শাহজাহান তন্ময় পর্ব -০৪

শাহজাহান তন্ময়

৪.
সাপ্তাহিক ছুটির আগের দিন রাতে তন্ময়ের রুমে জমজমাট পরিস্থিতি থাকে। অরু, শাবিহা, দীপ্ত, আকাশ প্রত্যেকে আসন পেতে বসে তার রুমের সোফা, চেয়ার এবং বিছানায়। লেট-নাইট মুভি দেখে। শুক্রবার বন্ধ যেহেতু রাতভর জেগে কাটায়। এটাসেটা খেলায় মগ্ন হয়। আজ খেলাধুলা নয় তারা মুভি দেখতে বসেছে। জম্বি মুভি। ভয়ংকর থ্রিলিং। এসব মুভিতে তন্ময় বেশ অ্যাটেনশন দেয়। সম্পূর্ণ রুম আঁধারে তলিয়ে। শুধু টেলিভিশনের আলোয়, অরুর ভয়ার্ত মুখশ্রী দেখা যাচ্ছে। একটু পরপর সে শাবিহার কোলে ঢুকে পড়ছে। পাশে তন্ময় বিষয়টা উপলব্ধি করছে। না করে উপায় কই? মেয়েটা হুড়মুড়িয়ে নড়ছে। অজান্তে তার পায়েও হুটহাট লাথি দিচ্ছে। তন্ময় স্পষ্ট শুনছে, অরু ফিসফিসিয়ে বলছে, ‘শাবিহা আপু, জম্বি লোকটা কী এখন নায়ককে খেয়ে ফেলবে?’

শাবিহা মুভি দেখায় বিভোর। সে ধীর গলায় বলে, ‘পড়ে বলব। দেখতে দে।’

অরু শাবিহার কোল থেকে বেরিয়ে, সোজাসাপ্টা হয়ে বসল। সে এখন কার কাছে যাবে জানা আছে তন্ময়ের। মূহুর্তে অরু ঘেঁষে তন্ময়ের পাশে আসল। ধীর গলায় শুধাল, ‘তন্ময় ভাই, জম্বি লোকটাকে কী খেয়ে বলবে?’

ওপাশে শাবিহা হাসছে নিঃশব্দে। তন্ময়ের দৃষ্টি টেলিভিশনে। সে দৃষ্টি না ফিরিয়েই জবাবে বলে, ‘সবাইকে খেয়ে ফেলবে। টেলিভিশন থেকে বেরিয়ে তোকেও খেতে পারে৷ কথাবার্তা বলিস না।’

অরু আতঙ্কে মাথা দোলায়। তন্ময়ের এ-ধরনের কথায় ভয় পেয়ে বসে দীপ্ত। ধড়ফড়িয়ে ওঠে দৌড়ে বেরিয়ে যায়। তার চেঁচামেচি শোনা যাচ্ছে নিচ থেকে। অরু আবার ওর থেকে বড়ো মানুষ কিনা। অতটা ভয় পায়নি। তবে বাকিটা সময় চুপসে রইল। ভয়ংকর দৃশ্য গুলোর সময়, হুটহাট একটু চোখ বন্ধ করে ‘ও মা গো’ বলেছে। ব্যস এতটুকুই। আর কোনো প্রশ্ন, আতঙ্ক সে দেখায়নি।
তন্ময় আড়ালে আবডালে স্মিথ হাসে। মাথা ঘুরিয়ে দেখে নেয় অরুকে। দু হাঁটু জড়িয়ে আছে। ভয়ার্ত চোখ-জোড়া টেলিভিশনের পর্দায়। তন্ময় মাথা ঘুরিয়ে পুনরায় টেলিফোনে নজর দেয়।
_________

‘তন্ময় ভাই।’
‘হু।’
‘আমি একটা বিচার নিয়ে এসছি।’
‘হু।’
‘এই বিচার খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’

তন্ময় ভীষণ মনোযোগী পড়াশোনায়। সামনে সেমিস্টার ফাইনাল। একটা কঠিন চ্যাপ্টারে আপাতত নজর দিচ্ছে। হাতে ক্যালকুলেটর। মনোযোগ ছিন্নবিচ্ছিন্ন না করেও, বেশ সাবলীল গলায় জবাবে পুনরায় ‘হু’ বলল। অরু আতঙ্ক নয়নে চারিপাশে তাকিয়ে নেয়। বিশেষ করে দরজার দিকটায়। কেউ চলে আসে নাকি। সে আরেকটু কাছে গিয়ে বসে। গলার স্বর নামিয়ে মিনমিন করে। তন্ময় এবার হাতের কলম, ক্যালকুলেটর টেবিলের ওপর রাখে। কিছু একটা হয়েছে আঁচ করতে পেরেছে। অরুর দিক পূর্ন নজর তাঁক করে। ভয়ার্ত চেহারাটা করুণ হয়ে আছে মেয়েটার, ‘কী হয়েছে?’

অরু ছটফট করছে। নিজেই নিজের সাথে যুদ্ধ করছে যেন। তন্ময় অপেক্ষা করে। সেভাবেই বসে রয়। অরুর কী বলার আছে জানতে চায়! সময় দেয় পর্যাপ্ত। অরু হাসফাস করে, সময় নিয়ে বলেও_
‘আমার স্কুল যেতে ভয় লাগে।’

তন্ময়ের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হয়। ভ্রু দুয়ের মাঝে ভাঁজ পড়ে। কন্ঠ চওড়া না করার প্রচেষ্টা সহিত প্রশ্ন করে, ‘কেন?’

অরু পুনরায় ছটফট করছে। দৃষ্টি তার এলোমেলো। চিন্তায় তন্ময়ের রক্তের ভাঁজে ভাঁজে ভয় ঢুকে। কোনো খারাপ কিছু অগোচরে হচ্ছে নাকি অরুর সঙ্গে, তার চিন্তাভাবনা মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে। নিজেকে শান্ত করে। ডান হাত অরুর মাথায় রাখে। চুল বুলিয়ে দিয়ে সাবধানতাজনিত গলায় বলে, ‘আমাকে বল। কী হয়েছে? আমি দেখব। ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। আমি আছি না?’

অরু মাথায় দোলায়। সরল গলার স্বরে আজ ভয়ার্ততা লেপ্টে, ‘দুদিন ধরে আমাকে একজন ভদ্রলোক ফলো করে। খাবার সাধতে চায়। বলে কী, ঘুরতে নিবে আমায়! সুমনাও লোকটার সঙ্গে ঘুরে। আর ও আমায় প্রত্যেকদিন বিরক্ত করে। বলে কী, চল মিলেমিশে যাই! আমাদের মজা কিনে দেবে নাকি। কিন্তু আমিতো মজা চাই না। আমাদের বাসায় তো সব মজা আছে। আমি না করলেই, আমাকে সুমনা ধমকায়। বলে, আমার আম্মুকে বিচার দেবে। আমার নামে খারাপ বলে, মার খাওয়াবে। এগুলো তো মারজি জানে। আমিতো মারজিকে সব বলি। মারজি বলেছে এক্ষুনি গিয়ে আপনায় বিচার দিতে। তাই আমি বিচার নিয়ে এসছি।’

বুকের ভেতরে চলাচল নামক তুফান উপেক্ষা করে তন্ময়। শান্ত ভঙ্গিতে মাথা দোলায়। সে একইভাবে অরুর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, ‘সকালে আমি যাব সঙ্গে। ভয় নেই। শুয়ে পড় গিয়ে। রাত হয়েছে।’

অরু বড়ো শ্বাস ফেলে। মাথা দোলায়। খুব বিশ্বাসী সে তন্ময়ের প্রতি। তার ধারণা তার বাপ-চাচা-ভাইদের থেকে শক্তিশালী পৃথিবীতে আর কেউ নেই। ছোটো ছোটো পা ফেলে বেড়িয়ে গেল।

তন্ময় আর পড়তে বসল না। উঠে দাঁড়ায়৷ বিছানায় রাখা সেলফোন হাতে নেয়। ফোন দেয় কাউকে। টুকটাক কথা বলে রাখে। সেদিন রাতে আর ঘুম হয়না ছেলেটার। কপালে আঙুল ঘষে বসে থাকে। খুবই চিন্তিত সে।
______

মোস্তফা সাহেব সচরাচর ভোরে ঘুম থেকে ওঠেন। উঠে তার সর্বপ্রথম কাজ বাড়িটায় ঘুরেফিরে বেড়ানো। আজও তাই করলেন। প্রত্যেকদিনের ন্যায় দোতলার উত্তর দিকের করিডর ধরে এগোলেন। অরুর পাশের রুমটা খোলা। মোস্তফা সাহেবের পা-জোড়া থমকে যায়। তন্ময়ের রুম এ-সময় খোলা কেন? তিনি আধখোলা দরজা ঠেলে সম্পূর্ণ খুলে ডাকেন, ‘তন্ময়?’

জবাব আসেনি। মোস্তফা সাহেব ধীরেসুস্থে ঢোকেন। চারিপাশে নজর বোলালেন। দু-একবার ডাকেন। না, নেই ছেলেটা! এতো ভোরে কই গিয়েছে? মোস্তফা সাহেব রুম থেকে বেরিয়ে ছাঁদে ওঠেন। নেই সেখানেও। নিচে নেমে বাইরের দিক হাঁটা ধরেন। বাগান ডিঙিয়ে সদরদরজার সামনে এসে দাঁড়ান। দারোয়ান বসে ঝিমাচ্ছে। মোস্তফা সাহেব গম্ভীর স্বরে ডাকেন। ধড়ফড়িয়ে দাঁড়ায় দারোয়ান। ঘুম-ভাঙা গলায় সালাম জানায়। মোস্তফা সাহেব জিজ্ঞেস করেন, ‘তন্ময় বেরিয়েছে?’
‘জি স্যার। একটু আগেই বেরোলো।’
‘ছেলেটা এমন ভোরবেলা বেরোলো, আমায় জানাবে না?’
‘তন্ময় বাবা না করলেন।’

অতিষ্ঠ ভঙ্গিতে বাড়ির ভেতর এলেন মোস্তফা সাহেব। সেলফোন বের করে ছেলেকে কল করলেন। ধরছে না তবে রিং হচ্ছে! চিন্তিত তিনি লিভিংরুমে বসে থাকলেন ছেলের আশায়। এমনটা তন্ময় কখনো করে না। পরিপাটি ছেলে সে। উশৃংখল বোধক কোনো আচরণ তার মধ্যে নেই। কী এমন হলো?
_____

চলবে ~

(আমার প্রথম বই ‘প্রেমান্দোলন’ এর প্রি-অর্ডার চলছে। অর্ডার কনফার্ম করেছেন ত?)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here