শেষটাও সুন্দর হয় পর্ব -০৮+৯

#শেষটাও_সুন্দর_হয়
#বিদায়_বেলা
#আমিনা_আফরোজ
#পর্ব:-০৮

সকালের মিষ্টি আলোর ছটায় ঘুম ভেঙ্গে গেল আমার। চোখ খুলে দেখলাম আমি তখনো নিদ্র ভাইয়ের বাহু বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে আছি। নিদ্র ভাই গভির ঘুমে নিমগ্ন। নিদ্র ভাইয়ের দিকে এক নজর তাকিয়ে ওনার বাহু বন্ধন থেকে মুক্ত হবার প্রয়াস করতেই নিদ্র ভাই ওনার দু-চোখ বুঁজে ভরাট কন্ঠে বলে ওঠল,

–” সকাল সকাল ছোট বাচ্চাদের মতো এত নড়াচড়া করছিস কেন? ”

আমি নিদ্র ভাইয়ের কথায় কপট রেগে বললাম,

–” আমি ছোট বাচ্চাদের মতো নড়াচড়া করছি। বেশ , তবে তাই। এখন ছাড়ুন আমায়।”

–” আহ্ চুপ করে থাক তো। আমার এখনো পুরোপুরি ঘুম হয় নি।”

–” আপনার ঘুম না হলে আমি কি করবো? আমি এখন ওঠবো। আমাকে ছাড়ুন নিদ্র ভাই। অহনার সাথে কথা বলতে হবে তো।”

–” এই আমি আমি তোর কোন জনমের ভাই লাগি? তোরে কি ভাই ডাক শুনোনের লাইগা বিয়া করছি আমি?”

হঠাৎ নিদ্র ভাইয়ের রাগী কন্ঠস্বরে বুক কেঁপে উঠলো আমার। কিছু সময় চুপচাপ ওনার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমাকে চুপ থাকতে দেখে নিদ্র ভাই আবারো বলে ওঠলেন,

–” কিরে এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন? উত্তর দে। ছোট বেলার কথা এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেছিস? মনে করাইয়া দিতে হইবো নি?”

নিদ্র ভাইয়ের কথা শুনে আমার ছোট বেলার সেই সব ভয়ানক শাস্তির কথা মনে পড়ে গেল। আমি ভয়ে ভয়ে বললাম,

–” না না লাগবে না। আসলে অভ্যেস হয়ে গেছে তো তাই আর কি। কয়েক দিন সময় দাও সব ঠিক হয়ে যাবে। ”

–” উহু তোকে শাস্তি না দিলে তুই শুধরাবি না। ”

–” কোন শাস্তি চাই না আমার। ছাড়ুন এখন। অনেক দেরি হয়ে গেছে। ”

–” দেরি হলে আমার কি ? আজ তো তোকে শাস্তি পেতেই হবে,সে তুই চাস বা না চাস।”

–” আমি বলছি তো নিদ্র ভাই আর এমন হবে না।”

কথাটা বলেই দুই হাতে মুখ ঢাকলাম। নিদ্র ভাই আমার দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন,

–” ছাড় দিবো ভেবেছিলাম কিন্তু তুই তো ভালো মেয়ে না তাই তোকে এখন শাস্তি পেতেই হবে।”

কথাটা বলেই নিদ্র ভাই তড়িৎ গতিতে এগিয়ে এসে আমার কাঁধে জোরে এক কামড় বসিয়ে দিলেন । আমি ব্যথায় দুচোখ বুজে রইলাম। মিনিট খানেক পর নিদ্র ভাই আমার থেকে সরে গিয়ে আমার কাঁধের দিকে ইশারা করে বললেন,

–” পরের বার আমাকে ভাই বলার আগে এই ক্ষতের কথা মাথায় রাখবি। এখন চুপচাপ শুয়ে থাক আমার পাশে। আমার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটিয়েছিস তো খবর আছে আগেই বলে রাখলাম।”

আমার ভয়ে আর কথা বাড়ানোর সাহস হলো। লক্ষী মেয়ের মতো চুপচাপ শুয়ে রইলাম। নিদ্র ভাই আমাকে জড়িয়ে নিয়ে আবারো পাড়ি জমালেন ঘুমের রাজ্যে।

এদিকে অহনা ঘুম ভেঙ্গে গেলে প্রথমেই কল দিলো সৌরভকে। এত সকালে অদ্রকে ফোন করে বিরক্ত করবার ইচ্ছে হলো না ওর। সৌরভ কল রিসিভ করতেই বলে ওঠল,

–” এই হাদারাম, তুই এখনো পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছিস?”

–” তো কি করবো বল ? ঘুম ছাড়া আমাদের ব্যাচেলরদের আর কোন কাজ আছে নাকি? ”

–” এই তুই থাম তো। তোকে যে কাজ দিয়েছিলাম তা করেছিস?”

–” কি কাজ দিয়েছিলি বল তো? আমার তো কিছুই মনে পড়ছে না।”

–” তোর মনে পড়বেও না। সাধে তো তোকে আর হারালাম বলি না। যতসব, রাখ ফোন। তোর সাথে কথা বলাই ঘাট হয়েছে আমার।”

সৌরভকে কোন কথা বলতে না দিয়ে রাগে ফোনটা কেটে দিল অহনা। অহনার পাশেই ঘুমিয়ে ছিল নিরা কিন্তু অহনার চেঁচামেচিতে ঘুম ভেঙ্গে গেল ওর। নিরা চোখ পিটপিট করে তাকালো অহনার দিকে। ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলে উঠলো,

–” সকাল সকাল কাকে ঝাড়ছিলি বল তো? এ সৌরভ ছাড়া আর কেউ হবে না।”

–” ঠিক ধরেছো। উজবুক হারালাম একটা। কিছুই মনে রাখতে পারে না।”

–” তোকে তো ঠিকই মনে রাখতে পারে। তোদের দুইজনকে অনেক আগে থেকেই চিনি আমি। তাই বলছি রাগ না করে ছেলেটার সাথে কথা বল। তুই তো চিনিস ওকে । তোর রাগ ভাঙ্গানোর হয়তো শেষমেষ এখানেই চলে আসবে।”

–” আসুক গে। আমার কি ? চলো তো ফ্রেশ হয়ে নিই এখন । কিছু পরেই আবার অদ্রিকে আনতে যেতে হবে। গতকাল থেকে মা ফোন করেছে তো করছেই।”

–” কিন্তু ওদের এখন বিরক্ত করা ঠিক হবে কি? না মানে সদ্য বিবাহিত ওরা।”

–” কিন্তু আর কোন উপায়ও তো নেই। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাড়িতে ফিরতে হবে।”

অহনা আর নিরা কথা না বাড়িয়ে ফ্রেস হয়ে সকালের নাশতা করতে বসতেই বাসার কলিং বেল বেজে ওঠল। নিরা অহনার দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে বলে ওঠলো,

–” আমি জানি কে এসেছে?”

অহনা অবাক হয়ে বলল,

–” কে এসেছে গো?”

–” একটু অপেক্ষা কর, এখনি জানতে পারবি।”

কথাটা বলেই নিরা ওঠে চলে গেল দরজার দিকে। তারপর মিনিট দুয়েকের মাথায় সৌরভকে নিয়ে হাজির হলো খাবার টেবিলে। সৌরভের চোখে তখনো ঘুমের ঘোর লেগে রয়েছে। মাথার চুলগুলো খানিকটা এলোমেলো। সৌরভকে দেখে অহনা বলে ওঠল,

–” কি রে তোর এ অবস্থা কেন? আর নিরা আপুর বাড়িই বা চিনলি কিভাবে।”

সৌরভকে কথা বলার সুযোগ না দিয়েই নিরা বলে ওঠল,

–” আহা সেসব কথা পরে হবে ক্ষন। সৌরভ আয় তো আগে নাশতা করে নে। বাকি কথা পরে হবে।”

তিনজনে একসাথে নাশতা করে অহনা আর সৌরভ নিরার কাছ থেকে বেরিয়ে চলে গেল সৌরভদের বাগান বাড়ির উদ্দেশ্যে।

সৌরভ আর অহনা যখন বাগান বাড়িতে পৌছলো বেলা তখন বারোটা ছুঁই ছুঁই করছে। মাথার উপর সূর্য তখনো তির্যকভাবে তার রশ্মি ছড়াচ্ছে। সৌরভ আর অহনা বাংলোতে পৌঁছে দেখলো অদ্রি আর নিদ্র তৈরী হয়ে বসে আছে। তাই আর দেরি না করে ওদেরকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো ওরা দুজনে। আলাদা করে গাড়ির জোগাড়ের যন্ত্রণা আর পোহাতে হলো ওদের। সৌরভের গাড়িতে করেই চলে এলো ক্ষনিকের বিশ্রামাগারে অর্থ্যাৎ অহনাদের বাড়ির সামনে। গাড়ি থেকে নেমে নিদ্র অদ্রির হাতে হাত রেখে বলল,

–” বাবা-মাকে নিয়ে তোমার ভাবতে হবে না । এদিকটা আমি সামলিয়ে নিবো। আর শোন এই ফোনটা তোমার কাছে রাখ। তোমাকে দিবো বলে গতকাল কিনেছিলাম। আমি ঢাকায় আরো কয়েকদিন আছি । প্রতিদিন বিকেলে দেখা হবে আমাদের । আর হ্যা আমি কল দিলে কলটা রিসিভ করতে যেন দেরি না হয়। বুঝতে পেরেছো আমার কথা।”

নিদ্র ভাইয়ের কথা শুনে আমাকে মাথা নামিয়ে সম্মতি দিলাম তার কথায়। তারপর নিদ্র ভাইয়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমি আর অহনা বাসায় চলে এলাম । বাসায় ঢুকে দেখি ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে বাবা খবরের কাগজ পড়ছেন। আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন,

–” সারা রাত বাড়ির বাহিরে থাকাটা ভালো নয় আর বাকি রইল নিদ্রের কথা। ওর সাথে কোথায় গিয়েছিলে তোমরা? মানছি নিদ্রের সাথে তোমার বিয়ে ঠিক হয়েছে ,তাই বলে রাত বিরাতে ঠ্যাং ঠ্যাং করে ওর সাথে ঘুরতে বেরোবে এইটা বরদাস্ত করব না আর। এক কাজ কর বিকেলে নিদ্রকে এখানে আসতে বলো। কিছু কথা আছে ওর সঙ্গে। ”

কথাগুলো বলেই বাবা খবরের কাগজ হাতে চলে গেলেন পাশের ঘরে। আমি আর অহনা তখনো দুজন দুজনের মুখের দিকে তাকিয়ে রইয়েছি। সম্মিত ফিরতে আমরা দুজনে দৌড়ে ঘরে এসে দরজা লাগিয়ে কল দিলাম নিদ্র ভাইকে। নিদ্র ভাই ছাড়া আর কোন গতি নেই আমার…….
#শেষটাও_সুন্দর_হয়
#আবারো_একত্রে_নৈশ_ভ্রমন
#আমিনা_আফরোজ
#পর্ব:-০৯

আজ ফেব্রুয়ারির ২৫ তারিখ। দেখতে দেখতেই কেটে গেছে পনেরোটা দিন। আজ আপন গৃহে ফেরার পালা। এই কয়েকটা দিন যে কিভাবে কেটে গেলো তা এখনো বুঝে উঠতে পারছি না। সকাল থেকেই সবার মন খারাপ। সব থেকে বেশি মন খারাপ ফুফুর। সেই সকাল থেকে বাবা আর আমাকে পাশে বসিয়ে একাধারে কেঁদেই চলেছে। আমরা অবশ্য ফুফুকে শান্তনা দিচ্ছি কিন্তু ফুফু কোন কথাই বলছে না। ফুফুর ঘোর আপত্তি থাকা সত্ত্বেও আমরা বিকেল পাঁচটা নাগাদ “ক্ষনিকের বিশ্রামাগার” থেকে বেরিয়ে পড়লাম। উদ্দেশ্যে কমলাপুর রেলস্টেশন। সেখান থেকে সোজা আমাদের সেই ছোট্ট শহটাতে পৌছাবো।

কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে বগুড়ার উদ্দেশ্যে রওনা দিতে দিতে সাড়ে সাতটা পেরিয়ে গেল। ট্রেন দেরিতে না আসলে হয়তো আরো অনেক আগেই রওনা দিতে পারতাম আমরা। সে যাই হোক। সেদিনের মতোই আজো আমরা সবাই এঅসাথেই বসেছে। তবে এবার আমি বসেছি সোজা জানালা বরাবর। খোলা জানালা দিয়ে উত্তরের হিমেল হাওয়া এসে অবিরত ছুঁয়ে যাচ্ছে আমায়। ঠান্ডা হাওয়ায় একটু শীত লাগলেও খুব একটা খারাপ লাগছে না। আমি জানালা দিয়ে অন্ধকারে ঐ দূর সীমান্তে তাকিয়ে হারিয়ে গেলাম সেদিনের ঘটনায়।

সেদিন বিকেল বেলা বাবার কথামতো নিদ্র ভাই এসেছিলেন অহনাদের বাড়িতে। সেদিন অবশ্য নিদ্র ভাই একাই এসেছিলেন। সোনা মা আর সোনা মা তার তিন চারেক আগেই ফেরত চলে গিয়েছিল রাজশাহীতে। বিলাস বহুল এই ঢাকাতে একাই রয়ে গিয়েছিলেন নিদ্র ভাই। এইটা অবশ্য সেদিন নয় প্রায় বছরের বেশিরভাগ সময় নিদ্রভাইকে ঢাকাতেই থাকতে হয়। সে আরেক কথা। পরে একদিন বলা যাবে ক্ষন। বাবা নিদ্র ভাইয়াকে নিয়ে চলেন গেলেন “ক্ষনিক বিশ্রামাগার” এর বাগানটিতে। অহনাদের বাগানটি খুব একটা বড় না হলেও মাঝামাঝি বলা চলে। হরেক রকমের রঙ-বেরঙের ফুল আছে সেখানে। ফুলের মিষ্টি গন্ধে ভরপুর থাকে বাগানের চারিপাশ। প্রায় ঘন্টাখানেক নিজেদের মধ্যে আলোচনা করল তারা। অতঃপর নিদ্র ভাই বাবার থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে যান বাড়ি থেকে। আমার সাথে সেদিনের পর আর দেখা হয় নি নিদ্র ভাইয়ের তবে ফোনের কথা হয়েছে প্রতিদিন। সেদিন বাবা আর নিদ্র ভাইয়ের মধ্যে কি আলোচনা হয়েছিল তা আজও জানতে পারি নি। জানার চেষ্টা যে করি নি এমনটা নয়। কিন্তু কেউ যদি স্বেচ্ছায় না বলতে চায় তাকে তো আর জোর করা যায় না। তাই আর নিদ্র ভাইকে এই বিষয়ে আর কিছু জিজ্ঞেস করি নি।

আমার সেই সেদিনের ভাবনার মাঝে ছেদ ঘটল। ফোনের টুংটাং শব্দে। হাতে রাখা ফোনটার দিকে তাকিয়ে দেখি ফোনের স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করছে নিদ্র ভাইয়ের নাম। আমি অবশ্য নিদ্র ভাইয়ের নাম্বার মি.ক্যাবলাকান্ত ট্রেনওয়ালা নামেই সেইভ করে রেখেছি। ফোনের লক খুলে দেখলাম নিদ্র ভাইয়ের নাম্বার থেকে একটা মেসেজ এসেছে। মেসেজটা দেখে আমি হতবাক। নিদ্র ভাই মেসেজে লিখে পাঠিয়েছে,

–” তোমার হিটলার বাবা ঘুমিয়ে গেলে ট্রেনের দরজার কাছে চলে আসবে। আমি অপেক্ষা করবো তোমার জন্য।”

এর মানে নিদ্র ভাই এই ট্রেনেই আছে। আচ্ছা তিনিও কি আমাদের সাথে বগুড়া যাচ্ছে নাকি? কিন্তু তাকে দেখতে পাচ্ছি না কেন? আমি এদিক সেদিক ঘাড় ঘুরিয়ে নিদ্র ভাইকে দেখার চেষ্টা করলাম কিন্তু কিছুতেই ওনার দর্শন পেলাম না। শেষে হতাশ হয়ে জানালার পানে তাকাতেই আবারো টুংটাং শব্দ বেজে উঠলো ফোনে। আমি এবার উৎসুক ভাবে ফোনের দিকে তাকালাম । নিশ্চয় নিদ্র ভাই মেসেজ দিয়েছে। তড়িঘড়ি করে ফোনের লক খুলতেই দেখলাম নিদ্র ভাই শিখে পাঠিয়েছেন,

–” এভাবে ঘাড় ঘুরিয়ে আমাকে না খুঁজে তোমার হিটলার বাবাকে ঘুম পাড়াও। আর কতক্ষন এভাবে তোমার জন্য অপেক্ষা করতে হবে কে জানে।”

নিদ্র ভাইয়ের মেসেজ পড়া শেষ করে আমি আড়চোখে একবার বাবার দিকে তাকালাম। বাবা তখন খবরের কাগজে মুখ ডুবিয়েছেন। অতএব এখন আর ওনার ঘুমানোর সম্ভাবনা নেই। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে ব্যাগ থেকে একটা বই বের করে পড়া শুরু করলাম।

রাত এগারোটা বেজে ত্রিশ মিনিট। শীতের তীব্রতা এখন বেড়েছে কিছুটা। বাবা,মা আর অথৈ গায়ে চাদর জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। আমিও এই সুযোগে গায়ে কালো রঙের একটা চাদর টেনে চলে এলাম ট্রেনের দরজার সামনে। এখানেই নিদ্র ভাইয়ের সাথে প্রথম দেখা হয় আমার । সেদিনো এমন নিঝুম রাত্রি ছিল। তবে সেদিনের আকাশে ছিল পূর্নিমার গোল চাঁদ কিন্তু আজকের আকাশে কোন চাঁদের দেখা নেই। আজকে চারিদিকে শুধু নিকষ কালো অন্ধকার। তবে এই অন্ধকারটাও খুব একটা খারাপ লাগছে না। ঝিকঝিক ঝিকঝিক শব্দ তুলে ট্রেন এগিয়ে চলছে সামনের দিকে। আমি তখনো দরজা বরাবর তাকিয়ে আছি। এমন সময় পিছন থেকে এক বলিষ্ঠ হাত নিজের সাথে জড়িয়ে নিল আমাকে। আমি প্রথমে ভয় পেলেও ভরাট কন্ঠস্বর শুনে চুপ করে রইলাম। বাহিরের উদ্দাম হাওয়ার তোড়ে টিকতে না পেরে আমরা দুজনে কিছুটা পিছিয়ে এসেছি ততক্ষণে। নিদ্র ভাইও শীতের দোহায় দিয়ে আমার চাদরের মধ্যে আশ্রয় নিয়েছেন। দুজনের মধ্যে দুরত্ব খুব একটা নেই। দূরের অন্ধকার সীমান্তের পানে তাকিয়ে আমি বললাম ,

–” আপনি যে আজ আমাদের সাথে বগুড়ায় যাবেন,তা আমাকে আগে বলেন নি কেন?”

নিদ্র ভাই আমাকে আরো খানিকটা নিবিড় ভাবে আঁকড়ে ধরে বললেন,

–” ভাবলাম আমার এলোকেশীকে একটু সারপ্রাইজ দেই। কেন আমার এলোকেশীর কি আমার সারপ্রাইজটা পছন্দ হয় নি?”

–” আপনার দেওয়া সারপ্রাইজ আপনার এলোকেশীর পছন্দ না হয়ে পারে নাকি?”

–” তাই বুঝি? তো আমার এলোকেশী নিকষ কালো অন্ধকারে আমার সাথে হারিয়ে যেতে রাজি হবে কি?”

–” হারিয়ে যেতে তো কোন বাঁধা নেই তবে আজ থাক।”

–” কেন আজ থাকবে কেন? আজকে কি নিষিদ্ধ কোন দিন নাকি?”

–” উহু তা নয়।”

–” তবে?”

আমি নিদ্র ভাইয়ের দিকে ঘুরে ওনার কাঁধে হাত রেখে বলে উঠলাম,

–” রাতের আঁধারে সুন্দর পুরুষ মানুষের সাথে হারিয়ে যেতে ভয় হয়।”

–” কেন?”

–” প্রেমিকার চোখের দিকে তাকিয়ে তার কথা বার্তার ধরন বুঝে নিতে হয়।”

–” যদি কোন প্রেমিক তার প্রেমিকার চোখের ভাষা বুঝতে অপারগ হয় তবে?”

–“যে প্রেমিক তার প্রণয়নীর চোখ এবং তার কথার ধরন বুঝতে পারে না সে প্রেমিক তার প্রেমিকার অনুভূতিও বুঝতে পারে না।”

–” একথা তো আগে শুনি নি। এলোকেশী কি তার মি.ক্যাবলাকান্তের সাথে থেকে থেকে কাব্যিক হয়ে ওঠছে নাকি?”

–” কাব্যিক হলেই বা ক্ষতি কি?”

–“উহু ক্ষতি নেই । তবে এলোকেশীকে শুধু আমার কবি হয়েই থাকতে হবে। সে শুধুই আমার । একান্তই আমার হবে।”

–” যদি একান্তই না হয় আপনার তবে?”

–” খুন করে ফেলবো তাকে। তারপর নিজেকেও শেষ করে দিবো। সে যদি আমার না হয় তো অন্যকারো হতে পারবে না।”

–” আপনি আপনার এলোকেশীকে কতটুকু ভালোবাসেন?”

–” যতটুকু ভালোবাসলে নিজের অস্তিত্বকে ভুলতে পারা যায় ঠিক ততটুকু।”

–” তাই বুঝি?”

–” কেন বিশ্বাস হয় না।”

–” হয় তো।”

–” তবে।”

–” তবে কিছু না। এলোকেশী এখন তার মি.ক্যাবরাকান্তকে একান্তে পেতে চাচ্ছে।”

–” এলোকেশীর মতিগতি তো সুবিধের লাগছে না। কি চলছে এলোকেশীর মনে?”

–” আপনার এলোকেশীর মনে এখন প্রেম প্রেম অনুভূতি জেগেছে।”

–” তাই বুঝি।”

আমি আমার মুখটা নিদ্র ভাইয়ের কানের কাছে নিয়ে গিয়ে ফিসফিসিয়ে বললাম,

–“প্রিয়,
কোনো এক মধ্য রজনীতে ডেকে বলো
শুনো গো কাজল চোখের মেয়ে
আমার বেলা ফুরোয় তোমার আলোয়
ঐ চোখেতে চেয়ে।”

কথাটা বলেই আমি আরো নিবিড়ভাবে আঁকড়ে ধরলাম নিদ্র ভাইকে। বাহিরের হিমশীতল বাতাস তখনো ছুঁয়ে যাচ্ছে আমাদের দুজনকে। অন্ধকারের ফাঁকে ফাঁকে জ্বলে ওঠেছে জোনাকি পোকার দল। রাতের কোলে ঢলে পড়ছে সময়ের গতি। ট্রেন তার ঝিকঝিক ঝিকঝিক শব্দে এগিয়ে চলছে আমাদের গন্তব্যের পথে।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here