শাহজাহান তন্ময় – ৯
শাবিহা দুয়ারে দাঁড়িয়ে সমানে কাঁদছে। কাঁদতে কাঁদতে মেয়েটার মুখমণ্ডল লাল। চোখের সামনে থেকে গায়েব হয়ে গেল মা-ভাই। হাজার আকুতি করেও থামাতে পারেনি। বাড়ির বাকি সদস্যদের অবস্থাও নাজেহাল। অরু ঘুমন্ত মুখশ্রী নিয়ে হন্তদন্ত ভঙ্গিতে নিচে নামছে। তাড়াহুড়ো পায়ে বেরিয়ে গেল দুয়ার খুলে। দীপ্ত ও তার পিছু পিছু ছুটেছে।
তন্ময় করুণ গলায় বলে,
‘আম্মু! প্লিজ, জেদ করে না। তুমি ভেতরে যাও।’
জবেদা বেগম অঝোরে কাঁদে। ল্যাগেজ হাতে হাঁটতে শুরু করে ছেলের সামনে,
‘তোকে একা যেতে দিব? কখনো না। কীভাবে থাকবি? কখনো একা বাইরে থাকতে পেরেছিস? হোম-সিক হয়ে পড়িস। একা থাকতে পারবি না।’
‘তুমি চলে এলে বাবাকে কে দেখবে? অসুস্থ হয়ে পড়বে। শাবিহার কথাও তো ভাবা দরকার।’
‘কোনো চিন্তা নেই। সুমিতা-মুফতি আছে। দেখেশুনে রাখবে।’
জেদি মায়ের সামনে তন্ময় হার মানল। অরু আর দীপ্ত তাদের সামনে এসে থেমেছে। ঘুমন্ত অরুর ঘুমের রেশ এখনো কাটেনি। মেয়েটার সদ্য ঘুম ভাঙা মুখশ্রী চোখের জলে লেপ্টে। তন্ময় সেই মুখপানে দৃষ্টিপাত করে রইল। অরু জবেদা বেগমের আঁচল টেনে ধরেছে,
‘অ্যাই বড়ো মা! কোথায় যাচ্ছ আমায় ফেলে? কোথাও যেতে দিব না। চলো বাড়ি।’
জবেদা বেগম অরুকে বুকে টেনে নিলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
‘তোর চাচ্চুর খেয়াল রাখিস। খুব বড়ো দায়িত্ব দিয়ে গেলাম। পালন করবি, কেমন?’
অরুর সেই কী কান্না! হাউমাউ শব্দে কাঁদছে। জবেদা বেগমকে মানাতে না পেরে তাকায় তন্ময়ের পানে। তন্ময়ের শান্ত মন কিংবা তার শান্ত দৃষ্টি কিছুই আজ আর শান্ত নেই। অশান্ত এবং বেসামাল। অরু দু’পা এগিয়ে তন্ময়ের পেটের দিকটার শার্টের অংশ টেনে ধরে। আকুতি ভর্তি কন্ঠে বলে,
‘ফিরে চলুন না তন্ময় ভাই।’
তন্ময় নিজের পুরুষালি হাতটা অরুর মাথায় রাখে। অগোছালো চুলগুলো গুঁছিয়ে দেয়। এক আকাশসম মন খারাপ আড়াল করে, গভীর গলায় বলে,
‘বাগানে উদোম পায়ে যাবি না। ঘরের দরজা ঘুমানোর আগে বন্ধ করে শুবি। স্কুলে যাবার পথে গাড়ি নিবি। বি আ গুড গার্ল।’
অরুর কান্নার মাত্রা বাড়ল বলে। তন্ময় দীপ্তর মাথায় হাত বুলিয়ে এগিয়ে সদরদরজা পাড় করে। জবেদা বেগম শেষবার নিজেদের বাড়িটার দিক তাকালেন। আঁচলে মুখ চেপে ছেলের পেছন-পেছন চলে গেলেন।
বারান্দায় আড়াল হয়ে দাঁড়ানো মোস্তফা সাহেবের নয়ন ভর্তি জল। খুব গোপনে কোণ ঘেঁষে আসা জল মুছে নিলেন। লালিত করুণ চোখজোড়া দেখে গেল যন্ত্রণাদায়ক দৃশ্যটি।
ডেবিট-ক্রেডিট এমনকি গাড়ির চাবি সহ সবকিছুই তন্ময় রেখে এসেছে লিভিংরুমে। পকেটে হাজারের ওপরে কিছু টাকা। সে একা হলে বন্ধুদের বাড়ি উঠে যেত। তবে সঙ্গে তার মা রয়েছে। এজন্য তন্ময় বেশ চিন্তায় পড়ে। জবেদা বেগম ছেলের চিন্তা বুঝে নিলেন মূহুর্তে। তিনি কাঁধ ব্যাগে হাত ঢুকিয়ে কিছু টাকা বের করে বলেন,
‘এগুলো আমার জমানো। দশ হাজার। তোর নানা দিয়েছিলেন। আপাতত নে। তারপর গয়না আছে। এগুলোও তোর নানীর। বিক্রি করে ফেলবি।’
তন্ময় মন খারাপ নিয়েও হাসে। মায়ের হাত থেকে ল্যাগেজ নিয়ে নেয়। তার কাঁধ চেপে নিজর সাথে নিতে নিতে বলে,
‘শাহজাহান মোস্তফা সাহেবের থেকেও তোমায় বেশি ভালো রাখব মা!’
জবেদা বেগম হাসেন অশ্রুসিক্ত নয়নে। আগ বাড়িয়ে ছেলের ঘামে ভেজা মুখশ্রী মুছে দিলেন আঁচল দিয়ে।
______
‘রানিং শপ’ রেস্টুরেন্টে ঢুকে প্রথমেই জবেদা বেগমকে বসিয়ে দিল সোফায়। মায়ের জন্য খাবার আর নিজের জন্য কফি অর্ডার করে, মোবাইল হাতিয়ে ফেইসবুক ঢুকল। চটজলদি ফ্ল্যাট খোঁজার জন্য, একটা পোস্ট করে ফেলল। খুব ভালো মানের ফলোয়ার থাকায় ভীড় জমে গেল মন্তব্য সেকশনে। তাদের এরিয়ার মধ্যেই ভালো মানের ফ্ল্যাট সম্পর্কে জানতে পেল। যেগুলো ইতোমধ্যে খালি। চাইলে আজই ওঠা সম্ভব। তন্ময় ফ্ল্যাটের ছবির সাথে উল্লেখিত কন্টাক্ট নাম্বারে কল দিতে লাগল, একেক করে। কয়েকটার সঙ্গে কথাবার্তা বলে দুটো ফ্ল্যাট বাছাই করে নিলো। আর দুটো ফ্ল্যাটই পাশাপাশি। যেকোনো একটা চুজ করবে দেখেশুনে। তাদের ফ্ল্যাট শাহজাহান বাড়ি থেকে বেশি দূরে যেন না হয়, তার খেয়াল রাখল দারুণ ভাবে।
জবেদা বেগম খাবেন না। তন্ময় তাকে একপ্রকার জোরপূর্বক ভাবেই খাওয়াল। তারপর মা-কে নিয়ে বেরোলো রেস্টুরেন্ট থেকে। রিকশা নিয়ে সোজা গন্তব্যে এসে থামল। আটতলা বিল্ডিংয়ের বাড়ি। খুব পরিপাটি এবং নির্জন। বাড়ির সামনে একটা কৃষ্ণচুড়ার গাছ। খুবই সুন্দর সেটি। জবেদা বেগম বলেন,
‘আমাদের বাড়ির সদর-দরজার সামনে এমন একটি গাছ লাগালে কেমন হয়?’
‘ভালো। বাড়ি ফিরলেই একটা লাগিয়ে নিয়ো।’
জবেদা বেগম মন খারাপ করলেন,
‘সে তো কত দেরি।’
‘তাহলে কাল এনে দিব, আপাতত বারান্দায় লাগিয়ে নাও।’
‘হ্যাঁ, ভালো বলেছিস।’
ফ্ল্যাটটি পছন্দ হলো জবেদা বেগমের। বারান্দা খানা ভীষণ বড়ো। সবথেকে ভালো বিষয় দুটো বেডরুমেই বারান্দা। বড়ো রান্নাঘর। লিভিংরুমে দারুণ স্পেস। সমস্যা হলো ভাড়া নিয়ে। ত্রিশ হাজার। তন্ময় অবশ্য গ্রাহ্য করল না। সে অগ্রীম দশ-হাজার দিয়ে, তৎক্ষণাৎ উঠে পড়ল। পুরো খালি ফ্ল্যাটে চোখ বুলিয়ে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল। জবেদা বেগম ল্যাগেজ লিভিংরুমে মেঝেতে রেখে, রান্নাঘরে ছুটলেন। তড়িঘড়ি করে বললেন,
‘তন্ময়। আগে রান্নাবান্না কিছু করা দরকার। রান্নার জন্য আপাতত যেসব লাগবে লিস্ট করে দেই, নিয়ে আয়। তোর বন্ধুদের কল করে ডাক। খেয়েদেয়ে যাবে। নতুন ফ্ল্যাটে উঠলাম। ইনভাইটেশন দিয়ে ঘরের একটা আমেজ আনা দরকার।’
তন্ময় ভুলেও নিজের বিচ্ছু বন্ধুদের ডাকবে না। মা যতই বলুক না কেন! চুপচাপ বাজার করে আনলো দু’হাত ভরে। মায়ের হাতে সেগুলো ধরিয়ে সে বারান্দায় দাঁড়াল। চিন্তায় মশগুল। ফ্ল্যাটে এক্ষুনি কিছু ফার্নিচার লাগে। তার মায়ের কোমরে সমস্যা। নরম বিছানা ছাড়া ঘুমাতে পারবে না। চিন্তিত সে অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে।
জবেদা বেগমের রান্নাবান্না তখনো চুলোয়। সেসময় কলিং বেল বেজে ওঠে। তন্ময় দ্রুত পায়ে লিভিংরুমে আসে। জবেদা বেগম দরজা ইতোমধ্যে খুলেছেন। দারোয়ান দাঁড়িয়ে। হেসে বলে,
‘নিচে অনেকগুলো ভ্যানগাড়ি নিয়ে বেশকিছু লোকজন এসেছে। তারা নাকি আপনাদের বাড়ির অতিথি। মানে পাঁচতলার। যদি একটু এসে দেখতেন।’
তন্ময় চমকালো, ভড়কালো। জবেদা বেগম ও অবাক। ছেলের সাথে তড়িঘড়ি নেমে এলেন নিচে। সদরদরজায় এসে আহাম্মক হয়ে গেল মা-ছেলে। মোট এগারোটা ভ্যানগাড়ি। এগারোটা ভ্যানগাড়ি জুড়ে ফার্নিচার। সোফার স্যাট, ডাইনিং টেবিল, বক্স বেড, কাবার্ড ধরে অনেককিছুই। একেকটা ফার্নিচারের ওপর বড়ো কাগজ লাগানো। সেখানে লেখা তন্ময়ের বিচ্ছু বন্ধু-বান্ধবদের নাম। যেমন, গিফট ফ্রম মাহিন। গিফট ফ্রম ইব্রাহিম। গিফট ফ্রম রিহান। গিফট ফ্রম শুহানি।
মাহিন হৈচৈ ফেলে এগিয়ে আসলো,
‘আন্টি দাওয়াত দিয়েছে। দাওয়াত খেতে এলাম। খালি হাতে তো আর আসা যায় না।’
তন্ময় নির্নিমেষ চোখে শুধু তাকিয়ে রইল। সে আসলে রাগবে নাকি কাঁদবে নাকি হাসবে বুঝে পেলো না।
চলবে ~