শিশির ভেজা রোদ্দুর পর্ব -৪১+৪২

#শিশির_ভেজা_রোদ্দুর
#Part_41
#Writer_NOVA

পরের দিন…..

সব মিলে সকাল সাতটায় জোর করে উঠালো। এমনভাবে উঠিয়েছ মনে হচ্ছে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ লেগে গেছে আর আমি শেষ সৈনিক হিসেবে বেঁচে আছি।চোখ টেনে মেলতে পারছি না। নামাজ পরে একটু ঘুমিয়েছিলাম। তাও এদের সহ্য হলো না। এখন আমার মাথাব্যথা না উঠলেই চলে। ঘুম ঘুম চোখে বাইরে আসতে দেখি সব টেবিলে গোল করে খেতে বসেছে। আমাকে দেখে সামাদ ভাইয়া বললো,

— বোইনা খেতে আয়।

— এত সকালে খেতে ভালো লাগে না। দশটার সময় সব হজম হয়ে যাবে। তখন আমাকে কে খেতে দিবে?

— তখন আবার খাবি।

— আমাকে রেখে সব বসে পরছে। আবার কত কথা। যা খাবো না তোদের সাথে।

তায়াং ভাইয়া মুখ বাঁকিয়ে বললো,
— তোর খেতে হবে না। যা গিয়ে পরে পরে ঘুমা। তুই তো ঘুমাতে এসেছিস।

আমি তায়াং ভাইয়াকে একটা ভেংচি কেটে জোরে চেয়ার টেনে বসলাম। আমি বসতেই এনজিও সংস্থা তায়াং ভাইয়ার সাথে থেকে প্লেট নিয়ে আমার পাশের খালি চেয়ারে বসে পরলো। এর কান্ড দেখে আমি রেগে তাকালাম। বেচারা বোকা ফেস করে এক হাসি দিতেই আমিও ফিক করে হেসে উঠলাম। তায়াং ভাইয়া এনাজকে টম্পনি কেটে সামাদ ভাইয়াকে বললো,

— বুঝছেন ভাই, আজকালের পিচ্চি পোলাপাইন গুলাও বেশি এডভান্স হয়ে গেছে। বড় সমন্ধিরা যে সামনে আছে তাও কোন লাজ শরম নেই। সব বোধহয় প্রেমে পরার সাথে সাথে খেয়ে ফেলেছে। এমন ছেলের কাছে বোনের বিয়ে দিতে চাই না।

এনাজ এক ভ্রু উঁচু করে একগালে হেসে বললে,
—আমাকে পিচ্চি পোলাপাইন বললে ইফাত কিরে ভাই? আর শালা কি বললি তুই? আমার কাছে তোর বোনের বিয়ে দিবি না? এই বড় ভাইকে সাক্ষ্যি রেখে বলছি যদি তোর বোন মানে তোর খালাত বোনকে আমার কাছে বিয়ে না দিস তাহলে সোজা উঠিয়ে নিয়ে কাজী অফিস চলে যাবো। বিয়ের পর কল দিয়ে বলবো তোর বোনকে বিয়ে করে ফেলছি। দেখি এখন তুই কি করিস? এভাবে মান-সম্মান খোয়ানোর থেকে ভালো চুপচাপ আমার হাতে তুলে দিস।আমি কিছু করবো না।

তায়াং ভাইয়া তরকারির বাটি থেকে কাঁচামরিচ তুলে নিয়ে এনাজকে ছুঁড়ে মেরে বললো,
— তোর এত সাহস আছে নাকি? সাহস থাকলে আমার সামনের থেকে তুলে নিয়ে যাস।

— সাহস নিয়ে প্রশ্ন তুলিস না তায়াং। তাহলে ভালো কিছু হবে না।

আমি এনাজের দিকে কপাল কুঁচকে তাকালাম। সে আমার দিকে তাকিয়ে মুখটাকে কুচোমুচো করে বললো,
— তুমি এভাবে তাকিয়ে না। আমার তেমন কিছু করার ইচ্ছে নেই। তবে যদি পরিস্থিতি খারাপ হয় তাহলে করতেও পারি। আমাকে দিয়ে বিশ্বাস নেই।

আমি তার কথা শুনে ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে শব্দ করে মুখ ভেংচি দিয়ে অন্য দিকে তাকালাম। সামাদ ভাইয়া আমাদের কান্ড দেখে হাসছে। সামাদ ভাইয়াকে হাসতে দেখে আমি জিজ্ঞেস করলাম,

— তোর বউয়ের সাথে কথা হইছে ভাইয়া?

— না রাতে একটু হইছিলো।

— তুই জিতলি ভাই। মামাতো বোনকে ছোট থেকে একতরফা পছন্দ করে তাকে বিয়ে করে এখন ঘরে তুলবি। তোরা বিদেশি ছেলেরাই জিতিস। বুড়ো বয়সে কচি মেয়ে বিয়ে করতে পারিস।

— ঐ আমি কি করছি?

— কি করিস নি তাই বল? আবার বড় গলায় কথা বলিস? তোকে যদি জিজ্ঞেস করতাম তখন বলতি না মারিয়া আমার মামাতো বোন। ওকে আমি কেন পছন্দ করবো? এখন তাহলে বিয়েটা কি আমার ফুফাতো বোনের সাথে হচ্ছে সালাদ😤? তোর বয়স ৩৩ আর তোর বউয়ের মাত্র ১৮। আমার থেকে তিন বছরের ছোট। আগে নাম ধরে ডাকলেও এখন তো নাম ধরে ডাকতে পারি না। অবশ্য ওর জামাইকে সামাদের বদলে সালাদ বলি তাহলে ওকে কি প্রথম প্রথম ভাবী বলতে পারবো? তবুও কিচ্ছু করার নাই। ভাবী বলেই ডাকতে হবে। তুই তলে তলে রেলগাড়ী চালিয়ে এখন বলছিস কি করছি?

সামাদ ভাইয়া আমার কথার উত্তর না দিয়ে হাসতে লাগলো। মারিয়া মানে সামাদ ভাইয়ার বউ সম্পর্কে ভাইয়ার আপন মামাতো বোন। সে বহু আগের থেকে ওকে একতরফা পছন্দ করে। অনেক চড়াই-উতরাই পার করে এক বছর আগে ওদের কাবিন (আকদ) হয়েছে। এখন শুধু অনুষ্ঠান করে উঠিয়ে নিয়ে আসবে।ভাইয়া জানে একতরফা ভালোবাসাটা কতটা কঠিন।তাই হয়তো এনাজের বিষয়টা জেনেও কিছুই বলেনি।
ভাইয়া এখনো হাসছে।তাতে আরো রাগ উঠলো। আমি রেগে বললাম,

— একদম দাঁত কেলাবি না। ডালের চামচ ফিইক্কা মারমু। শয়তান ছেমরা। একটাও ভালো না। সব তলে তলে রেলগাড়ী চালায়।

তায়াং ভাইয়া ফোঁস করে রেগে বললো,
— কি করেছি তোর সাথে?

— তোকে কিছু বলছি আমি? তুই ফোঁস করে উঠিস কেন? আমি তো কাউকে মিন করে বলিনি। যেহেতু তোর গায়ে ফোস্কা পরেছে তাহলে তোকেই বলছি।

আমাদের ভাই-বোনের ঝগড়া দেখে মনে হচ্ছে এনাজ হাসতে হাসতে চেয়ার থেকে পরে যাবে। শাহিনুর আপু রান্নাঘর থেকে এসে ভাতের বোল টেবিলে রেখে বললো,

— কি হয়েছে তোদের? ঝগড়া করিস কেন?

আমি আপুর উত্তর না দিয়ে উল্টো জিজ্ঞেস করলাম,
— অন্যা,অর্থি, ইভা কোথায়?

— মেজু কাকা আসতাছে। তাদের আনতে গেছে।

— দুই আপু আসবে না?

— হুম জামাই নিয়ে আসবে। এর মধ্যে বোধহয় চলেও আসছে।

আমার আব্বু, চাচ্চুরা মিলে তিন ভাই। ভাইদের মধ্যে আব্বু ছোট।বোন চারটা ছিলো। কিন্তু এখন মাত্র একজন বেঁচে আছে। যে বেঁচে আছে সে আবার আব্বুর ছোট। বড় চাচ্চুর চার ছেলে-মেয়ে।মেজু চাচ্চু ঢাকায় থাকে। তার তিন ছেলে-মেয়ে। দুই মেয়ে আর এক ছেলে। মেয়ে দুটোর বিয়ে হয়ে গেছে। কিন্তু ছেলেটা আবার আমার ছোট। তাই ওকে নাম ধরেই ডাকা হয়।আর আমার আব্বুর আমরা দুই মেয়ে।

শাহীনুর আপু আমাকে জিজ্ঞেস করলো,
—বড় মামীরা কবে আসবে?

— কারা নূর আপিরা?

— হুম, নূরদের কথাই বলছি।

— হ্যাঁ, বিকালে আসবে।

— তন্বী, খালামণি কোথায়?

— আসলেই তো তারা কোথায়?

তায়াং ভাইয়া বললো,
— আম্মু, তন্বী খালামণির সাথে ঐ পাশের বাসার এক আন্টির বাসায় গিয়েছে।

সামাদ ভাইয়ার খাওয়া হতেই সে উঠে গিয়ে আমাদের বললো,
— আচ্ছা থাকো তাহলে তোমরা। আমার আবার ডেকোরেশনের লোকদের সাথে কথা বলতে হবে। হলুদের স্টেজ কবে করবে কে জানে? উনাদের হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে আগামীকাল করবে।

শাহীনুর আপুর সাথে কিছু টুকটাক কথা বলে সামাদ ভাইয়া চলে গেল। আপু তায়াং ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করলো,
— তায়াং কিছু দিবো?

আমি তায়াং ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে শয়তানি হাসি দিয়ে বললাম,
— আপু, মুলার তরকারি আছে? থাকলে ভাইয়াকে দিয়ে যাও। ভাইয়ার মুলার তরকারি ভীষণ পছন্দ। এটা হলে আর কিছু লাগে না।

শাহীনুর আপু বললো,
— মুলার তরকারি রান্না করি নাই। সিমের তরকারি আছে তা দিবো? দুপুরে না হয় তোমার জন্য আলাদা করে মুলার তরকারি রান্না করবোনি।

তায়াং ভাইয়া চেচিয়ে বললো,
— না আপু। আমি মুলার তরকারি পছন্দ করি না। এই শাঁকচুন্নি মিথ্যে বলছে।

এনাজ মুখ টিপে হেসে বললো,
— তোর পছন্দ তায়াং তা বলতেই পারিস। এতো লজ্জা পাওয়ার কি আছে?

— শালা, এখুনি আমার বোনের আইন টানিস? আর তো দিন পরেই আছে। তুই বউয়ের আঁচল ধরেই ঘুরবি।

শাহীনুর আপুকে ফুপি ডাক দিতেই সে রান্নাঘরের দিকে ছুটলো। তায়াং ভাইয়া আমার দিকে কটমট করে তাকিয়ে বললো,
— তোর ভিটামিন মাইরের অভাব আছে। ভিটামিন মার খেলে তুই ঠিক হবি।

আমি প্লেটের খাবার শেষ করে গ্লাস নিয়ে একটু দূরে হাত ধুয়ে এলাম। গ্লাসটা টেবিলের ওপর রেখে হাতে থাকা পানি তায়াং ভাইয়ার মুখে ছিটা মিরে বললাম,

— কম করে খা পাঠা, কম করে খা। দিনকে দিন যে ফুলছিস সেই দিকে খেয়াল আছে তোর? চিন্তা করতেছি সামনের কুরবানির পশুর হাটে তোকে উঠাবো। তাতে আমার বেশ লাভই হবে। চড়া দামে তোকে বিক্রি করা যাবে।

ভাইয়া চেয়ার থেকে উঠে আমার দিকে আসতে নিলেই আমি দৌড়ে রান্নাঘরের সামনে গিয়ে সবার সাথে বসে পরলাম। এখানে ভাইয়া আসবেও না। আর আমাকেও ধরতে পারবে না😝।

💖💖💖

দুপুরে….

আমাদের বাড়ির পুকুরে সব গোসল করতে নেমেছে। তায়াং ভাইয়া, এনাজ, সামাদ ভাইয়া সাথে দুই দুলাভাই। ঐশী, মেজু ভাইয়ার বড় মেয়ে আশা, ফুপাতো বোনের দুই ছেলে-মেয়ে। ইচ্ছে মতো ডুবচ্ছে আর শুধুই জোরে জোরে চিৎকার করে সারা বাড়ি তুলে ফেলছে। এখন মনে হচ্ছে আসলেই এই বাড়িতে বিয়ে। আমি, অন্যা,অর্থি,ইভা,তন্বী পুকুরের পাড়ে দাঁড়িয়ে ওদের হৈচৈ দেখছি। আমি মোবাইলে ভিডিও করে নিচ্ছি। তায়াং ভাইয়া ডুব দিয়ে কিছুটা কাদামাটি উঠিয়ে এনে আমার দিকে ছুঁড়ে দিলো। অর্থি আমাকে অন্য দিকে টেনে নিয়ে যেতেই রক্ষা হয়েছে। তায়াং ভাইয়া শয়তানি হাসি দিয়ে বললো,

— ইস একটুর জন্য বেঁচে গেলি। তুই ঐখানে দাঁড়িয়ে থাকিস। আমি তোকে কাদা দিয়ে ভুত বানাবো।

আমি দাঁতে দাঁত চেপে বললাম,
— সাহস থাকলে দিয়ে দেখাস। তুই যখন আগামীকাল জামাই সেজে কনের বাড়ি যাওয়ার জন্য তৈরি হবে তখন শোধ তুলবো।

— ঘন্টা করবি তুই আমার।

ভাইয়া আবার ডুব দিয়ে অন্য দিকে চলে গেল। এনাজ জোরে চেচিয়ে বললো,
— টিডি পোকা গোসল করবে নাকি?

— জ্বি না। আপনারাই করেন। তা এনজিও সংস্থা আপনি সাঁতার জানেন তো? নাকি ঘাট ধরে বসে থাকবেন?

— এভাবে অপমান🙁? সাঁতার না জানলে পুকুরে নামতাম আমি? আমি এখন পুকুরের মাঝখানে আছি। আর তুমি আমাকে ঘাট ধরে বসে থাকতে দেখছো। এগুলো কোন কথা?

তায়াং ভাইয়া এনাজকে বললো,
— আরে আমাদের পানিতে নামতে দেখে ওর হিংসে হচ্ছে। তাই এসব কথা বলছে।

— জ্বি না। আমার কাউকে দেখে হিংসে হচ্ছে না।

অনন্যা শয়তানি হেসে বললো,
— ঐ যে এলো সাপ এলো। ঐদিকে দেখো মামা।

সামাদ ভাইয়া ভাবলো সত্যি সাপ। উনি অনন্যাকে জিজ্ঞেস করলো
— কোথায় সাপ?

আমরা পাঁচজন পেয়ে গেলাম শয়তানি করার উপায়। একে অপরের দিকে তাকিয়ে ক্লোজ আপের এড দিলাম। অর্থি চেচিয়ে বললো,
— ছোট মামা তোমার ঐদিক দিয়ে দেখলাম। উঠে আসো। নয়তো সাপে কামড় দিবে।

ইভাও মুখটাকে সিরিয়াস মুডে নিয়ে বললো,
— ভাইয়া কামড় দিলে কিন্তু আপনার আর বিয়ে করতে হবে না।

আমি চেচিয়ে বললাম,
— লুঙ্গি সাবধানে রাখিস। সবগুলো তো লুঙ্গি পরে নেমেছিস। সাপের ধাওয়া খেয়ে যেন আবার লুঙ্গি খুলে না যায়😷। তাহলে কিন্তু আরেক সর্বনাশ। পানিতেই থাকতে হবে।

তন্বী মুখে হাত দিয়ে বললো,
— ভাইয়ারা সাবধান। সাপে কামড় দিয়ে আবার লুঙ্গি টেনে নিয়ে না যায়। ভালো করে গিট দিয়ে নে।

আমাদের কথা শুনে সবাই আমাদের দিকে চোখ বড় বড় করে তাকালো। আর পাড়ে দাঁড়িয়ে আমরা পাচজন হাসতে হাসতে লুটোপুটি খেতে বাকি।তায়াং ভাইয়া আমাকে ধমক দিয়ে বললো,
— তোদের যদি পুকুরে গোসল করতে হয় তাহলে নেমে পর। পাড়ে দাঁড়িয়ে আমাদের দেখে জ্বলতে,পুড়তে হবে না।

আমি কিছু বলার জন্য মুখ খুলতে নিলেই অনন্যা বললো,
— আমাদের এত শখ নাই মামা। আমরা এখন বড় হয়েছি। পুকুরে ডুবিয়ে গোসল করার বয়স চলে গেছে।

আমি মুখ ঝামটা মেরে বললাম
— তোর মাথার ঘিলু কি গলে পরে গেছে রে পাঠা? কি বলিস এসব? পুকুরে নেমে ডুবানোর বয়স আমাদের আছে? তোরাই বেশি করে ডুবা। যদি একটারো জ্বর আসে কিংবা ঠান্ডা লাগে তাহলে খবর আছে।

তায়াং ভাইয়া আমার কথা গায়ে না মেখে মাঝখানের দিকে চলে গেল। তারা পাঁচজন ইচ্ছে মতো ডুবাচ্ছে। পুঁচকেগুলো ঘাটের সামনেই সাঁতার কাটছে। ভাইয়াদের দেখে মনে উনিও আজ ওরাও পুঁচকেদের মতো ছোট হয়ে গেছে। টানা দুই ঘন্টা ডুবিয়ে তারপর সবগুলো উঠলো। একেকটার চোখ লাল টকটকে হয়ে গেছে। ফ্রেশ হয়ে সবাই একসাথে আবার খেতে বসলো। আমি, অনন্যা, অর্থি,ইভা আর দুই ভাবী মিলে ওদের সবাইকে খাবার সার্ভ করে দিচ্ছি। শাহীনুর আপু সবাইকে বিনা ডিটারজেন্টে ধুচ্ছে। আমি বেশ ইনজয় করছি। আমার হেব্বি লাগছে।

শাহীনুর আপু একটু থেমে আবার শুরু করলেন,
— সবগুলো ছোট বাচ্চাদের মতো করে দুই ঘন্টা ডুবিয়ে আসলো। চোখগুলো এখনো লাল হয়ে আছে। যদি একটারো ঠান্ডা লাগে তাহলে খবর আছে। জ্বর আসলেও একটারও সেবা করবো না। কাউকে সেবা করতে দিবো না। এই বুড়ো বয়সে কেউ এতো ডুবায়। চোখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। অন্যার আব্বু তুমিও ওদের সাথে জোড়া বেঁধে গেছো। জ্বর আসলে আমি একটুও সেবা করবো না। যেমন তোমার ছোট মেয়ে ডুবাইছে তেমন তুমিও।

ফুপাতো বোনও সবাইকে ঝারছে। তার দুই ছেলে-মেয়ের পিঠে কতগুলো তাল ফেলেছে। তিনি বললেন,

— পুকুরে গোসল করতে নেমে একদম ছোট বাচ্চা হয়ে গেছে। যদি কেউ একজন অসুস্থ হও তাহলে সরকারি হসপিটালে কোরনার রোগী বলে ভর্তি করে রেখে আসবো।

আমি সবার দিকে তাকিয়ে শয়তানি হাসি দিলাম। তারপর আপুদের সাথে সুর মিলালাম।

— একদম ঠিক বলছো আপু। একটাকেও ধরবো না। জ্বর,ঠান্ডা লাগা তো দূরে থাক। যে একটা হাঁচি দিবে তাকে ঐ পশ্চিম দিকের বাঁশবাগানে ফেলে দিয়ে আসবো। নয়তো চ্যাংদোলা করে ছাদের ওপর রোদে শুকাতে দিবো। রোদের তাপে শুটকি হলে এরা ঠিক হবে। তার আগে নয়।

আমার কথা শেষ হতেই এনাজ হাঁচি দিয়ে মুখ ঢেকে ফেললো। সবাই ওর দিকে তাকিয়ে জোরে হেসে উঠলো। বেচারা শুকনো মুখে আমার ও আপুর দিকে তাকালো। চোখ দুটো লাল হয়ে আছে। আমি আপুকে উদ্দেশ্য করে বললাম,

— এই তো পেয়ে গেছি। এটাকে আগে ধরো। বাঁশ বাগানে ফেলে রেখে আসি। তারপর রোদে শুকাতে দিবো। তোমরা চাইলে সরকারি হসপিটালে করোনার রোগী বলে ভর্তি করে রেখে আসতে পারো৷ (এনাজের দিকে তাকিয়ে) তা ভাইয়া চোখ দুটো তো লাল করেছেন। জ্বালা করছে না।

এনাজ দাঁতে দাঁত চেপে বিরবির করে বললো,
— কে ভাইয়া? কার ভাইয়া? আমাকে ভাইয়া বলতে বারণ করেছি টিডি পোকা।

আমি তার কানের কাছে মুখ নিয়ে বললাম,
— সবার সামনে ভাইয়া বলবো না তো কি জামাই বলবো?

এনাজ একগালে হাসি দিয়ে বললো,
— খারাপ নয়। বলতে পারো। আমি কিছু মনে করবো না। তবে ভাইয়া বলবা না।

— চুল টেনে ছিঁড়বো। এখন যদি ঠান্ডা, জ্বর আপনাকে ধরে তাহলে আমি একটুও আপনার সামনে ভিড়বো না। ইচ্ছে করে ওদের দাওয়াত দিলেন।

— এমন করো কেন? কত বছর পর পুকুরে গোসল করলাম। সবার সাথে মজা করতে করতে কখন যে এত সময় চলে গেল বুঝতেই পারিনি🥺।

উনার ছোট বাচ্চাদের মতো ঠোঁট উল্টানো কথাগুলো শুনে আমার ভীষণ হাসি পাচ্ছে। কিন্তু না হেসে মুখটাকে কঠিন করে বললাম,
— আপনি অসুস্থ হলে এখন আমিও বুঝবো না। এটাই আপনার শাস্তি।

আমাকে এনাজের কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মেজু ভাবী বললো,
— কি ফুসুরফাসুর করছো নোভা?

— কিছু না ভাবী।

আমি তরকারির বাটি নিয়ে রান্নাঘরের দিকে চলে গেলাম। ভাবীর চোখে আমি সন্দেহ দেখতে পেয়েছি। এখন ধরে ফেললে ভেজালেও পরতে পারি। তারচেয়ে মঙ্গল এখান থেকে ভালোই ভালোই কেটে পরি।
#শিশির_ভেজা_রোদ্দুর
#Part_42
#Writer_NOVA

হলুদ সন্ধ্যায়…..

বিকেল থেকে আমার একটু দম ছাড়ার অবসর নেই। এদিক দিয়ে ডাকে, ঐদিক দিয়ে ডাকে। সবার এখন আমাকেই প্রয়োজন। ভাইয়ার হলুদের স্টেজে সামনে যে খাবারগুলো ডিসপ্লেতে দেওয়া হবে সবগুলো ফলের ও খাবারের ডিজাইন করতে হবে আমাকে। অলরেডি অনেকগুলো শেষ। আর মাত্র দুইটা বাকি।এদিকে সবার রেডি হওয়া বোধহয় শেষ। কিন্তু আমার কাজ শেষ হয় না। তন্বী ও ইভা এখন সবাইকে সাজানোর দায়িত্বে আছে। তায়াং ভাইয়া, এনাজকে বিকেলে দেখেছিলাম রাতের খাবারের তদারকি করছে। এখন কে কি করে কিছু জানি না। সন্ধ্যা ৭ টা বলছিলো ভাইয়াকে স্টেজে উঠাবে। তার জন্য আবার চেচামেচি শুরু করছে। আমি ভেবেছিলাম আজ জমকালো সাজ দিবো। কিন্তু আশেপাশের সবকিছু দেখে মনে হচ্ছে আজ সাজতেই পারবো না। খাবারের সবকিছু সামলে বাইরে বেরুতে দেখি সব রেডি। শুধু আমি ছাড়া। সামাদ ভাইয়া দিলো এক রামধমক। আমি এখনো তৈরি হয়নি কেন তাই। রেগে বললো,

— তুই রেডি হোস না কেন?

— তোর জন্য খাবার রেডি করলাম। এখন আমার সাথে শুধু শুধু চেচামেচি করবি না। তাহলে কিন্তু আমি শাড়ি পরবো না। আর তোর স্টেজের সামনেও আসবো না।

— তুই শাড়ি পরে রেডি না হলে আমি স্টেজে উঠবোও না। আর হলুদের অনুষ্ঠানও হবে না। দেখে নিস তুই। যদি চাস অনুষ্ঠান হোক তাহলে জলদী শাড়ি পরে আয়।

আমি দ্রুত রুমে ছুটলাম। একে দিয়ে বিশ্বাস নেই। সত্যি সত্যি তারপর অনুষ্ঠান বাদ করে দিবে। আর সব মিলে তারপর আমাকে বকবে। কোন রকম পেটিকোট আর ব্লাউজ পরে ওয়াসরুম থেকে বের হলাম। এখন শাড়ি পরবো কার কাছে? নূর আপিরা মাগরিবের আজানের আগে আসছে।সামান্য একটু উঁকি মেরে দেখলাম প্যান্ডেলের মধ্য নূর আপি দাঁড়িয়ে আছে। আমি নূর আপিকে ডাকলাম।

— ও নূর আপি। নূর আপি।

— হ্যাঁ।

— এদিকে একটু আসো।

— আচ্ছা আসতেছি।

নূর আপি রুমে চলে এলো। ঐদিকে সবাই আমাকে বকা শুরু করে দিছে। আমার যে কেন দেরী হয়েছে তা কেউ বুঝতে চাইছে না। আমার দেরী হয়েছে সেটাই আমার দোষ। নূর আপি এসে বললো,
— তুই এখনো রেডি হোস নাই? আমি ভাবলাম তুই বোধহয় ঐ রুমে রেডি হয়ে গেছিস।

— তুমিও শুরু করলা? সবগুলোকে রেডি করতে পাঠিয়ে আমি একা একা সবগুলো খাবার সাজালাম। এখন আমিই বকা খাচ্ছি। এখন তাড়াতাড়ি শাড়িটা পরিয়ে দাও। আমার সাজগোজ আজকে মাটি। ঐদিকে আমাকে ছাড়া ভাইয়া স্টেজে উঠবো না। এতে যেন সবাই আরো বেশি বকতাছে।

— আমি রেডি হওয়ার সময় বারবার তোর কথা জিজ্ঞেস করলাম। ঐশী বললো কি তুই নাকি ঐ রুমে সাজতাছিস। দরজা আটকানো দেখে আমি কয়েকবার দরজা ধাক্কিয়ে আসছি। কিন্তু তুই খুলিসনি। আমি যদি জানতাম তুই রেডি হোস নাই তাহলে তো তোকেও নিয়ে আসতাম। আর পাকনামি করে সবকিছু একা একা করতে গেছিস কেন? সবাইকে নিয়ে করলেই তো তাড়াতাড়ি হয়ে যেতো।

— সবগুলো চেচামেচি শুরু করছে। তারপর আর কি করবো সবগুলোকে পাঠিয়ে দিয়ে আমি আর অন্যা অনেকগুলি করলাম। তারপর অন্যাকে পাঠিয়ে দিলাম। এখন আমার জায়গায় অন্যা থাকলে ও আর রাগ করে শাড়ি পরতো না।

নূর আপি শাড়ির কুচিগুলো ঠিক করে গুঁজে দিলো। আম্মু এসে রেগে বললো,
— নোভা, তোর হয় নাই? সবাই তোর জন্য বসে আছে। সামাদ তো সোজা বলে দিছে তোকে ছাড়া স্টেজে উঠবে না। এখন শুরু করলে ১২ টার মধ্যে শেষ করে দিতে পারবো। এই হলুদের অনুষ্ঠান নিয়ে কি গ্রামে সারারাত পার করে কেউ?

— আম্মু চিল্লাইয়ো না তো। আমি কি ইচ্ছা করে দেরী করছি তুমিই বলো? এখন সাজার টাইমটাও আমার নাই। বেশি আশা করছিলাম না হলুদে অনেক সাজবো। তাই ন্যাচারাল লুকেই আমার ক্যামেরার সামনে যেতে হবে। দয়া করে তুমিও সবার মতো শুরু করো না।

— জলদী আয়। আর সাজতে হবে না।

— আসতেছি তুমি যাও।

ওয়াসরুম থেকে কোনরকম ফেসওয়াশ দিয়ে মুখ ধুয়ে টিস্যু দিয়ে মুখ মুছে নিলাম। ঠোঁটটা অনেক শুষ্ক লাগছে তাই একটু লিপজেল দিলাম। মাথায় হিজাব পেঁচাতে পেচাতে দৌড় দিলাম স্টেজের দিকে। আমি, অনন্যা,অর্থি ইভা এই চারজন মিলে ভাইয়ার মাথায় ওড়না ধরে স্টেজে উঠিয়ে দিলাম। তারপর একে একে সবাই হলুদ ছোঁয়াতে লাগলো। স্টেজ থেকে নামতেই ইভা আমার দিকে তাকিয়ে শয়তানি হাসি দিয়ে বললো,
— একদম ঠিক হয়েছে। বেশি সাজতে চাইছিলা না। এর জন্য একটুও সাজতে পারো নাই। বেশি আশা করলে এমনি হয়।

অনন্যা বললো,
— আহারে! আমার খালামণিটার কত কষ্ট। একটু সাজতেও পারে নাই। থাক খালামণি, মন খারাপ কইরো না। কালকে বউ সাইজো।

আমি মুখটাকে(😒) এই ইমোজির মতো করে বললাম,
— হইছে তোমাদের আর আমার জন্য দুঃখ প্রকাশ করতে হবে না। দুঃখ প্রকাশ তো করছো না আমার পোড়া মনে আরো আগুন জ্বালিয়ে দিচ্ছো।

অর্থি আমাকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে বললো,
— খালামণি, তুমি ওদের কথায় কান দিও না তো। তোমাকে এভাবেই সুন্দর লাগতাছে।

— এই তো আমার মেজু ভাগ্নি বুঝতে পারছে।

ইভা মুখ বাঁকিয়ে বললো,
— কি আর করবা সাজতে তো পারোনি। এভাবেই মনকে সান্ত্বনা দাও।

আমি ইভার দিকে খাইয়া ফালামু লুক দিয়ে তাকিয়ে অন্যাকে জিজ্ঞেস করলাম,
—তন্বী ও নূর আপি কোথায়?

অনন্যা উত্তর দেওয়ার আগে অর্থি বললো
— তোমাদের দালানে ঢুকতে দেখছিলাম। তারপর আর দেখি নাই।

ওরা তিনজন অন্যদিকে চলে গেল। আমাকে জোর করেছিলো কিন্তু আমি যাইনি। স্টেজের কোণায় দাঁড়িয়ে রইলাম। ছেলেদের পরনে সবার গোল্ডেন কালার পাঞ্জাবী। গলায় গাঢ়ো জাম কালার সুতার কাজ। আর আমরা মেয়েরা সবাই গোল্ডেন পার জাম কালার শাড়ি পরেছি। শুধু সামাদ ভাইয়ার পাঞ্জাবী সাদা রঙের। আমি আশেপাশে তাকিয়ে এনাজকে খুঁজতে লাগলাম। বিকেল থেকে তাকে একবারও দেখিনি। বড় চাচ্চু ও চাচী ভাইয়াকে হলুদ ছোঁয়াচ্ছে। তা ভিডিও ম্যান ভিডিও করছে।

❝চোখে চোখে চোখ পরেছে
কি আর বলবো মুখে
কে তোমায় সাজিয়েছে
এত অপরুপে❞

কানের সামনে কারো সুর করে গান শুনে আমি চমকে দুই কদম পিছিয়ে গেলাম। বুকে থু থু দিয়ে চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে তাকে বললাম,
— এনজিও সংস্থা! এভাবে কেউ কানের সামনে গান গায়। আমি তো ভয় পেয়ে গেছিলাম।

— মা শা আল্লাহ আমার টিডি পোকা কে তো বেশ লাগছে। আজ চোখ ফেরানো দায় হয়ে যাবে।

— হইছে আর পাম মারতে হবে না। আমার দুঃখে বুকটা ফাডি যাইতাছে। আর উনি আসছে কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দিতে। আমি একটু সাজতেও পারলাম না।

— ন্যাচারাল লুকেই তোমায় ভীষণ সুন্দর লাগছে। শাড়িতে তোমায় অনেক বেশি সুন্দর লাগে।

— হইছে থামেন। মন ভালো না আমার।

—একটা কথা কি জানো তুমি?

— কি?

–তুমি যেরকম আছো সেরকমি থাকো। তোমাকে আমার এমনি ভালো লাগে। আমি কিন্তু তোমার নরমাল লুক দেখেই প্রেমে পরেছি। তাই ঐ কৃত্রিম সাজসজ্জা দিয়ে তোমায় সাজতে হবে না।

— আমি আজ সাজতে পারিনি তো কি হয়েছে? আগামীকাল বউ সাজবো মনে রেখেন হুহ😏।

— আমি বলে কি আর বুঝে কি!

— আমার আর কিছু বুঝতে হবে না। তায়াং ভাইয়া কোথায়?

— রান্নার ঐখানে।

— বিকেলে তায়াং ভাইয়া নাকি ঢাকায় গিয়েছিল। কেন?

— তুমি এই খবর জানলে কি করে? তায়াং-এর ঢাকায় যাওয়ার খবর তো আমরা কয়েকজন ছাড়া কেউ জানে না।

— আমার গোপনীয় সোর্চ আছে। তাদের থেকে জানছি। কেন গিয়েছে তাই বলেন?

— বলা যাবে না।

— সমস্যা নাই তাও খুঁজে বের করে ফেলবো।

💖💖💖

দুজনে স্টেজের সামনের সারির চেয়ারে গিয়ে বসলাম। আমি তাকে গভীর চোখে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলাম। সবার মতো একরকম পাঞ্জাবী, জাম কালার পয়াজামা, গলায় জাম কালারের ওড়না ঝুলানো। মা শা আল্লাহ বেশ লাগছে তাকে। চুলগুলো আজ সুন্দর করে সেট করেছে। কিন্তু আমার কাছে তার এলোমেলো চুলগুলোই ভালো লাগে। তাই হাত বাড়িয়ে সব চুল এলোমেলো করে দিলাম। সে চোখ পাকিয়ে ছোট ছোট করে জিজ্ঞেস করলো,

— এটা কি হলো?

— আপনি নাকি সব চুল এলোমেলো করেই রাখবেন। যেদিন জীবন গুছানোর মানুষ আসবে সেদিন চুল গুছাবেন। তাহলে আজ এত সুন্দর করে সেট করা কেন?

— আমার জীবন গুছানোর মানুষ আমাকে এক্সেপ্ট করে নিয়েছে তো তাই।

— আমি কখন এক্সেপ্ট করলাম?

— এই যে মিস টিডি পোকা একদম বোকা বানাবে না। সেদিন রাস্তায় একবার ঘোল খাইয়েছো। দ্বিতীয় বার নো চান্স।

— বুঝলাম না।

— তুমি আমার প্রোপজ এক্সেপ্ট করছো।

— কবে?

— বাসার সামনে বাইক থেকে নামার পর কে বলেছিলো যে আমার আব্বু-আম্মুকে রাজী করান। তাহলে আমার আপনার পোলাপাইনের আম্মা হতে সমস্যা নেই। এটাকে তো এক্সেপ্টই বলে। যেহেতু আমি তোমাকে প্রোপজে বলেছিলাম তুমি আমার পোলাইনের আম্মা হবে কিনা? তুমি পরবর্তীতে তাতে রাজী হয়েছে। তাহলে তো সেটা এক্সেপ্ট করাই হলো তাই না। যদি বলতাম ডু ইউ লাভ মি কিংবা ইউল ইউ ম্যারি মি তাহলে এই উত্তর খাটতো না। তাই এখন চালাকি না করে সোজা স্বীকার করে নাও তুমি রাজী হইছো।

আমি জিহ্বায় কামড় দিয়ে অন্য দিকে ঘুরে গেলাম। সত্যি একটু চালাকি করতে গিয়েছিলাম। কিন্তু এই ব্যাটা তাও ধরে ফেললো। আমি তো সত্যিই এক্সেপ্ট করে নিয়েছিলাম। দুজনের মধ্যে আর কোন কথা হলো না। কিছু সময় পর আমরা একসাথে দুজন ভাইয়াকে হলুদ ছোঁয়াতে গেলাম। স্টেজে উঠে সোফায় দুজন ভাইয়ার দুইদিকে বসে পরলাম।এনাজ ভাইয়ার কপালে হলুদ ছুঁয়ে একগাদা হলুদ আমার গালে ডলে দিলো। আমি একবার রেগে তাকাতে গিয়েও থেমে গেলাম। কারণ ভিডিও হচ্ছে। এখানে এমন করা ঠিক হবে না। তাছাড়া ন্যাচারাল লুকে আছি। তাই কোন সমস্যা নেই। যদি মেকআপ করা থাকতাম তাহলে তার ব্যান্ড বাজাতাম। এনাজ ভাইয়ার আগে একটা আঙুর নিয়ে আমার দিকে এগিয়ে দিলো। আমি কোন ভনিতা না করে তা নিয়ে মুখে নিলাম।ভাইয়াকে খাবার খাইয়ে এক টুকরো কেক এনাজের দিকে বাড়িয়ে দিলাম। উনি এক কামড় খেয়ে বাকিটা আমার মুখে পুরে দিলো। ভাইয়াকে মিষ্টি দিতে গেলে ভাইয়া চেচিয়ে বললো,

— বোইন আর না। আরো কত মানুষ আছে। আজকে আমাকে খাওয়াতে খাওয়াতে পেট ফাটিয়ে ফেলবে।

— সবে তো শুরু ভাইয়া। এখুনি হাঁপিয়ে যাচ্ছিস। হলুদ ছোঁয়ানো তো নয় খাইয়ে খাইয়ে মারার অনুষ্ঠান এটা।খেতে থাক তুই আমি গেলাম।

আমরা নামতেই তায়াং ভাইয়া ও নূর আপি উঠলো। নূর আপি যেতে চায়নি। আমি জোর করে ভাইয়ার সাথে পাঠিয়েছি। একে একে সবাই হলুদ ছোঁয়ালো ভাইয়াকে। হলুদ ছোঁয়ানো শেষ হতেই শুরু হলো খাবারের পালা। সবাইকে বিরিয়ানি সার্ভ করে দিচ্ছে তায়াং ভাইয়া, এনাজ আমার চাচাতো ভাই মুহিন, দুই দুলাভাই আরো অনেকে। গ্রামে বড় বিয়ের অনুষ্ঠান ছাড়া ওয়েটার আনা হয় না। নিজেরা মিলেই সবকাজ করে। আমাকে পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সামাদ ভাইয়া ডাকলো।

— নোভা এদিকে আয়।

— হ্যাঁ ভাইয়া বল।

— খাইছিস?

— না, পরে খাবো।

— তোরা কি আমাকে মেহেদী দিয়ে দিবি না?

— ওহ হ্যাঁ ভালো কথা মনে করছিস। আমি তো ভুলেই গেছি। ওয়েট আমি ইভাকে আর তন্বীকে ডাকতেছি। ওরা ভালো মেহেদী পরাতে পারে।

— তুই এক হাতে দিয়ে দিবি।

— আমি মেহেদী দিতে পারি না ভাইয়া।

— যা পারিস তাই দিবি।

— তুই আমাকে অনেক জ্বালাইতেছিস সালাদ😤। তোর বউ এসে নেক সব উসুল করবো।

অনন্যা,অর্থি,তন্বী,নূর আপি, ইভাকে আমি খুঁজেই পাই না। এরা একটু পর পর হাওয়া হয়ে যায়। অবশেষে সবগুলোকে খুজে এনে মেহেদী দিতে বসলাম। এক হাতে আমি আরেক হাতে ইভা। কি দিয়ে কি ডিজাইন করছি আমি নিজেও জানি না। হাত আমার বুড়ো মানুষের মতো ঠকঠক করে কাঁপছে।কিন্তু ভাইয়া জেদ ধরে বসে আছে আমাকেই দিতে হবে। পাক্কা আধা ঘণ্টা পর মেহেদী দেওয়া শেষ করে উঠলাম। খাওয়ার পর্ব শেষ অনেক আগে। রুমে গিয়ে শাড়ি খুলে সুতির একটা থ্রি পিস পরে সবাই একসাথে বিরিয়ানি খেয়ে বের হলাম। অনেকক্ষণ ধরে এনাজকে আর তায়াং ভাইয়াকে দেখছি না। উদ্দেশ্য এখন ওদের খুঁজে বের করা। আমার সাথে বাকি সদস্যও আছে। ঐশীকে দেখতে পেয়ে জিজ্ঞেস করলাম ওদের কথা।

— ঐশী, তোমার এনাজ, তায়াং মামাদের দেখছো?

এই মেয়ে হলো সারা বাড়ির রিপোর্টার। কোথায় কি হলো, কি হবে, কে কোথায় গিয়েছে, কেন গিয়েছে সবকিছুর উত্তর ওর কাছে পাওয়া যায়।এর থেকে জেনেছিলাম তায়াং ভাইয়া বিকেলে ঢাকা গিয়েছে। এই পুঁচকে ওদের আশেপাশে ছিলো তখন শুনছে। তা আবার আমাকে এসে বলে দিয়েছে। ঐশী কিছু সময় ভেবে বললো,

— একটু আগে সবগুলি মামাদের কতগুলি পলিথিনে পেঁচানো কি জানি নিয়ে বড় মামার দালানে ঢুকতে দেখছিলাম। তারপর আর বের হয় নাই। এখনো বোধহয় সেখানে আছে।

বড় ভাইয়ার দালানে ঢুকতেই বিচ্ছিরি একটা গন্ধ এসে নাকে বারি খেলো। পাশের রুমের দরজাটা হালকা আবজানে। আমরা পাঁচজন দরজা দিয়ে উঁকি দিতেই চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেলো।

রুমের ভেতর একেকটা টাল হয়ে এদিক সেদিক পরে আছে। ভিয়ারের খালি বোতলগুলো এদিকে একটা ঐদিকে একটা করে পুরো রুমে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। প্লেটে এখনো কতগুলো চিপস, চানাচুর দেখা যাচ্ছে। আরেক প্লেটে ফলের টুকরা দেখতে পাচ্ছি। তায়াং ভাইয়া, এনাজ, সামাদ ভাইয়া, মুহিন, দুই দুলাভাই, সামাদ ভাইয়ার দুইটা খালাতো ভাই আরো অনেকগুলো এলোমেলো হয়ে একটার ওপর আরেকটা পরে আছে। আমি বাকিগুলোকে আড়াল করে দরজার সামনে জোরে চেচিয়ে বললাম,

— কি হয়েছে এখানে?

তায়াং ভাইয়া আমাদের দেখে তার পায়ের কাছে থাকা মদের খালি বোতল দুটো দ্রুত খাটের নিচে লুকিয়ে ফেললো। বাকি যে পাশে দুটো পরে আছে সেগুলো লুকানোর কথা বেমালুম ভুলে গেছে। নয়তো ঐগুলো সেখানে পরে থাকতো না।তায়াং ভাইয়া ঝিমতে ঝিমতে ধমক দিয়ে বললো,
— ঐ তুই এখানে কি করিস? যা ভাগ।

— আমি এমনি চলে যাবো। তার আগে তোদের কুকীর্তিগুলো একটু ভিডিও করে নেই। এর জন্য বিকালে তুই ঢাকায় গিয়েছিলি। এখন আমি প্রত্যেকটাকে বকা খাওয়াবো। ওয়েট আব্বুকে নিয়ে আসতেছি। চাচ্চুকে আনলে কাজে দিবে না। তাদের গুণধর ছেলেদের ও জামাইদের কীর্তিকালাপ তো স্বচোখে দেখাতেই হয়। একেকটা মদ খেয়ে ভালো করে তাকাতে পারে না। আবার আমাকে ধমক দেওয়া হচ্ছে? এখানে মদের আসর বসাইছো তোমরা। ওয়েট করো আমি আসতেছি আব্বুকে নিয়ে।

সামাদ ভাইয়া হালকার ওপর নিচ থেকে মাথা উঠিয়ে বললো,
— যা বলার বলিস, আমরা কি কাউকে ভয় পাই?

— বেহুশে আছিস তো তাই হাওয়ায় উড়ছিস। হাওয়ার থেকে নিচে পরলেই এই সাহসগুলো ফুস করে উড়ে যাবে। কাউকে যদি নাও বলি তাহলে তোদের ব্লাকমেইল করার ব্যবস্থা আমি করে রাখছি। এনজিও সংস্থা আপনিও? আপনাকে দিয়ে এমনটা আশা করিনি।

মোবাইলে অলরেডি প্রত্যেকটাকে ভিডিও করে ফেলছি। এনাজ মাথাটাকে এদিক সেদিক ঘুরিয়ে স্বাভাবিকভাবে উঠার চেষ্টা করলো। কিন্তু উঠতে পারলো না। চোখে নিশ্চয়ই সব ঘোলা দেখছে। একটু দাঁড়িয়ে ধপ করে বসে পরলো। তারপর অপরাধী ভঙ্গিতে নেশার কন্ঠে বললো,

— আমার কোন দোষ নেই টিডি পোকা। সবাই আমাকে জোর করছে। তাই আমিও কয়েক পেগ খেলাম আরকি। তবে বেশি খাইনি😁।

সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছে না আর উনি নাকি বেশি খায়নি। এমন গা জ্বালানী কথা শুনে রাগটা বেরে গেল। কিন্তু কিছু বললাম না। ভিডিও অফ করে চুপচাপ আস্তে করে বের হয়ে গেলাম। একটাও এখন হুশে নেই। যা ভিডিও করেছি তাই ব্লাকমেইলের জন্য যথেষ্ট।আমি দরজার সামনে দাঁড়িয়ে এত বড় বড় ডায়লগ ছেড়েছি। ভেতরে ঢোকার সাহস আমার নেই। সবগুলো বেহুশে আছে। কিছু করে বসতেও পারে। এখন এদের দিয়ে বিশ্বাস নেই। ভেতরে ঢোকা আমার জন্য নয় নম্বর বিপদ সংকেত। কোনরকম সেখান থেকে সবগুলোকে নিয়ে কেটে পরলাম।

#চলবে
#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here