শাহজাহান তন্ময় – ১১
জানালায় পর্দা লাগানো হয়নি। ফলস্বরূপ স্কাই-ব্লু থাই-গ্লাস ভেদ করে সূর্যের স্পর্শ পড়েছে তন্ময়ের মুখমণ্ডল জুড়ে। ঘর জুড়ে সূর্যের প্রতিফলন। আড়মোড়া ঘুম ভাঙে। তার পায়ের ওপর লম্বা পা-জোড়া ফেলে রেখেছে সৈয়দ। পিঠের ওপর মাহিনের মাথা। চোখের সামনে ইব্রাহিম নাক ডেকে যাচ্ছে। এদের একেকজনের ঘুমের ভঙ্গিমা ভীষণ রকমের বিশ্রী। তন্ময় সবগুলোকে ঠেলেঠুলে উঠে বসে। জানালার সামনে এসে দাঁড়ায়। বাইরে নজর ফেলতেই ভাবনায় আসে, রুমে পর্দা লাগানো প্রয়োজন। এতো আলো ঘরে থাকাটা তার মোটেও পছন্দ নয়৷ নিভু-নিভু রুম তার স্বাচ্ছন্দ্যের। সেদিকে অরু আবার ভিন্ন। মেয়েটা জানালা কখনো লাগায় না, না লাগায় সে পর্দা। ঘর-দুয়ার আলোয় আলোয় রাঙিয়ে রাখে। দুদন্ড আঁধার মেনে নিতে পারে না। সবকিছু উজ্জ্বল এবং রঙবেরঙের হতে হবে ওর। তন্ময় যদি এই মেয়ে নিজের রুমে তোলে, জীবন যৌবনের সব চাওয়া-পাওয়া ছেড়ে দিতে হবে। অবশ্য সে ছাড়তেও রাজি৷ ভাবতেই ঠোঁট জুড়ে বিচিত্র হাসি ছুটে এলো। সেলফোন হাতে নিল। অরুর ম্যাসেজ এসেছে ভোর পাঁচটায়। মেয়েটা ঘুমোয়নি। জেগেই ছিল সারারাত! তরতর করে ম্যাসেজ দিয়েই চলেছে ছ’টা পর্যন্ত। একে এখন আর লাই দিয়ে মাথায় চড়ানো যাবে না। একটু-আধটু ধমকে রাখতে হবে। নাহলে যেই বয়সে ও পড়েছে! সবকিছু ভস্ম করার পূর্বে তন্ময়কেই জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ভস্ম করে ফেলবে।
ব্রেকফাস্ট খেতে বসে হৈ-হুল্লোড়ের ঠ্যালায় তন্ময়ের মাথা ব্যথা শুরু হলো। তার বন্ধুবান্ধব থাকবে আর মাথা ব্যথা হবে না, তা আদোও সম্ভব? চুপচাপ খেতে থাকা তন্ময়কে খোঁচানোর একটুকরো সময় ব্যয় করছে না মাহিন। পরিমাণ মতো তেলে ভাজা রুটির সঙ্গে আলুভাজি খেতে খেতে বলে,
‘কোন কোন কোম্পানিতে এপ্লাই করলি?’
তন্ময় সাবলীল গলায় জবাব দিল। কোম্পানির নাম গুলো বলল। পরমুহূর্তেই রিহানের মুখ খুলল। এতক্ষণ মুখে কুলুপ এঁটে বসে ছিল। জবেদা বেগম ছিলেন কি-না! যেই না তিনি রান্নাঘরে গেলেন, ওমনি বুলেটের গতিতে বলে উঠল,
‘খেয়াল রাখিস। চারপাশে নজর দিস। কখন না কখন আবার রমনীগণদের বুকে টোকা মেরে দিবি! ওমনি পিছু পড়ে যাবে তোর। ভূলবসত আবার কোম্পানির এমডির কচি মেয়ের হৃদয় নিয়ে ফেলিস না। কেস খাবি বলে দিলাম।’
হেসে উঠল সৈয়দ। কিছু একটা মনে পড়েছে এমন ভঙ্গিতে বলে ওঠে,
‘রাইসার কথা মনে আছে? রিসাবের বোনটা! মেয়েটা কি পাগল ছিল তন্ময়ের! কতকিছুই না করেছে। এখনো আমায় পেলে জিজ্ঞেস করে, তন্ময় কেমন আছে!’
‘বিয়ে হয়ে গিয়েছে শুনেছিলাম।’
‘এখন বাচ্চাও আছে একটা।’
তন্ময়ের খাওয়ার ভঙ্গিমার মোটেও পরিবর্তন এলো না। সে নিজের মতোই খেয়ে চলেছে। বন্ধুদের কথায় একটু-আধটু মুখ তুলছে। সে যেমন নিজের বন্ধুদের হাড়গোড় সহ চেনে, তেমনি তার বন্ধুরা তার হাড়গোড় সহ চেনে। তাই তাদের এসব অদ্ভুত কথাবার্তার সমাপ্তি ঘটবে না, যতক্ষণ না তন্ময় বলবে, ‘আহ, থামবি তোরা!’
______
বড়ো বড়ো কোম্পানির বড়সড় পদ গুলোতেই সিভি ড্রপ করেছিল তন্ময়। দুটো থেকে ডাক পড়েছে পরদিনই। ডাক পড়ারই কথা। তাদের নিজেদের কোম্পানি বড়ো বড়ো কোম্পানির সাথেই যুক্ত। শাহজাহান লিমিটেড গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির প্রেসিডেন্ট পদে সে ছিল কিছুদিন। সাতটা ফ্লোর তার আন্ডারে ছিল। ছ’মাস সময় নিয়েছে তাদের যাবতীয় কাজের সূত্রপাত শুরু থেকে বুঝে নিতে। গতমাস থেকেই সে তাদের বেশ কিছু ব্যবসা বুঝে নিয়েছিল। নিজেই দেখত। সেগুলোর দায়ভার তার ওপর ছিল। তার সিগনেচার ছাড়া কোনো কিছু নড়চড় হতোনা। এতসব প্রাপ্তি নিয়ে একটা ভালো মানের চাকরি পাওয়া, তারজন্য কঠিন বিষয় অবশ্যই নয়। কিন্তু সে চাচ্ছিল না মোস্তফা সাহেবের নাম কামিয়ে চাকরি করতে। আবার তাছাড়া উপায় ও দেখা যাচ্ছে না। জবেদা বেগম আছেন সঙ্গে। তার দায়িত্ব তন্ময়ের। সেই দায়িত্ব পালন করার বড়ো রাস্তা টাকাপয়সা। তাই এক্ষুনি চাকরি দরকার। বাবার ওপর জেদ ধরে বসে থাকা সম্ভব নয়।
তন্ময়ের সেলফোন লিভিংরুমে। সেটি কখন থেকে বেজে চলেছে। জবেদা বেগম রান্নাঘর থেকে ছুটে এলেন। ফোন হাতে নিয়ে ছেলের রুমে প্রবেশ করেন। তন্ময় গোসলঘরে। তিনি শব্দ করে ডাকেন,
‘অ্যাই তন্ময়! ফোন বাজছে।’
তন্ময় ‘আসছি’ বলে ছোট জবাব দেয়। মিনিট খানিকের মধ্যেই বেরিয়ে আসে। জবেদা বেগম ততক্ষণে ফোন রেখে চলে গিয়েছেন। তন্ময় ফোন হাতে নিলো। কল এসেছে তার চাচ্চু, ওহী সাহেবের৷ পুনরায় আসতেই রিসিভ করে তন্ময়। ওপাশে ওহী সাহেব গলা খাঁকারি দিয়ে ওঠেন। রক্ষ গলা কোমল করার ভঙ্গিতে ডাকেন,
‘তন্ময়!’
‘জি চাচ্চু।’
‘কি অবস্থা তোমাদের?’
‘এইতো ভালো।’
‘এভাবে পড় করে ফেললে চাচ্চুকে?’
তন্ময় নিঃশব্দে হাসে। সে সত্যিকারের অর্থে একজন শাহজাহান। বাপচাচারা যেমন ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কথা বলতে জানে না, তেমন সেও জানে না। এইযে ওহী সাহেব কথা খুঁজতে চাচ্ছেন কিন্তু পাচ্ছেন না ব্যাপারটা তারজন্য হাস্যকর বটে৷ সে খুব সাধারণ ভাবেই জবাব দেয়,
‘ইম্পসিবল। আপনারাই তো সব।’
‘আমিতো তাই জানি। তাহলে বলছিলাম যেটা! আমরাই সব! আমরাই সব বলতে অবশ্যই আমি আর আনোয়ার তো, তাই না? বড়ো ভাইজানের সাথে রেগেছ সেটা ভাইয়ার ওপরে। আমাদের ওপরে ত রাগ নেই! আমিতো এরমধ্যে একদমই নেই। আর জানোই, আমি একটু অসুস্থ। সেই চট্রগ্রাম গিয়ে ব্যবসার দেখাশোনা করতে পারছি না। আব্বা, তুমি যদি একটু…’
তন্ময় মাঝপথেই ডেকে ওঠে,
‘চাচ্চুউ! শাহজাহান ব্যবসায় আমি আর থাকব না। আমি অন্য কোম্পানিতে এপ্লাই করছি। দোয়া করবেন যেন জব-টা হয়ে যায়। আর শাহজাহান মোস্তফা সাহেবকে বলে দেবেন, আমি শাহজাহান তন্ময় তার টাকাপয়সা ছাড়া বেশ চলতে পারব।’
ওহী সাহেবের ফোন স্পিকারে দেওয়া ছিল। তন্ময়ের কথাগুলো উপস্থিত সকলে শুনতে পেলো স্পষ্ট। লিভিংরুমে বসে থাকা মোস্তফা সাহেবের মুখশ্রী কালো হয়ে গেল। ওহী সাহেব আলগোছে স্পিকার সরিয়ে ফেলেন। থতমত খাওয়া বললেন,
‘বলছিলাম যে… ‘
সে-মুহুর্তে মোস্তফা সাহেব শব্দ করে বলেন,
‘ওকে বলে দে ওহী, আমি শাহজাহান মোস্তফা ওর হাত-পা ধরে কোম্পানিতে আনতে যাব না। ও না আসলে না আসবে। আমি আমার সম্পত্তি গোল্লায় ফেলব। জলে ঢালব, বিলিয়ে দিব। তাও ওকে ধরেবেঁধে আনতে যাব না। যাক… ও নিজের রাস্তায়। বাবার আর দরকার কী! বড়ো হয়েছে এখন যা ইচ্ছে করবে! আমি মরে যাচ্ছি না… ওদের ঘরে তোলার জন্য… ‘
তন্ময়ের এবার সামান্য হাসিই পেলো। সঙ্গে এই এক্ষুনি বাবাকে দেখার বড়ো পিপাসা জন্মাল। মানুষটা নিশ্চয়ই প্রেসার বাড়িয়ে ফেলেছে। গলার স্বর ও অচেনা লাগছে। ভেঙে ফেলেছে কন্ঠ। ওই কন্ঠস্বর শোনার মতো শক্ত মন তন্ময়ের আপাতত নেই। সে বাবার কথা মাঝপথে থামিয়ে বলে,
‘এসব বলে লাভ নেই। আমি শাহজাহান তন্ময় ফিরছি না। ফিরব না। রাখলাম।’
মোস্তফা সাহেব চোখ রাঙালেন ওহী সাহেবের ফোনের ওপর। তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ফোনের ওপাড়ে থাকা তন্ময়ের ওপর যেন!
______
বিকেলে তন্ময় বেরোচ্ছিল! তখনই দেখতে পেলো একজন ভদ্রমহিলা দাঁড়িয়ে। মোটাসোটা ধাঁচের খাটো ফর্সা মহিলা। তাদের ফ্ল্যাটেই এসছেন যেন! ওর আগাগোড়া দেখে আরেকদফায় হাসলেন। অপ্রস্তুত তন্ময় সালাম জানালো। মহিলা এবার আরও উদ্বিগ্ন চোখে তন্ময়কে দেখতে থাকলেন। হেসে বললেন,
‘আমি তোমার বাড়িওয়ালা আন্টি বাবা। ওপরের ফ্ল্যাটে থাকি। ব্যস্ত থাকার কারণে আসতে পারিনি। তোমার আম্মু আছে বাসায়?’
‘জি। ভেতরে।’
সদরদরজার সামনে আসতেই দারোয়ানের সাথে দেখা। টুকটাক কথা বলে বেরোতেই তার চোখ গেল মোড়ে। গোলাপি ফুলের গাছটার নিচে সাইকেল হাতে অরু দাঁড়িয়ে। এদিক-ওদিক সমানে তাকাচ্ছে। একে-ওকে ডেকে কিছু একটা জিজ্ঞেস করছে৷ সাদা ফ্রোক পড়েছে। লম্বা চুলে বিনুনি। দুদিন না দেখেই তন্ময়ের মনে হলো, মেয়েটাকে সে বছর ধরে দেখেনি। বেবিপাওডারের গন্ধটাও যুগ যুগ ধরে শুঁকেনি। দু-পাশে মাথা দুলিয়ে এগোল সামনে। তাকে দেখতে পেয়েই অরুর চোখজোড়া বড়ো হয়ে গেল। পরমুহূর্তেই কান্নারত মুখশ্রী জলে ভিজে ওঠে। সাইকেল খানা হাত ফসকে পড়ে। তন্ময় চটজলদি সেটা এক হাতে ধরে। ওমনি অরু ছুটে এসে তার বুকের মধ্যে পড়ে। যে কাজটা তন্ময় করতে পারতো না, কিন্তু তার আকাঙ্খায় ছিল, সে কাজটা অরু করে বক্ষে একরাশ শান্তি দিয়ে ফেলল। সমানে নাক টানার শব্দ আসছে। বুকের অংশের শার্ট নিশ্চিত চোখের জলে, নাকের জলে ভিজিয়ে ফেলেছে। তন্ময় মাথা তুলে তাকাতেই দেখল, আশেপাশে মানুষ তাকিয়ে। অরু তখনো কাঁদছে শব্দ করে। পাশে দিয়ে যেতে থাকা ছোকরা গুলো বিড়বিড় করছে। বিড়বিড় করে কি বলল, তা স্পষ্ট শুনল তন্ময়,
‘আমার গার্লফ্রেন্ড এমন করলে বুকের মধ্যে এতক্ষণে ঢুকিয়ে ফেলতাম ভাই! এই লোক কেম্নে এভাবে দাঁড়িয়ে কাঠের মতো!’
চলবে ~