শাহজাহান তন্ময় – ১০
বন্ধুবান্ধবদের আনা ফার্নিচার দিয়েই ফ্ল্যাট ফিল-আপ হয়ে গেল। খুব দারুণভাবে প্রত্যেকটা ফার্নিচার মিল করে নিয়ে এসেছে। লিভিংরুমের আকর্ষণীয় সোফার স্যাট খানা পুরো ফ্ল্যাটের নকশা পরিবর্তন করে ফেলেছে ইতোমধ্যে।
মাহিন ক্লান্ত ভঙ্গিতে হাত-পা ছড়িয়ে সোফায় বসেছে। রিহান, ইব্রাহিম ওরাও বসে। তিন ঘন্টা ধরে কাজ করেছে। ফার্নিচার ওঠানো, স্যাট করা থেকে ধরে এভ্রিথিং। তাই একেকজনের শ্বাসপ্রশ্বাস অস্বাভাবিক।
রান্নাঘরে জবেদা বেগমের সঙ্গে শুহানি রয়েছে। দুজন বেশ গল্পগুজব করে, রান্নাবান্না করছে। হুটহাট হাসছে শব্দ করে। এরমধ্যে রিহান দুবার উঁকি মেরেছে। ঘ্রাণে ম-ম করছে কি-না চারদিকে। ক্ষুধা কয়েকগুণ বেড়েছে। রান্নাবান্না শেষ হতেই শুহানি লিভিংরুমে এসে বলে গেল,
‘হ্যালো হ্যালো। ইটস ডিনার টাইম। ডিয়ার বয়েজ, ফ্রেশঅ্যান আপ হয়ে ডাইনিংয়ে চলে আসো চটজলদি।’
‘আসতেছি ভাই! ক্ষুধা লাগছে ভয়ংকর!’
তন্ময় গোসলে গিয়েছে সর্বপ্রথম। মাত্রই বেরিয়েছে গোসল সেড়ে। সারাদিন দৌড়াদৌড়ি করতে হয়েছে যেহেতু, শরীর ভীষণ ক্লান্ত ছিল। ঠান্ডা পানি ক্লান্তি বেশ খানিকটা দূর করতে সাহায্য করেছে। মাথা মুছতে মুছতে লিভিংরুমে আসতেই বন্ধুদের উদ্দেশ্যে বলল,
‘ফ্রেশ হয়ে নে।’
হুড়হুড় করে একেকজন গিয়ে ফ্রেশ হয়ে এলো। ছুটে গিয়ে ডাইনিংয়ে বসে পড়ল। টেবিল ভর্তি খাবার। অনেক পদের রান্না করা হয়েছে। সেগুলো সার্ভ করছে শুহানি। জবেদা বেগমের রান্নার হাত দারুণ। খাবারের নকশাই তার প্রমাণ। চেটেপুটে খেয়ে মাহিন প্রসংশা করেই চলেছে। রিহান খাওয়ার একফাঁকে বলল,
‘আন্টি, আপনার হাতে জাদু আছে। এতো দারুণ খেতে হয়েছে যে, আমার পেট ভরেছে তবে মন না।’
জবেদা বেগম হেসে বলেন,
‘তাহলে প্রত্যেকদিন চলে এসো খেতে।’
‘আমি ভীষণ নির্লজ্জ। চলে আসব কিন্তু!’
‘আচ্ছা বাবা এসো। আমি খুশি হব।’
ছেলেমেয়ে গুলো আজ খুব পরিশ্রম করেছে। সেজন্য জবেদা বেগম চাচ্ছেন না, এমন রাত করে ফিরুক। তাই তিনি বললেন,
‘আজ বরং সবাই থেকে যাও। সকালে ব্রেকফাস্ট করে না-হয় যাবে?’
তন্ময়ের বিচ্ছু বন্ধুবান্ধব জবাব না দিয়ে তন্ময়ের দিক তাকায়। যেমন তন্ময় মাথা দোলালেই সবগুলো থেকে যাবে। আর মাথা নাড়ালে হুড়মুড় করে বেরিয়ে পড়বে। খেতে খেতে অগোচরে হাসে তন্ময়। খাবার শেষ করে উঠতে নিয়ে প্রশ্ন করে,
‘থাকতে পারবি সবাই?’
‘পারব মানে? আলবাত পারব।’
এবং খাওয়া দাওয়া করেই, তন্ময়ের বিছানায় চিৎপটাং হয়ে শুয়ে পড়ে একেকটা। বিছানার এককোণে ইব্রাহিম তো আরেককোণে মাহিন। তাদের মধ্যে রিহান আবার রিহানের পায়ের কাছটায় সৈয়দ। পুরো বিছানায় তাদের রাজত্ব।
তন্ময় দাঁড়িয়ে তাদের সামনে। সবগুলোর ওপর তার নজর। দৃষ্টি নরম। গলার স্বর মোলায়েম। সময় নিয়ে বলে সে,
‘খুব চিন্তায় ছিলাম। ভেবেছিলাম খুব কঠিন হবে এবার পথা চলাটা। অথচ তোদের জন্য সবকিছু কেমন সহজ হয়ে গেল। ধন্যবাদ!’
মাহিন বিছানা থেকে ঝাপিয়ে চড়ে বসে তন্ময়ের পিঠে। হঠাৎ আক্রমণে তন্ময় প্রায় পড়ে যেতে নেয়। কিন্তু পড়ে না। দেয়াল ধরে নিজেকে সামলে ওঠে। মাহিন সেভাবেই ভেঙচি কেটে বলে,
‘শালা! এখন এই সামান্য কিছুর জন্য ধন্যবাদ দিচ্ছস! আর তুই যে আমাদের জন্য এততকিছু করছস, কখনো ধন্যবাদ দিতে দিছস? বাটপার! এরপর সাহায্য করিস খালি আমারে। তোর চোদ্দগুষ্টি সহ আমি মাহিন ধন্যবাদ দিয়ে ভাসামু, মনে রাখিস।’
হেসে ওঠে সবাই। তারাও ছুটে আসে বন্ধুত্বের বন্ধনে বন্দী হতে। শুহানি তখন মিষ্টির প্লেট হাতে কেবলই দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল। এমন দৃশ্য দেখতেই গলা ফাটিয়ে চেঁচায়,
‘আরে আরে, আমি কই! চাপ চাপ আমিইও ঢুকব।’
বলতে বলতে প্লেট পাশে রাখতে নেয়। যেমন রেখেই দৌড়ে ছেলেদের হাগিং সিচুয়েশনে ঢুকে পড়বে।
রিহান ধমক দেয়,
‘এই আসবি না তুই। খবরদার শুহানি। এখানে আমরা ছেলেরা!’
‘তাতে কী? আমি আসব। একশোবার আসব। দেখি সর মাহিন। জায়গা দেয়। আমায় ছাড়া কোনো গ্রুপ হাগ হবে না। বিগ নো!’
তন্ময় হাসে। মাহিনকে ঠেলে জায়গা করে। তারপর হাত বাড়ায়। শব্দ করে বলে,
‘আয় ঢোক।’
শুহানি দৌড়ে ঢুকে পড়ে বন্ধুদের মধ্যে। নিজেদের গ্রুপের ফেমাস গানটি ঘুড়তে ঘুড়তে গেয়ে ওঠে সবাই মিলে। এটা তাদের বন্ধুত্বের থিম সং। ভালো কিছু হলেই গেতে হবে। জবেদা বেগম দূর থেকে বাচ্চাদের এরূপ দৃশ্য দেখে হাসছেন। বাড়ি থেকে বেরোনোর শূন্যতা বাচ্চাগুলো কমিয়ে দিয়েছে।
______
ঘড়ির কাঁটা রাত তিনটায়। সকলে গভীর ঘুমে। তন্ময় ল্যাপটপের সামনে বসে। সবকিছু ফেলে আসলেও ল্যাপটপ ফেলে আসেনি। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আপাতত খুব ব্যস্ত ভঙ্গিতে বড়ো বড়ো কোম্পানির এভেইলএভল পজিশনে সিভি ড্রপ করছে৷ সেসময় তার ফোন বেজে ওঠে।
নাম্বারটি অরুর। লাস্টে বিরানব্বই। তন্ময়ের মুখস্থ নাম্বার। এবং সে নাম্বারটি সেভ করেছে ‘কালপ্রিট’ দিয়ে। যার মানে অপরাধী। খুব বড়ো অপরাধ করেছে অরু। আর সেটা হলো, তন্ময়ের শীতল হৃদয়ের জানালা খুলে ঢুকে পড়া। শুধু ঢুকে শান্ত হয়নি। সেখানে নিজের চঞ্চলতা দিয়ে রাজত্ব বসিয়েছে মেয়েটা।
তন্ময় ফোন হাতে উঠে দাঁড়ায়। স্লাইড ডোর খুলে বারান্দায় আসে। আকাশে বড়ো চাঁদ। বাতাস বইছে। আশপাশের দৃশ্য দারুণ। এখান থেকে মেইন রোডের দেখা যাচ্ছে। গাড়িঘোড়া নেই। সবকিছু শান্ত এবং নির্জন। কল রিসিভ করে কানে ধরতেই অরুর কান্নার স্বর শোনা গেল। এতে তন্ময়ের বিন্দুমাত্র খারাপ লাগল না। বরং সে চোখ বন্ধ করে চুপচাপ শুনছে। কান্নার একফাঁকে অরু ফুঁপিয়ে ডাকে,
‘তন্ময় ভাই।’
তন্ময়ের চিকন ঠোঁট ঘেঁষে হাসি ছুটে। গলার স্বর সাবলীল করে বলে,
‘হু। কি হয়েছে?’
‘আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। খুব মিস করছি বড়ো মাকে।’
‘শুধু বড়ো মাকে?’
অরুর কান্নার মাত্রা বাড়ল। ফুপিয়ে উঠল। নাক টানছে শব্দ করে। কান্নার তোড়ে নিশ্বাস আটকে আসছে যেন। তন্ময় নিঃশব্দে হাসছে। না দেখেই বুঝতে পারছে অরুর অবস্থা। রুম জুড়ে নিশ্চিত টিস্যু ফেলে রেখেছে। এই দাঁড়াচ্ছে না-হয় বসছে। মেয়েটা অশান্ত এবং অধৈর্য কি-না! অরু সময় নিয়ে জবাব দেয়,
‘আপনাকেও। ফিরে আসুন না।’
‘সময় হলেই ফিরব।’
‘কবে হবে সময়?’
‘খুব জলদি।’
‘কোথায় আছেন?’
‘কাছেই।’
‘আমিও আসব।’
‘আচ্ছা।’
‘প্রত্যেকদিন আসব।’
‘হু।’
‘সাইকেল করে আসতে পারব না?’
‘পারবি।’
‘পড়তেও চলে আসব।’
‘উম, ওকে।’
‘আমাকে পড়াবেন না?’
‘হু।’
‘প্রত্যেকদিন পড়ব।’
‘ঠিকাছে।’
‘আজকে বাড়ির সবাই না খেয়ে। সবার মন খারাপ। আমারও। তাই আমিও কিচ্ছু খাইনি। আমার না খিদে পেয়েছে। কিন্তু খেতে নিলেই কান্না পায়।’
‘কাঁদতে কাঁদতেই খেয়ে নে।’
‘আচ্ছা।’
তন্ময়ের হৃদয়ের অরু নামক অসুখটা অনেকাংশে কমে গেল। ভালো লাগায় দুলিয়ে উঠল শরীর। আকাশের পানে তাকিয়ে বিড়বিড়িয়ে বলে,
‘ক্ষনিকের দূরত্ব যদি তোকে চিরতরে পাওয়ার রাস্তা হয়ে থাকে, তাহলে তাই সই!’
চলবে ~