শহরজুড়ে বিষন্নতা পর্ব -২০+২১

#শহরজুড়ে_বিষন্নতা |২০|
সাদিয়া মেহরুজ

জীবন একটি রণক্ষেত্র। এখানে প্রতিটি লহমায়, প্রতিটি পদক্ষেপে যুদ্ধ করে এগিয়ে যেতে হয়। যুদ্ধে আসে নানা প্রতিকূল বাঁধা, নিদারুন ক ষ্ট! ভোগ করতে হয় অনেক যন্ত্রণা। এই জীবন নামক অধ্যায়ে রয়েছে সুখ নামক অতিথি পাখি। শীতকালে এদেশে যেমন অতিথি পাখি দূর দূরান্ত হতে উড়ে আসে এ দেশে কেবল এক নির্দিষ্ট সময়ে তেমনি সুখও একই পথের পথিক। সুখের আগমনী বার্তা শোনা যায় ভীষণ ভীষণ ক ষ্ট পোহানোর পর। তবে এক্ষেত্রে মেহতিশার জীবনে সুখ কোথায়? সবার জীবনেই কি একই নিয়ম বরাদ্দ থাকে কি? উঁহু! মেহতিশা তো সেই ছাব্বিশটা বছর ধরে দুঃখের কাঁটায় বিঁধে বিঁধে বড় হয়েছে। তার জীবনে তো সুখ হাতছানি দেয়নি। এইযে একটুখানি ভালো থাকতে শুরু করল, ক’দিন বা হলো? এক কি দু’দিন! এতো জলদিই কেন এলো বিষন্নতা? এতো জলদি কেন চলে গেল সুখ পাখি?
কান্না থেমে এসেছে মেহতিশার। কামড়ার দরজাটা চাপানো। ওপাশের রুম থেকে মেহজার আদুরে গলার স্বর শোনা যাচ্ছে। মেহতিশা ফুপিয়ে উঠল! দৃষ্টি দিল মুঠোফোনে। চাকরিটা চলে গেছে। এখন কি হবে তার? কি হবে তার ছোট্ট বোনটার? সে যেই গার্মেন্টসে ডিজাইনারের কাজ করতো ঐ গার্মেন্টস বন্ধ হয়ে গেছে। বর্তমানের এই টানাপোড়নের সময় সারতাজের বড় মামার আর সম্ভব হয়নি টিকিয়ে রাখা। এই কঠিন সময়ে যেখানে হুড়মুড়িয়ে সব ক্ষেত্রে কর্মী ছাঁটাই চলছে সেখানে তার আদও কি কোথায় চাকরি হবে কিনা ভেবে পেল না মেহতিশা।

কলিংবেল বাজল। মেহজা নিলিকে বিছানায় রেখে ছুটল দরজা খুলতে। রুম থেকে তখন বেড়িয়েছে মেহতিশাও। সদর দরজা খোলা মাত্রই দর্শন হলো বিধস্ত আয়েশাকে। দিক বেদিক না দেখে আয়েশা ছুটে এসে ঝাপটে ধরল মেহতিশাকে। হু হু করে কেদে দিল লহমায়! ক্রন্দনরত কন্ঠে শুধাল,

-” এখন কি হবে মেহতিশা? চাকরিটা যে চলেই গেল আমাদের। এতো কষ্ট করে পাওয়া চাকরি। মায়ের ঔষধ কেনারও টাকা শেষ। সাদিকের স্কুলের বেতন দেয়া হয়নি চার মাস ধরে। আমি এখন কি করবো বলো তো? ”

নিজেকে শক্ত করল মেহতিশা। ভরসার হাত রাখল আয়েশার মাথায়। সান্ত্বনা দেয়ার সুরে বলে উঠল,

-” শান্ত হও আয়েশা। আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই তো করেন। এখানেও হয়ত আমাদের কোনো মঙ্গল লুকিয়ে ছিল তাই তিনি এমনটা করেছেন। এত অল্পতে ভেঙে পড়তে নেই। তুমি ভেঙে পড়লে তোমার ছেলে, তোমার মায়ের কি হবে বলো তো? ”

সান্ত্বনাও কাজ হলো না। আয়েশার কান্নার হিড়িক বেড়েছে। মেহজা নিশ্চুপ! নিলিকে কোলে তুলে ঘরের এক কোনায় গুটিশুটি মে রে দাঁড়িয়ে সে। মেহতিশা মেহজাকে দেখল। অতঃপর ফিসফিসিয়ে উঠল,

-” কেঁদো না আয়েশা। দেখো মেহজা ভয় পাচ্ছে। কান্না থামাও! ”

আয়েশা কান্না থামানোর চেষ্টা করল। হচ্ছে না! তার ছেলে আছে পাঁচ বছরের। অল্প বয়সে বিয়ে তার। তারপর কোল জুড়ে সুখের দ্যুতি নিয়ে সাদিকের আগমন। তবে সুখ যে ক্ষণিকের! তার স্বামী তাকে ধোঁকা দিয়ে চলে যাওয়ার পর হতে একা হাতেই সাদিক, নিজের মা সহ পুরো সংসারটা শক্ত হাতে সামলেছে আয়েশা। এখন যখন আয়ের উৎসটা নিভে গেল অমনি তাকে ঝাপটে ধরল আ শ ঙ্কা! তার ছেলেটার কি হবে? তার অসুস্থ মায়ের কি হবে? তা ভেবে প্রাণ দ্যুতি তার নিভু নিভু হয়ে আসতে চাচ্ছে।

_

পাথুরে মূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে সারতাজ। নড়চড় নেই। প্রান্তিকা তার পাশে কাঁদছে। অথচ এ সময় যার পাগলাটে আচরণ করার কথা সে সম্পূর্ণ নির্লিপ্ত, নিশ্চল। শাকিব এক মনে শায়লার শুভ্র কাপড় দ্বারা পেঁচিয়ে রাখা টুকরো দেহ খাঁটিয়ায় তুলছে। তার মুখোশ্রী দেখে বোঝার উপায় নেই ওর মনে আদও কি চলছে। কিন্তু সারতাজ জানে এটা ঝড় আসার আগে বহমান শীতল সমীরণ।
শায়লা মা রা গেছে। ট্রেনে কা টা পড়ে। ভায়োলেন্ট হয়ে বাসা থেকে বের হয়ে ছুটতে ছুটতে তিনি চলে আসেন রেললাইনের নিকট। মধ্যদুপুর ছিল তখন। রেললাইনে নেই কোনো মানুষ। বা দিক থেকে প্রবল বেগে ছুটে আসছে তখন ট্রেন। দিশেহারা শায়েলার পা তখন আচমকা আঁটকে গেল রেললাইনের মাঝে বেফাঁস ভাবে। শায়লা চেঁচাল! চেঁচিয়ে বলতে চাইল কিছু। হুঁশ ফিরেছিল তার মৃ ত্যু র পূর্বে। তবে কেন যেন দেহে বিন্দু পরিমাণ শক্তি পাচ্ছিলেন। ওখানেই গা ছেড়ে দেয়ার পর প্রবল বেগে আসা ট্রেন তার দেহের ওপর দিয়ে তাকে খন্ডিত করে দিয়ে গেলো। র ক্ত ছিটে পড়ল আশেপাশে। মৃগী রোগীর মতোন কাঁপুনি দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে ইহলোকের মায়া ত্যাগ করলেন শায়লা। এরকম ভায়োলেন্ট শায়লা পূর্বেও হয়েছিল। ডাক্তার কড়া নজরদারিতে রাখতে বলেছিল তাকে। শাকিব তাই বাসায় নার্স দু’জন বাড়িয়ে রেখেছে। বাসার বাইরে গার্ডের সংখ্যাও বাড়িয়ে করেছে দ্বিগুণ। মা’কে তো আর নিজের সাথে তার নেয়া সম্ভব ছিল না। কোয়ার্টারে থাকে ও। সারাক্ষণ কাজে ব্যাস্ত। ফিরে রাত বারোটা কিংবা কোনো কোনো সময় দু’দিন হয়ে গেলেও দেখা মেলেনা তার কক্ষে। শায়লা একা কিভাবে থাকবে তা ভেবে আর নিজের সাথে উনাকে রাখেনি শাকিব। তবে এখন বোধগম্য হচ্ছে তার। কতো বড় ভুলটাই না শাকিব করল!

শাকিব হাঁটুগেড়ে ভূমিতে বসল। দু’হাতে আঁকড়ে ধরল শায়লার ফ্যাকাসে মুখোশ্রী। বাচ্চাদের মতো ঠোঁট উল্টে শাকিব আহ্লাদী গলায় বলল,

-” তুমি কখন ঘুম থেকে উঠবে মা? আমার খিদে পেয়েছে তো। খেতে দেবেনা? ”

আশেপাশে ছিল বেশ কয়েকজন র‌্যাব আর পুলিশ। তারা ব্যাতীত উপস্থিত সারতাজ, প্রান্তিকা। বাদ বাকি আর কেওই নেই। শাকিবের এহেন আচরণে ভড়কাল উপস্থিত সকলে কেবল সারতাজ বাদে।

-” মা ওঠো! উঠো জলদি। আমার কিন্তু অপেক্ষা সহ্য করতে পারছিনা আর। তুমি জানো না আমি ক্ষিদে সহ্য করতে পারিনা তবুও কেন উঠছো না তুমি? রাগ করেছ মা? আ’ম সরি! আজ তোমাকে সাথে নিতেই এসেছি তো। চলো উঠো। রেডি হও! ”

র‌্যাবের কয়েকজন সদস্য শাকিবকে ধরতে এলো কারণ তার পাগলামি চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে। তবে এতে বাঁধা দিল সারতাজ। হাতের ইশারায় তাদের পিছু হটতে বলল। সরে গেল তারা। শাকিব পাগলাম করে যাচ্ছে। আ র্ত না দী সুর তুলে শায়লাকে ডেকে যাচ্ছে। সারতাজ সবাইকে বেরুতে বলল। প্রান্তিকার নিকট এসে তাকে টেনে তুলে বলল,

-” আপু তোমার রেস্ট দরকার। রুমে যাও। আমি ভাইয়াকে দেখছি। ”

প্রান্তিকা পাগলাটে, অন্যরকম শাকিবকে পরখ করতে করতে ভীত গলায় শুধাল,

-” শাকিব অমন করছে কেন? আমার প্রচুর টেনশন হচ্ছে। ”
-” কিচ্ছু হবেনা। আমি দেখছি তো। ”

প্রান্তিকা জায়গাটা ছেড়ে চলে গেল। বিশাল রুমে এখন শাকিব, সারতাজ বাদে কেও নেই। ধীরস্থ পায়ে এগোল সারতাজ।শাকিবের পিঠে হাত রাখল। শাকিব তৎক্ষনাৎ পিছন ঘুরে পা ঝাপটে ধরল তার।

-” ভাই মা’কে বল না একটু তাকাতে। মা কি বেশি রাগ করে সারতাজ? মা কেন কথা বলেনা? একটু কথা বলতে বলনা। ”

শাকিবকে ঠেলেঠুলে সরিয়ে ভূমিতে পা ভাজ করে বসল সারতাজ। কোমল দৃষ্টিতে তাকাল শাকিবের পানে। দৃঢ় গলায় বলে উঠলো,

-” খালামনি আর কখনো চোখ খুলে তোমাকে দেখবে না ভাই। খালামনি আর নেই আমাদের মাঝে। হুঁশে ফিরো! চেয়ে দেখো বাস্তবতা। ”

পাগলামোর প্রকোপটা খানিকটা কমলো কি? হয়ত! শাকিব শায়লার হাত ছুঁয়ে দিল। পরম মমতায় চুমু খেলো। পরক্ষণেই হন্য হয়ে সারতাজের কাছে ছুটে এসে চেঁচিয় উঠল,

-” ভাই, ভাইরে..! আমার আর কেও রইল না ভাই। আমি এতিম হয়ে গেলাম ভাই। আমার মা আমাকে ছেড়ে চলে গেল। ইয়া আল্লাহ! আমার জানের বিনিময়ে আমার মা’কে ফিরিয়ে দাও আল্লাহ। ভাই আমার মা’কে এনে দে না। আমার আর কিচ্ছু চাই না। আল্লাহ এতবড় শাস্তি আমায় কেনো দিলেন? ”

বিলাপ করে কাঁদছে শাকিব। সারতাজের ধ্যান নেই সেদিকে। সে একদৃষ্টে তাকিয়ে শায়লার ফ্যাকাশেটে মুখোশ্রীর পানে। তার শ্বাস রুখে আসছে চাইছে এটা ভাবতেই, এই মায়াময় চেহারাটা নাকি তার আর দেখা হবেনা! কেও আর তাকে তাজ বলে ডাকবে না। কেও আর হাতে তুলে খাইয়ে দেবে না। ঠোঁট দু’টো কাঁপল সারতাজের! অক্ষিকোটরে জলের উপস্থিতি। নিজেকে দমাল ও। মাথা ঝাঁকিয়ে ফের যন্ত্রের মতো গহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল শায়লার মায়াময়ী মুখশ্রীর পানে।

চলবে~

| গল্পের আর হাতে গোনা কয়েকটা পর্ব আছে মাত্র। আচ্ছা আমি ক্লিয়ার করিনি এমন কোনো কিছু আছে কি? |#শহরজুড়ে_বিষন্নতা |২১|
সাদিয়া মেহরুজ

সীতাকুণ্ডে ভোর ছাপিয়ে সূর্যালোকের আনাগোনা আরম্ভ হয়েছে কেবল। বাতাবরণে মৃদুমন্দ হাওয়ার তোড়। সমীরে পুষ্পের সুঘ্রাণ, দূর আকাশে নাম না জানা পাখিদের অবিরত উড়াউড়ি।ব্যাস্ত হয়ে উঠছে নভোমণ্ডল। শরৎকালের রাজত্ব শুরু হয়েছে। অম্বর জুড়ে শুভ্র মেঘেদের ছোটাছুটি। কাশফুলের বাগানে চুপটি করে দাঁড়িয়ে মেহতিশা। একদৃষ্টে তাকিয়ে সে ঝর্ণার পানে। পাহাড়ি ঝর্ণা। ঝমঝম শব্দে মুখোরিত আশপাশ। মেহতিশার মনে হলো সে গান শুনছে, ঝর্ণার গান। যে গানের স্রষ্টা ঝর্ণা নিজেই। সুর দাতা ঝর্ণার পানি। দুই আঁখি মুদে নিরবে নিভৃতে দাঁড়িয়ে থাকাকালীন মেহতিশা আবিস্কার করল, তার পিছন কেও দাঁড়িয়ে। পা টিপে টিপে এদিকেই আসছে কেও।

-” আপনি এখানে? ” মাথা পিছন দিকে বাঁকিয়ে চেঁচাল মেহতিশা উচ্চস্বরে!

নিজের দেহ হতে লতাপাতা ছাড়াচ্ছিল সারতাজ। চিৎকার শুনে মুখে কুলুপ এঁটে রইল। প্রতি উত্তর করল না। মেহতিশার চেঁচানোর শব্দে ছুটে এসেছে আয়েশা। সারতাজকে দেখে তার আঁখি জুড়ে দেখা দিল বিষ্ময়!

-” চারটে মাস কোথায় গায়েভ হয়েছিলেন? আপনি বাসা ছেড়েছেন বলেননি তো। ” সারতাজ শীতল গলায় শুধাল।

মেহতিশার হতবাকের রেশ কাটেনি তখনো। তার সম্মুখে স্বয়ং সারতাজ দাঁড়িয়ে এই ব্যাপারটা তার এখনও বিশ্বাস হয়নি। ও দু’কদম এগিয়ে এসে প্রশ্ন করল,

-” আপনি এখানে কেন? কিভাবে এলেন বলুন তো? আমার সাথে দেখা করতে এসেছেন নাকি কোনো কাজে? ”

সারতাজ মেহতিশার পেছন আয়েশাকে দেখল। পা ফেলে সামনে এগোল। খানিকটা চেঁচাল ও,

-” আপনার সাথে একা কথা বলতে চাই মেহতিশা। প্লিজ কিছুক্ষণের জন্য আপনার মূল্যবান সময় আমাকে দেবেন? ”

সারতাজের চেঁচিয়ে বলার কারণটা আয়েশা বোধহয় বুঝতে পারল। জায়াগাটা ছেড়ে সে পুনরায় নিজের স্থানে ফিরে গেল। আয়েশার প্রস্থান মাত্র সারতাজ চটপট বলল,

-” আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দিন মেহতিশা তারপর সব বলছি। ”

মেহতিশার এ মূর্হতে ত্যাড়া হতে ইচ্ছে করল! তবে সে নিজেকে দমন করে নিয়ে বলে উঠলো,

-” চাকরি চলে গিয়েছিল আমার। ওখানে থেকে লাভ কি? বাসা ভাড়া দেয়ার মতো পয়সা আমার ছিল না। তাই বাসা ছেড়ে দিয়ে এখানে এসেছি। এই জায়গায় আমার বাবার ছোট্ট একটা ঘর ছিল যেটা আমার বাবা আমার আর মেহজার নামে করে গিয়েছিল। ঐটা আমি জানতাম না। ফুপি বলল! তখন এখানে এসে পড়ি মেহজাকে সঙ্গে করে। ”

-” এখানে এসে চলছেন কি করে? ঢাকায় অন্য কোথাও কাজ দেখলেই তো হতো। ” দ্বিতীয় প্রশ্ন সারতাজের।

মেহতিশা ঠোঁট বাঁকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসিঁ দিল। বলল,

-” আপনার কি মনে হয়? আমি চেষ্টা করিনি বুঝি? করেছিলাম! কিন্তু তখন অবস্থা এতোটা বাজে ছিল যে আমার মতো এতো নিম্ন শ্রেণির চাকরি পাওয়াটা দুষ্কর ছিল। চাকরি পাইনি। এখানে আপাতত মাঠে সবজি লাগিয়ে বিক্রি করি। এতে দিন ভালো চলে যায়। ”

-” আমার ফোন কেন রিসিভ করেননি মেহতিশা? ”

-” ফোন থাকলে তো রিসিভ করব। বিক্রি করে দিয়েছি ওটা। ”

লম্বা কয়েক শ্বাস ফেলল সারতাজ। আশপাশ পরখ করে এগিয়ে এলো মেহতিশার সন্নিকটে। তারপর কেমন কাতর গলায় শুধাল,

-” এতোকিছু হয়ে গেল আর আপনি আমাকে একটুও জানালেন না? ”

ব্যাথিত সারতাজকে আরেকটু পীড়া দিতে মেহতিশার অধর জোড়া দিয়ে বের হলো আরো কিছু নিষ্ঠুর বার্তা,

-” আপনাকে কেন বলতে যাব আমি? কি হোন আপনি আমার? কিছুই না! তাহলে কেন বলতে যাব আশ্চর্য! লাইফটা আমার। লাইফে আসা সব স্ট্রাগল ফেস করা আমার দায়িত্ব। আমি আমার লাইফে কারো হস্তক্ষেপ নিতে পারবোনা। ”

দিনের নতুন আলোয় অসহায়, ব্যাথিত সারতাজ চেয়ে চেয়ে দেখল এক নি ষ্ঠু র রমনীকে। মেয়েটার কি মনে বিন্দুমাত্র মায়া দয়া নেই? একটুও ক ষ্ট হয়না মেয়েটার সারতাজের জন্য? মেহতিশা তো অবুঝ নয়! তবুও কেন তৃষ্ণার্থ সারতাজের চোখের ভাষা মেয়েটা পড়তে পারেনা? নাকি বুঝতে পেরেও না বোঝার ভান করে থাকে?

দূরে সরল সারতাজ। কপালে লেপ্টে থাকা ঘর্মাক্ত চুলগুলোকে কানের পিঠে গুঁজে দিয়ে অন্যত্রে তাকাল। সারতাজের প্রতিটি পদক্ষেপ চোখ দিয়ে শুষে নিচ্ছে মেহতিশা। তার হৃদয় অস্থিতিশীল! ইচ্ছে করছে তার সম্মুখে দাঁড়ানো রোগা পাতলা ছেলেটাকে ঝাপটে ধরতে, নিজের সকল ক্লান্তির ইতি টানতে। তবে তৎক্ষনাৎ নিজেকে সামলালো ও। এসব চিন্তা করাও পাপ, অন্যায়!

-” নিলি, মেহজা ওর ভালো ভালো আছে? ”

মেহতিশা হুঁশে এলো। সারতাজ তখন উত্তরের আশায় তার পানে তাকিয়ে। ঘন ঘন মাথা নাড়ল মেহতিশা। বলে উঠলো,

-” হু ভালো আছে। দেখা করবেন ওদের সাথে? ”
-“অবশ্যই। ”

চার মাস হলো মেহতিশার সীতাকুণ্ডে আসার। এই চার মাস ধরে গাধার খাটুনি খাটতে হচ্ছে তাকে। ঢাকায় চাকরি না হওয়ার পর সিদ্ধান্ত নেয় গ্রামে এসে ছোট খাটো কিছু করবে। অতঃপর তার আর আয়েশার নেওয়া সিদ্ধান্ত দাঁড়ায় সবজির বাগান করা পর্যন্ত। চার মাসে মোটামুটি ভালো আয় হয়েছে ওদের। মেহজা, সাদিক দু’জনকে এখানকার এক স্কুলে ভর্তি করানো হয়েছে। সবজি বিক্রির টাকা থেকে তারা কিছু হাস ও মুরগী কিনে তা দেখাশোনা শুরু করেছে। মুরগী গুলো ডিম দেয়া শুরু করার পর তাদের আয়ের মাত্রা আগের তুলনায় দ্বিগুণ হয়েছে। সবকিছুই পরিপাটি। তবে এর মাঝে কিয়ৎ অবিন্যস্ত ছিলো মেহতিশা। খেয়ালে কিংবা বেখেয়ালে তার অন্তঃকরণে আচানক হাজির হতো সারতাজ। অক্ষিপটে ভেসে উঠত ছেলেটার মুখশ্রী। ভুলে থাকার প্রাণপণ চেষ্টা করত ও। তবে যাকে মস্তিষ্কে খোদাই করে রাখা তাকে ভোলা আদৌও কি সম্ভব?

_

-” বাজার শেষ হয়ে গেছে। ” প্রান্তিকা কোমল কন্ঠে বলে উঠলো।

গায়ে কালো পোশাকটা জড়াতে জড়াতে আরশিতে এক ঝলক প্রান্তিকাতে নজর বুলায় শাকিব।মেয়েটার মাঝে পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। চোখের নিচে গাঢ় কালি। ঠোঁট রুক্ষ। অর্থবহুল আঁখিজোড়া কেমন যেন নিষ্প্রাণ, অনুভূতিহীন। প্রান্তিকাকে অস্বাভাবিক দেখেও শাকিব পাল্টা কোনো প্রশ্ন করল না। কেবল ছোট্ট করে গাম্ভীর্যতা ধরে রেখে শুধাল,

-” নিয়ে আসব। ”

প্রান্তিকাকে হতাশ করে শাকিব চলে গেল। নিষ্প্রভ দৃষ্টিতে শাকিবের প্রস্থান নিবিড় নয়নে পর্যবেক্ষণ করল প্রান্তিকা। শাকিব বদলে গেছে! অনেকটা। আগের মতো প্রান্তিকার সাথে দু দন্ড সময় নিয়ে আর কথা বলেনা। প্রান্তিকার খোঁজখবর নেয়না। একই ছাঁদের নিচে থেকে তাদের মনের মধ্যকার দূরত্ব যোজন – যোজন। শাকিবের পরিবর্তনটা শুরু হয়েছে শায়লার মৃত্যুর পর হতে। ছেলেটা পুরোদমে যন্ত্রে পরিণত হয়েছে।

বিছানায় বসল প্রান্তিকা। ডান হাত পেটের ওপর আলত করে রেখে শুধাল,

-” তোর বাবা তোর কথা জানলে কি আবার আগের মতো হয়ে যাবে বাবু? ”

_

সারতাজের কোল দখল করে বসে নিলি। মেহজা ঠিক তার পাশে কথার ঝুলি নিয়ে বসেছে। সারতাজ মেহজার প্রত্যেকটা মন দিয়ে শুনছে, ফাঁকে ফাঁকে উত্তর দিচ্ছে তো নিলির গায়ে আদুরে ভাবে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। মেহতিশা অদূরে দাঁড়িয়ে ওদের কান্ড দেখছিল। আয়েশা পাশে এসে দাঁড়াল তার। বলল,

-” তোমার উচিত নিজের অনুভূতি ব্যাক্ত করা তিশা। নয়ত পরে দেখা যেতে পারে আর সুযোগই পেলে না। ”

আয়েশা দাঁড়াল না। চট করে চলে গেল। মেহতিশা হতবিহ্বল! এই মেয়েটাও তার অনুভূতি টের পেয়ে গেল? কি আশ্চর্য! বিষয়টা কতো করে চাপা দিতে চাচ্ছিল অথচ হলোটা কি?

মেহতিশাকে দেখে সারতাজ ছটফট করে ছুটে এসেছে। ছটফটে সারতাজকে দর্শন মাত্র কপালে ভাজ পড়ল মেহতিশার। বলে উঠলো,

-” কি সমস্যা? ”

সারতাজ তৎক্ষনাৎ জবাব দিল, ” একটু কথা বলার ছিল। বাহিরে যাই চলুন? ”

-” কেন? ঘরে বললে কি সমস্যা? ”
-” সমস্যা আছে বলেই বলছি। বাহিরে চলুন। ”

মেহতিশার হাত ধরতে নিয়েও গুটিয়ে নিলো নিজের হাত সারতাজ। তাড়া দিলো ওকে। নির্জন স্থানে এসে থামতেই মুখাবয়ব পরিবর্তন হলো সারতাজের, কিয়ৎ পূর্বের চঞ্চলতার বিলীন হয়ে মুখশ্রীতে ফুটে উঠেছে তার অদ্ভুত কাঠিন্যতা। গলার স্বর খাদে নামিয়ে শীতল কন্ঠে বলল,

-” হেয়ালি পছন্দ নয়। সোজাসাপ্টাই বলি! আমি আপনাকে পছন্দ করি মেহতিশা। আমি জানি আপনি এটা জানতেন। কেনো রেসপন্স করেননি? তখন করেননি ইট’স ওকে। বাট নাউ আপনাকে আমার হতে হবে মেহতিশা। সম্পূর্ণরূপে আমার। উইল ইউ এক্সেপ্ট মি? আপনি কি আমার শেহজাদি হবেন মেহতিশা? ”

চলবে~

| একটি অগোছালো পর্ব…💔 |

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here