#শূন্য_থেকে_আসে_প্রেম
#পর্ব – ৩
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
আমাদের গাড়ি এসে থামলো সৌরভ ভাইয়া এর বাড়ির সামনে। আন্টি মানে সৌরভ ভাইয়ার মা এসে নিজে আমাকে গাড়ি থেকে নামালেন। আর বাড়িতে ঢুকার সাথে সাথে সবাই আমাকে ঘিরে ধরলো। সবাই রীতিমতো ঠাট্টা মজা করছে। আমিতো অবাক। মানে সবাই এত স্বাভাবিক কিভাবে ? বউ বদল হয়েছে এটা কি সবার চোখে পড়েনি। কি জানি ? সৌরভ ভাইয়া আর আমি দরজার সামনে দাড়িয়ে আছি। আর আন্টি আর কিছু মেয়ে মিলে আমাদের দিকে ফুল ছিটিয়ে দিচ্ছেন। তারপর আন্টি সৌরভ ভাইয়াকে কি যেনো ইশারা করলেন। আমি কিছু বুঝি নি। আর সৌরভ ভাইয়া ইশারায় বারবার মানা করছেন আন্টিকে। কিন্তু আন্টির চোখ রাঙানি দেখে এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঝট করে আমাকে কোলে তুলে নেন। আমিতো রীতিমতো শকড। লজ্জায় আমি উনার বুকে মুখ লুকিয়ে আছি। আর চারিদিক থেকে লোকজন ” উহো , জিও ভাই “” বলে চিল্লাচ্ছে। আমি লজ্জায় আর আশপাশে তাকিয়ে দেখিনি। সৌরভ ভাইয়া সোফায় আমাকে বসিয়ে ঝটপট সেখান থেকে চলে গেলেন। মনে হয় এরপর যা হবে উনার তাতে কোনো ইন্টারেস্ট নেই। আর আমি লজ্জায় মাথা নিচু করে আছি। আন্টি আমার পাশে বসে আমার উনার হাত দিয়ে আমার মুখটা তুলে নরম গলায় বলেন,
” এত লজ্জা পাওয়ার কি আছে হুম ? তোমারই তো হাসবেন্ড। আর এটা আমাদের পরিবারের নিয়ম। যখন তোমার বাচ্চা হবে তখন তুমি তোমার ছেলেকে এই নিয়ম পালন করতে বলবে। ঠিক আছে ? ”
আমি আর কি বলবো। আন্টির মুখে বাচ্চা – কাচ্ছার কথা শুনে আমি লজ্জায় পুরো মিইয়ে যাচ্ছি। কিন্তু পরক্ষণে ভাবি যে সম্পর্ক শুরুই হয়েছে ঘৃনা দিয়ে সেই সম্পর্ক কি আদৌ এতটা এগুবে ? এসব ভেবেই আমার বুকটা ভারী ভারী লাগছে। আন্টি আর আমাকে কিছু না বলে বাকি নিয়ম গুলা পূরণ করতে লেগে গেলেন।
পাক্কা ১ ঘন্টা পর সকল নিয়ম শেষ হলো। আন্টি আর কিছু মেয়ে মিলে আমাকে সৌরভ ভাইয়ার রুমে নিয়ে এলেন। উনার রুম পুরোটা ফুল আর মোমবাতি দিয়ে সাজানো। কিন্তু সৌরভ ভাইয়া কই ? উনিতো সোজা নিজের রুমে এসেছিলেন। কিন্তু জানি এ সাজানো রুম সবকিছুই মূল্যহীন। কারণ সৌরভ ভাইয়া আর আমার মধ্যে মনে হয়না আজ এমন কিছু হবে। কিন্তু উনি যদি আমাকে জোড় করে তাহলে ? ভাবতেই আমি ভয়ে শিউরে উঠছি। আন্টি আমাকে বিছানায় বসিয়ে বাকি মেয়েগুলা কে বলেন,
” তোমরা একটু যাও। আমার ইপ্সিতার সাথে একটু কথা আছে। ”
আন্টির কথা শুনে সব মেয়েগুলা চলে গেলো। ওরা চলে গেলে আন্টি বিষন্ন মনে বলেন,
” আসলে এবাড়ির কেউই জানে না সৌরভের হবু বউ কে ? আসলে সৌরভ কাউকে বলতে মানা করেছে। আর বিয়েটা ঘরোয়া ভাবে হওয়ার কথা ছিল তাই বরযাত্রী হিসেবে কজন গুরুজন ছাড়া আর কেউ যায়নি। এই জন্যেই কনে বদল সম্পর্কে বাকিরা জানে না। কিন্তু একটা কথা শুধু তোমার দাদী শাশুড়ি জানেন কনে বদলের কথাটা। দেখো পুরনো মানুষ তো হয়তো তোমাকে দু চারটা কথা শুনাতে পারেন। তুমি কিছু মনে করো না প্লিজ। ”
আমি আন্টির কথা শুনে একটু খুশিই হলাম। ভালোই হয়েছে অন্তত কিছু মানুষের কথা থেকে তো বাঁচতে পারবো। আমি আন্টির দিকে তাকিয়ে বলি,
” আপনি কোনো চিন্তা করবেন না আন্টি। আমি কিছু মনে করব না। বুড়ো মানুষ হয়তো উনার চোখে এই বিয়েটা ভুল মনে হতে পারে। এতে দোষের কিছু নেই। ”
তারপর আমি আন্টির দিকে করুন চোখে তাকিয়ে বলি,
” আন্টি , আপনি কি আমার উপর রাগ করেছেন ? মানে সৌরভ ভাইয়ার সাথে এইভাবে বিয়ে…..”
আন্টি আমার কথা শুনে তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন,
” না না , আমি জানি এইখানে তোমার দোষ নেই। আমার বিশ্বাস , তুমি এতটা নিচে কখনোই নামবে না। ”
তারপর আন্টি আমাকে বিছানার উপর ভালো করে বসিয়ে সেখান থেকে চলে গেলেন।কিছুসময় পর হটাৎ ওয়াশরুমে দরজা খুলার আওয়াজে আমি সেদিকে তাকালাম। সৌরভ ভাইয়া মনে হয় মাত্রই সাওয়ার নিলেন। তাই উনি টাওয়েল দিয়ে চুল মুছতে মুছতে বের হচ্ছেন। আমাকে বিছানার উপর দেখেও না দেখার ভান করে ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে মুখে ক্রিম দিয়ে ঠিকঠাক হয়ে বিছনায় উপর বসলেন। আর আমার বুকটা শুধু ধুকপুক ধুকপুক করছে যে কখনো উনি কোন কাজ করে বসেন। হটাৎ সৌরভ ভাইয়া আমার দিকে ঝুঁকে আসলেই আমি চমকে মাথাটা পিছিয়ে নেই। সৌরভ ভাইয়া ঠোঁটে বাঁকা হাসি দিয়ে বলেন,
” আজ তো আমাদের বাসর রাত। তো বাসর রাতে কি করতে হয় তা নিশ্চই তোমার জানা। ”
আমি উনার কথা শুনে ভয়ে এক ঢুক গিলি। কাপা কাপা গলায় বলি,
” আম.আমাদের ব.বিয়ে স্বাভাবিক নয়। তাই আমি এ.এখন এসব ক.কিছুই করতে প. পারবো না। ”
সৌরভ ভাইয়া আমার দিকে আরেকটু ঝুঁকলেন। আর আমি পিছাতে পিছাতে একেবারে বিছানার অন্য প্রান্তে চলে গেলাম। উনি ঠোঁটের সেই বাঁকা হাসিকে আরেকটু প্রশস্ত করে বলেন,
” কেনো ? তুমি কি ভেবেছো এসব বলে আজ পার পেয়ে যাবে ? ”
আমি ভয় ভয় চোখে উনার দিকে তাকাই। উনি আমার ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলেন ,
” তো বলো কোথা থেকে শুরু করবো ? উমমম…এক কাজ করি এই নরম নরম ঠোঁট থেকেই না হয় শুরু করি। কি বলো ? ”
বলেই আমার ঠোঁটের দিকে এগুতে লাগলেন। আমি ভয় পেয়ে দু হাত দিয়ে আমার মুখ চেপে ধরলাম। সৌরভ ভাইয়া একটা হাসি দিয়ে আমার থেকে সরে এসে বিছানার উপর চিৎ হয়ে শুয়ে পড়লেন। শরীরটাকে মোচড় দিয়ে বললেন,
” ভুলে যাও এসব। আমার এতটাও বাজে দিন আসে নি যে আমি তোমাকে আপন করে নিবো। So just forget it..”
বলেই উনি চোখ বুজে ফেললেন। আর আমি আমার মুখ থেকে হাত সরিয়ে একটা ভেংচি মেরে বিড়বিড় করে বলি,
” ভাব ! যেনো আমি নিজে উনাকে যেচে যেচে বলছি নেন আমাকে আপন করুন। যত্তসব। ”
বলেই আমি বালিশটা ঠিক করে শুয়ে পড়লাম। হটাৎ সৌরভ ভাইয়া পাশ ফিরে আমার দিকে উপুড় হয়ে শুয়ে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। আর আমি অনেক ভয় পেয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে আছি। উনি আমার চুলগুলো কানের পিঠে গুজে দিয়ে রাগী কণ্ঠে বললেন,
” এই যে এত দামী শাড়ি , গহনা পড়ে শুয়ে পরলে , টাকা কি তোমার বাবা দিয়েছে ? এসব আমার নিজের উপার্জন করা। আর এগুলোর মধ্যে একটাও নষ্ট হলে সব টাকা আমি তোমার অঙ্গ প্রত্যঙ্গ বিক্রি করে হাসিল করবো। বুঝেছ ? এক্ষণি এসব খুলে নরমাল জামা পরে ঘুমাবে। So go fast…”
বলেই আমার থেকে সরে এসে অপরদিকে মুখ করে শুয়ে পড়লেন। আমি উনার ডাক তাকিয়ে ভাবি কথাটা তো আরো ভালো ভাবে বলা যেত।তাইনা ? কিন্তু না উনার মুখ থেকে আমার জন্যে কোনো ভালো শব্দ কি কখনো বের হতে পারে ? কখনোই না। আমি মনে মনে উনাকে আরো একশোটা গালি দিয়ে বিছানা থেকে উঠে ড্রেসিং টেবিলের সামনে এসে দাড়ালাম। একটা একটা করে সব গহনা , আর চুলের ক্লিপ খুললাম। কাবার্ড থেকে একটা গোলাপী কালারের ত্রি পিস নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলাম। একেবারে সাওয়ার নিয়ে তারপর বের হলাম। আর জনাব ত রীতিমত মহা ঘুম ঘুমাচ্ছেন। যতসব। এই লোকটাকে আমার জাস্ট অসহ্য লাগে। পুরো জীবনটা আমার তছনছ করে দিয়েছে। আমিও লোশন , ক্রিম দিয়ে এসে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। ভাগ্যিস সিনেমার নায়কদের মত বলেনি যে ,
” যাও বারান্দা ঘুমাও। বা সোফায় ঘুমাও।”
ভালোই হয়েছে , নিজের বিছানাতেই জায়গা দিয়েছে। এটাই মনে হয় জীবনের প্রথম ভালো কাজ উনার। নাহলে এতো ঠাণ্ডায় বারান্দায় ঘুমালে নির্ঘাত শরীর খারাপ করতো আমার।
***
***
” এই মেয়ে , মরার মত ঘুমাচ্ছো কেনো ? উঠো । মা এসে অনেকবার ডেকে গেছেন। উঠো বলছি। ”
কারো বাজখাই ডাক শুনে আমি দরফরিয়ে ঘুম থেকে উঠলাম। নিভু নিভু চোখে তাকিয়ে দেখি সৌরভ ভাইয়া ভয়ংকর রেগে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। মনে হচ্ছে এই চোখ দিয়েই উনি আমাকে ভষ্ম করে দিবেন। আমাকে উঠতে দেখে উনি এক বিরক্তির নিশ্বাস ফেলে ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে চুল ব্রাশ করতে লাগলেন। আর আমি একটা হাই ফেলে ওয়াশরুমে চলে গেলাম। ফ্রেশ হয়ে বের হয়ে রুমের দরজা খুলতে গেলে উনি আমাকে হাত ধরে হেচকা টান দেন। আমি ব্যালেন্স হারিয়ে উনার বুকের উপর গিয়ে পরি। উনি সাথে সাথে আমাকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে সরে দাঁড়ান।দাতে দাত চেপে বলেন,
” বিয়ের দিন সকালে সাওয়ার নিতে হয় জানোনা, ইডিয়ট ? ”
আমি উনার কথার মনে বুঝতে না পেরে বলি,
” কিন্তু কেনো ? ”
উনি আমার কপালে জোড়ে টোকা মেরে রাগী গলায় বলেন ,
” আমি বলছি সেই জন্যে । Now go ..এক্ষণি সাওয়ার নিয়ে বের হবে। ”
আমি উনার রাগী গলা শুনে জলদি জামা দিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলাম। ওয়াশরুমে আয়নার সামনে দাড়িয়ে ভাবছি ,
” আমাদের মধ্যে তো এমন কিছুই হয়নি যে সাওয়ার নিতে হবে ? তাহলে উনি এমন করলেন কেনো ? ”
পরমুহূর্তেই মাথা থেকে এসব ভাবনা ঝেড়ে ফেলে দিলাম। কারণ সৌরভ ভাইয়াকে বুঝা আমার কাম্য নয়। একদমই নয়।
#শূন্য_থেকে_আসে_প্রেম
#পর্ব – ৪
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে দেখি সৌরভ ভাইয়া সোফায় বসে ফোন টিপছেন। আমাকে দেখে ফোনটা পকেটে রেখে উঠে দাড়ালেন। আর দরজাটা খুলে বললেন,
” বের হও । ”
আমি কিছু না বলে রুম থেকে বেরিয়ে গেলাম। আর উনি আমার পিছু পিছু আসতে লাগলেন। নিচে গিয়ে উনি সোজা সোফায় বসে ফোন টিপতে লাগলেন। সবাই ড্রয়িং রুমে বসে কিসব নিয়ে আলোচনা করছে। আমাকে দেখে সুরভী ( সৌরভ ভাইয়ার বোন ) সোফা থেকে উঠে এসে জড়িয়ে ধরলো আমাকে। আমি মুচকি হেসে ওর পিঠে হাত রাখলাম। সুরভী আমাকে ছেড়ে দিয়ে হেসে বললো,
” ও ভাবী , কি লাগছে তোমায়। আসলেই খুব , খুব সুন্দর লাগছে। ”
আমি এর বদলে এক লজ্জামাখা হাসি দিলাম। আন্টি এসে আমাকে নিয়ে সোফায় বসালেন। সবাই মিলে আমাদের রিসিপশনের ব্যাপারে কথা বলছে। আর আমি মাথা নিচু করে বসে আছি সোফায়। একসময় একটা একজন ভাবী আমার মাথা থেকে আঁচলটা সরিয়ে দিলো। আমি চমকে উনার দিকে তাকিয়ে তারাতারি আঁচলটা আবার মাথায় দিয়ে দিলাম। ভাবী মিটমিটিয়ে হেসে বলে,
” আর লুকিয়ে কি হবে ? যা দেখার তাতো দেখেই নিয়েছি। ”
আমি উনার কথা শুনে জিজ্ঞেস দৃষ্টিতে উনার দিকে তাকাই। ” কি দেখেছেন উনি ? ” একটা মেয়ে বলে উঠে,
” আরে ভাবী , বিয়ের পরের দিন , এটাতো হওয়ারই ছিল। তাইনা ? ”
আমি এদের কথা শুনে শুধুই অবাক হচ্ছি। নানা প্রশ্ন এসে আমার মাথায় জমা হচ্ছে যেগুলার কোনো উত্তর নেই। আমি তাই না পারতে জিজ্ঞেস করেই ফেললাম,
” কি হওয়ার কথা ছিল ? ”
আমার কথা শুনে সব মেয়েরা হাসতে লাগলো। আমি বেক্কেল হয়ে ওদের হাসি দেখছি। একটাসময় ওই ভাবী টা বহু কষ্টে নিজের হাসি থামিয়ে বলে,
” সক্কাল সক্কাল গোসল , কি ব্যাপার গো ? কি হয়েছে কাল রাতে ? বলো বলো ? ”
বলেই আমার হাতে গুতা দিলেন উনি। আর আমি তো লজ্জায় মাথা নুইয়ে রেখেছি। কি বলবো আমি ওদের। ওরাতো আর জানে না যে আমাদের মধ্যে কিছুই হওয়ার নেই। এসব ভেবেই আমি আড়চোখে সৌরভ ভাইয়ার দিকে তাকালাম। উনি ভাবলেশহীন ভাবে ফোন টিপছেন। শুনেন নি নাকি ? যেভাবে বসে আছেন মনে হচ্ছে যে এসবে উনার কোনো কিছু যায় আসে না। হটাৎ আন্টি নিজের চোখ মুখ শক্ত করে বললেন,
” ইরা , এখানে বড় মানুষ আছে। দেখে শুনে কথা বলো । ”
আন্টির কথা শুনে ভাবী চুপ হয়ে গেলেন। কিন্তু এখনও উনি নিরবে হেসেই চলেছেন। ” এত হাসির কি আছে কি জানি ?? ”
আন্টি একটুপর উঠে চলে গেলেন। আর তখন ইরা ভাবী আমার দিকে তাকিয়ে চোখ টিপ দিয়ে মিটমিটিয়ে হেসে বলেন,
” কি গো , এত লজ্জার কি আছে ? এটাতো স্বাভাবিক। ”
বলেই আবার মুখ টিপে হাসতে লাগলেন। উফফ কি মসিবত রে বাবা। লেগ পুল করা ছাড়ছেনই না উনি। আমি কিছু না বলে মাথা নিচু করে রইলাম। আন্টি একটুপর ডাইনিং থেকে ডাক দিলেন,
” ইরা , সবাইকে ডাইনিংয়ে নিয়ে আসো। খাবার রেডি। ”
আন্টির কথা শুনে ইরা ভাবী সিরিয়াস হয়ে বললেন,
” চলো ,তোমার শাশুড়ি মা ডাকছেন।”
আমাকে কথাটা বলেই মুখ ঘুরিয়ে সৌরভ ভাইয়ার দিকে তাকালেন উনি । বললেন,
” এই যে দেবর জি , আপনার কানে কি কথাটা গেছে ? নাকি স্পেশাল ভাবে আলাদা করে বলতে হবে। ”
ভাবির কথা শুনে সৌরভ ভাইয়া ভাবীর দিকে বিরক্ত দৃষ্টি দিয়ে সোফা থেকে উঠে দাড়ালেন। ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে খাওয়ার টেবিলের দিকে এগুলেন। আর আমি ভাবির সাথে করে খাওয়ার টেবিলে আসলাম।। ভাবী আমকে সৌরভ ভাইয়ার পাশে বসিয়ে দিলেন। উনার পাশে বসতে আমি একটু ইতস্তত বোধ করছিলাম। তবুও কথা শুনতে হবে বিধায় বসেই গেলাম। দুজন পাশাপাশি বসে আছি কিন্তু কারো মুখে কোন কথা নেই। উনি একধ্যানে বসে ফোন টিপছেন। আর আমি নিজের মনে উনার জন্যে একরাশ ঘৃনা পুষে খালি প্লেটের দিকে তাকিয়ে আছি। একটুপর একেক করে বাড়ির সকল মেম্বার এসে বসতে লাগলেন টেবিলে। ওদের খাওয়ার টেবিলটা অনেক বড়। তাই অনায়াসে অনেকজন বসা যায়। একটা কাজের মহিলা একজন বৃদ্ধ মহিলাকে হাতে ধরে খাবার টেবিলে এনে বসালো। দেখেই বুঝতে পারলাম যে উনিই সেই দাদী শাশুড়ি। উনি চেয়ারে বসেই আমার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে লাগলেন। আর আমি উনার দিকে একবার তাকিয়ে আবার মাথা নিচু করে ফেললাম। দাদী চোখ মুখ কুচকে বললেন,
” তাহলে এই সেই মেয়ে। তা নীলিমা , যেকোনো একটা মেয়েকে যে নিজের ছেলের ঘাড়ে ঝুলিয়ে দিলে , তা খোঁজ খবর নিয়েছো তো ভালো করে ? ”
আন্টি খাবার সার্ভ করছিলেন। উনার কথা শুনে সার্ভিং বন্ধ করে দাদীর দিকে নম্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন,
” মা , ঈপ্সিতা ঈনায়ার আপন বোন। আপনি বোধ হয় ওকে ভালো করে লক্ষ করেননি। খুব ভালো মেয়ে ও। ”
দাদী মনে হয় আন্টির কথা পছন্দ হয়নি। তাই ভ্রু কুচকে আমার দিকে তাকিয়ে শক্ত গলায় বলেন,
” মাইয়া তো দেখতে ঠিকঠাকই আছে। এহন দেখো যে সামনে কি করে ? তা আমার নাতির মত আছে তো এইখানে ? না জোড় করে ওর ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছ ওই মেয়েকে ? ”
আমি কিছু না বলে শক্ত হয়ে নিজের প্লেটের খাবার নড়াচড়া করছি। কি বলবো উনাকে ? উনিতো আর জানেন না যে উনার নাতীই জোড় করে আমাকে বিয়ে করেছে। হয়তো কখনো উনি জানতেও পারবেন না। কারণ উনিতো কখনো এই নিয়ে মুখ খুলবেন না আর না আমাকে এর প্রতিবাদ করতে দিবেন। আস্ত একটা নিকৃষ্ট লোক। আন্টি দাদীর কথার উত্তরে কিছু বলতে যাবেন তখন সৌরভ ভাইয়া গম্ভীর গলায় বলেন,
” আমরা ভালোবেসে বিয়ে করেছি দাদী । তাই এখানে আমার মত অবশ্যই আছে। ”
আমি উনার এই কথা শুনে রীতিমত ঝটকা খেলাম। উনি আর ভালোবাসা, তাও আমাকে। কিভাবে ? উনিতো জানেইনা কাউকে কীকরে ভালোবাসতে হয়। আর আন্টি উনার কথা শুনে চমকে উনার দিকে তাকিয়ে আবার চোখ নামিয়ে খাওয়ায় মন দিলেন।
দাদী উনার কথা শুনে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকালেন উনার দিকে। ভ্রু কুচকে বলেন,
” তা নাতি বাবাজি , এই ভালবাসা আগে কই ছিল ? এই মাইয়ার কথা তোমার বিয়ের দিনই মনে হইলো ? ”
সৌরভ ভাইয়া দাদীর কথা শুনে ভাবলেশহীন ভাবে রুটি ছিঁড়তে ছিঁড়তে বললেন,
” না মনে ছিল না । বিয়ের দিন মনে হয়েছে ওকে আমার দরকার ব্যাস বিয়ে করে নিয়েছি। আর কোনো প্রশ্ন দাদী ? ”
উনার কথা শুনে দাদী আর কিছু না বলে খাওয়ায় মন দিলেন। আর আমি নিরবে এক ফোঁটা চোখের পানি ফেলে আবার খাওয়ায় মন দিলাম। এত প্রশ্ন আর জেরা শুনে খাওয়ার রুচিই মরে গেছে। কিন্তু খেতে টি হবেই। নাহলে আমার আবার প্রেসার লো করে। খাওয়ার মাঝখানে দাদী আমার দিকে তাকিয়ে বলেন,
” তো মাইয়া , শুনো । কাল তোমারে নিজ হাতে পায়েস করা লাগবে। আর যদি তোমার পায়েস ভালো হয় তাইলে বুঝমু যে তুমি সারাজীবন এই পরিবার কে ভালো রাখতে পারবে। তাই কাল যেনো সক্কাল সক্কাল উঠো । বুজলা ? ”
আমি উনার দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে হ্যা বললাম। খাওয়া শেষে সৌরভ ভাইয়া উনার রুমে চলে গেলেন। আর আমি আন্টির সাথে খ্বর টেবিল পরিষ্কার করলাম। আন্টি এক কাপ চা বানিয়ে আমার ডেকে বলেন,
” চা টা সৌরভের কাছে নিয়ে যাও। ”
আমিও বাধ্য মেয়ের মত চা ত নিয়ে উনার রুমে গেলাম। রুমে ঢুকে দেখি উনি রেডী হচ্ছেন। কিন্তু উনি কোথায় যাবেন ? যায় হোক আমার কি ? আমি কেনো উনার লাইফে দখল দিবো। আমি চা টা টি টেবিলের উপর রাখলাম। কিন্তু আমার মাথায় একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। জিজ্ঞেস করবো করবো বলে আর জিজ্ঞেস করা হচ্ছে না। সৌরভ ভাইয়া রেডী হয়ে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে সোফায় বসলেন। পকেট থেকে ফোন বের করে বসে বসে ফেসবুক স্ক্রল করতে লাগলেন। আর আমি বিছানায় বসে নক কামড়াচ্ছি। হটাৎ উনি ধমকে বলে উঠলেন,
” কিছু বলতে হলে বলো নাহলে বিদেয় হও এইখান থেকে। ডিস্গাস্টিং। ”
বলেই আবার ফোন মনোযোগ দিলেন। আমি একটু সাহস সঞ্চয় করে আনা দিকে তাকিয়ে বললাম,
” আ.আপনি কি আম.আমায় ভালোবাসেন ? ”
আমার কথা শুনে উনি আমার দিকে তাকালেন । আমার চোখে উনার চোখ রেখে গভীর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলেন,
” তোমার কি মনে হয় ? ”
আমি কিছু না বলে মাথা নিচু করে ফেললাম । উনি সোফা থেকে উঠে চায়ের কাপটা সোফার টেবিলে রাখলেন। ধীর পায়ে আমার দিকে এগুতে লাগলেন। আর আমি ভয়ে সেখানটায় জমে শক্ত হয়ে রইলাম। আমার একদম কাছে এসে বসলেন। আমার দিকে একটু ঝুঁকে বলেন,
” বললে না যে কি মনে হয় তোমার ? ”
আমি উনার এত কাছে ভাবতেই কিরকম যেনো অসস্তি লাগছে। ” আমি কি করে জানবো যে উনি আমাকে ভালোবাসেন কিনা ? উনি কি কখনো আমাকে বলেছেন যে উনি আমাকে ভালোবাসেন। ”
আমি কিছু না বলে মাথা নিচু করে রইলাম । হটাত উনি আমার গাল শক্ত করে চেপে ধরলেন। আমি ব্যাথা আর অবাক হয়ে উনার চোখের দিকে তাকালাম। উনি আমার গালটা আরো শক্ত করে চেপে ধরে রাগী গলায় বলেন,
” ভালবাসা ? হুমম ভালোবাসি কিনা জানতে চাও ? তো শুনে রাখো আমি তোমায় সবথেকে বেশি ঘৃনা করি। এতটা ঘৃনা যতটা ঘৃনা করলে ক্ষণে ক্ষণে তোমার মৃত্য কামনা করা যায়। বুঝছো ? ”
বলেই আমার গালটা ছেড়ে দিলেন। গালে অসম্ভব ব্যাথা করছে। কিন্তু আজ এই ব্যাথার থেকে মনের ব্যাথাটা যেনো ক্রমাগত চাঙ্গা হচ্ছে। এক অবিরাম রক্তক্ষরণ হচ্ছে মনে। বারবার মনে হচ্ছে আমি কি এতটা ঘৃণার যোগ্য ? উনি আমাকে ছেড়ে দিয়ে উঠে দাড়ালেন। দাতে দাত চেপে বললেন,
” তোমাকে টর্চার করা একমাত্র আমার অধিকার। আর এই অধিকার আমি আর কাউকে দিবো না। তাই দাদীকে ওই কথাটা বলেছি। আর ভুলেই এই ভাবনা মাথায় এননা যে আমি , এই সৌরভ তোমাকে ভালোবাসে। নাও বিদেয় হও এইখান থেকে। ”
আমি উনার কথা শুনে আহত চলে উনার দিকে তাকালাম। চোখের পানি বইতে চাইছে চোখ থেকে। কিন্তু আমি দেই নি। কি দরকার একটা পাষন্ড মানুষের জন্যে আমার অমূল্য অশ্রু ঝরানোর। আমি আর কিছুনা বলে চোখের কণায় জমে থাকা পানি কে হালকা হাতে মুছে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলাম। আজ অনেক কষ্ট লাগছে। মনে হচ্ছে আমি সবচেয়ে সবথেকে নিকৃষ্ট প্রাণী। যার ভাগ্যে শুধু এবং শুধুই অবহেলা জমা আছে।
চলবে …..
চলবে ….