শিশির ভেজা রোদ্দুর পর্ব -৩৭+৩৮

#শিশির_ভেজা_রোদ্দুর
#Part_37
#Writer_NOVA

তন্বী আজ দুই ক্লাশ করে কোথায় জানি চলে গেলো। আমাকে ভালো-মন্দ কিছু বললো না। শুধু বললো চলে যাচ্ছি। তারপর রাস্তার দিকে ছুটলো। ওর এমন অদ্ভুত আচারণে আমি একটু নয় বরং অনেক বেশি অবাক হয়েছি।কলেজ ছুটি হয়েছে মিনিট দশ আগে।শারমিনকে বিদায় জানিয়ে গেইট পার হতেই এনাজের সাথে দেখা। বাইকের পাশে দাঁড়িয়ে রওনকের সাথে হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে কথা বলছে। আমি তাদের সামনে যেতেই রওনক বড় করে একটা সালাম দিলো।

— আসসালামু আলাইকুম।

— ওয়া লাইকুমুস সালাম।

— তা কেমন আছেন ভাবী?

ভাবী ডাক শুনে বিস্মিত চোখে রওনককে জিজ্ঞেস করলাম,

— ভাবী! কে ভাবী?

এনাজ ওর দিকে তাকিয়ে চোখ গরম করতেই বেচারা থতমত খেয়ে বললো,
— ওফস সরি। বড় আপু হবে।

— জ্বি আলহামদুলিল্লাহ ভালো। আপনি?

— আলহামদুলিল্লাহ ভালো। দিনকাল কেমন যাচ্ছে আপনার?

— বিন্দাস। তা আপনি আজকাল থাকেন কোথায়?

— কেন বাসায়?

— আরে ধূর তা না। আপনাকে যে আজকাল কলেজে দেখি না তাই জিজ্ঞেস করলাম।

— প্রয়োজন ছাড়া খুব বেশি একটা আসি না। গত সপ্তাহে মোবাইল চালাতে চালাতে রাস্তা পার হতে গিয়ে ম্যানহোলে পরে গিয়েছিলাম৷ পায়ে ভীষণ ব্যাথা পেয়েছি। বাসায় ফুল রেস্টে ছিলাম। তাই এতদিন দেখেননি।

— একদম ঠিক হয়েছে। রাস্তা পার হওয়ার সময়ও কি মোবাইল চালাতে হয়? এবার বুঝুন ঠেলা।

— হ্যাঁ, আমি নিজেও স্বীকার করি দোষ আমার। আচ্ছা আসি তাহলে। এনাজ ভাই আসছি। আজ আবার বিকেল তিনটায় আমাদের ছাত্র সংসদের মিটিং আছে। তার বন্দবস্ত করতে হবে।

এনাজ ওর কাঁধে হালকা চাপর মেরে বললো,
— সাবধানে যাস।

রওনক হালকা পা খুড়িয়ে খুড়িয়ে কলেজের ভেতর দিকে চলে গেল। আমি এক পলকে সেদিকে তাকিয়ে ছিলাম। এনজিও সংস্থা চোখের সামনে তুড়ি বাজাতেই আমার ধ্যান ভাঙলো।

— এই যে মিস টিডি পোকা। হারালে কোথায়?

— কই কোথাও না। আজ হঠাৎ আপনি এখানে?

— কেন আসতে পারি না?

— তা কখন বললাম?

— চলো আমার সাথে।

— কোথায়?

— আজ আমি আমার ভালোবাসার মানুষটাকে প্রপোজ করবো। তুমিও আমার সাথে থাকবে।

কথাটা শোনার সাথে সাথে সারা শরীরের পশম দাঁড়িয়ে গেলো। মনের ভেতর তোলপাড় শুরু হয়ে গেলো। অবিশ্বাস্য চোখে এনাজের দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমার মনে হচ্ছে আমি ভুল শুনেছি। এখুনি এনাজ বলবে, “আসলে তেমন কিছু নয়। তোমার সাথে মজা করছি।” কিন্তু আমার ভাবনা ভুল করে দিয়ে এনাজ আমাকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে বললো,

— কি হলো চলো?

— আমি যাবো না।

— কেন?

— আমার শরীরটা ভালো লাগছে না।

— সেকি কথা! কি হয়েছে তোমার? তুমি ঠিক আছো তো? কোন সমস্যা হয়েছে কি?

— এমনি ভালো লাগছে না। আমআমি বাসায় যাবো।

— না, এটা তো হতে পারে না। তুমি সেদিন কফি হাউসে বলেছিলে আমাকে সাহায্য করবে। এখন পালাতে চাইলে তো হবে না। তোমাকে আমার সাথে যেতেই হবে। তুমি সব ব্যবস্থা করবে বলে আমি কিছু করতে চাইছি না। আর এখন এরকম কথা তো আমি মানছি না।

— প্লিজ আমাকে জোর করবেন না। আপনি যান। আপনাদের নতুন জীবনের জন্য শুভকামনা রইলো।

— এটা কিন্তু ঠিক নয় টিডি পোকা। তুমি কিন্তু তোমার কথার বরখেলাপ করছো। তুমি বলেছিলে প্রপোজ করার সময় তুমি আমার সাথে থাকবে। তাহলে এখন না যাওয়ার কথা কেন আসছে?

আহত চোখে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। কিন্তু সে কি জানে আমার ভেতরটা পুড়ে যাচ্ছে। সেই পোড়া গন্ধ তার নাকে যাচ্ছে না? যাবে কি করে? সে তো অন্য কাউকে ভালোবাসে। তাহলে কেন আমাকে তার প্রতি দূর্বল করলো? আবারো কষ্ট পাওয়ার জন্য। এনাজ আমার কোন কথা শুনলো না। হাত ধরে টেনে নিয়ে বাইকে বসিয়ে দিলো। আমার চোখের পানিগুলো টলমল করছে। এই বুঝি অবাধ্য হয়ে ঝরে পরবে। আজ তার কাঁধে হাত দেওয়ার মতো সাহসটা আমার হচ্ছে না। কাঁপা কাঁপা হাতে তার কাঁধে হালকা করে হাতটা রাখতেই উনি বাইক চালু করলো।

💖💖💖

সময় এখন বিকেল সাড়ে তিনটারো বেশি হবে। এই এনাজের হাবভাব আমার সন্দেহজনক লাগছে। সেই দুপুর দুটোর দিকে আমাকে কলেজ থেকে নিয়ে আসলো। তারপর একটা রেস্টুরেন্টে বসে দুপুরের খাবার খেলো। কিন্তু আমার গলা দিয়ে কি খাবার নামে? তবুও মুখে মিথ্যে হাসি ঝুলিয়ে রেখে কোনরকম খেয়ে উঠে গেছি। তারপর আবার বাইকে করে রওনা দিলাম। নদীর পাড়ে এসে বাইক থামলো। যতদূর চোখ যায় নদীতে টলটলা পানি। নদীর পাড়টা বালি আর বালি। সেখানে থোকায় থোকায় সাদা কাশফুল ফুটে আছে। পড়ন্ত রোদের আলোতে চারিদিকটা অনেক বেশি সুন্দর লাগছে। অন্য সময় হলে আমি খুশিতে টিডি পোকার মতো লাফাতাম। কিন্তু এখন সেই মুডে নেই। মনটা ভীষণ খারাপ।

এনাজ বাইক থেকে নেমে কারো সাথে মোবাইলে কথা বললো। তারপর কথা বলতে বলতে আমার হাত ধরে হাঁটতে লাগলো। একবার হাত সরিয়ে নিলেও আরেকবার নিজে আমার হাত টেনে নিয়ে শক্ত করে ধরে হাঁটতে লাগলো। আমি আর কোন দ্বিধা করলাম না। ঝরঝরা বালুতে হাঁটতেও বিরক্ত লাগছে। রোদ না থাকলেও বালু বেশ গরম। ছনের চালা বিশিষ্ট একটা ছোট ঘরের কাছে এসে থামলাম। শুধু ছনের চাল আছে। আর কিছু নেই। বাঁশের সিড়ি দেওয়া বেশ উঁচু জায়গাটা। এনাজ খুব সাবধানে আমার হাত ধরে সেখানে নিয়ে গেলো। আমি আশেপাশে কাউকে না দেখে জিজ্ঞেস করলাম,

— তায়াং ভাইয়া, আপনার বন্ধু কাউকে যে দেখছি না। তারা কোথায়?

— এখুনি চলে আসবে।

মিনিট দুই পর আমার মাথার ওপর ফুলের পাপড়ি আর জরি পরতে লাগলো। ওপরে তাকিয়ে দেখি মাথার ওপরে থাকা বেলুনগুলো আপনাআপনি ফেটে আমাদের গায়ের ওপর ফুলের পাপড়ি, জরি পরছে। মন খারাপ থাকায় ওপরের দিকেও খেয়াল হয়নি। একসময় হৈ হৈ করে তিনজন এসে হাজির। তায়াং ভাইয়া, তওহিদ ভাইয়া তাদের সাথে রওনককে দেখে বেশি অবাক হলাম। আমি রওনককে জিজ্ঞেস করলাম,

— আপনার না মিটিং আছে। তাহলে আপনি এখানে কি করেন?

রওনক শয়তানি হাসি দিয়ে বললো,
— বড় ভাই তার ভালোবাসার মানুষকে প্রপোজ করবে। আর আমি থাকবো না। তা কি হয় বলো?

আমি কোন উত্তর দিলাম না। আমার কিছুই ভালো লাগছে না। আমাদের দুজনকে এক গ্লাস করে ঠান্ডা লাচ্ছি দিলো। আমি ধীরে ধীরে সেটা খাওয়া শেষ করলাম। তারপর সেখান থেকে নেমে নদীর পাড়ে নিয়ে গেলো। সেখানে লাইন বাই লাইন কয়েকজনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বেশ অবাক হলাম।ইমরান হাশমি ভাইয়া, শাহেদ ও রায়হান ভাইয়া হাতে বড় একটা কাগজ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমার একবার মনে হচ্ছে এসব আমার জন্য। আবার মনে হয় না আমার জন্য নয়। আমি এনাজকে জিজ্ঞেস করলাম,

— আপনার ভালোবাসার মানুষটাকে যে দেখছি না।

এনাজ মুচকি হেসে বললো,
— চলতে থাকো তাহলেই দেখতে পাবে।

তায়াং ভাইয়া মুখ টিপে হেসে বললো,
— কিরে শাঁকচুন্নি কেমন লাগছে?

— আমার আবার কেমন লাগবে? এসব তো আমার জন্য নয়।

কথাটা বলে মুখ গোমড়া করে রাখলাম। তায়াং ভাইয়াকে বলতে ইচ্ছে করছিলো ভেতরটা পুড়ে যাচ্ছে আমার। কিন্তু বলা হলো না। সামনে যেতেই শারমিন ও তন্বীকে দেখে বড়সড় একটা ঝাটকা খেলাম। বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,

— কি রে তোরা এখানে?

শারমিন ভ্রু নাচিয়ে বললো,
— সারপ্রাইজটা কেমন লাগলো?

— তুই না বাসায় চলে গেলি?

— আবার চলে এসেছি।

ওদের হাতেও একিরকম সাদা শক্ত হার্ড কাগজ। সম্ভবত তাতে কিছু লেখা। কিন্তু উল্টো করে রাখায় কিছু দেখা যাচ্ছে না। আমি তন্বীকে জিজ্ঞেস করলাম,

— কাগজে কি লেখা?

তন্বী মুখ ভেংচি দিয়ে বললো,
— দেখাবো না। ভাইয়ার ভালোবাসার মানুষের আগে এগুলো কেউ দেখতে পারবে না।

— ওহ্।

নদীর দিকে চোখ যেতেই ফুলে সজ্জিত একটা নৌকা দেখতে পেলাম। নৌকার কিনারে ও ভেতরে নানা ফুলের সমাহার। এনাজ আমার এক হাত ধরে নৌকা উঠলো। আমি বোকার মতো সবকিছু দেখছি। কি হচ্ছে কিছুই বোধগম্য নয়। এনাজকে জিজ্ঞেস করলাম,

— আমাকে এখানে নিয়ে এলেন কেন?

এনাজ কথার উত্তর না দিয়ে নৌকার ওপর থেকে সবার মতো হার্ড কাগজটা নিয়ে এক হাঁটু মুড়ে বসে আমার দিকে মেলে ধরলো। আরেক হাতে কতগুলো গোলাপ বাড়িয়ে দিলো।কাগজে থাকা লেখাটা পড়ে আমার চোখ দুটো বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম। পেছনে তাকিয়ে দেখি সবাই হাসছে। আর তাদের হাতের কাগজেও সেম লেখা। অবিশ্বাস্য চোখে সবার দিকে চোখ বুলিয়ে এনাজের দিকে তাকালাম। এনাজ কাতর গলায় কাগজে লেখা কথাটাই বললো,

— নোভা,will you be my পোলাপাইনের আম্মা?

এনাজ কথাটা বলার সাথে সাথে সবাই একসাথে “ওহো” বলে উঠলো। পার্টি স্প্রে দিয়ে পুরো সাদা ভুত বানিয়ে দিলো আমাদের দুজনকে।আমি এখনো শর্কডে আছি। আমি বোধহয় জেগে জেগে স্বপ্ন দেখছি। নিজের গায়ে জোরে একটা চিমটি মারলাম। না, স্বপ্ন দেখছি না। বেচারা আমার উত্তরের আশায় এখনো উৎসুক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। এতকিছু তাহলে আমার জন্য ছিলো। আর এনাজের ভালোবাসার মানুষটা আমি। এতকিছু দেখেও আমি পুরো সিউর হতে পারলাম না। কিন্তু এখন আমার খুশি হওয়ার বদলে রাগ লাগছে। আমি ভেবেছিলাম সে অন্য কাউকে ভালোবাসে। তাই এতকিছু ইনজয় করতে পারিনি। এখন উনি সারপ্রাইজ দিলো তো দিলো পুরো মাটি করেই দিলো। আগে একটু বললে কি হতো? তাহলে কি এত আনন্দ নষ্ট করতাম আমি। আমার এখন হাত-পা ছুঁড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে😵। দাঁতে দাঁত চেপে তায়াং ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে কটমট করে বললাম,

— ভাই তোরা শুরু করছিস কি? আমাকে আগে থাকতে অল্প একটু জানালে কি হতো? নয়তো আমি এত সুন্দর সুন্দর মোমেন্টগুলো কি মন খারাপ করে বরবাদ করতে পারতাম? এখন তোরা আমারে এক গ্লাস আনারস না থুরি দুধ আর সাথে আনারস দে। খাইয়া, চিৎ হইয়া ভেটকাইতে ভেটকাইতে মইরা যাই।#শিশির_ভেজা_রোদ্দুর
#Part_38
#Writer_NOVA

— নোভা, will you be my পোলাপাইনের আম্মা?

আমার কথা শেষ হতেই এনাজ আবারো তার বিখ্যাত উক্তিতে আমাকে জিজ্ঞেস করলো। আমি একবার সবার দিকে কটমট করে তাকিয়ে এনাজের দিকে তাকালাম। এতদিন আমি জানতাম প্রপোজ করে ডু ইউ লাভ মি, উইল ইউ ম্যারি মি বলে। আজ প্রথম এমন আজব স্টাইলের প্রপোজ দেখলাম। সোজা পোলাপাইনের আম্মা। আমার সাথে থাকতে থাকতে কি তারও মাথা খারাপ হয়ে গেলো নাকি🤔? আসলেই ভাববার বিষয়। আমি মুখ বাঁকিয়ে বললাম,

— ভালোবাসা, বিয়ের কথা না বলে সোজা বাচ্চা-কাচ্চার চিন্তা? এত এডভান্স হতে কে বলেছে?

এনাজ মুখটা কুচোমুচো করে বললো,
— গতকাল ইফাতের যা কান্ড দেখলাম তাতে আমি আর দেরী করতে চাইনি। সোজা প্রপোজ করে দিলাম। ঐ পিচ্চি পোলা তোমার পেছনে যেভাবে আঠার মতো লেগেছে তাতে আমার তো ভয় হচ্ছিলো তুমি আবার ওকে মেনে না নাও। তাহলে আমার কি হবে বলো তো?

আমি কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করলাম,
— আপনার যখন ভালোবাসা, বিয়ে ছাড়া বাচ্চার দরকার তাহলে ইন্টারনেট থেকে ডাউনলোড করে নিন।নয়তো অনলাইন থেকে অর্ডার করুন। কিংবা আল্লাহর কাছে চান। উপর থেকে টুপ করে ফেলে দিবে।

তায়াং ভাইয়া আমাকে ধমক দিয়ে বললো,
— এতো কথা পেঁচাচ্ছিস কেন? ও যা জিজ্ঞেস করেছো তার উত্তর দে।

আমি ডান হাতের নখ কামড়িয়ে তায়াং ভাইয়ার দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললাম,
— বাচ্চা যে আকাশ থেকে টুপ করে পরে তা তোরা জানিস না? কেন ঐ গল্পটা শুনিস নি?

সবাই আমার দিকে বিস্মিত চোখে তাকালো। আমার এমন আজব কথাবার্তা শুনে তারা যে অবাক প্লাস রেগে যাচ্ছে তা আমি জানি। তবে আজ আমি কিছুতেই এনাজের প্রপোজ এক্সেপ্ট করবো না। আমার আনন্দ মাটি করে সারপ্রাইজ দিলো।আরেকটু হলে আমি কান্না করে দিতাম। এবার বুঝবে মজা।আগে থাকতে একটু জানালে কি হতো? সবাই একসাথে জিজ্ঞেস করলো,

— কোন গল্প?

আমি হাই তুলে বললাম,
— বলছি। তবে আগে একটু বসে নেই। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে পা ব্যাথা করছে। (এনাজের দিকে তাকিয়ে) নৌকার মাচা ভালো তো?

এনাজ একবার রেগে তাকালো। আমি তার দৃষ্টি উপেক্ষা করে আরাম করে দুই পা মুড়ে নৌকার ওপর বসে পরলাম। তারপর বললাম,

— তোমরা চাইলে বালিতে বসতে পারো। যদি তোমাদের ইচ্ছে হয় আরকি। এত মানুষ তো আর এই ছোট নৌকায় জায়গা হবে না।

রওনক মুখটাকে নিস্তেজ করে বললো,
— আমি আগেই বলছিলাম তায়াং ভাই আপনার বোন দেখেন আজকের এত সুন্দর একটা মোমেন্টকেও তেরটা বাজিয়ে দিবে। এবার বিশ্বাস হলো তো?

শারমিন বিরক্তির সাথে বললো,
— নোভা তুই কি শুরু করছিস?

আমি ঠোঁট উল্টিয়ে বললাম,
— আমি আবার কি করলাম? আমিতো একটা গল্প বলতে চাইছিলাম। কিন্তু তোরাই শুনছিস না।

তায়াং ভাইয়া রেগে বললো,
— তোর গল্পের গুষ্টি কিলাই। এনাজের প্রপোজালের উত্তর দে।

আমি হুমকির সুরে বললাম,
— একদম আমার সাথে রাগ দেখাবি না। চুপচাপ আমার গল্প শোন। নয়তো তোর বন্ধুকে কিন্তু রিজেক্ট করে দিবো।

এনাজ তায়াং ভাইয়াকে বললো,
— চুপ কর তায়াং। ওকে বলতে দে। ওকে দিয়ে বিশ্বাস নাই। তারপর যদি সত্যি আমায় রিজেক্ট করে দেয় তখন কি হবে? টিডি পোকা তুমি বলো।

আমি অনুমতি পেয়ে খুশি হয়ে গেলাম। তায়াং ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে মুখ ভেংচি দিয়ে বলতে শুরু করলাম।

— এক ছোট বাচ্চা ছেলে তার মা কে জিজ্ঞেস করলো, “আম্মু আমি কিভাবে হলাম?” তার মা মুচকি হেসে বললো, “আমি একটা টবে ছোট একটা বীজ বুনেছিলাম। তারপর সেটাকে প্রত্যেকদিন পানি দিতাম, যত্ন নিতাম আর আল্লাহর কাছে একটা ছেলে বাবু চাইতাম। একদিন গিয়ে দেখি টবের মধ্যে তুমি শুয়ে শুয়ে কাঁদছো। আল্লাহ তোমাকে আমার কাছে এভাবেই পাঠিয়েছে।” ছোট বাচ্চাটা এসব কথা মনোযোগ সহকারে শুনলো। সেদিন বিকেলেই তাদের বারান্দায় থাকা টবে একটা ছোট বীজ লাগিয়ে দিলো। পরেরদিন বিকেলে সে পানি দিতে গেলো। গিয়ে দেখে টবের ওপরে মাঝারি সাইজের একটা ব্যাঙ বসে আছে। তাকে দেখে বাচ্চাটা রেগে বললো,” ইচ্ছা করতাছে তোরে আছাড় দিয়া মাইরা ফালায়। কিন্তু কেমনে মারি? তুই তো আমার পোলা। বাবা হয়ে তো আমি সন্তানকে মারতে পারি না।” আমার গল্প এখানেই শেষ। এনজিও সংস্থা আপনি এই পদ্ধতি অবলম্বন করতে পারেন। তাহলে আপনার আর পোলাপাইনের আম্মাকে খুঁজতে হবে না।

আমার গল্প শুনে সবাই মুচকি হাসতে লাগলো। শারমিন, তন্বী হো হো করে হাসছে। তন্বী বললো,
— এটা কি ছিলো নোভাপু? টবে বীজ বুনলে বাচ্চা হয়। আজকে প্রথম জানলাম। এসব গল্প তোমার দ্বারাই সম্ভব।

আমি দাঁত বের করে শয়তানি হাসি দিয়ে বললাম,
— ধন্যবাদ।

তন্বী হাসি থামিয়ে বললো,
— আমি সিউর ঐ পিচ্চি ছেলেটা ইফাত। কারণ ঐ পিচ্চি এতো এডভান্স।

এনাজের দিকে তাকিয়ে দেখি সে এক হাত মাথায় দিয়ে দুই পা ছড়িয়ে নৌকার ওপর বসে আছে। তায়াং ভাইয়া সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললো,
— চল তো সবাই। ওদের একটু একা কথা বলতে দে।

ভাইয়ার বলতেই সবাই একে একে চলে গেল। কিছু সময় কেউ কোন কথা বললাম না। আমি নৌকার ওপর থেকে একটা গোলাপ ফুল নিয়ে মনোযোগ সহকারে তার পাপড়ি ছিঁড়তে লাগলাম। নীরবতা ভেঙে এনাজ প্রথমে আমাকে ডাকলো।

— টিডি পোকা!

— হুম বলুন।

— আমাকে এক্সেপ্ট করে নাও না প্লিজ?

— উহু এত সহজে না। খুব সহজে আমাকে পেয়ে গেলে আমার মূল্য বুঝবেন না। আগেরজনের মতো অবহেলাও করতে পারেন। আপনাকে আমি এক্সেপ্টও করবো না। আবার রিজেক্টও করবো না। আপনি ঝুলে থাকবেন। বাদুড়ের মতো ঝুলতে থাকুন। দেখি আপনি আমাকে কতটা ভালোবাসেন। আপনার ভালোবাসার পরীক্ষাও হয়ে যাবে।

— দেখো আমি কিন্তু তোমার অতীতের সবকিছু জানি। আমার তোমার অতীত নিয়ে কোন মাথাব্যথা নেই। তুমি শুধু আমার হলেই চলবে।

— পাওয়ার আগে সবাই এরকম ডায়লগ ছাড়ে।

— আমি ডায়লগ ছাড়ছি না। সত্যি বলছি। আচ্ছা একটা সত্যি কথা বলবে।

— হুম বলেন।

— তুমি কি আমায় একটুও পছন্দ করো না?

— সত্যি বলবো নাকি মিথ্যে বলবো?

— অবশ্যই সত্যি বলবে।

— আপনাকে আমার ভালো লাগে। তবে সেই ভালো লাগাটা ভালোবাসায় পরিণত হয়েছে কিনা তাতে আমার ডাউট আছে।

— তাহলে এক্সেপ্ট করতে সমস্যা কি?

— ঐ যে বললাম খুব সহজে পেয়ে গেলে আমার মূল্য বুঝবেন না। বরং আমাকে সস্তা ভাববেন। তাছাড়া আরো দুটো কারণ আছে।

— কি?

— আপনি যেদিন দেশে আসছেন সেদিন এয়ারপোর্টে কিন্তু আমাকে ইনসাল্ট করেছিলেন। অনেক এটিটিউড দেখিয়েছেন। যেটা আমার ভীষণ খারাপ লেগেছিলো। আমি মনে মনে সেটা জমিয়ে রেখেছি।

এনাজ শুকনো মুখ করে জিজ্ঞেস করলো,
— কি করছি আমি?

— এখুনি ভুলে গেছেন। আপনি হ্যান্ডশেক করার জন্য হাত বাড়িয়ে ছিলেন। তখন আমি হাত মেলানোর আগে আপনি তন্বীর সাথে হাত মিলিয়ে ফেলছেন। আমার সেটা অনেক খারাপ লাগছে।আমার প্রেস্টিজে লেগেছে।তাছাড়া আপনি একবার আমার দিকে তাকাননি। বাপরে কি এটিটিউড! এখন থাকেন আপনার এটিটিউড নিয়ে। আমি আপনাকে এক্সেপ্ট করবো না তো।

— সেই মাসখানেক আগের কথা এখনো মনে রেখেছো?

— মেয়েরা এমনি। যেই বিষয়টা তাদের প্রেস্টিজে লাগে সেটা সারাজীবন মনে রাখে। আর সুযোগ পেলে সেটার সুদসুদ্ধ উসুল করে।

— আমি তোমার সাথেই হাত মিলাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু মনে হঠাৎ শয়তানি বুদ্ধি জাগলো। তাই তোমার সাথে না মিলিয়ে তন্বীর সাথে হাত মিলালাম। আর তোমার দিকে আমি তাকাইনি তা কে বলেছে? গাড়িতে না হলেও বিশ-ত্রিশবার আমি তোমার দিকে তাকিয়েছি। সেটা কি তুমি দেখছো?

— হুহ😏! ভালো করছেন। এবার বসে থাকেন।

—এবার ২য় কারণ বলো।

— আমাকে এতবড় সারপ্রাইজ দিবেন তা আগে বললেন না কেন? আমি মন খারাপের জন্য কোনকিছু উপভোগ করতে পারিনি। আমি ভেবেছি আপনি হয়তো অন্য কাউকে পছন্দ করেন। আমার ভীষণ খারাপ লাগছিলো।যখন আপনি বললেন আপনার ভালোবাসার মানুষকে প্রপোজ করবেন। তখন আমার অনেক কান্না পাচ্ছিলো।

💖💖💖

আনমনে যে আমি কি বলে দিয়েছি নিজেও জানি না। যখন হুশ এলো তখন জিহ্বায় কামড় দিয়ে একহাতে মুখ ঢেকে ফেললাম। এনাজ মুচকি হেসে আমার দিকে এগিয়ে এলো। তাকে এগিয়ে আসতে দেখে আমি পেছন দিকে হেলে পরলাম। উনি মিটমিট করে হাসতে হাসতে বললো,

— তুমিও আমাকে ভালোবাসো। আগে ডাউট ছিলো এখন সিউর হলাম।

— একটুও না। আপনাকে আমার ভালো লাগে। ভালো লাগা আর ভালোবাসা এক নয়।

— তুমি আমাকে ভালো না বাসলে প্রপোজের কথা শুনে কখনই মন খারাপ করতে না। কিংবা তোমার চোখ পানিতে টলমল করতো না। আমি কিন্তু বাইকের আয়নায় দেখেছিলাম তুমি উপর দিকে তাকিয়ে চোখের পানি নিচে না পরার ব্যর্থ চেষ্টা করছিলে।

— একদম না। আমি আপনাকে ভালোবাসি না। দূরে যান। অস্বস্তি লাগছে।

— তুমি আমাকে ভালোবাসো। সেটা তুমি স্বীকার না করলেও আমি জানি। আর যদি ভালো নাও বাসো তাতেও সমস্যা নেই। খুব শীঘ্রই আমাকে ভালোবেসে ফেলবে৷ তোমার মুখ থেকে আমি ভালোবাসার কথাটা স্বীকার করিয়েই ছাড়বো। যাস্ট ওয়েট এন্ড ওয়াচ।

— এত সোজা নয়।

— এত কঠিনও নয়।

— হু হু আমিও দেখবো।

— ওকে দেখে নিও।

এনাজ আমার থেকে দূরে সরে গেলো। আমি বড় করে হাফ ছাড়লাম। এতক্ষণ ধরে মনে হচ্ছিলো কেউ নিঃশ্বাস বন্ধ করে রেখেছে। হঠাৎ একটা কথা খেয়াল হতেই আমি এনাজকে বললাম,

— চলুন নৌকা দিয়ে ঘুরি।

— আমি নৌকা চালাতে পারি না।

— তাহলে পারেনটা কি?

— তোমাকে অনেক ভালোবাসতে।

— ইস!

— তায়াং, ইমারনদের ডাকি। দেখি ওরা কেউ পারে কিনা।

এনাজ সবাইকে ডাকলো। একে একে সবাইকে জিজ্ঞেস করা হলো। কিন্তু কেউ নৌকা চালাতে পারে না। আমি ভেবেছিলাম নৌকায় ঘুরবো। কিন্তু সেই আশায় গুড়ে বালি। রেগে বললাম,

— কেউ যখন নৌকা চালাতে পারেন না তাহলে এই নৌকা রাখার মানে কি? মনে হচ্ছে মাশরুমের বদলে ব্যাঙের ছাতা সাজিয়ে রেখেছে। যাও সবাই মিলে এই নৌকাকে জাদুঘরে সাজিয়ে রেখে আসেন। কেউ যদি জিজ্ঞেস করে এই নৌকার সাথে কি ইতিহাস জড়িত,তাহলে সাথে লিখে দিয়েন এই নৌকায় এনজিও সংস্থা তার টিডি পোকাকে প্রপোজ করেছে। তাই এই নৌকা এত স্পেশাল। একটাও কাজের না সব নিষ্কর্মা।

এনাজ মুখ গোমড়া করে বললো,
— আমার কোন দোষ নেই। এই পুরো প্ল্যান ওরা সবাই মিলে করেছে।

আমি জোরে চেচিয়ে বললাম,
— এই নৌকার আইডিয়া কার?

সব বন্ধুরা একসাথে ইমরান হাশমি ভাইয়ার দিকে তাকালো। ভাইয়া হে হে করে হেসে বললো,
— নৌকায় বসে প্রপোজ করার আইডিয়া আমার ছিলো। কিন্তু তোমার যে নৌকা দিয়ে ঘুরতে মন চাইতে পারে সেটা আমার খেয়াল হয়নি। নয়তো সেই ব্যবস্থাও করে রাখতাম।

আমি দাঁতে দাঁত চেপে বললাম,
— যেমন ঘাটোরা মানুষ তেমন তার ঘাটোরা আইডিয়া। একটাও কাজের নয়। ধূর, মুডটাই নষ্ট করে দিলো।

আমি নৌকা থেকে নেমে গেলাম। এনাজও নেমে এলো। সে নামতেই তার সব বন্ধু তাকে ঘিরে ধরলো। তওহিদ ভাইয়া জিজ্ঞেস করলো,
— কি এনাজ এক্সেপ্ট করেছে?

এনাজ মুখটাকে একটুখানি করে মাথা নাড়িয়ে না বললো। তারপর কান্নার অভিনয় করে রায়হান ভাইয়ার কাঁধে মুখ গুঁজে বললো,
— এক্সেপ্টও করেনি আবার রিজেক্টও করেনি। ঝুলিয়ে রেখে দিয়েছে😵।

শাহেদ ভাইয়া বললো,
— এই মেয়েরা না এরকমি। ছেলেদেরকে তাদের পিছনে না ঘুরিয়ে কখনও এক্সেপ্ট করে না। একটা ছেলেকে তার পেছনে ঘুরিয়ে কি মজা পায় তা আল্লাহ আর মেয়েরাই জানে। আজ অব্দি আমি বুঝতে পারলাম না।

তাদে কথা শুনে আমি মিটমিট করে হাসতে লাগলাম। সবাই বেচারাকে সান্ত্বনা দিচ্ছে। আর তায়াং ভাইয়া আমার দিকে রেগে খাইয়া ফালামু লুক দিচ্ছে। মিনিট দশেকের মধ্যে সেখান থেকে সবাই বের হয়ে গেলাম। একটা ছোট টং দোকান থেকে সবাই একসাথে আনন্দ করে চা খেলাম। চায়ের বিলটা অবশ্য এনাজই দিয়েছে। তারপর যার যার বাড়ির দিকে রওনা দিলাম। শারমিনকে তওহিদ ভাইয়া পৌঁছে দিবে। তন্বী তায়াং ভাইয়ার বাইকে আর আমি এনাজের বাইকে উঠলাম। নদীর পাড়ে যাওয়ার সময় যতটা খারাপ লাগছিলো এখন তার দুই ডবল বেশি ভালো লাগছে। ইস, এনজিও সংস্থা আমাকে ভালোবাসে🙈। এই কথাটা মনে আসতেই মনে লাড্ডু ফুটছে। আমি এনাজকে মেনে নিবো। তবে একটু দেরী করে। বাসার গেইটের সামনে আসতেই আমরা নেমে গেলাম। তায়াং ভাইয়া, তন্বী ভেতরে ঢুকে গেছে। এনাজ বাইকের সামনে থেকে প্রপোজ করার সেই গোলাপগুলো আর এক বক্স চকলেট আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,

— এগুলো তোমার জন্য। রিজেক্ট যেহেতু করোনি এগুলো নিতে তো কোন সমস্যা হওয়ার কথা নয়।

— একসেপ্টও কিন্তু করিনি।

— করোনি তো কি হয়েছে? খুব শীঘ্রই করে নিবে।তাছাড়া এতদিন অপেক্ষা করতে পেরেছি আর কয়েকটা দিন কি করতে পারবো না? অবশ্যই পারবো। ইফাতের মতো আমিও একটা কথা বলছি তুমি ভালো করে মাথায় ঢুকিয়ে নিও। এই এনাজ বিয়ে করলে তার টিডি পোকাকেই করবে। টিডি পোকা শুধু এনাজের। আর কারো নয়।

কথাটা বলেই এক চোখ মারলো। আমরা দুজন একসাথে হেসে উঠলাম। আমি চকলেট বক্সটা আর গোলাপগুলো তার হাত থেকে নিয়ে নিলাম। সে বাইক ঘুরিয়ে স্টার্ট করতেই আমি কিছুটা জোরে চেচিয়ে বললাম,

— আমার বাবা-মাকে রাজি করান। তারা রাজী হলে আমার কোন আপত্তি নেই। আপনার পোলাপাইনের আম্মা হতে আমি রাজী আছি।

এনাজ চোখ দুটোকে রসগোল্লা বানিয়ে চাবি ঘুরিয়ে বাইক বন্ধ করে আমার দিকে তাকালো। আমি হাতে থাকা গোলাপগুলো দিয়ে মুখ ঢেকে ফেললাম। গোলাপ সরাতেই দেখতে পেলাম সে খুশি হয়ে ঠোঁটে হাত দিয়ে ফ্লাইং কিস দেখালো। আমি লজ্জা পেয়ে বাসার ভেতরে দৌড় দিলাম। পেছনে তাকানোর মতো অবস্থায় আমি নেই।

#চলবে

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here