#শুভ্ররাঙা_ভালোবাসা
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
#পর্ব_০৩
” তোর ডিভোর্স হয়েছে, যে তোর গুরুত্ব বোঝেনি সে চলে গিয়েছে। তোর বাবা-মা মা*রা যায় নি যে এত চিন্তা করবি। আমরা এখনো বেঁচে আছি আর মাথার ওপর সৃষ্টিকর্তা আছে তিনি নিশ্চয়ই তোর ভাগ্যে ভালো কিছু লিখে রেখেছেন। কথায় আছে না, জীবনসঙ্গী যদি স্বস্তিই না দেয় তাহলে একলা থাকাই শ্রেয়। শোন মা, মানুষটা তোমার জন্য সঠিক ছিল না জন্যই তোমার গুরুত্ব বোঝেনি, ভালোবাসলে কান্না করতে দেওয়া তো দূরের কথা দীর্ঘনিঃশ্বাস অবধি নিতে দিত না। তুই যে ইমতিয়াজের কথা ভেবে দিনরাত এরকম কান্না করছিস এত ভালোবাসা, চোখের পানি ওর প্রাপ্য নয়। তুই ওকে ভেবে এত কান্না কেন করবি বল তো? তুই নাকি ওকে বলেছিস তুই ওকে ছাড়া ভালো থেকে দেখিয়ে দিবি? তাহলে কেন কান্না করছিস? আমার মেয়ে তো এমন ছিল না! আমি আমার আগের মেয়েকে ফেরত চাই যে ছিল সাহসী, রগচটা, প্রতিবাদী, বেয়ারা, হাস্সোজ্জ্বল, লাফিয়ে, নেচে বেড়াতো সারা বাড়ি আমি আগের শুভ্রতাকে ফিরে চাই।”
সন্ধ্যাপর মায়ের কোলে মাথা রেখে কথা বলতে বলতে কান্না করে ফেলে শুভ্রতা। প্রিয় মানুষকে ছেড়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে বিষয়টা এমন না, এত ভালোবাসার পরও মানুষ ছেড়ে যেতে পারে, এতকিছু করার পরও শূণ্যহাতে ফিরিয়ে দিতে পারে এটা ভেবে তার খারাপ লাগছে।
আয়েশা বেগম আবার বলে ওঠেন, ” ওই ছেলেই কি শুধুমাত্র তোর ভালোবাসার মানুষ ছিল? আমরা কেউ না?”
শুভ্রতা মায়ের কোল ছেড়ে এবার উঠে বসে। চোখ মুখ মুছে নেয়। মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে, ” মা তোমরা ভালো করেই জানো আমি ওরকম মেয়ে নই যারা মুখবুজে সব কষ্ট সহ্য করে। আমি কিছুক্ষণ কান্না করব, নিজেকে হালকা করব আর তারপর নিজেকে ঠিক দাঁড় করিয়ে নেব। আমি ওকে ভালোবাসি বলে কষ্ট পাচ্ছি না, ওর জন্য সত্যিই আর ভালোবাসা ভেতর থেকে আসে না মা। আমি ভালোবেসেছিলাম জন্য এতগুলো দিন ওকে সহ্য করেছি সুযোগ দিয়েছি। তাছাড়া আমি তো ওরকম মেয়ে যে ভালোবাসার বদলে ভালোবাসা দেয় আর ঘৃণার বদলে ঘৃণা। আমি আর কান্না করব না, অনেকদিন তো হলো কান্নাকাটির। এবার ও কাঁদবে আর আমি হাসব।”
” তোকে একটা কথা বলার ছিল রে মা।”
” যা ইচ্ছে বলো, কিন্তু মা এখনই আর কারো সাথে বিয়েতে বসতে বোলো না শুধু।”
” একদিন না একদিন বিয়ে তো করতেই হবে, কিন্তু এখন বলছিলাম কি মা এভাবে ঘরে বসে না থেকে আবার ক্লাস করা শুরু কর। এখন থেকে পড়াশোনায় রেগুলার হয়ে যা।”
শুভ্রতাও যে এই বিষয়টি ভাবে নি তেমন না। সে নিজেও ভেবেছি রুমে এভাবে একা একা থাকার চেয়ে নিয়মিত ক্লাস করলে আর বন্ধুবান্ধবদের সাথে মিশলে একটু ভালো থাকা যাবে। বন্ধু নামক মানুষগুলো যে খুব ভালো রাখতে পারে!
” হ্যাঁ মা আমিও ভেবেছি ক্লাশ করব রেগুলার। আর এখন তো ভার্সিটি এখান থেকে বেশি দূরেও হবে না প্রতিদিন যেতে পারব।”
আয়েশা বেগম মেয়ের মাথা আর মুখ স্পর্শ করে আদর করে দেয়। মেয়েটার শরীরের অবস্থা খুব খারাপ, কেমন শুকিয়ে গিয়েছে। সারাদিনে একবেলাও যে ঠিকমতো খেতে চায় না সে। তিনি বলেন,
” একটা মেয়ে ততক্ষণ দুর্বল থাকে যতক্ষণ সে কান্না করে। সে যখন কান্না করা বন্ধ করে দেয় তখন কান্না করতে হয় তাকে, যে সেই মেয়েকে কাঁদিয়েছে।”
” হ্যাঁ মা, এই যে তোমার মেয়ে কথা দিলো আজকের পর থেকে তোমার মেয়ের চোখে আর কান্নার পানি দেখবে না।”
আয়েশা বেগমের মুখে হাসি ফুটে যায়। বাবা মা কখনো তার মেয়ের চোখের পানি, কষ্ট সহ্য করতে পারে না। পৃথিবীর সব কষ্ট তারা সহ্য করে নিলেও সন্তানের মন খারাপই যেন তাদের গলায় কা*টার মতো বিধে যায়।
আয়েশা বেগম আর শুভ্রতা কথা বলছে এমন সময় স্নিগ্ধা আবার দলবল নিয়ে ঘরে প্রবেশ করে। মা আর মেয়ে একসাথে দরজার দিকে তাকায়। শুভ্রতা গলা ঠিক করে নিজেকে স্বাভাবিক করে নেয় আর তাদের উদ্দেশ্যে বলে,
” কি রে, তোদের কি হয়েছে? সকাল থেকে কয়পাক দিলি বল তো?”
সবার মাঝখান থেকে নেহা এগিয়ে এসে বলে, ” মা বলেছে আজ আমাদের বাড়ি সবার খাওয়া দাওয়া হবে। ছাদে সবকিছুর ব্যবস্থা করা হবে,কাকাও ছাদে চলে গেছে। বাবা, তোর বাবা, আমজাদ কাকা, রায়হান ভাইয়া সবাই আজ রান্না করবে। কি রান্না হবে জানিস? বিরিয়ানি। রায়হান ভাইয়া আমজাদ কাকা বাজারে চলে গেছে বাজার করতে।”
শুভ্রতার মুখে হাসি ফুটে যায়। অনেকদিন পর সবাই একসাথে হচ্ছে, কি যে মজা হবে! রায়হান ভাই ও এসেছে, ভাবা যায়! বেচারি শাকিরার কি যে হবে ভাবতেই তার হাসি পাচ্ছে। শুভ্রতা আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করে,
” শাকিরার কি খবর রে? ওকে ডাকিস নি তোরা?”
” শাকিরা আপুকে ডাকতে যাব তো, আগে তোমাকে ডাকতে আসলাম।”
ইরা কথাটা বলেই শুভ্রতার পাশে এসে বসে। সাথে সাথে স্নিগ্ধা আর নেহাও এগিয়ে আসে। স্নিগ্ধা টেবিলে রাখা পানিভর্তি গ্লাস হাতে নিয়ে বলতে থাকে,
” আপু আজকে কিন্তু সবাই শাড়ি পরবে। আমরা কয়েক বোনই পরব তুমি কিন্তু অমত করবে না বলে দিলাম।”
” ও কেন অমত করবে? তোদের সাথে শুভ্রতাও শাড়ি পরবে। আমার আলমারিতে অনেক শাড়ি আছে, যেটা পছন্দ হয় সেটাই পরবে। তোরা শুভ্রতাকেও নিয়ে যা ছাদে, ও একা একা এখানে থাকলে মন খারাপ করে বসে থাকবে। আমি যাই কাজগুলো শেষ করে নিই।”
আয়েশা বেগম কথাটা বলেই সেখানে থেকে বেরিয়ে গেলেন। চারবোনের মধ্যে রায়হান আর শাকিরাকে নিয়ে আরো কিছুক্ষণ আলাপ আলোচনা চলল। বেচারি শাকিরা তো রায়হান ভাইকে দেখলেই পালাবে, ভেবেই তাদের হাসি পাচ্ছে।
বাড়ির সবগুলো বোন সমবয়সী শুধু ইরা একটু ছোট সে এবার এসএসসি দিয়েছে। স্নিগ্ধা, নেহা, শাকিরা অনার্স ফার্স্ট আর সেকেন্ড ইয়ারে তাদের মাঝে আবিরা সবার সিনিয়র সে এবার অনার্স ফাইনাল দিবে। রায়হান তাদের ফুপাতো ভাই, মাস্টার্স কমপ্লিট করে চাকরি না পেয়ে বাবার সাথে ব্যবসা করছে। শাকিরার বাবা আর শুভ্রতার বাবারা চাচাতো ভাই, বাড়ি পাশাপাশি। শাকিরা সেই ক্লাস নাইন থেকে রায়হানকে পছন্দ করে একপ্রকার লুকিয়ে লুকিয়ে ভালোবাসে সেটা রায়হান নিজেও বোঝে কিন্তু পাত্তা দেয় না। বেচারিকে সবসময় দৌঁড়ের ওপর রাখে, শাকিরা মাঝেমাঝে রেগে গিয়ে শুভ্রতাকে বলতো, ” এই তোদের রায়হান ভাইয়ের মুখে কি জন্মের পর মধু দেয় নি কেউ? ব্যাটার মুখ দিয়ে মিষ্টি কোন কথা বেরই হয় না! সারাক্ষণ মুখ গম্ভীর করে রাখবে আর আমি গাধী ওই ব্যাটার প্রেমে পড়ে বসে আছি, শা*লা খবিশ কোথাকার!”
রায়হানের সামনে কিছু বলার সাহস না পেলেও তার আড়ালে বংশশুদ্ধ বকে উদ্ধার করে দেওয়ার মেয়ে সে। মাঝেমাঝে এত অ*শ্লীল শব্দ ব্যবহার করে যে কানে আঙুল দিয়ে রাখতে হয়।
সারাদিন বাড়ির সব বড়রা রান্না আর রান্নায় সাহায্যে ব্যস্ত। বাড়ির মেয়েগুলো আড্ডা আর খেলাধুলায় ব্যস্ত। একমাস পেরিয়ে গেছে শুভ্রতার এ বাড়িতে আসার। একটা সময়ের জন্যও সে মন খুলে হাসে নি। হয়তো কোনসময় জোরপূর্বক হাসির রেখা টেনেছে সে। আজ মেয়ের মুখে হাসি আর চটপটে স্বভাব দেখে শাহাদাত সাহেবের মুখেও হাসি ফুটেছে। তিনি কাজের ফাঁকে ফাঁকে মেয়েকে এক নজর করে দেখে নিচ্ছেন। কি সুন্দর করে হাসতে পারে মেয়েটা। যে মেয়ের সৌন্দর্য্য হাসিতে প্রকাশ পায় সেই মেয়েকে ইমতিয়াজের মতো গর্দভ কাঁদিয়েছে ভাবতে যেন গায়ে জ্বালা ধরে যায় উনার। মেয়ে নিজে পছন্দ না করলে কোনদিন ওই ছেলের কাছে তিনি মেয়ে বিয়ে দিতেন না। তাকে পাওয়ার জন্য যে একজন বাচ্চা মানুষের মতো কান্না করেছিল, একটা বাচ্চা যেমন তার পছন্দের খেলনা পাওয়ার জন্য মায়ের কাছে কান্না করে ঠিক তেমনই শুভ্রতাকে বোঝানোর কথা বলে তাকে পাওয়ার জন্য দমবন্ধ করা কান্না করেছিল কেউ। তার কাছে মেয়েটা থাকলে এত কষ্ট সহ্য করতে হতো না শুভ্রতার। নারীতো আস্ত একটা ভালোবাসা কিন্তু একটা পুরুষ যখন কোন নারীকে মন থেকে ভালোবাসে সেই ভালোবাসা অতি ভ*য়ংকর আকারের হয়।
সবাই একসাথে খেতে বসেছে। বাড়ির মেয়েগুলো একসাথে খেতে বসেছে। শুভ্রতা সবার হাসিমাখা মুখটা দেখছে আর ভাবছে ইশ! প্রতিটা দিন যদি এমন সুন্দর হতো! কতদিন এতগুলো মানুষের মুখের হাসি একসাথে দেখা হয় না। এটা ভেবে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস নেয় যে সে নিজেই তো কতদিন মন খুলে হাসে না, সে তো হাসতেই ভুলে গিয়েছিল।
খাওয়া দাওয়া শেষ করে বড়রা গল্পের আসর বসিয়েছে আর বাড়ির মেয়েগুলো শাড়ি পরে সাজগোজ করছে রায়হান নিজে সবাইকে আজ সন্ধ্যায় বাহিরে ঘুরতে নিয়ে যাবে। সবাইকে সাজানোর দায়িত্ব পরেছে ইরার ওপর। নিজের মেকাপ প্রডাক্টগুলো আজ ঠিকঠাক ব্যবহৃত হচ্ছে। স্নিগ্ধা আর শাকিরার সাজ কমপ্লিট। ইরা এবার আবিরাকে সাজাতে বসে। অন্যদিকে শুভ্রতা কোন শাড়ি পরবে সেটাই ঠিক করতে পারছে না। স্নিগ্ধাকে পাঠিয়ে দেয় বড়মাদের ছাদে, মা এসে যেন শাড়ি সিলেক্ট করে দেয় সেজন্য। কিন্তু স্নিগ্ধা এখন ছাদে যেতে নারাজ কারণ সিড়ি দিয়ে উঠতে গেলে শাড়ির ভাজ নষ্ট হয়ে যাবে। শুভ্রতারও যেতে ইচ্ছে করছিল না। শাকিরাকে বলতেই শাকিরা এক কথায় রাজি হয়ে যায়। সে রুম থেকে বেরিয়ে ছাদের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়। সিড়ি দিয়ে ছাদে ওঠার সময় শাড়ির কুচি ধরে পায়ের দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে ওপরে উঠছিল সে।
” এই এভাবে কেউ সিড়িতে ওঠে? সামনে না তাকিয়ে পায়ের দিকে তাকালে ছাদে পৌঁছতে হবে না ওপরে পৌঁছে যাবি।”
ভারি পুরুষালি কণ্ঠে এমন ধমক শুনে চমকে ওঠে শাকিরা। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলে, ” আ আ আপনি!”
শাকিরা মুখ তুলে তাকালে রায়হান খেয়াল করে উজ্জ্বল শ্যামলা গায়ের রঙের এই মেয়েটাকে আজ আকাশি রঙের শাড়িতে অসম্ভব সুন্দর লাগছে। বেশিরভাগ মেয়ের পছন্দের রঙ তো নীল আর কালো কারণ এই রঙে তাদের অপ্সরী লাগে দেখতে কিন্তু শাকিরাকে আকাশি রঙে দারুণ লাগছে। রায়হান এবার সিড়ি দিয়ে নেমে শাকিরার কাছাকাছি এসে বলে, ” এভাবে ওপরে উঠছিলি কেন?”
” আয়েশা কাকিকে ডাকতে, শুভ্রতা শাড়ি পরবে কিন্তু কোনটা পরবে বুঝতে পারছে না।”
” তুই যা আমি পাঠিয়ে দিচ্ছি। সোজা ওদের কাছে চলে যাবি। বামে ডানে আর কোনদিকে গেলে পা ভেঙে ফেলে রেখে দেব।”
” আমি ছোট না, আমার বয়স একুশ।”
” তো কি হয়েছে? তুই আমার চেয়ে বড়?”
” না মানে আমি বড় হয়ে গেছি এখন আর এভাবে শাসন করতে হয় না। একা কোথাও যাই ও না।”
” খুব বড় হয়ে গেছেন দেখছি তো। যা এখন এখান থেকে।”
শাকিরা আর দেরি না করে সেখান থেকে চলে যায়। শাকিরার এমন আলতো ভয়ার্ত মুখ দেখতে রায়হানের দারুণ লাগে। তাই তো তাকে ভয় দেখানোর সুযোগটা সে কখনই ছাড়ে না। রায়হান মুচকি হেসে ছাদের দিকে পা বাড়ায় আর মনে মনে আওড়াতে থাকে, ” এই মেয়েগুলোও না! দুই ঘণ্টা হয়ে যাচ্ছে রেডি হতে গেছে এখনো নাকি একজন শাড়িই ঠিক করতে পারে নি, এটা কোন কথা!”
চলবে….
আজকের পর্বটা বড় দিয়েছি। গল্পভিত্তিক কিছু মন্তব্য চাই। সকলের সুস্থতা কামনা করছি।