শিশির ভেজা রোদ্দুর পর্ব -৩৯+৪০

#শিশির_ভেজা_রোদ্দুর
#Part_39
#Writer_NOVA

সারা বাসায় হুলস্থুল লেগে গেছে। সেই সকাল ছয়টার থেকে গোছগাছ শুরু হয়েছে। এখন সকাল নয়টা। তবুও গোছগাছ শেষ হয়নি। আজ থেকে কলেজ বন্ধ। আর আজই আমরা গ্রামে যাবো। আগামীকাল ভাইয়ার হলুদ সন্ধ্যা। সকাল থেকে এই অব্দি আম্মু,আব্বু, চাচাতো ভাই-বোন, ভাগ্নিরা কল দিতে দিতে হাঁপিয়ে উঠছে। গতকাল রাতে কোন কিছু গোছানো হয়নি। এতে তায়াং ভাইয়া আমাদের তিনজনের ওপর হেব্বি রেগে আছে। সব গুছিয়ে বোরখা পরে তৈরি হয়ে বসে আছি। কিন্তু এখন তায়াং ভাইয়ার খবর নেই। আধা ঘণ্টা আগে বের হয়ে গেছে এখনও আসার নাম নেই। বোরখা উঠিয়ে সোফায় দুই হাঁটু মুড়ে বসে বসে মোবাইল গুতাচ্ছি। তন্বীরও একি অবস্থা। খালামণি নেকাব লাগিয়ে আমাদের সামনে এসে বললো,

— সব ঠিকমতো নিয়েছিস তো? গ্রামে গিয়ে আবার বলিস না এটা নিতে মনে নেই, ঐটা আনিনি।

আমি মোবাইলের থেকে চোখ সরিয়ে খালামণির দিকে তাকিয়ে বললাম,
— আমি সব ঠিক মতো নিয়েছি। তন্বীকে জিজ্ঞেস করো ভালো করে। এর তো আবার অভ্যাস আছে এসবের।

খালামণি আমার সামনে থেকে সরে গিয়ে তন্বীকে জিজ্ঞেস করলো,
— সবকিছু গুছিয়ে নিয়েছিস তো? কোনকিছু বাদ পরেনি তো আবার? ভালো করে চেক করে দেখ। যদি বিয়ের অনুষ্ঠানে বলিস কোন জিনিস আনতে মনে নেই তাহলে কিন্তু খবর আছে।

তন্বী বোকার মতো খালামণির দিকে তাকিয়ে আছে। তারপর জোরে চেচিয়ে বললো,
— আমাকে কিছু বলো? কি বলো? কিছু শুনতে পাচ্ছি না তো। জোরে বলো।

— একটা থাপ্পড় দিয়ে বয়রা বানিয়ে ফেলবো। তাহলেই শুনতে পাবি। কানের থেকে ইয়ারফোন খোল। যখন সময় পায় তখুনি কানে ঢুকিয়ে বসে থাকে।

— কি বলো আম্মু?

খালামণি রেগে তন্বীর কানের থেকে টেনে ইয়ারফোন খুলে ফেললো। তন্বী খালামণির মুখের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে তিনি এতো রেগে আছে কেন। আমি মুখ টিপে কিছু সময় হাসলাম। খালামণি ওকে একদফা ঝারলো। আমি হাতে থাকা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময় দেখে নিলাম। নয়টা বেজে পনের মিনিট। তায়াং ভাইয়া আসার নাম নেই। আমি খালামণিকে জিজ্ঞেস করলাম,

— খালামণি আমরা কি বাসে যাবো? আমার বাসে উঠতে ভালো লাগে না। বমি করতে করতে অবস্থা খারাপ। বাসায় যাওয়ার পর বিছানার থেকে মাথা উঠাতে পারি না। বাসের ঘূর্ণিটা মনে হয় আমার মাথায় ঘুরে।

খালামণি ব্যাগগুলো একসাথে জোরো করতে করতে বললো,
— তোর তায়াং ভাইয়া তো সিএনজি আনতে গেলো। কে জানে পেয়েছে নাকি। যদি সিএনজি পায় তাহলে বাসে যাবো না। ডাইরেক্ট এখান থেকে সিএনজি নিয়ে তোদের বাসার সামনের রাস্তার মোড়ে নামবে। আর যদি সিএনজি না পায় তাহলে বাসেই যেতে হবে।

— বাসের কথা শুনলেই আমার ভেতর থেকে সব গুলিয়ে আসে। এখনি বমি বমি লাগছে। বাসে উঠলে কি হবে আল্লাহ মালুম 😵।

— সাতটা বাজে রওনা দিতে চেয়েছিলাম। দশটা বেজে গেলো। যামে পরলে বিকালের আগে যেতে হবে না। ছেলেটার আসারও খবর নেই।

আমি সোফা থেকে উঠে দাঁড়ালাম। উদ্দেশ্য ইফাতদের ফ্ল্যাটে যাবো। তাদের থেকে বিদায় নিতে হবে তো। ৬-৭ দিনের সফরে যাচ্ছি। তায়াং ভাইয়া বলে বৌ-ভাতের পরদিন সকালে চলে আসবে। কিন্তু আমি জানি জামাই বাজারের আগে আসা হবে না। আজকে বুধবার আসতে আসতে সামনের মঙ্গলবার। আমাকে উঠতে দেখে খালামণি জিজ্ঞেস করলো,
— কোথায় যাচ্ছিস?

— ইফাতদের বাসায়। সবার থেকে বিদায় নিয়ে আসি।

— আমি সকালে গিয়েছিলাম। যাওয়ার আগে আরেকবার বলে যাবো।

আমি দ্রুত পায়ে ওদের ফ্ল্যাটের দিকে চলে গেলাম। দরজা খোলায় ছিলো। ভেতরে ঢুকে গেলাম। দেখি ইফাত, সিফাত সোফায় বসে টিভিতে কার্টুন দেখছে। আমাকে দেখে সিফাত জিজ্ঞেস করলো,
— কোথায় যাও ভাবী?

— আমাদের গ্রামের বাসায় যাচ্ছি। তোর আম্মু কোথায়?

— রুমে আছে।

আমি গ্রামে যাবো শুনে ইফাতের মুখটা একটুখানি হয়ে গেলো। মুখ গোমড়া করে জিজ্ঞেস করলো,
— কবে আসবা?

— ১ সপ্তাহ পর।

— এতদিন থাকবা কেন?

— চাচাতো ভাইয়ের বিয়ে।

আমি আর ড্রয়িংরুমে দাঁড়ালাম না। ইফাতের আম্মুর রুমে ঢুকলাম। তার থেকে বিদায় নিলাম। ইফাতের দাদীর সাথেও দেখা করে এলাম। আন্টি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,
— সাবধানে যেও। আর তাড়াতাড়ি ফিরে এসো। তুমি বাসায় না থাকলে মনে হয় সবকিছু ফাঁকা ফাঁকা।

আমি তাকে আলতো হাতে জড়িয়ে ধরে বললাম,
— দোয়া করবেন। সহিসালামত যেন বাসায় ফিরে আসতে পারি। নিজের খেয়াল রাখবেন। আমার ননদিনীকে না খাইয়ে রাখবেন না। (পেটের কাছে কান রেখে) এই যে ননদী, আমার শাশুড়ী আম্মাকে কষ্ট দিও না। কিক মেরো না। তবে তোমাকে না খাইয়ে রাখলে দু-একটা কিক মেরো। তবে বেশি জোরে না।

দাদী ইফাতকে উদ্দেশ্য করে বললো,
— কিরে ইফাত তোর বউ তো গ্রামে চলে যাচ্ছে। তুই যাবি না তোর শ্বাশুড়বাড়ি।

ইফাত মন খারাপ করে বসে ছিলো। ওর দাদীর কথায় দৌড়ে নিজের রুমে চলে গেল। ধরাম করে দরজা আটকে দিলো। সিফাত মুখ টিপে হেসে বললো,
— ভাবী চলে যাবে তাই ভাইয়া কষ্ট পাচ্ছে।

ওর কথা শুনে আমরা সবাই হো হো করে হেসে উঠলাম। এর মধ্যে তন্বী দরজা দিয়ে উঁকি মেরে বললো,
— নোভাপু চলে আসো।ভাইয়া সিএনজি নিয়ে চলে আসছে। আরো দেরী করলে ভাইয়া রেগে আইটেম বোম হয়ে যাবে। তখন যাওয়া ক্যান্সেল হয়ে যাবে।

আমি দ্রুত পায়ে দরজা দিয়ে বের হতে হতে তাদেরকে বললাম,
— আসি আন্টি, আসছি দাদী। সিফাত ভালো থাকিস। আমার শ্বাশুড়ি মা কে জ্বালাস না। আরেকজন তো গাল ফুলিয়ে দরজা আটকে বসে আছে। তাকে বলে দিয়েন আমি চলে গেছি।

💖💖💖

বাসায় ঢুকে ব্যাগ নিয়ে দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেলাম। খালামণি তাদের থেকে বিদায় নিয়ে ভালো করে তালা লাগিয়ে নিচে চলে এলো। সিএনজির সামনে যেতেই দেখি তায়াং ভাইয়া আমাদের দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে আছে। আমি ওর মন জয় করার জন্য সব দাঁত বের করে একটা ভুবন ভুলানো হাসি দিলাম। এতে কাজ হলো না। ভাইয়া আরো রেগে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। ব্যাগ,জিনিসপত্র সব সিএনজিতে উঠালো ভাইয়া। তন্বী সিএনজি তে উঠে বসলো। আমি উঠতে নিলে ভাইয়া বললো,
— তুই এখানে কেন উঠিস?

— তাহলে কোথায় উঠবো?

— সিএনজিতে তোর জায়গা হবে না।

— তাহলে আমি কিসে যাবো?

— সিএনজির ছাদে বসে যদি যেতে পারিস তাহলে তোকে নিতে পারি। নয়তো তুই তোর ভালুপাসা ইফাতের কাছে থাকবি।

আমি ওর দিকে খাইয়া ফালামু লুক দিয়ে জোরে চিৎকার দিয়ে খালামণিকে ডাকলাম,
—খালামণি দেখো তোমার পোলায় কি কয়?

— কি বলে?

— আমাকে সিএনজির ছাদে বসে যেতে বলে।

— ওর কথায় কান দিস না তো।

আমি মুখ ভেংচি কেটে সিএনজিতে উঠতে নিলে তায়াং ভাইয়া আবার বললো,
— সিএনজি তোর জন্য আনি নাই।

আমার ভীষণ রাগ হচ্ছে। সাথে কান্নাও পাচ্ছে। রেগে বললাম,
— যা আমি যাবো না। তোরাই যা।

চোখ দিয়ে পানি বোধহয় এই পরে যাবে। তায়াং ভাইয়া আমার দিকে তাকিয়ে বললো
— না গেলে আরো ভালো। থাক তুই। তোর জন্য বাইকের ব্যবস্থা করলাম। আর তুই আমার সাথে এমন করলি না। যা তুই সিএনজি তে যা। আমি বাইকে চলে যাচ্ছি।

তায়াং ভাইয়ার কথার আগাগোড়া কিছু বুঝলাম না। চোখ, মুখে বিস্ময় চিহ্ন নিয়ে ভাইয়ার দিকে তাকালাম। তখুনি আমার সামনে এসে একটা বাইক থামলো। বাইকে থাকা মানুষটা দেখে আমি আরেকদফা অবাক। এনজিও সংস্থা এখানে কি করছে? তার কাঁধে ব্যাগ। পরনে পাঞ্জাবী। চোখে সানগ্লাস। ভাব পুরো জামাই, জামাই।এনাজ মুখ দিয়ে টক করে শব্দ করে বললো,
— বাইকে উঠো।

— মানে?

— গ্রামে যাবা না?

— হ্যাঁ।

— তাহলে বাইকে উঠে বসো।

— আপনি কোথায় যাবেন?

— তোমার গ্রামে।

— আমি ঠিক বুঝলাম না।

— আমিও তোমাদের সাথে বিয়ের অনুষ্ঠানে যাচ্ছি।

— আপনিও আমাদের সাথে যাবেন?

— হুম। দাওয়াত ছাড়া যাচ্ছি না।গরীব হতে পারি। কিন্তু এতটা নিচ মানসিকতার মানুষ নই।

— আমি তা কখন বললাম? আসলে কিভাবে কি আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।

তায়াং ভাইয়া সিএনজিতে উঠার আগে এনাজকে বললো,
— সাবধানে আসিস। আর শাঁকচুন্নিকে ধরে, বেঁধে রাখিস। কোন শ্যাওড়া গাছ পেলে যেন আবার ঝুলে না পরে।

এনাজ মুচকি হেসে বললো,
— তোরা যেতে থাক। আমরা আসছি। গ্রামে গিয়ে দেখবি তোদের আগে আমরা পৌঁছে গেছি।

তায়াং ভাইয়া আমার দিকে তাকিয়ে ভেংচি কাটলো। আমি রেগে ওর দিকে তাকালাম। এনাজ ওর পিঠের ব্যাগটা দৌড়ে সিএনজিতে রেখে আসলো। খালামণি এনাজকে বললো,
— সাবধানে চালিয়ো। বেশি স্প্রিডে চালানোর দরকার নেই।

তন্বী চেচিয়ে আমাকে বললো,
— তোমারই তো ভালো হলো নোভাপু। আরামে বাইকে করে আসতে পারবে। একটু সাবধানে বসো। এনাজ ভাইকে আবার জাপ্টে ধরে চাপ্টি বানিয়ে ফেলো না। গ্রামে দেখা হচ্ছে। হ্যাপি জার্নি।

আমি ওর দিকে রেগে তাকাতেই ও খিল খিল করে হেসে উঠলো। খালামণি আমাকে সাবধান করে দিয়ে বললো,
— বোরকা সাবধানে রাখিস। বাইকের চাকার মধ্যে পেচিয়ে যেন না যায়। দূর্ঘটনা ঘটতে সময় লাগে না।

এনাজ এসে বাইকে বসলো। সিএনজির চালক আল্লাহর নাম নিয়ে রওনা দিলো। এনাজ আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
— গ্রামে যাওয়ার ইচ্ছে আছে?

— জ্বি।

— তাহলে উঠেন। এবার রওনা দেই।

আমি চুপচাপ তার পেছনে উঠে বসলাম। কাঁধে হাত রাখতেই উনি বাইক চালু করলো। আমার কাছে একটা সাইড ব্যাগ ছাড়া কিছুই নেই। সবকিছু সিএনজিতে। মাঝারি স্প্রিডে বাইক চলছে। আমার মন খুঁতখুঁত করছে। আমি এনাজকে জিজ্ঞেস করলাম,
— আপনি সত্যি আমাদের বাসায় যাবেন?

— না তোমাকে বেচতে যাচ্ছি। মেয়েদের দালালের হাতে তুলে দিয়ে বেশ বড় একটা এমাউন্ট পাবো। সেগুলো নিয়ে বিদেশ চলে যাবো।

— ধূর!

এনাজ জোরে হাসতে লাগলো। তারপর হাসি থামিয়ে বললো,
— সত্যি তোমাদের বাসায় যাবো। বিয়ের অনুষ্ঠানে থেকে তোমাদের সাথেই আসবো। নিশ্চয়ই মনে মনে ভাবছো আমি দাওয়াত ছাড়া যাচ্ছি নাকি?

— আরে না তা নয়।

— সেদিন তায়াং-এর সাথে তোমার ভাইয়ার বিয়ের শপিং-এ গিয়েছিলাম। তোমার মনে আছে? আমি যেতে চাইনি। তায়াং জোর করে নিয়ে গিয়েছিল।

— হ্যাঁ।

— সেখানে শপিং শেষ করে তোমার চাচাতো ভাই-বোন জেঁকে ধরেছিলো। বিয়েতে আমাকে যেতেই হবে। ঐদিনই আমাকে দাওয়াত করেছিলো। সকালে তোমার চাচাতো ভাই কল করেছিলো। এত করে তারা বললো আমি যদি না যাই তাহলে তো বিষয়টা খারাপ দেখায়। সকালে তায়াং ও জোর করে বললো যেতেই হবে। আমি তো প্রথমে রাজী হয়নি। তায়াং রেগে যায় আমি আসবো না বলে। অগত্যা আসতেই হলো। আমিও মনে মনে ভাবলাম হবু শ্বশুরবাড়ি দেখা হয়ে যাবে। তাছাড়া হবু বউও আমার চোখের সামনে থাকবে। এই সুযোগ তো মিস করা যায় না

আমি মুচকি হাসলাম তার কথায়। কিন্তু কোন উত্তর দিলাম না। মেইন রোডে উঠে দশ মিনিট পর যামে পরলাম।একটু এগোই আবার যাম। আজ থেকে সরকারি ছুটি। পুজোর ছুটি উপলক্ষে সবাই কম-বেশি গ্রামে যাচ্ছে। যাম থাকাই স্বাভাবিক। গুলিস্তানে এসে আবার পরলাম যামে। সেকি যাম বাবা গো🥵! অবস্থা খারাপ। আমি এনাজের পিঠে হেলান দিয়ে কখন ঘুমিয়ে পরেছি নিজেও জানি না। আমি জার্নি করতে গেলে ঘুমিয়ে সময় পার করি।

💖💖💖

কুচিয়ামোড়া ব্রিজে আসতেই বিকেল তিনটে বেজে গেলো। এত যামে আগে কখনও পরিনি। বসে থাকতে থাকতে কোমড় ধরে গেছে। ঘুম ভাঙলো একটু আগে। একটু জাগি আবার একটু ঘুমাই। বেচারার পিঠকে আমি বালিশ বানিয়ে নিয়েছি। কখন যে তার এক বাহু পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে তার পিঠে মাথা রেখেছি বলতেও পারি না। এনাজ অনেকবার জিজ্ঞেস করেছিলো কিছু খাবো কিনা। কিন্তু আমি জার্নির সময় কিছু খেতে পারি না। আসলে খেতে ভালো লাগে না। আমি খাইনি বলে এনাজও খায়নি।মাওয়া রোডে চলে এসেছি। নীমতলা আসার কিছু আগে আমাদের বাইক আটকালো ট্রাফিক পুলিশ। এনাজের সামনে এসে বললো,

— বাইকের লাইসেন্সের কাগজ দেখান।

— ওয়েট।

এনাজ বাইকের সামনের থেকে কাগজপত্র খুজে পুলিশের হাতে দিলো। পুলিশ একবার কাগজের দিকে তাকিয়ে আরেকবার আমার দিকে তাকালো। তারপর এনাজকে জিজ্ঞেস করলো,

— মেয়েটা কে?

— আমার বউ।

— কোথায় যাচ্ছেন?

— শ্বশুরবাড়ি।

এনাজের কথা শুনে আমার চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেলো। তবে মুখে কিছু বললাম না। তাহলে আমরা দুজনেই এখন কট খাবো। এনাজ কথাগুলো বলার সময় একটু হাসেওনি।পুরো সিরিয়াস মুডে ছিলো।পুলিশ আমার দিকে তাকাতেই আমি জোর করে একটা হাসি দিলাম। ট্রাফিক পুলিশ এনাজকে বললো,

— আপনারা যে স্বামী-স্ত্রী তার প্রমাণ কি?

এনাজ বিরক্তি মুখে বললো,
— এখন কি বউ নিয়ে শ্বশুড় বাড়ি গেলেও প্রমাণ সাথে নিয়ে ঘুরবো? আগে জানলে কাবিননামা গলায় ঝুলিয়ে রাখতাম।

— দেখুন আপনি কিছু মনে করবেন না। আসলে ঢাকা টু মাওয়া রোডে প্রায় অনেক ছেলে-মেয়ে বাইকে করে ঢাকা থেকে ঘুরতে আসে। তারপর তারা অনেকে এখানে অসামাজিক কার্যকলাপও করে। তাতে আমাদের এখানে নিয়োগ করা হয়েছে। আগে এখানে কোন পুলিশ কাস্টাডি ছিলো না।

এনাজ পকেট থেকে মোবাইল বের করে ওন করলো। মোবাইলের ওয়ালপেপার দেখালো। ওয়ালপেপারের ছবিটা দেখে পুলিশটা বললো,
— ওফস সরি। আপনারা এখন যেতে পারেন।

আমিও একটু উঁকি মেরে ওয়ালপেপারের ছবিটা দেখলাম। ছবি দেখে আমার চোখ চড়কগাছ। এটা তো গতকালের নৌকায় থাকা ছবি। আমি পেছনে হেলে আছি আর এনাজ আমার দিকে ঝুঁকে আছে। তখন ছবি কে তুললো? আর এরকম একটা ছবি কেউ ওয়ালপেপারে দেয়। ইস, আমার দেখেই তো লজ্জা করছে। আর উনি এই ছবি পুলিশকে দেখালো। আমি মুখ ঘুরিয়ে রাখলাম। পুলিশ আমাদের ছেড়ে দিলো। এনাজ বাইক চালু করতেই আমি তার দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলাম।

— এই ছবি কে তুলছে?

— ইমরান।

— কখন তুললো?

— যখন আমি তোমার দিকে ঝুঁকে ছিলাম তখন।

—এরকম ছবি কেউ ওয়ালপেপার দেয়?

— আমার কাছে ভালো লাগছে তাই দিয়েছি। আরো অনেক ছবি আছে। তোমার অজান্তে তুলেছি।

—😳😳

— কি হলো চুপ হয়ে গেলে যে?

— বদমাশ বেডা কি সাধে বলি?

— আমি ভালো ছেলে।

— হুম তার নমুনা তো দেখতেই পাচ্ছি। আপনি পুলিশকে মিথ্যে বললেন কেন? পুলিশকে কি ভয় পান না? উনার সাথে এভাবে কথা বললেন কেন?

— আমি কি ক্রিমিনাল নাকি যে ভয় পাবো? আর আমি তো ভালোভাবেই কথা বলছি।

— হুম দেখলামই তো। তা আমি আপনার বউ হলাম কবে?

— হওনি তবে খুব শীঘ্রই হবে। আমি আসলে হবু বউ ও হবু শ্বশুরবাড়ি থেকে হবু শব্দটা কেটে দিয়েছি। মিথ্যে তো বলিনি।

— সবসময় সব কথার লজিক জমানোই থাকে।

— রাখতে হয়।

আমি ভেংচি কেটে আশেপাশে দেখতে লাগলাম। আমাদের উপজেলার রাস্তায় এসে পরেছি। উপজেলার মোড়ে আসতেই পেছনের একটা রাস্তা দেখিয়ে এনাজকে বললাম,
— এই রাস্তা দিয়ে তাজপুর নামের একটা গ্রামে যাওয়া যায়। ঐ গ্রামের রাস্তাটা খুব সুন্দর। ছায়াঢাকা, সবুজ গাছপালায় ঘেরা খুব সুন্দর একটা রাস্তা। বিকেলে হাঁটতে আসলে মন পুরো ফ্রেশ হয়ে যায়।

— আমরাও তাহলে একদিন আসবোনি।

— আচ্ছা।

উপজেলার বাজারে এসে এনাজ বাইক থামালো। আমাকে থানার সামনে রেখে সে বাজারের ভেতরে চলে গেল। দশ মিনিট পর কয়েকটা প্যাকেট নিয়ে ফিরে এলো। এক প্যাকেটে চিপস,বিস্কুট, চানাচুর দেখা যাচ্ছে। আর দুটো তে ফল, মিষ্টি। আমি দুই হাত কোমড়ে রেখে রেগে জিজ্ঞেস করলাম
— এসব কি?

— প্রথমবার শ্বশুরবাড়ি যাবো। খালি হাতে তো আর যেতে পারি না।

— আমি কিন্তু এক্সেপ্ট করিনি।

— রিজেক্টও করোনি। এবার কথা না বলে বাইকে উঠো।

প্যাকেটগুলো বাইকের হাতলে ঝুলিয়ে দিলো।আবার চলতে শুরু করলাম আমরা।গ্রামের রাস্তায় এসে পরেছি আমরা।রাস্তার দুই পাশে যতদূর চোখ যায় খেতের পর খেত। সেগুলো এখন পরিষ্কার করা হচ্ছে। কোন কোন খেতে চাষ দেওয়া হচ্ছে। কোনটায় বা রোদে পুড়ে সার দিচ্ছে। এখন আলু বোনার মৌসুম। আলু বোনার আগের সকল ব্যবস্থা নিচ্ছে সবাই। রাস্তার দুই পাশে বড় বড় গাছ লাগানো। সেগুলো থাকায় রোদ লাগছে না গায়ে। প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিলাম। নিজের গ্রাম এটা। সবকিছুকে নিজের বলে দাবী করতে পারি। চারিদিকে সবুজ আর সবুজ। ঠান্ডা হাওয়া আর বিশুদ্ধ অক্সিজেন। মনটা এমনি খুশি খুশি লাগছে। চারিদিকে তাকাতে নিমিষেই মন ভালো হয়ে গেছে। এনাজ চুপচাপ বাইক চালাচ্ছে তার নিজের গতিতে। প্রায় ৬ মাস পর গ্রামে আসা হলো। অনেক কিছু বদলে গেছে। তবুও ভীষণ ভালো লাগছে। ইচ্ছে করছে উড়াধুরা নাচতে। হাত দুটো দুই দিকে মেলে বাতাসটা অনুভব করতে লাগলাম। কিন্তু এনাজের ধমকে বেশি সময় হাত মেলে রাখা হলো না। এক হাতে তার কাঁধে রেখে চুপ করে বসলাম। বাইক থামলো আমাদের বাসার সামনের মাটির রাস্তায়।
#শিশির_ভেজা_রোদ্দুর
#Part_40
#Writer_NOVA

বাইক থেকে নামতেই আমার বড় চাচাতো বোনের তিন মেয়ে অনন্যা, অর্থি, ঐশি ও ইভা দৌড়ে আমাদের নিতে আসলো। চারটা আমাকে জড়িয়ে ধরে চ্যাপ্টা বানিয়ে ফেলছে। আমি ওদের থেকে কোনরকম নিজেকে ছাড়িয়ে বললাম,

— খালামণিরারে আমাকে একটু নিঃশ্বাস নিতে দে।আমাকে এভাবে জড়িয়ে ধরলে আমি শ্বাস আটকিয়ে নিচে পরে থাকবো।

অনন্যা মুখ গোমড়া করে বললো,
— এত দেরী! তোমাকে কল করতে করতে আমি হয়রান হয়ে গেলাম। আমি কিছু সময় পরপর ইভাকে জিজ্ঞেস করতাছি খালামণি কখন আসবো? কতখন পর পর রাস্তায় এসে দাড়ায় থাকি।তোমারা এত দেরী করে আসবে তা জানলে তোমাদের জন্য বরণডালা নিয়া আসতাম। তোমার জন্য আমরা কেউ দুপুরের ভাত খাই নাই। একসাথে খাবো বলে।

আমি ওর গাল দুটো টেনে এক হাতে জড়িয়ে ধরে বললাম,
— আহারে, আমার বড় কাকিটা রে। মেয়ের জন্য কত চিন্তা।

অর্থি গাল ফুলিয়ে বললো,
— হু বড় আপিরেই আদর করে। আমরা তো কেউ না। তোমার জন্য আমরা কখন থেকে অপেক্ষা করতাছি।কিন্তু আমাকে কেউ দেখেয় না।

আমি এদের কান্ড দেখে মিটমিট করে হাসলাম।তারপরে অর্থির এক হাত টেনে আমার পাশে দাঁড় করালাম,
— থাক খালামণি রাগ কইরো না। তুমি আমার কিউটি একটা খালামণি। এখন রাগ করলে কিন্তু আবার চলে যাবো।

অর্থি চেচিয়ে বললো,
— এই না। এক সপ্তাহের আগে কোথাও যাইবা না।আমরা যতদিন থাকবো তুমি ততদিন থাকবা।

ঐশি আমার এক হাত ওর দুই হাতের মুঠোয় নিয়ে আমাকে বললো,
— কেমন আছো খালামণি?

— আলহামদুলিল্লাহ ভালো তুমি?

— আমিও ভালো। তোমার জন্য আমরা কখন থেকে বসে আছি। বারবার ইভা খালামণিকে জিজ্ঞেস করি নোভা খালামণি কখন আসবো। আর তোমরা কত দেরী করে আসলা।

— আমরা ইচ্ছা করে দেরী করি নাই। সারা রাস্তা যাম। এতো যামে আগে কখনও পরিনি। সকাল দশটায় রওনা দিয়ে এই চারটা বাজে আসলাম।

— খালামণি ঐ আঙ্কেলটা কে?

— তোমার তায়াং মামার বন্ধু।

অনন্যা বললো,
— আম্মু আর মামার সাথে যে শপিং করছিলো সে?

ইভা আমার থেকে সাইড ব্যাগটা নিয়ে অনন্যাকে উত্তর দিলো।
— হুম এনাজ ভাইয়াই ছিলো শপিং-এর সময়।

অর্থি বললো,
— উনি কি শাড়ি চয়েজ করে দিছে?

অনন্যা বললো,
— হুম সেই শাড়ি চয়েজ করছে। উনার চয়েজ খুব সুন্দর। বিয়ের শাড়িটা বাসার সবাই পছন্দ করছে।

এনাজ বাইক নিয়ে আমাদের কিছুটা পেছনে আসছে।আমি ইভাকে বললাম,
— ইভা,যা উনার থেকে মিষ্টির প্যাকেটগুলা নিয়ে আয়।

ইভা ও অর্থি একসাথে দৌড় দিলো পেছন দিকে। এনাজের সাথে কুশল বিনিময় করে তার থেকে জোর করে প্যাকেটগুলো নিয়ে এলো। আমাদের পাশের বাসায় আসার পর আমি এনাজকে বললাম,

— আপনি আপাতত বাইকটা এখানে তালা মেরে রাখেন। বাসার অবস্থা বুঝে একটু পর এসে নিয়ে যাবেন।

এনাজ মাথা হেলিয়ে সম্মতি প্রকাশ করলো। বাইক রেখে আমাদের সাথে সাথে চলতে লাগলো। এর মধ্যে অনন্যা,অর্থি,ঐশী তিন বোনই এনাজের সাথে কথা বলেছে। এরা আবার খুব সহজে সবার সাথে মিশতে পারে। ঐশীতো ইতিমধ্যে ভাব জমিয়ে ফেলেছে। এনাজের হাত ধরে হাটছে। এবার ছোট করে ওদের তিন বোনের পরিচয় দিয়ে দেই। আমার বড় চাচ্চুর চার ছেলে-মেয়ে। তিন ছেলে আর এক মেয়ে। মেয়ের নাম শাহীনুর।এই আপু বংশের বড় মেয়ে। আর ভাই-বোনের মধ্যে উনি ২য়। তার তিন মেয়ে এই অনন্যা, অর্থি ও ঐশী। অনন্যা এবার কলেজে উঠেছে। অর্থি ক্লাশ 10-এ। ঐশী ক্লাশ ফাইভে। ওদের আপন খালামণি নেই বলে আমি ও ইভা ওদের সব। এই বাসায় আসলে আমাদের দুইজনকে ছাড়া কোন কাজ করবে না। যার বিয়ে সে হলো ওদের ছোট মামা।

বাড়িতে ঢুকতেই আমাদের নিয়ে হৈচৈ পরে গেল। তাদের কান্ড দেখে মনে হচ্ছে ছয় মাস পর আমি শ্বশুর বাড়ি থেকে জামাই নিয়ে বাবার বাড়ি এসেছি।বাসায় এখন আমাদের নিয়ে হুলস্থুল। সবার সাথে কুশল বিনিময় করে রুমে ঢুকতে পারলাম। আমাদের উঠোনেই L আকৃতির করে প্যান্ডেল সাজানো হয়েছে। মানুষ আজ খুব বেশি নয়। আমার এক ফুপি, তার মেয়ে, মেয়ের জামাই, বাচ্চারা ছাড়া আর কেউ আসেনি। আম্মু কাজ ছেড়ে উঠে আসলো। আমি ফ্যান ছেড়ে দিয়ে রুমের ফ্লোরে হাত-পা ছড়িয়ে বসে পরলাম। এনাজ খাটের ওপর চার হাত-পা চারদিকে দিয়ে শুয়ে পরলো। বেচারার ওপর দিয়ে ঝড়ই গেছে। আম্মু ওড়নায় হাত মুছতে মুছতে রুমে ঢুকে আমাকে জিজ্ঞেস করলো,

— আসতে কোন অসুবিধা হয়নি তো?

— একটুও না। বাইকে আসায় আমি হেব্বি আনন্দে আসছি। খালমণিরা আসে নাই?

— এই প্রশ্ন আমি তোকে করতাম। আধা ঘণ্টা আগে কল দিছিলাম তখন বললো বাবু বাজার ব্রীজে যামে আটকে আছে। এখনও কি যামে আটকে আছে কিনা কে জানে?

— আমরা বাইকে আসায় চিপাচাপা দিয়ে জলদী এসে পরেছি।

এনাজ উঠে বসে আম্মুকে সালাম দিলো।
— আসসালামু আলাইকুম আন্টি।

— ওয়া লাইকুমুস সালাম। কেমন আছো বাবা?

— আলহামদুলিল্লাহ ভালো আপনি?

— আলহামদুলিল্লাহ। ফ্রেশ হয়ে নাও। আমি খাবারের ব্যবস্থা করি।

— এত ব্যস্ত হতে হবে না। তায়াং-এর খালামণির বাসা মানে আমারো খালামণির বাসা। যা করতে হবে নিজের হাতেই করতে পারবো।

— আচ্ছা তা করো। এখন যাও হাত মুখ ধুয়ে আসো। আমি টেবিলে খাবার দিতে বলি।

— গোসল করবো আন্টি। নয়তো অস্বস্তি লাগবে।

— তাহলে এই ওয়াসরুমে গোসল করে ফেলো। বিকেল হয়ে গেছে আরো দেরী করলে দুপুরের ও রাতের খাবার একসাথে খেতে হবে।(আমার দিকে তাকিয়ে) বোরখা খুলিস না কেন? বোরখা খুলে ফ্রেশ হো।

আমি আম্মুকে বললাম,
— হ্যাঁ হচ্ছি। একটু জিরিয়ে নেই।

বোরখা খুলে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। এনাজ গোসলে ঢুকছে। আমি মোবাইল বের করে ফেসবুক ওন করে খাটে বসতেই অনন্যা এসে বললো,
— এখন আবার মোবাইল নিয়া কেন বসছো?খেতে চলো। আজকে কি আর খাবে না? তোমার জন্য আমরা বসে আছি। পেটে ইদুর দৌড়াইতাছে।

আমি মোবাইল রেখে বললাম,
— মেহমান রেখে একা একা কি করে খাবো? বিষয়টা কি ভালো দেখায়?
—গোসল থেকে বের হয়নি?

— না।

— তাকে কি বলবো? আঙ্কেল নাকি মামা?

— মামা বলবি। আঙ্কেল কেন বলবি?

— ছোট মামা কিন্তু আমায় সব বলছে।

— কি বলছে?

— এই আঙ্কেল তোমাকে পছন্দ করে।

আমি চোখ দুটো রসগোল্লা বানিয়ে ওকে বললাম,
— কার থেকে জানলি?

— বললাম না ছোট মামা বলছে।

— ছোট ভাইয়া কার থেকে জানলো?

— মামাকে তো আঙ্কেল বলছে।

ওর কথা শুনে আমি আরেকদফা অবাক। এনাজ এই কথা ছোট ভাইয়াকেও বলে দিছে। আল্লাহ জানে এবার কি হয়? অনন্যাকে ওর মা ডাক দিতেই ও বের হয়ে গেলো। আমি চিন্তায় পরে গেলাম। যদিও ছোট ভাইয়া ও অনন্যা কাউকে এসব বিষয় বলবে না। তবুও একটা কিন্তু রয়ে যায়।

💖💖💖

ছোট ভাইয়ার নাম আব্দুস সামাদ। তারই বিয়ে। একে আমাদের বাড়ির সবাই ভয় পায়।ভাইয়া আবার আমার আব্বুকে ভয় পায়। আব্বুকে শুধু ভাইয়া নয় আমার চাচাতো সব ভাই-বোন ভয় পায়। আসলে আব্বুকে দেখতে খুব ঠান্ডা ও নরম মনের মানুষ মনে হবে। কিন্তু তার রাগ বাড়ির সবার থেকে বেশি। তাই তাকে ভয় পাওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু আব্বুকে আমাদের দুই বোনের থেকে চাচাতো ভাই-বোনের ভয় পাওয়া দেখলে মাঝেমধ্যে আমার ভীষণ হাসি পায়।কিন্তু ভাইয়া আবার অন্যরকম। তার মাথা সবসময় গরম থাকে।যেদিন ভাইয়া রেগে যাবে সেদিন বাড়িতে ভাংচুর অবশ্যই হবে। তবে আমি মাঝে মাঝে আব্বুকে ভয় পেলেও ভাইয়াকে একটুও ভয় পাই না। ভাইয়া আমার থেকে ১২ বছরের বড়। কিন্তু আমাদের বন্ডিং দেখলে বলবে পিঠাপিঠি ভাই-বোন। ওকে আমি তুই করে বললেও সবার সামনে সবসময় বলি না। আম্মু জানতে পারলে বকা দেয়।যার কারণে লুকিয়ে তুই বলতে হয়। তায়াং ভাইয়াকে তুই করে বলাও আম্মু পছন্দ করে না। তাই আম্মুর সামনে আমি দুজনকে আপনি বলে সম্বোধন করি। আর আম্মুর আড়ালে তুই।

— এই যে মিস টিডি পোকা হারালে কোথায়?

— কোথাও না।

— তিন মিনিট ধরে তোমার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। কিন্তু তোমার কোন রিয়েকশন নেই।

— আমি খেয়াল করিনি।

— তাতো দেখতে পাচ্ছি। তায়াং,আন্টি,তন্বী আসছে?

— না এখনো আসেনি।

— তায়াং আজ অনেক রাগবে। সকালে এমনি রেগে ছিলো। যামে পরে আজ ওর মেজাজ হাই লেভেলের চড়া হবে।

— হুম তাতো হবেই।

— চলো খেতে যাই। নাকি আমাকে রেখে পেটভোজন করে এসেছে?

— ইস, ওমন নই আমি। আপনার জন্য বসে আছি। আর আমার জন্য আমার সব ভাগ্নিরা বসে আছে।

— তোমার ভাগ্নিগুলো ভীষণ মিশুক। ছোট টা তো আমার হাত ছাড়ছিলোই না।

— ওরা এরকমি। সবার সাথে খুব সহজে মিশে যেতে পারে।

— ওদের নাম কি?

— বড়জনের নাম অনন্যা, আমরা ওকে অন্যা বলে ডাকি। মেজু অর্থি, ছোট ঐশী।

— খুব সুন্দর নাম।

এনাজ তোয়ালে দিয়ে চুল মুছতে লাগলো। তখুনি রুমে শাহীনুর আপু প্রবেশ করে আমাকে বকা আরম্ভ করলো,

— কি রে নোভা এখনো খেতে আসিস না কেন? মেহমান নিয়ে আসছিস আর না খাইয়ে রাখবি? একটু পর মাগরিবের আজান দিবে। আর কখন খাবি? রাতের রান্না বসিয়ে দিলে কি খাবারের ভেজাল করতে পারবো?

— আমার কি দোষ? উনি তো গোসলে গিয়েছিলো। তাকে ছাড়া কি খেতে পারি? মেহমান রেখে খেলে কেমন দেখায়?

শাহীনুর আপু আমার দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে এনাজের দিকে তাকালো। এনাজের সাথে কুশল বিনিময় সেরে নিয়ে বললো,

— তুমি তাহলে আসছো ভাই? আমি তো ভাবছিলাম আসবা না। তুমি আসছো তাতে অনেক খুশি হইছি। সামাদকে জিজ্ঞেস করলাম তোমাকে কল দিছে কিনা। ও বললো হ্যাঁ দিয়েছে। তুমি না আসলে সত্যি আমি অনেক রাগ করতাম।

এনাজ মাথার পেছনে চুলকে লাজুক হেসে বললো,
— এতবার করে বলছেন না আসতে পারি? ছোট ভাইয়ের কাছে বড় বোন দাওয়াত রক্ষা করার কথা বলেছে। ছোট ভাই সেটা অমান্য করলে তো বড় বোনকে অপমান করা হয়।

— চলো তাড়াতাড়ি খেতে আসো। আন্টিরাতো এখনো আসলো না।নোভা আয় জলদী।

আপু চলে গেল। বলে রাখা ভালো শাহীনুর আপু ও ছোট ভাইয়া ঢাকায় গিয়েছিল শপিং করতে। তখুনি এনাজ ও তায়াং ভাইয়া ছিলো তাদের সাথে। আমাদের পরিবারটা এমনি বেশ বড়। যদিও সবাই ভিন্ন খায়। তবে কোন অনুষ্ঠান হলে সবাই একসাথে খাওয়া-দাওয়া করি। এনাজ বললো,

— তোমাদের পরিবারের সবাই খুব ভালো। আমাকে কত সহজে সবাই আপন করে নিয়েছে। আমার মনে হচ্ছে নিজের বাসার অনুষ্ঠানে এসেছি। খুব বড় কপাল থাকলে এরকম ফ্যামেলী পাওয়া যায়।

— তা ভুল বলেননি। আমার পরিবারের মানুষ এরকমি। আরো দুটো দিন যাক তখন আপনিও তাদের সাথে পুরোপুরি মিশে যেতে পারবেন। আমাদের বিক্রমপুরের মানুষ অনেক অতিথিপরায়ণ। অতিথি পেলে আমরা ভীষণ খুশি হই। এখান থেকে যাওয়ার পর আপনি সারাজীবন এখানকার আতিথিয়েতা মনে রাখবেন।

এনাজ শয়তানি হাসি দিয়ে এক চোখ মেরে বললো,
— এই জন্য তো এই বাড়ির মেয়েকে বিয়ে করতে চাইছি। পুরো পরিবার পেয়ে যাবো তাহলে😉।

— ইস, শখ কত!

— অনেক শখ।

— হু হয়েছে চলেন এবার। এখন না গেলে সত্যি বকা খাবো। আমার বাকি চাচাতো ভাইয়ের বউদের সাথে আপনাকে পরিচয় করে দিবো।

— ওকে চলো।

রুম থেকে বের হয়ে বাইরে এলাম। উঠানের কোণার দিকে দুটো টেবিল পাতা। সেখানে চেয়ার টেনে খেতে বসে পরলাম। আমাদের সাথে অনন্যা,অর্থি,ইভাও বসলো। ওরা এনাজের সাথে কথা বলছে। আম্মু আমাদের খাবার বেড়ে দিয়ে গেল। এনাজ খেতে খেতে আমাকে জিজ্ঞেস করলো,
— রান্না কে করেছে?

আমি ডালের বাটি থেকে ডাল প্লেটে নিয়ে বললাম,
— এতগুলো মানুষের রান্না শাহিনুর আপু একা করছে। আপু রান্নায় বেশ এক্সপার্ট। উনি একা ১০০ জন মানুষের রান্না একা করতে পারবে। উনাকে অনুষ্ঠানের সময় রান্নাঘর ছাড়া অন্য কোথাও পাওয়া যায় না।

— তাহলে তো আপু অনেক কাজের। তুমি তাহলে এতো অলস কেন?

— সব পরিবারে একটা অলস থাকেই। আর আমার পরিবারে সেই একজন আমি।

— এমনভাবে বলছো যেন মনে হচ্ছে কি বীরত্বের কাজ।

—ইয়েস।

— সব রান্না কি মাটির চুলোয় করেছে?

— জ্বি হ্যাঁ। গ্যাস বেশি হয়ে যাইনি আমাদের।

— আপুর রান্না অনেক মজা।

— যে খাবে সেই বলবে। আপু অনেক ভালো রান্না পারে।

— তুমি মাটির চুলোয় রান্না করতে পারো?

— এটা কি এমন কঠিন কাজ যে পারবো না?

— তুমি সত্যি পারো😳?

— ক্লাশ নাইন থেকে মাটির চুলোয় রান্না করতে পারি। এটা আমার কাছে কোন ব্যাপারই মনে হয় না।

— গ্যাস নেই এইখানে?

— প্রত্যেকের ঘরে ঘরে আছে। তবে গ্রামের মানুষ মাটির চুলোয় রান্না করতে বেশি পছন্দ করে। খরচ কম আবার রান্নাও খুব দ্রুত হয়।

— মাটির চুলোর রান্না ভীষণ মজা।

— হ্যাঁ।

আমরা দুজন ফিসফিস করে কথা বলছি। অর্থি আমাদেরকে জিজ্ঞেস করলো,
— তোমরা দুজন কি কথা বলো?

এনাজ দুষ্টুমির সুরে বললো,
— বলতেছি ভাগ্নিগুলো অনেক বড় হয়ে গেছে এবার বিয়ে দিতে হবে।

অর্থি মুখ বাঁকিয়ে বললো,
— এ্যাহ না। ছোটমামার পর সিরিয়ালে নোভা খালামণি। তারপর ইভা। আমাদের বিয়ে দেরী আছে।

এনাজ সবার সাথে কথা বলে খেতে লাগলো। আমি কোন কথা না বলে চুপচাপ খাওয়ায় মনোযোগ দিলাম। কিছু সময় পর খালামণি, তায়াং ভাইয়া, তন্বী চলে এলো। একেকজনের চেহারার অবস্থা কাহিল। তায়াং ভাইয়া অনেক রেগে আছে। আমার দিকে রেগে একবার তাকিয়ে হনহন করে আমাদের দালানে ঢুকে পরলো। আমি মুচকি হেসে শসায় কামড় দিয়ে চাবাতে লাগলাম।
তায়াং ভাইয়ার সাথে আজ সাবধানে কথা বলতে হবে। নয়তো সব রাগ আমার ওপর ঝারবে।

#চলবে

😊।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here