শাহজাহান তন্ময় – ১২
এইযে তন্ময় কাঠকাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে। হাত জোড়া ঠিক কোথায় রাখবে ভেবে পাচ্ছে না। মস্তিষ্ক ফাঁকা হয়ে আছে। অরু হচ্ছে আগুনের দ্বিতীয় রূপ। যাকে ছুঁয়ে দিলেই ধ্বংস নিশ্চিত।
এসেছে অবদি মেয়েটা জাপ্টে ধরে আছে তাকে। ওরকম নরম তুলতুলে শরীর লেপ্টে রাখার কোনো মানে হয়? ও কি ছোটো আছে? নির্ঘাত সে ধৈর্যবান পুরুষ। তার জায়গায় অন্যকেউ হলে মাথায় আগুন লাগিয়ে ঝলসে যেতো! পৃথিবী ত্যাগ করে বসত! ইচ্ছে তো করছে বড়ো এক রামধমক দিতে। তবে শেষমেশ অরুর মায়াবী-করুণ মুখমণ্ডল দেখে, ধমক দেওয়ার ইচ্ছেটা পূর্নতা আর পেলো না। চুপচাপ রয়েসয়ে রইল তন্ময়। কিন্তু সেটুকুও থাকতে পারলো না। অরুর শরীর আরেকটু নিবিড়ভাবে লেপ্টে আসতেই মগজ জ্বলে ওঠে! দ্রুত অরুর কপালে আঙুল ছুঁয়ে সরিয়ে দেয়। নাকমুখ লাল করে ফেলেছে কেঁদেকেটে। ফুলে টমাটো হয়েছে গাল দুটো। চোখের জল নাকের জল লেপ্টে এলাহি কান্ড। তন্ময় নিজের বুকের দিক তাকাল। ভিজিয়ে ফেলেছে। শার্ট পরিবর্তন করা প্রয়োজন।
প্যান্টের পেছন পকেট হাতড়ে রুমাল বের করে।
অরুর হাতে ধরিয়ে বলে,
‘অরু! একদম চুপ! এতো কাঁদার কি আছে? এখনো বেঁচে আছি।’
‘আ..আপনি এভাবে কথা বলতে পারছেন আমার সাথে? একটুও মিস করেন নাই আমাকে!’
রুমালটায় সর্দি মুছে মুহুর্তে নষ্ট করে ফেলে অরু। তারপর ওটাকে তন্ময়ের সামনে এগিয়ে ধরে, জেনেও যে তন্ময় ওটা আর নিবে না। তন্ময় তখন সরু চোখে তাকিয়ে অরুর পানে। এভাবে তাকানো দেখে অরু ভড়কায়,
‘একটুই ত ময়লা হয়েছে! আমি ধুয়ে দিব।’
তন্ময় জবাব দেয় না। পাগলের সাথে আগ বাড়িয়ে কথাবার্তা বাড়ানোর কোনো মানে নেই।
আপাতত বন্ধুদের একটা কল দেওয়া প্রয়োজন। সে মূলত বেরিয়েছিল ওদের কাছে যাওয়ার জন্য। এখন অরুকে ফেলে যাওয়া অসম্ভব ব্যাপার স্যাপার। মাহিনকে কল করে জানালো, সে যেতে পারবে না। কাল সন্ধ্যায় দেখা করবে। সেলফোন প্যান্টের পকেটে ভরে, সাইকেলটা শক্তপোক্ত ভাবে ধরে। সাইকেলের সামনের ঝুলিতে একটি ফুলগাছ। খুব সুন্দর স্যাট করা। ডেকোরেশন করে রেখেছে পুরো সাইকেল জুড়ে। মেয়েটা ডেকোরেশনে এক্সপার্ট, মানতেই হয়। অরু তন্ময়ের নজর খেয়াল করে গাল ফুলিয়ে হাসে। আগ বাড়িয়ে বলে,
‘সুন্দর না? ফুল এতটাই সুন্দর যে এটা যেখানে থাকে সেটাও সুন্দর হয়ে ওঠে! দাঁড়ান, আপনার পকেটে একটা ফুল গুঁজে দেই।’
‘না।’
‘আরে একটাই তো…’
অরু হুড়মুড়িয়ে একটা ফুল ছিঁড়ে নেয়। তন্ময়ের সামনে দাঁড়িয়ে শার্টের পকেটে ফুলটা গুঁজে দেয়। মুগ্ধ নয়নে দেখতে লাগে। কি সুন্দর ফুটে উঠেছে ফুলটি তন্ময়ের স্কাই রঙের শার্টের সঙ্গে! তন্ময় দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে। সাইকেল হাতে চালিয়ে সামনে অগ্রসর হয়। সেই পর্যন্ত অরুর মুখ এক-সেকেন্ড থেমে নেই,
‘কোনটা বিল্ডিং? ওইযে গাছের সাথেরটা? সুন্দর। চলুন তাড়াতাড়ি যাই। বড়ো মা কেমন আছে? কি করছে সে? নিশ্চয়ই আমার জন্য কেঁদেছে? আমি জানি তো। আপনি মিস না করলেও, বড়ো মা আমায় ভীষণ মিস করেছে….’
এবং অরুর কথার শেষ নেই। চলতেই থাকে। তন্ময় সামনে তাকিয়ে। যেমন পাশের মেয়েটি কি বলছে তার গ্রাহ্য নেই! অথচ কানে প্রত্যেকটা শব্দ ভেসে আসছে। এবং একজন বিচক্ষণ শ্রোতা হয়ে শুনছে। সদরদরজায় দাঁড়ানো দারোয়ান চাচা হাসে। তন্ময়কে প্রশ্ন করে,
‘কি হয় তোমার!’
তন্ময়ের জবাব দিতে হয় না। অরু হুড়মুড়িয়ে এগিয়ে সামনে যায়। গলার স্বর নামিয়ে বলে,
‘আমরা খুব আপন। কেমন আপন ভবিষ্যতে বলব!’
দু-চোখে ডান হাতের আঙুল চেপে নিঃশব্দে, অগোচরে হেসে ফেলে তন্ময়। এবং অরুর মাথা ফেরার পূর্বেই হাসিটুকু মিলিয়ে নেয়। ওদিকে বোকার মতো তাকিয়ে থাকে দারোয়ান চাচা। তন্ময় আর তাকে বিশ্লেষণ করে না। সাইকেল ডাউন ফ্লোরে রেখে, অরুকে নিয়ে লিফটে চড়ে। মেয়েটা একমুহূর্ত শান্ত থাকে না। এইযে পাশে গুইসাপের মতো নড়েচড়ে যাচ্ছে। আড়চোখে সমানে তাকাচ্ছে। একবার ওপরে, একবার নিচে। যেন সে তন্ময়ের আগাগোড়া মুখস্থ করছে। অরু
পিটপিট করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে মুখ খোলে,
‘কোথাও যাচ্ছিলেন তন্ময় ভাই?’
‘হু।’
‘কোথায় যাচ্ছিলেন?’
তন্ময় পলক নিচু করে তাকায়। অরু তার তুলনায় ছোটো। দেখতেও ছোটো, লম্বায় ও ছোটো। এই কারণ বসত উঁচু জুতো পরে থাকে ইদানীং। বিষয়টি লক্ষ্য করেছিল সে। আড়ালে আবডালে হেসেছিলও। তবে আজ স্নিকার পরে এসেছে। তাই ঠিক তার বুকের মাঝের উচ্চতায় স্থান পেয়েছে। পলক নিচু করলেই ওর আগাগোড়া মাপা যায়। ঠিক তার এক হাতে সম্পূর্ণ অরু এঁটে যাবে। নজর সরিয়ে নিয়ে বলে,
‘ধানমন্ডি লেক।’
‘আপনার বন্ধুদের কাছে? ওইযে লম্বা ভাইয়াটা?’
‘কোন লম্বা?’
‘ওইযে ইব্রাহিম নামের।’
‘হু।’
‘আমি ওই ভাইয়াটার একটা সিক্রেট জানি।’
‘কি সিক্রেট?’
‘বলব না।’
লিফটের দরজা খুলেছে। ওমনি অরু দৌড়ে চলে গেল। ফ্ল্যাট চিনতেই সেখানে লাগাতার বেল বাজাতে শুরু করে। ভেতরে জবেদা বেগম একপ্রকার আতঙ্কিত হয়ে ছুটে আসেন। স্পটে অরুকে দেখে চটজলদি দরজা মেলে দেন। অরু ঝাপিয়ে পড়ে জবেদা বেগমের বুকে। কাঁদতে থাকে দিনদুনিয়া ভুলে। এইযে একটু আগে তন্ময়ের সামনে কে হাসছিল? এই মেয়েটার মুড পরিবর্তন হতে মিনিটের প্রয়োজন পড়ে না। তন্ময় আঁড়চোখে তাদের দেখে ভেতরে ঢুকে। জুতো রেখে লিভিং-রুমে আসতেই থমকে যায়। বাড়িওয়ালা আন্টি এখনো আছেন। সোফায় বসে। তন্ময়কে দেখেই মিষ্টি করে হাসেন। তন্ময় পুনরায় সালাম দেয়। এবং আলগোছে নিজের রুমে চলে যায়, কথাবার্তা বাড়ানোর সুযোগ না দিয়ে।
_______
রাহনুমা বেগম চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে প্রশ্ন করেন,
‘কি হয় আপনার?’
জবেদা বেগম অরুর চুলের মধ্যে আঙুল চালাতে চালাতে হেসে বলেন,
‘আমার আরেক মেয়ে।’
রাহনুমা বেগম হাতের ইশারায় অরুকে কাছে ডাকেন। অরু নেচেকুঁদে এগোয়। পাশে বসে। ওমনি রাহনুমা বেগম জিজ্ঞেস করেন,
‘কি নাম গো তোমার?’
‘আরাবী।’
‘বাহ! সুন্দর নাম। কে রেখেছে?’
‘আমার চাচ্চু। চাচ্চু বলেছেন এই নাম আমার জন্য তৈরি। আবার তন্ময় ভাই-র নাম ও তারজন্যই তৈরি, এটাও বলেছেন।’
‘তন্ময় বুঝি তোমার খুব পছন্দের ভাইয়া?’
অরু কী খানিক লজ্জা পেলো? হয়তো! মেয়েটা হুড়মুড়িয়ে উঠে জবেদা বেগমের পেছনে চলে এলো। হাসলেন রাহনুমা বেগম এবং জবেদা বেগম দুজনেই। তন্ময় তখন দুয়ারের সামনে দাঁড়িয়ে। বোতলটা নিতে এসেছিল। এমন কান্ড দেখে স্মিথ হাসি ঘেঁষে আসে ঠোঁট জুড়ে। নিজের রুমে ঢুকে পুনরায়। চেয়ারে বসে সে কমবেশ সবকিছুই শুনছে।
জবেদা বেগম অরু গাল টিপে শুধালেন,
‘কান্নাকাটি ত অনেক করলি। এখন বল, কি খাবি?’
‘আবহাওয়া সুন্দর। খিচুড়ি করে দিবে বড়ো মা? গরুর মাংস সাথে!’
জবেদা বেগম হেসে মাথা দোলান। পা বাড়িয়ে রান্নাঘরে ছোটেন। তন্ময় ঠিক জানে অরু এখন ছটফটিয়ে তার রুমে ঢুকবে। হলোও তাই! এসেই মাতব্বরি শুরু করেছে। নিজে নিজে এটা-ওটা ধরে ধরে দেখছে। তন্ময়ের রুমে এভাবে ঢুকে সবকিছু হাতানোর সাহস বাড়িতে কারোর নেই। কেউই করে না মূলত। অথচ এই মেয়েটা তার রুমের সবকিছু উলটপালট করে দেখবে। তন্ময় একটা সাধারণ ধমক ছাড়া কিছুই বলতে পারে না। এইযে এখন সে তন্ময়কে ডিঙিয়ে টেবিলের সব ধরছে। শব্দ করে প্রশ্ন করছে, এটা কি, ওটা কি!
তন্ময় একপর্যায়ে গম্ভীর স্বরে ডাকে,
‘অরু!’
‘একটু দেখছিলাম মাত্র।’
এতটুকু বলে চুপচাপ বিছানার কোণে গিয়ে বসে পড়ে। তন্ময় সেদিকে একবার তাকিয়ে পুনরায় নজর ল্যাপটপে ফেলে। তন্ময়ের অ্যাটেনশন না পেয়ে অরু ধীরেসুস্থে বেরিয়ে যায়। সে মুহূর্তে কল আসে আনোয়ার সাহেবের। তন্ময় রিসিভ করে। ওপাশে চিন্তিত গলার স্বর,
‘তন্ময়! অরু গিয়েছে?’
‘জি চাচ্চু। এখানেই।’
‘ওহ আচ্ছা। কখন বেরিয়ে গেল কেউই জানি না। বাইরের অবস্থা ভালো না। ঝড়বৃষ্টি হবে মনে হয়। এগুলো না থামা অবদি অরুকে ছেড়ো না। অবশ্য আজ ফিরতে চাইবে না। জোরপূর্বক পাঠানোর প্রয়োজন নেই। একটাদিন থাকুক। বড়ো বড়ো মা করে পাগল হয়ে গেছে মেয়েটা।”
‘জি আচ্ছা। ঠিকাছে চাচ্চু।’
কল কেটে দরজার দিক তাকায় তন্ময়। অরুর কন্ঠের স্বর ভেসে আসছে রান্নাঘর থেকে। জবেদা বেগমের সাথে হৈ-হুল্লোড় করছে। পকেটে ফুলটা এখনো রয়েছে। সেটি হাতে নেয়৷ ছোটো ফুল। খুব আলগোছে ফুলটা ডায়েরির ভেতর রাখে৷ তারপর শার্ট খুলে ওয়াশরুম ঢুকে, দরজা লাগায়। এবং সে নিশ্চিত ভাবে বলতে পারে, অরু পুনরায় তার রুমে ঢুকেছে। এখন হয়তো ওয়াশরুমের দরজার সামনে কান পেতে দাঁড়িয়ে।
তন্ময় মাঝেমধ্যে ভাবে, সে যদি নিজের মনমাফিক কাজ করে, তাহলে কী হবে? কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তার আর অরুর সম্পর্ক? নিজেকে আটকে না রাখলে কী খুব বেশি ক্ষতি হবে? এইযে সে এখন অর্ধ-উলঙ্গ। শরীরে কিছু নেই, শুধু প্যান্ট ছাড়া। সম্পূর্ণ ভিজে আছে। এই মুহুর্তে যদি সে দরজাটা খুলে অরুকে টেনে ভেতরে নেয়, ব্যাপারটা কেমন হবে? অরু এরপর নিশ্চয়ই আর এমন ভাবে কান পেতে থাকার সাহস পাবে না। বরং ভীষণ ভয় পাবে।
তন্ময় দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে। চোখ বুঝে দেয়ালে মাথা ঠেলে দাঁড়ায়। শাওয়ার ঝর্ণা থেকে হুড়মুড়িয়ে পানি পড়ছে। বেয়ে চলেছে তা তার সর্বাঙ্গ জুড়ে….
চলবে ~