরল মেহতিশা। সর্বপ্রথম সে শাল হাতে নিয়ে ছুটলো সালমার রুমে। মেহজা সেখানেই ছিলো। মেহতিশা দেখা মাত্রই সে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলো বোনকে। সালমা হেঁসে বললেন,
-‘ মাত্র ফিরলি নাকি? আয় ভেতরে। ‘
মেহতিশা মেহজা নিয়ে প্রবেশ করলো ভেতরে। জবাব দিলো,
-‘ এক্ষুণি ফিরলাম আন্টি। এটা আপনার জন্য। ‘
-‘ কি এটা? ‘
-‘ খুলে দেখুন। ‘
সালমা ব্যাগটা হাতে তুলে নিল। ব্যাগের ভেতর থেকে বের করলো লাল রঙের শাল। ভারী সুন্দর দেখতে। মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে দেখল কিছুক্ষণ। তবে ক্ষণিক বাদে কড়া কন্ঠে বলল,
-‘ বেতন পেয়েই এই আকাম করেছিস তাই না? ‘
মেহতিশা হেঁসে বসলো সালমার পাশে। মিহি কন্ঠে শুধালো,
-‘ আকাম না ভালো কাজ এটা। আগে বলুন তো দেখি, আপনার পছন্দ হয়েছে কিনা? ‘
-‘ তা হয়েছে। তোর পছন্দ খারাপ হয় কখনো? কিন্তু আমার জন্য না এনে মেহজার জন্য কিছু আনলেও তো পারতিস। ‘
-‘ এনেছি তো ওর জন্য। ‘
-‘ আর নিজের জন্য? ‘
মেহতিশা নিশ্চুপ রইল এবার। আমতা আমতা করে প্রতিত্তোর করতে নিলেই তাকে ধমকালেন সালমা।
-‘ ফাজিল মেয়ে! সারাজীবন অন্যের কথাটাই তুই ভেবে যাবি। নিজের শখ, আহ্লাদ বলতে কিছু নেই?’
-‘ আমার কোনো শখ নেই আন্টি। আমার কাছের মানুষ গুলো খুশি হলেই আমি খুশি। ‘
-‘ বড়দের মতো কথা শিখেছিস। ‘
মেহতিশা শব্দ করে হাসল! সালমা মুগ্ধ দৃষ্টিতে পরখ করলেন সেই হাসি। মেয়েটা হাসছে অথচ হাসির আড়ালে মাটি চাপা দিয়েছে নিজের তিক্ত অতীত, কষ্ট! সালমা কয়েকপল চুপ রইলেন। তারপর হুট করে মনে পড়ে যাওয়ার মতো ভঙ্গি করে বললেন,
-‘ ওহ ভালো কথা। বাসা দেখেছিস নাকি? মেহজা আমায় বললো। ‘
-‘ জি আন্টি। এই কাছাকাছি উঠব। চৌরাস্তার মোড়ে দুই তলা যেই পুরোনো বাড়িটা সেখানকার নিচ তলায় ভাড়া নিয়েছি। ‘
সালমা মরা গলায় শুধালেন,
-‘ চলেই যাচ্ছিস তবে। এতদিন ভালোই ছিলাম এখন আবার একা হয়ে যাবো। ‘
মেহতিশার অন্তঃকরণ ছটফট করে উঠল কিছু জিজ্ঞেস করার আকাঙ্খায়। শেষে সাহস নিয়ে সে প্রশ্ন করেই বসলো,
-‘ আন্টি কিছু মনে করবেন না একটা কথা জিজ্ঞেস করি? ‘
-‘ হ্যা বল! ‘
-‘ আঙ্কেলকে এ বাসায় দেখলাম না আসার পর থেকে। আর আপনার বড় ছেলে সারতাজ। উনি কেন আপনাদের সাথে থাকেন না? ‘
ফ্যাকাশেটে বর্ণের হলো সালমার মুখোশ্রী। মুখোবয়বে ভেসে উঠেছে বেদনার চিহ্ন। মেহতিশা সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে খেয়াল করলো তা। সালমা নিষ্প্রাণ চাহনি ফেললেন সম্মুখে। কণ্ঠে থমথমে ভাব টেনে বললেন,
-‘ তোকে আমি একবার একটা কথা বলেছিলাম যে, তোর মায়ের কাছে ঋণী আমি। মনে আছে নিশ্চয়ই কথাটা। সে কথা বলার কারণটা বলি শোন, সারতাজ আমার আপন পেটে ধরা সন্তান না। আমার আপন ছেলে দু’টো বিদেশে। শারাফ আর শাহিন। শাহিনের কথা মনে আছে তোর? ছোট বেলায় তো এ বাড়িতে এলে ওর সাথেই খেলতি। সারতাজকে পাওয়ার পিছনে সম্পূর্ণ তোর মায়ের অবদান রয়েছে। বেশ আগের কথা! অল্প বয়সে বিয়ে হয়েছিল আমার। বিয়ের পাঁচটা বছর কে টে যাওয়ার পরও বাচ্চার দেখা নেই। সারতাজের বাবা, দাদি অতিষ্ঠ করে ফেলছিলো আমাকে একটা বাচ্চা দেয়ার জন্য। ওরা আমাকে দিনে রাতে হুমকিও দিত বাচ্চা না হলে আমাকে তালাক দেবে। বাবা ছিলো না আমার। আমরা ছিলাম তিন বোন। বড় আপার আর মেঝ আপার বিয়ে হচ্ছিলো না কারণ তারা ছিলেন শারীরিক প্রতিবন্ধী। মা একা হাতে ইনকাম করে আপাদের চিকিৎসা চালাতে হিমশিম খাচ্ছিলো আর তার ওপর যদি আমার তালাক হয়ে যেতো তাহলে আমার মা স্ট্রোক করে মা রা যেতেন। তাই আমি প্রতি রাতে নামাজে আল্লাহর কাছে একটা সন্তান ভিক্ষা চাইতাম। তারপর একদিন আল্লাহ বুঝি আমার প্রতি মুখ তুলে তাকালেন। সন্তানসম্ভবা হলাম। কিন্তু ডেলিভারির সময় জানতে পারলাম আমার বাচ্চা মৃ ত জন্মেছে! সারতাজের বাবা তখন কথাটা জানতো না। হটাৎ করে প্রসব ব্যা থা উঠায় আমায় হসপিটালে নিয়ে আসে তোর মা। তোর মা তখন অনেকদিন হলো আমার বাড়িতে কাজ করে। মৃ ত সন্তানকে বুকে নিয়ে যখন আমি নিজের ভবিষ্যত এবং সন্তানের দুঃখে কাঁদছিলাম তখন কোথা থেকে যেনো একটা বাচ্চা নিয়ে এলো তোর মা। ফুটফুটে কি সুন্দর একটা বাচ্চা! পরে তোর মা আমাকে জানালো ঐ হাসাপাতালে এক গণিকার সন্তান হয়েছে। গণিকা তার সন্তানকে হাসপাতালের ময়লার ঝুড়িতে রেখে পালিয়ে যাচ্ছিল তখন তোর মা দেখে ফেলে। গণিকার থেকে বাচ্চাটা নিয়ে আমার কাছে আনে। আমি বেশ কিছু টাকা তখন ঐ গণিকাকে দিয়ে সাথে যাবতীয় কাজকর্ম সম্পাদন করে বাচ্চাটা দত্তক নেই। ঐ বাচ্চাটাই আমার বড় ছেলে, আমার সারতাজ! এই পরিবারের থেকে এই কথাটা আমি লুকিয়ে রেখেছিলাম। কিন্তু একদিন, ‘
প্রখর শব্দ কর্ণপাত হওয়াতে সালমা থামলেন। দৃষ্টি ফেললেন দরজায়। তিনি দেখলেন কেমন অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে রয়েছে সারতাজ। ছেলেটার হাত থেকে পড়ছে তাজা র ক্ত! সালমার গলা শুকিয়ে কাঠ। তিনি স্বগতোক্তি করলেন, ছেলেটা এই অসময়ে এখানে কেন? কখনই-বা এলো!
#শহরজুড়ে_বিষন্নতা |০৭|
সাদিয়া মেহরুজ
শুভ্র রঙের ফিনফিনে কাপড়ের টুকরোটা জড়িয়ে আছে সারতাজের বাম হাত জুড়ে। নিষ্প্রভ দৃষ্টি আঁটকে রয়েছে তার হাতে। সে ভাবছিল কিছু। গহীন মনে! সালমার আপন সন্তান নয় সে, এটা সম্পর্কে তো অবগত ছিলো কিন্তু সে গণিকার ছেলে এই তথ্যাটা সম্পর্কে অবগত নয় সারতাজ। বাবা তো তাকে বলেছিল তার জন্ম এক দরিদ্র পরিবারে। তার বাবা, মা নাকি অভাবের তাড়নায় তাকে সালমার কাছে আমানত রেখেছিলেন অর্থের বিনিময়ে।সালমার সন্তান নেই। তাই সে নাকি একটা বাচ্চা খুঁজছিলো যাতে তার সদ্য জন্ম নেয়া বাচ্চাটা মা রা যাওয়ার শোক কিছুদিন ভুলে থাকতে পারে। অনাথ আশ্রমে একটা বাচ্চা দত্তক নেয়ার জন্য তিনি খুব চেষ্টা করছিলেন তবে বর্তমানে বাচ্চা দত্তক নেয়া অতোটা সহজ নয় বলে তা আর হয়ে উঠেনি। তারপরই তো সাক্ষাৎ মিললো সারতাজের বাবা মার। আলাপচারিত করে সারতাজকে অর্থের বিনিময়ে নির্দিষ্ট কিছু সময়ের জন্য নিজের কাছে রাখার প্রস্তাব দিতেই সারতাজের বাবা মা রাজি হয়ে যায়। নির্দিষ্ট এক সময় পূর্বে সারতাজকে তারা নাকি নিয়েও যাবে তা কথা দিয়েছিলেন এমনকি নিতেও এসেছিলেন কিন্তু সালমা নাকি তাদের তাড়িয়ে দিয়েছে হুমকি দিয়ে! সারতাজকে দেয়নি তার বাবা – মার নিকট। কথার খেলাফ করে নিজের সন্তান হিসেবে দাবি করেছিল সালমা তাকে। বাবার এরূপ কথার পরিপ্রেক্ষিতেই তো মায়ের প্রতি তার এতো অভিমান! বাবার ওপরও রেগে ছিল সে। বাবা কি পারেনি তাকে পরবর্তীতে বাবা – মায়ের কাছে ফিরিয়ে দিতে? এমন আরো বেশ কয়েক কথার বদলেই তো বাবা – মায়ের সাথে কথা কাটাকাটি করে তরুণ সেই সদ্য ভার্সিটিতে পা দেয়া সারতাজ ঘর ছাড়ল চিরতরের জন্য।
কিন্তু এখন? বিষয়টা এখন ঠিক কোথায় গিয়ে ঠেকেছে ভাবা যায়! বাবা তাকে এতো বড় একটা মিথ্যা কথা বলতে পারলো? কেনই-বা বলল এ কথা তাকে? কি আশ্চর্য! সবকিছু কেমন ঘোলাটে হয়ে রয়েছে।ঘর ছাড়ার অবশ্য আরেকটা কারণ রয়েছে। শারাফ! তার ছোট ভাইটা যখন জানলো সে এই বাড়ির ছেলে না তখন কেমন নি ষ্ঠুর, পা ষা ণ রূপ ধারণ করলো! তাকে খোঁটা দিলো। কথা শোনালো! সবশেষে সম্পত্তির দোহাই দিয়ে বাড়ি ছাড়তে বলল তাকে। সেই বিষন্ন দিনগুলোর কথা সারতাজ আজ অব্দি ভুলেনি। ভোলা সম্ভব কি? উঁহু! শাহিনের দিক থেকে সবটা ছিলো ধোঁয়াশা। তবে সারতাজ আন্দাজ করেছে শাহিন নিজেও তার বাড়িতে থাকা নিয়ে সন্তুষ্ট নয়। সম্পত্তির লোভ মাথায় চড়েছে যে! সারতাজ চলে গেলেই তো তাদের সম্পত্তির পরিমাণ অনেকটা বেড়ে যাবে।
শিশির পরা সবুজ ঘাসে কেমন অন্যমনস্ক হয়ে বসে ছিল সারতাজ। দূর থেকে মেহজা তাকে লক্ষ করে ছুট লাগিয়ে বাগানে আসলো। সারতাজের পাশে দু পা ভাজ করে শব্দ করে বসল সে। হুঁশ ফিরে এলো আনমনা সারতাজের। মেহজাকে দেখে আলত হেঁসে গাল টানল তার। আদুরে গলায় শুধাল,
-‘ আসার পর থেকে তোমাকে খুঁজছি পিচ্চি।কোথায় ছিলে? ‘
মেহজা বাড়ির প্রতি আঙুল তাক করে জবাব দিলো,
-‘ আমি তো ঘরে ছিলাম ভাইয়া। আপার কাছে। তুমি এতো রাতে এখানে বসে বসে কি করছো? একা একা ভয় লাগেনা? ‘
-‘ নাহ লাগেনা। আমি বড় হয়ে গিয়েছি না? বড় হলে ভয় লাগে না একা থাকতে? ‘
-‘ সত্যিই? তাহলে আমি বড় হলে আপাকে ছাড়া একা ঘুমাতে পারবো? এখন তো পারিনা ভয় লাগে না? তাই! ‘
-‘ হুম পারবে। ‘
মেহজা পা গুটিয়ে বসলো আয়েশ করে। শিশির ভেজা গাছ গুলো ছিঁড়ে হাতে তুলে নিয়ে নাড়াচাড়া করতে লাগল। ফাঁকে সারতাজকে টানা টানা দুই চোখ দিয়ে দেখছিল। সারতাজ বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে মেহজার হাত ধরে টেনে দাঁড় করিয়ে বলল,
-‘ এভাবে বসে থাকলে ঠান্ডা লাগবে মেহজা। চলো তোমাকে বাসায় দিয়ে আসি। ‘
মেহজা প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-‘ তুমি যাবেনা বাড়িতে? ‘
-‘ নাহ! ‘
-‘ কেন? ঐটা তো তোমার বাড়ি। ওখানে কেনো থাকোনা তুমি? ‘
সারতাজ মেহজার ছোট্ট হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে হাঁটা ধরলো। প্রতিত্তোর করলো কিয়ৎক্ষণ পর,
-‘ আমার আরেকটা বাসা আছে। আমি ওখানে থাকি। এই বাসাটা সুন্দর লাগে না। তাই এখানে থাকি না। একদিন তোমাকে আমার ঐ বাসায় নিয়ে যাবো ঠিক আছে? ‘
-‘ ঠিক আছে? ‘
হটাৎ পথিমধ্যে পদচারণ থামাল সারতাজ। মেহজার পানে দৃষ্টি ফেলে বলে উঠলো,
-‘ চকলেট খাবে মেহজা? চলো তোমাকে আজকে চকলেট খাওয়াই। ‘
-‘ আপা ব কা দিবেনা? ‘
-‘ দিবেনা। ‘
-‘ তাহলে চলো যাই। ‘
সারতাজ হাসল! নিচু হয়ে মেহজার অবিন্যস্ত চুল গুলো ঠিক করে মেয়েটার কোমল হাতে চুমু খেলো। আদুরে ভাবে গাল টেনে দিয়ে হাত ধরে চলল সামনে থাকা আইসক্রিম পার্লারের দিকে। লহমায় সে ভুলে বসলো কিয়ৎ পূর্বের বুকভার করা বিষন্নতা! ক্ষনিক এর জন্য সবকিছু তার মস্তিষ্ক থেকে মুছে গেলো নিমিষেই।
_
-‘ সারতাজের বাবার সাথে আমার কখনোই তেমন ভালো সম্পর্ক ছিলোনা। বলা বাহুল্য আমরা নামে মাত্র স্বামী – স্ত্রী। দরিদ্র ঘরের মেয়ে ছিলাম আমি আর তিনি ছিলেন শিক্ষিত এবং বিত্তশালী পরিবার এর সন্তান। সারতাজের বাবা শরিফ, ও সবসময় চাইতো স্টাইলিশ, মর্ডান মেয়ে নিজের জীবনসঙ্গী হিসেবে কিন্তু আমার শশুর, শাশুড়ী চাইতেন সরল সহজ মেয়ে তাদের ছেলের বউ হিসেবে। মূলত তার বাবা – মার জন্যই আমাদের বিয়েটা হয়। শরিফ তার বাবা মাকে খুব মানতেন, শ্রদ্ধা করতেন। তাই তিনি এই বিয়ের পরিপ্রেক্ষিতে কিছু বলতে পারেননি। বিয়ের পর থেকেই শুরু হয় মানসিক অ ত্যা চা র আমার ওপর। শরিফ আমাকে কখনো শারীরিক ভাবে আ ঘা ত করেনি কিন্তু তার মানসিক আ ঘাত ছিলো ধারালো ছু রি র মতো! যা একটা মানুষকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে যথেষ্ট ছিল। ‘
সালমা থামলেন। কন্ঠনালী কাঁপছে তার। বিন্যস্ত শব্দগুচ্ছ কেমন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। অক্ষিপটে ভেসে উঠছে ফেলে আসা সেই করুণ, যন্ত্রণাদায়ক অতীত! অতীতের বেড়াজালে আজও সে আবদ্ধ।
মেহতিশা সালমাকে পরখ করলো। ভদ্রমহিলার মুখোশ্রীতে রাজ্যের মায়া লেপ্টে রয়েছে। এমন এক ব্যাক্তিকে কেও কিভাবে এতোটা আ ঘা ত করতে পারে? য ন্ত্র ণা দিতে পারে? সালমাকে দেখে ঘুনাক্ষরেও বোঝা যাবেনা ইনি নিজের অন্তঃকরণে এতোটা ক ষ্ট পুষে রেখেছেন। মেহতিশার বুক ভার হয়ে এলো।সে এদিক – সেদিকে চাহনি মেলে দিলো। তারপর হটাৎ করে কেমন এলোমেলো হয়ে উঠলো। একটু ছন্নছাড়া গলায় শুধাল,
-‘ আন্টি, আপনি কেন ওনাকে ছেড়ে চলে গেলেন না? তাহলে এখন তো অতীতের কষ্ট গুলো মনে করে চোখের পানি ঝরাতে হতো না। ‘
-‘ সবাই তোর মতো সাহসী হয় নারে মেহতিশা। সবাই তোর মতো সাহসী হয় না। ‘
-‘ কান্না থামান আন্টি। এক্ষুণি কান্না থামান! যার কাছে আপনার চোখের জলের কোনো মূল্য নেই, আপনার কোনো মূল্য নেই। তার জন্য চোখের পানি ফেলাও পাপ! ‘
সালমা পুনঃপুন বললো, ‘ ঠিক বলেছিস। ঠিক বলেছিস। ‘
চোখ মুছে নিষ্প্রাণ চাহনি সিলিং ফ্যানের প্রতি তাক করে সে পুনরায় বলা আরম্ভ করলো,
-‘ সারতাজ আমার সন্তান নয় এটা কিভাবে যেন শরিফ কয়েকবছর আগে জেনে গেল। সারতাজটা তখন মাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছে। ছেলেটার কি আনন্দ! সেদিন শরিফ সারতাজকে একান্তে কথা বলবে বলে ছাঁদে ডাকলো আর তারপর আমার জীবন আঁধারে ডুবল। ছেলেটা ছাঁদ থেকে নেমেই আমাকে জিজ্ঞেস করলো, ও আমার সন্তান না এটা আগে কেনো বলিনি? তারপর কেঁদে দিলো। বড় হওয়ার পর ঐ প্রথম সারতাজকে ওমন হাউমাউ করে কাঁদতে দেখি। কাঁদতে কাঁদতে কি যেন বিড়বিড় করে বলছিল আমাকে। শুনিনি ঠিক মতো। ওকে কাছে টানতে চাইলে চিৎকার দিয়ে উঠল। তারপর দু’দিন নিজেকে ঘরবন্দী করে রেখে বাড়ি ছেড়ে চলে গেল! আর ফিরলো না। আমার সাথে আর কথাও বলেনা ও। কেমন দূরে সরে থাকে। আমি শরিফের সাথে এ ঘটনার পর উঁচু গলায় কথা বলেছিলাম। জানতে চেয়েছিলাম কি বলেছিল সে সারতাজকে। ও বলেনি ঠিক মতো! শরিফ এখন আর বাড়ি থাকে না ঠিক মতো। কই থাকে জানিনা। তবে যতদূর মনেহয় ও বাহিরে খুব একটা ভালো কাজ করেনা। আমার কিছু দায়িত্ব পালন বাকি! দায়িত্ব গুলো শেষ করে ওকে তালাক দিয়ে এ বাড়ি ছেড়ে অনেক দূরে চলে যাবো আমি। অনেক দূরে..!’
বলা হয়, মানুষ নাকি বেশি আঘাত পেলে কঠিন হয়, পাথর হয়ে যায়, নিজেকে সামলে শক্ত হয়!এ কথার পরিপ্রেক্ষিতে বলাই যায় সালমা নিজেও একসময় শক্ত হবেন, ঘুরে দাঁড়াবেন। কম কষ্ট তো পেলো না মানুষটা। ক্রন্দনে লিপ্ত সালমাকে পরখ করে মেহতিশা কেবল দীর্ঘশ্বাস ফেলল! অপেক্ষা এবার এই মানুষটার শক্ত হয়ে ওঠার।
_
ঘড়িতে চারটা বেজে বত্রিশ মিনিট। নভোমণ্ডলে এখন গোধূলি বেলার রাজত্ব। শহর নিজের সাথে জড়াতে শুরু করেছে কুয়াশার চাদর। প্রকাণ্ড সূর্য ডুবো ডুবো প্রায়। অম্বরে রক্তিম মেঘেদের অবিরত ছুটে চলা। অনিলের নিরুদ্দেশ ছুট!অলিন্দে একাকী বসেছিল সারতাজ। হিমশীতল সমীরণ তার মুক্ত চিকুর অবিন্যস্ত করে দিচ্ছে বারংবার। সেদিকে তার খেয়াল নেই। সে তুমুল ব্যাস্ত ল্যাপটপে! সারতাজ তার সদ্য তোলা ছবি গুলো দেখছে। সামনে তার বিশাল বড় কাজ। দুইমাস পর নিউইয়র্কে বিশ্বের সব থেকে বড় ফটোগ্রাফি কনটেস্ট হবে। সেখানে আমন্ত্রণ করা হয়েছে বিশ্বের সকল বড়, নামকরা ফটোগ্রাফারদের যার মধ্যে সারতাজ বাংলাদেশের পক্ষ থেকে যাচ্ছে। সারতাজের ছবি তোলার হাত ভালো। কি দারুণ এবং নিখুঁত ছবি তোলে সে! বেশ পুরস্কার পেয়েছে ফটোগ্রাফার হওয়ার দরুন।
মুঠোফোনে বার্তা এসেছে। সারতাজ ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল একবার। আননোন নাম্বার থেকে ম্যাসেজ। সে ল্যাপটপ কোল থেকে নামিয়ে ফোনটা হাতে তুলে বার্তাটি পড়ার জন্য ফোনের লক খুললো। বার্তাটি ছিলো এরূপ,
-‘ শরিফ সাহেব, উরফে তোমার বাবা! তার আসল রূপ দেখতে চাইলে হোটেল রেডিসন ব্লু’তে চলে এসো কাল রাত আটটায়। আমি হোটেল ম্যানেজারকে বলে রাখব তোমাকে যেনো সঠিক জায়গায় পৌঁছে দেয়। ৩২১ নাম্বার রুম।
ইতি
তোমার কাছের কেও যাকে এতদিন ধরে খুঁজছ তুমি। ‘
ললাটে ভাজ পড়লো পরাপর কয়েকটা। অদ্ভুত তো! বার্তাটা প্রেরণ করলো কে? আননোন নাম্বারে কল দিয়েও লাভ হলো না। ফোন ইতিমধ্যে বন্ধ!
চলবে~
চলবে~
|