শিশির ভেজা রোদ্দুর পর্ব -৪৯+৫০

#শিশির_ভেজা_রোদ্দুর
#Part_49
#Writer_NOVA

সকালের ধোঁয়া ওঠা চায়ের সাথে কমবেশি সবাই পরিচিত।অনেকে কুয়াশায় মোড়ানো সকালটাকে উপভোগ করে এক কাপ চা কিংবা কফির সাথে। কিন্তু সকালটা যদি হয় গরম গরম ধোঁয়া ওঠা ভাপা পিঠার সাথে তাহলে তো তার তুলনাই নেই।

আম্মু মাটির চুলের পাশে বসে ভাপা পিঠা বানাচ্ছে। সাথে খালামণি ও বড় মামী সাহায্য করছে। আমি, নূর আপি, অনন্যা চাদর মুড়ি দিয়ে চুলোর কাছেই বসে আছি। ইভা,তন্বী, অর্থি এখনো উঠেনি। আজকে বেশ শীত লাগছে। মনে হচ্ছে কয়েকদিনে পুরো দমে শীত বুড়ি তার কার্যক্রম শুরু করবে। গরম ভাপা পিঠা মুখে দিতেই শীতে আসার আনন্দ উপভোগ করা যায়। যদিও শীত সবার জন্য সমান আনন্দের নয়। তবুও এর শাক-সবজি ও পিঠাপুলির কারণে একে একটু বেশি পছন্দ করি আমি। গরম ভাপা পিঠার থেকে একপাশ ভেঙে মুখে দিতেই তায়াং ভাইয়া ও এনাজের আগমন। তারা সকাল সকাল দোকানে গিয়েছিলো। কেন গিয়েছিল তা আমি আন্দাজ করে ফেলেছি। দুই বন্ধু গরুর জাবরকাটার মতো করে চুইংগাম চাবাচ্ছে। এনাজের হাতে মুঠ ভর্তি তাজা, সতেজ লাল শাক।তার মধ্যে থাকা শিশির বিন্দুগুলো প্রমাণ করে দিচ্ছে সদ্য তুলে আনা হয়েছে। আমাদের কাছে এসে এনাজ আম্মুকে বললো,

— আন্টি, শাকগুলো কিরকম হয়েছে?

আম্মু, খালামণি, মামী তিনজনেই শাকগুলো দেখে খুশি হয়ে গেলো। আসলেই শাকগুলো দেখতে টাটকা,তরতাজা দেখাচ্ছে। যে কাউকে আকর্ষণ করতে সক্ষম। আম্মু খুশি মনে বললো,
— মা শা আল্লাহ। শাকগুলো তো টাটকা মনে হচ্ছে। কোথা থেকে আনলে?

— ঐ তো দোকান থেকে আসার সময় জমি থেকে তুলতে দেখলাম। আমার এতো পছন্দ হয়েছে যে কিনেই নিয়ে আসলাম। জমির মালিক বললো কোন ধরনের ঔষধ ব্যাবহার করেনি। একদম নির্ভেজাল।

— পাতাগুলোও টাটকা লাল। আমার কাছে শাক দিয়ে তোমরা হাত-পা ধুয়ে এসো। আমি গরম গরম পিঠা দিচ্ছি খেয়ে নিবে।

— ভাপা পিঠা 😋!

— তুমি পছন্দ করো না?

— অনেক বেশি। আম্মু বেঁচে থাকতে প্রতি শীতে আমার জন্য কয়েকদিন পরপর বানাতো। এখন আম্মুও নেই কোন পিঠাও নেই।

শেষের কথাগুলো বলতে বলতে এনাজের মুখটা কালো হয়ে আসছিলো। তার দিকে তাকিয়ে বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো। আম্মু হাড়ির ওপর ভাপে পিঠার ছাঁচটা টোকা দিয়ে পিঠা ফেলে দিয়ে বললো,

— আম্মু নেই তো কি হয়েছে আমরা আছি তো। মন খারাপ না করে জলদী জলদী পিঠা খেতে এসো।

খালামণি এনাজের হাত থেকে শাকের আঁটিগুলো নিয়ে বড় খাঁচিতে রেখে আম্মুর সাথে গলা মিলিয়ে বললো,

—পুরনো কথা মনে করে মন খারাপ করিস না তো বাবা। যা ফ্রেশ হয়ে আয়। তায়াং তুইও যা।

এনাজ মুখটাকে গম্ভীর করে বললো,
— পুরনো কথা তো মনে করতে চাই না আন্টি। তবুও মনে পরে যায়।

আব্বু সবেমাত্রই দালান থেকে বের হয়ে রান্নাঘরের সামনে এসেছিলো। এনাজের কথা শুনে মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
— জীবন অনেক বড় বাবা। থেমে না থেকে চলতে থাকো। মনে রাখবে গতিতে জীবন, স্থিরতায় মৃত্যু। পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মানব, আমাদের নবী হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) ও কিন্তু এতিম ছিলেন।

এনাজ মুখের চুইংগামটা দূরে ফেলে দিয়ে আব্বুকে বললো,
— দোয়া করবেন আঙ্কেল। শেষ পর্যন্ত যেন সঠিক পথে চলতে পারি।

— ইন শা আল্লাহ পারবে। এখন কথা না বলে পিঠা খেয়ে নাও। নোভার আম্মু, ওদেরকে পিঠা দাও। ওরা দাঁড়িয়ে আছে তুমি ওদের দিচ্ছো না।এটা কি ঠিক?

বড় মামী বললো,
— ওরা ফ্রেশ হয়ে আসুক। দোকান থেকে এলো। এখন হাত-পা ধুয়ে খেতে বসলে ভালো হবে। নোভার মা তুমি নোভার আব্বুকে পিঠা দাও।

আব্বু মামীকে বললো,
— আমার জন্য না ভাবী। ওদেরকে আগে দিন। মেহমান রেখে কি আমরা আগে খাবো? ওরা আগে খেয়ে নিক। যাও তোমরা দুইজন টিউবওয়েল থেকে হাত,মুখ ধুয়ে নাও।

এনাজ আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে একটা হাসি উপহার দিয়ে তায়াংকে বললো,
— চল হাত-পা ধুয়ে নেই।

তায়াং ভাইয়া মোবাইল চালাচ্ছিলো।এনাজের কথা শুনে মোবাইল থেকে চোখ উঠিয়ে চুইংগাম চাবাতে চাবাতে এনাজের দিকে তাকিয়ে বললো,

— হুম চল।

তায়াং ভাইয়া মুখে চল বললেও আবারো মোবাইলের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা করতে মনোযোগী হয়ে গেলো। এনাজ একা গিয়ে টিউবওয়েলে হাত-পা ধুতে নিলে আমি আস্তে করে খাওয়া ছেড়ে উঠে তার সামনে চলে এলাম। তার সামনে গিয়ে টিউবওয়েলের হাতল ধরে বললাম,

— আমি টিউবওয়েল চাপ দিয়ে দেই? যদি আপনার কোন অসুবিধা না হয়।

এনাজ এক চোখ মেরে দুষ্টুমীর সুরে বললো,
— কেউ আমার কাজে হেল্প করতে চাইলে আমি কি মানা করতে পারি? তাও আবার আমার প্রিয় মানুষ।

আমি মুচকি হেসে টিউবওয়েলের হাতল ধরে চাপ দিতে লাগলাম। এনাজ উবু হয়ে হাত-পা ধুতে মন দিলো। খালামণি, আব্বু, মামী কথা বলছে। তাই এদিকে খেয়াল নেই তাদের।

💖💖💖

হেমন্তের আগমণের সাথে সাথে শীতবার্তা পাঠিয়ে দেয়৷ যার মানে হলো হেমন্তের পরের রুক্ষরাজ ঋতু শীতের আগমন ঘটবে। হেমন্ত শেষ না হতে হতেই শীত বুড়ি তার অস্তিত্ব গেড়ে বসে। এই সময় গ্রামে আমন ধান কাটার তোড়জোড় শুরু হয়ে যায়। ধান মাড়াই করার পর সকালবেলা কৃষক গিন্নি ঘোমটা টেনে ধান সিদ্ধ করতে ব্যস্ত হয়ে পরে। রোদ ওঠার সাথে সাথে সিদ্ধ ধান রোদে শুকাতে দিতে হবে। ধান ঝাড়া,
উড়ানো, রোদে শুকানো কত কাজ তার। শীতের আমেজটা তাদের উপভোগ করার সময় নেই।

অনেকখন ধরে এদিক সেদিক তাকিয়ে এনজিও সংস্থাকে খুঁজছি। কিন্তু তার দেখা নেই। পিঠা খেয়ে এনামের সাথে কলে কথা বলতে বলতে কোনদিকে গেলো কে জানে! তায়াং ভাইয়া নূর আপির সামনে বসে আছে। ভাইয়া আপিকে নানা কথা বলে রাগাচ্ছে। সবার সামনে নূর আপি কিছু বলতেও পারছে না। আবার সহ্যও করতে পারছে না। আমি তাদেরকে ক্রস করে পুকুরপাড়ের দিকে চলে গেলাম। সেখানে গিয়ে দেখি মহাশয় পুকুরপাড়ে দুই পায়ে ভর দিয়ে বসে আরামচে মোবাইল চালাচ্ছে। আমি তার সামনে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম।

— এখানে কি করছেন?

আমার কন্ঠ পেয়ে সে পেছন দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে বললো,
— রোদ পোহাচ্ছি।

— তাই বলে পুকুরপাড়ে?

— হুম মিষ্টি রোদ উঠেছে আজ। সকালে দোকানে যাওয়ার সময় আমি ঠকঠক করে কাঁপছি। বাপরে, যা শীত ছিলো। ঠান্ডায় জমে যাওয়ার জোগাড়।

— হুট করে শীতটা পরে গেলো।

— হ্যাঁ, একটা টি-শার্ট পরে বের হয়েছিলাম। দেখি শীতে আমাকে জমিয়ে ফেলছে।দ্রুত বড় হাতার শার্ট পরে তারপর বের হলাম।

— কেন গিয়েছিলেন?

— এমনি হাঁটতে।

— মিথ্যে কথা কেন বলেন?

— মিথ্যে কেন বলবো?

— সিগারেট টানতে গিয়েছিলেন দুই বন্ধু। আমি জানি।

এনাজ চোখ দুটো বড় বড় করে আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
— তোমাকে কে বললো?

— আমি জানি তো এই কাজে গিয়েছিলেন। এটাই আপনাদের ইমপোর্টেন্স কাজ।

— 😶😶

— কি আমি মিথ্যে বলছি?

— না।

— আম্মু,খালামণি আর মামীকে বলবো?

উনি বসা থেকে উঠে আমার হাতদুটো তার হাতের মুঠোয় নিয়ে বললো,
— প্লিজ কাউকে কিছু বলো না। তোমাকে আইসক্রিম খাওয়াবো।

আমি দ্রুত টান মেরে আমার হাত সরিয়ে কঠিন গলায় বললাম,
— এখন ঘুষ দেওয়া হচ্ছে? আমি তো কিছু শুনবো না।এবার সবাইকে বলে দিবো। লুকিয়ে লুকিয়ে সিগারেট খান আপনারা দুজন। তাছাড়া ড্রিংক করার ভিডিওতো আমার কাছে আছেই।

— প্লিজ এমন করো না। তুমি যা বলবে আমি তাই করবো। দশবার কান ধরে উঠবস করতে বললে তাতেও রাজী আছি।

— কান ধরে উঠবস করতে হবে না।

— তাহলে কি মাফ করে দিছো?

— জ্বি না।

— তাহলে?

—আমি যা বলবো তাই শুনবেন?

— অবশ্যই।

— এখন থেকে সিগারেট খাওয়া বন্ধ।

— আমি তো সবসময় খাই না। মাঝে মাঝে দু-একটা খাই। যখন সবকিছু অশান্তি লাগে তখন। সকালে তায়াং বললো ওর ভালো লাগছে না। দোকান থেকে দুটো খেয়ে এসে পরবে। ওর কথায় রাজী হয়ে গেলাম।

— ঐ মাঝে মাঝে দু-একটাও চলবে না। নয়তো আমি সারা বাড়িতে ঢোল পিটাতে গেলাম। আমার আব্বু সিগারেট পছন্দ করে না। উনি কোনদিন খাইনি। সে যদি জানতে পারে আপনি সিগারেট খান তাহলে আপনার কাছে আমাকে বিয়ে দিতে গেলে ঝামেলাও করতে পারে।

— ওকে আমি ছেড়ে দিবো।

— সত্যি তো?

— হুম সত্যি।

আমি ডান হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললাম,
— প্রমিজ করেন।

উনি আমার হাতটা লুফে নিয়ে বললো,
— প্রমিজ আর খাবো না।

— যদি বন্ধুদের পাল্লায় পরে আবার খান তাহলে কিন্তু খারাপ হয়ে যাবে। মনে রেখেন কথাটা।

উনি বাধ্য ছেলের মতো মাথা হেলিয়ে সম্মতি প্রকাশ করলো। আমি তার হাতের থেকে নিজের হাত সরিয়ে নিতেই সে নিজের হাত দুটো হালকা ঘষে বললো,
— আমার হাত দুটো কি ঠান্ডা হয়ে আছে। কিন্তু তোমার হাতগুলো এতো গরম কেন?

— আপনার হাতগুলো সত্যি অনেক ঠান্ডা।

— আমার মনে হচ্ছে বরফ জমে আছে। এই যে দেখো।

আমার দুটো গালে সে তার দুটো হাত ছোঁয়াতেই আমি লাফ দিয়ে পেছনে চলে গেলাম। তার হাত সত্যি বরফ হয়ে আছে। উনি নিঃশব্দে হাসলেন। তারপর কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,

— আমরা দুজন যে সিগারেট খাই সেটা তুমি জানলে কি করে?

আমি মেকি হেসে বললাম,
— সিক্রেট।

— প্লিজ বলো।

— ভাইয়ার ওয়ারড্রবের ড্রয়ারে বহু আগে একদিন সিগারেটের খোসা পেয়েছিলাম। তখন থেকে জানি পাঠা সিগারেট খায়। সবসময় খেতো না বলে কাউকে বলিনি। আর সেদিন আপনার শার্ট ভাজ করতে গিয়ে সিগারেটের গন্ধ পেয়েছিলাম। তখুনি বুঝে গেছি আপনিও নিকোটিনের ধোঁয়া আসক্ত। আজ যখন দুজনের মুখে চুইংগাম দেখলাম আমি সিউর হয়ে গেলাম সিগারেট খেয়ে চুইংগাম চাবানো হচ্ছে।

— ওরে আল্লাহ খি ঠেলেন্ঠেড🥵!

— ইয়েস।

— তুমি একটা কথা ভুল বলছো।

— কি কথা?

— আমি নিকোটিনের ধোঁয়ায় আসক্ত নই। আমি তোমাতে আসক্ত। এটা আমার না হলেও চলবে। কিন্তু তোমাকে আমার সারাজীবনের জন্য লাগবে।

আমি লাজুক হেসে মাথা নিচু করে রাখলাম। এনাজ দুষ্টুমীর সুরে বললো,
— ইস, আমার লজ্জাবতী লজ্জা পেয়েছে।

আমি কোন কথা বললাম না। উনি কিছু সময় থেমে বললো,

— বড়শী আছে?

— কেন?

— অনেকখন ধরে ঘাটের পাশে একঝাঁক পুটিমাছের আনাগোনা দেখছি। বড়শী থাকলে মাছ ধরতে পারতাম।

— আপনি মাছ ধরতে পারেন?

— এমন করে বলছো যেন জীবনে বড়শী দিয়ে মাছই ধরিনি।

— না তা নয়। আমি এমনি জিজ্ঞেস করলাম।

— বড়শী আছে কি না তাই বলো?

— না নেই। মাছ এখন আর কেউ ধরে না। তাই বড়শীও রাখা হয় না।

— এই দোকানে পাওয়া যাবে বড়শী?

— হুম পেতে পারেন।

— তাহলে নিয়ে আসি গিয়ে।

এনাজ দ্রুত আমাকে সাইড কাটিয়ে চলে যেতে নিলে আমি বললাম,
— আবার সিগারেট খাওয়ার জন্য দোকানে যেতে চাইছেন না তো?

এনাজ থেমে আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
— আমি প্রমিজ করেছি খাবো না আর। তুমি আমার জীবনে যতদিন থাকবে ততদিন আর স্পর্শও করবো না। কিন্তু তুমি আমার জীবনে না থাকলে সিগারেট আবার ফিরে আসবে।

আমি কপাল কুঁচকে, চোখ ছোট করে তার দিকে তাকাতেই সে হাত দিয়ে ঠোঁট স্পর্শ করে ফ্লাইং কিস দেখিয়ে তায়াং ভাইয়াকে খুঁজতে ছুটলো। তাকে নিয়ে এখুনি দোকানে যাবে। এর হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে আজকে, এখুনি মাছ না ধরলে তাকে আমরা সকালের খাবার দিবো না। আমি তার যাওয়ার পানে কিছু সময় তাকিয়ে থেকে নিজের রুমে চলে গেলাম।
#শিশির_ভেজা_রোদ্দুর
#Part_50
#Writer_NOVA

জামাই বাজার উপলক্ষে সামাদ ভাইয়ার শ্বশুর বাড়ি এসেছি। আজকে ভাইয়া ও ভাবীকে নিয়ে যাবো বাসায়। খাওয়া-দাওয়ার পর্ব চুকানোর পর একগাদা ফল কেটে দিয়েছি। সবার মুখ চললেও আমি চুপ করে বসে আছি। একটু আগে খেয়ে এখন আবার এসব পেটে ঢুকবে না। অনন্যা, অর্থি,ইভা, তন্বী, নূর আপি বাইরে ঘুরছে।অনেকখন ধরে আরেকটা বিষয় খেয়াল করছি। যার দরুন আমি তাদের সাথে ঘুরতে যাইনি। ভাবীর এক মামাতো বোন কিছু সময় পরপর এনাজের দিকে তাকাচ্ছে। যেটা আমার চোখ এড়ায়নি। কেন জানি আমার এটা সহ্য হচ্ছে না। আমি ধীর পায়ে তার সামনে গিয়ে বসলাম। মেয়েটা তার সমবয়সী এক মেয়ের সাথে হেসে হেসে কথা বলছে আর আড়চোখে এনাজকে দেখছে। এনাজ ও তায়াং ভাইয়া বাইরের চেয়ারে বসে আছে। আমি মিষ্টিসুরে জিজ্ঞেস করলাম,

— তোমার নাম কি আপু?

মেয়েটা এনাজের দিক থেকে চোখ সরিয়ে কিছুটা বিব্রত হয়ে বললো,

— জেরিন।

— তুমি মারিয়া ভাবির মামাতো বোন?

— জ্বি আপু। আপনি?

— ওর ননদ। আবার অন্য দিক থেকে বড় বোনও হই।

— ওহ আচ্ছা। আপু আপনি কি বিবাহিত?

— না কেন?

— না, আপনার নাকে নাকফুল তাই জিজ্ঞেস করলাম।

— আমার নাকফুল পরতে ভালো লাগে। তাই পরে রাখছি। তবে বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। খুব শীঘ্রই হয়ে যাবে। ঐ যে মিষ্টি কালার শার্ট পরা যে ছেলেটাকে দেখছো তার সাথে। আমার হবু বর।

আমি জানি মিথ্যে বলেছি। না বললে তো মেয়েটা ওর দিকে সারাক্ষণ এনাজের দিকে তাকিয়ে থাকবে। যেটা আমার সহ্য হবে না। আমার কথা শুনে জেরিন নামের মেয়েটি চমকে উঠলো। এনাজ আজকে মিষ্টি কালার শার্ট ও কালো প্যান্ট পরে এসেছে। জেরিন, এনাজকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে আমাকে প্রশ্ন করলো,

— ঐ ছেলেটা আপনার হবু বর?

— জ্বি আপু।

— ওহ্

— কেন আপু, কোন সমস্যা? আমার হাসবেন্ডটা দেখতে সুন্দর না?

— না মানে হ্যাঁ খুব সুন্দর। আচ্ছা আপু আমি একটু আসছি।

জেরিন কোনমতে সেখান থেকে কেটে পরলো। আমি মুখ টিপে বেশ কিছু সময় হেসে নিলাম। বেচারীর মুখটা দেখার মতো হয়েছিলো। মন ভেঙে গেছে নিশ্চয়ই। একদম ঠিক হয়েছে। এত ছেলে থাকতে আমরটার দিকে নজর দিবে কেন? এবার বুঝুক মজা।এবার গিয়ে আরেকজনকে টাইট দিতে হবে। কে বলেছিলো তাকে এত সুন্দর করে সেজে আসতে।

“জামাই বাজার” বিক্রমপুরের বিয়ের একটা রিতী। একেক অঞ্চলে বিয়ের একেকটা রিতী থাকে। যেগুলো শুধু সেই অঞ্চলভেদে পালন করা হয়। আমাদের এই রীতিটা অন্য কোথাও পালন করা হয় কিনা তা আমি জানি না। বৌ-ভাতের আড়াই দিন পর এটা পালন করা হয়। যাকে আরেক ভাষায় আড়াই নাহারি ও বলা হয়। জামাই বাজারের দিন সকালবেলা নতুন জামাই রুমাল মেলে ধরে। সেখানে মেয়েরপক্ষের আত্মীয়রা যার যার সামার্থ্য অনুযায়ী দুই হাজার, পাঁচ হাজার, সাত হাজার টাকা যে যা পারে ততটুকু টাকা দেয়। মোট টাকা ও নিজের টাকা মিলিয়ে সেদিন নতুন জামাই রান্নার প্রয়োজনীয় যাবতীয় জিনিসপত্র কিনে নিয়ে আসবে। সেই জিনিসপত্র দিয়ে মেয়েবাড়ির লোক রান্না করবে। তাতে ছেলেপক্ষের লোককেও দাওয়াত করা হবে। ছেলেপক্ষের লোক দাওয়াত রক্ষা করে নতুন বর-কনে কে নিয়ে যাবে।

— এই যে শুনুন। এদিকে একটু আসুন তো।

এনাজের সামনে গিয়ে তাকে ডাকতেই তার কপাল কুঁচকে এলো। শান্ত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বললো,

— কি হয়েছে?

— আমার সাথে একটু আসতে বলছি।

তায়াং ভাইয়া শয়তানি হাসি দিয়ে এনাজকে বললো,
— আরে যা যা। দেখ তোর টিডি পোকা তোকে কি জানি দিবে।

আমি ভাইয়ার দিকে চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে এনাজের দিকে রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম। সে কোন কথা না বলে আমার সাথে চলে এলো। হাঁটতে হাঁটতে বাড়ির পাশে সেই বালুর মাঠে চলে এলাম। সেখানে আসতেই তার চুলগুলো সব এলোমেলো করে দিলাম। শার্টের বোতাম একদম কলার অব্দি লাগিয়ে দিলাম। ফোল্ড করা হাতা নামিয়ে কব্জি অব্দি নিয়ে আসতেই সে বললো,

— আরে করছো কি? পাগল হলে নাকি? আমার স্টাইলগুলো সব নষ্ট করে দিলে। এমন পাগলামি করছো কেন?

শার্টের হাতা কব্জি অব্দি এনে বোতাম লাগিয়ে তাকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে আমার মুখে হাসি ফুটলো। আমি হাসিমুখে বললাম,

— এবার ঠিক আছে।

— এই নিরিহ ছেলেটার ওপর এমন অত্যাচার কেন? একা একটা ছেলেকে পেয়ে এভাবে অত্যাচার করতে পারো না তুমি। কি করলে দেখো তো?

— খবরদার যেভাবে আছে সেভাবেই থাকবে। যদি কোনকিছু ঠিক করেছেন তাহলে আপনার সাথে আমার কোন কথা নেই।

— এমন আবুল সাজানোর মানেটা কি?

— কে বলছিলো নায়ক সেজে আসতে?

— কোথায় নায়ক সেজেছি? সমন্ধির শ্বশুর বাড়ি আসছি একটু ভালো গেটআপে আসতে হবে না? নয়তো মানুষ কি বলবে?

—তাই বলে এমন নায়ক সেজে আসবেন?

— তোমার হঠাৎ কি হলো বলো তো? তুমি তো কখনো আমার ড্রেসআপ নিয়ে মাথা ঘামাওনি? আজ এমন আবুল সাজিয়ে দিলে কেন?

আমি তার কথার উত্তর না দিয়ে এক হাত কোমড়ে আরেক হাতের আঙুল ঠোঁটে দিয়ে তাকে পা থেকে মাথা অব্দি স্ক্যান করতে লাগলাম। তাকে থামিয়ে দিয়ে বললাম,

— চুপ করেন তো। কি জানি একটা মিস পরে গেছে। কি মিস পরেছে, কি মিস পরেছে? ওহ পেয়েছি। প্যান্টটাকে পায়ের দিকে কিছু অংশ ভাজ করে দিতে হবে। তাহলে ঠিক হবে।

যেমন ভাবা তেমন কাজ। নিচে বসে তার টাখনুর দিকের প্যান্টে কয়েকটা ভাজ দিয়ে দিলাম। তারপর উঠে গাল দুটো টেনে দিয়ে বললাম,

— হু এবার ঠিক আছে। পুরো পারফেক্ট। এখন আর কোন মেয়ে নজর দিবে না।

— তুমি ঠিক আছো তো?

— এতখন ছিলাম না। এখন ঠিক আছি।

— তাতো দেখতেই পাচ্ছি।

— এবার চলুন।

— এই অবস্থায়?

— বেশি কথা বলবেন আপনার সাথে আর কথাই বলবো না।

উনি আর কথাই বললেন না। চুপচাপ আমার সাথে চলতে লাগলো।বেচারাকে যা লাগছে না। তাতে আমার কি? কেউ তো এখন আর আমার এনজিও সংস্থার দিকে নজর দিবে না। তার এক বাহু ধরে হাঁটতে লাগলাম। উনি বোকার মতো একবার আমার দিকে তাকিয়ে নিরবে আমার সাথে পথ চলতে লাগলো।তায়াং ভাইয়ার সামনে যেতেই সে চোখ কপালে তুলে বললো,

— কি রে এনাজ তুই এমন আবুল সাজে কেন?

— আর বলিস না ভাই। তোর বোনের হঠাৎ কি হলো আমি কিছুই বুঝলাম না। দেখ তো আমাকে কি সাজিয়ে দিলো?

তায়াং ভাইয়া হো হো করে হাসতে হাসতে চেয়ার থেকে পরে যাওয়ার জোগাড়।আমি মিটমিট করে হেসে ঘরের ভেতর ঢুকে পরলাম।আমার জিনিস নিয়ে যদি আমি না ভাবি তাহলে কে ভাববে!

💖💖💖

আজও এনাজের পিঠকে বালিশ বানিয়ে নিয়েছি। সকাল সকাল ঢাকার উদ্দেশ্য রওনা হয়েছি। মনটা ভীষণ খারাপ। দিনগুলো কত দ্রুত চলে গেলো। মনে হচ্ছে সেদিন বাসায় গেলাম। আজ ফিরে আসছি। বাসার সবার মুখ থমথমে ছিলো আম্মু,ইভা,অনন্যা,
অর্থি সবার মনটা খারাপ করে রেখেছিলো। আম্মুর মুখটা পুরো কাঁদো কাঁদো ছিলো। তাদের রেখে আসতেই মন চাইছিলো না। সবাই অনেক জোর করেছিলো আরেকটা দিন থাকার জন্য। কিন্তু আমার বিটলার খালাতো ভাই কিছুতেই থাকবে না। নূর আপিরা আমাদের সাথেই বের হয়েছে। এতখনে বোধহয় বাসায়ও চলেও গেছে। আমি ও এনাজ আজও বাইকে এসেছি। তন্বী,তায়াং ভাইয়া ও খালামণি সিএনজি ঠিক করে তাতে করে আসছে। আমরা তাদের থেকে অনেক এগিয়ে।

— মন খারাপ করো না টিডি পোকা। আবার ডিসেম্বরে চলে যেয়ো।

নীরবতা ভেঙে এনাজই প্রথম কথা বলে উঠলো।আমি কোন কথা বললাম না। চুপ করে রাস্তার দুই ধারের পরিবেশ দেখতে ব্যস্ত হলাম। এনাজ থেমে আরেকবার বললো,

— তোমার মনের অবস্থা আমি বুঝতে পারছি। সত্যি বলতে আমার নিজেরই খারাপ লাগছে। তোমার লাগাটা তো একেবারেই স্বাভাবিক। সবাই কত সহজে আমাকে আপন করে নিয়েছিলো। ভালোবেসে একেকটা কাজের দায়িত্ব দিচ্ছিলো। আমার তখন মনে হয়েছে আমি নিজের বাসায় আছি। সময়গুলো কত দ্রুত চলে গেলো। আমার স্মৃতিতে এই ছয়টা দিন বেস্ট থাকবে। আমি কখনও ভুলতে পারবো না। ধন্যবাদ তোমাকে। তুমিও কিন্তু আমায় অনেক সুন্দর সুন্দর মোমেন্টের সাথে পরিচিত করে দিয়েছো।

একটা দীর্ঘশ্বাস বুক চিঁড়ে বের হয়ে গেলো। বিষন্ন মনে কোন কথা বলতেও ইচ্ছে করছে না। তার পিঠে মাথা ঠেকিয়ে চোখ দুটো হালকা বন্ধ করে রাখলাম। হঠাৎ ব্রেক কষতেই আমি কিছুটা চমকে তাকে জিজ্ঞেস করলাম,

— কি হয়েছে?

— কিছু না।

আমার দিকে না তাকিয়ে সামনের একটা ফুল বিক্রতা ছোট ছেলেকে জিজ্ঞেস করলো,

— গোলাপ ফুল কত করে?

— একটা দশ টেহা ভাইজান।

— দুইটা দাও তো।

—আইচ্ছা।

ছেলেটা তার নীল বালতি থেকে সতেজ দুটো লাল গোলাপ এনাজের হাতে তুলে দিলো। এনাজ মানিব্যাগ খুলে বিশ টাকার নোট ছেলেটার হাতে দিয়ে দিলো। ছেলেটা অন্য দিকে চলে গেল। আমার দিকে ফিরে মিষ্টি হেসে বললো,

— এই দুটো তোমার জন্য।

— শুকরিয়া।

হাত বাড়িয়ে ফুল দুটো নিয়ে মুঠ করে রেখে দিলাম।বিনিময়ে মিষ্টি হাসি ফেরত দিয়ে দিলাম। সে মাথা চুলকে বিষন্ন মনে বললো,

— আমার তো এতো এতো টাকা নেই। তাই মাত্র দুইটা গোলাপ উপহার দিলাম। আমার অঢেল টাকা থাকলে তোমাকে পুরো বালতির ফুল উপহার দিতাম।

— কি শুরু করলেন বলেন তো? এই পুরো বালতি ফুল দিয়ে কি আমি মাথায় বেঁটে দিবো? দুটো দিয়েছেন তাতেই আমি খুশি। আপনি ভালোবেসে আমাকে একটার বদলে দুটো গোলাপ দিয়েছেন তাও বা কম কিসের? আমি সামান্য কিছুতেই খুশি থাকি।তাই আপনার মন খারাপ করার কোন দরকার নেই।

এনাজ মুচকি হেসে বাইক স্টার্ট দিলো। গোলাপের ওপর পানি ছিটানোর দরুন সেগুলো মুক্ত দানার মতো পাপড়ির গায়ের ওপর বসে আছে। আমি একবার গোলাপের ঘ্রাণ নিয়ে সেগুলোকে হাতেই রেখে দিলাম।ভালোবাসার প্রতীক বলে কথা💖।

#চলবে
#

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here